নয়নে_বাঁধিব_তোমায় #আফসানা_মিমি পর্ব: বাইশ

0
55

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: বাইশ

সন্ধ্যা নামতে বেশি সময় বাকী নেই। এতো সময় কীভাবে পেরিয়ে গেলো নয়না বুঝতেই পারেনি। মেয়েরা যেভাবে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কান্না করে নয়না ঠিক সেভাবেই কান্না করছে। তূর্য অধৈর্য চিত্তে সোফায় মারুফের সাথে বসে ছটফট করছে। মিছিলদের বাড়িতে নয়না সেইদিনই না এলো! এতো তাড়াতাড়ি দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে! এই তো সেদিন ধুমধামে মিছিলদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। নয়নার সেদিন আনন্দ দেখে কে! মিছিলের সাথে সাথে সেও চঞ্চলা পাখির মতো উড়ছিল। সারাবাড়ির আনাচে কানাচে নয়না মিছিলের হাস্য ধ্বনি বাজছিল। এতো তাড়াতাড়িই সময় ফুরিয়ে গেলো! নয়না ভেবেছিল সে এখানেই থাকবে কিন্তু তার ধারণায় এক বালতি পানি ঢেলে তূর্য সকাল থেকে এসে বসে আছে। নয়না যাবে না বলার উত্তরে শান্ত স্বরে বলেছে, ” এই বাড়ির ঠিকানা তোমার পরিবার জানে। আমি চাই না তারা তোমাকে খুঁজে বের করে আবারও সেই নরকে নিয়ে যাক।”

তূর্যের কথায় মিছিলের পরিবার সবাই সহমত পোষণ করলো। এসব দেখে মিছিল বেজায় ক্ষেপে গেলো। বিদায়ের সময়ে নয়নার সাথে মিছিলেরও সেই কী কান্না! দুই বান্ধবীর কান্নায় কোরবানি হচ্ছে পুরো পরিবার। মারুফের স্ত্রী হেনার মনটাও খারাপ।
এই কান্নার শেষ নেই তূর্য বুঝে গেছে। এক প্রকার অধৈর্য হয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। নয়নার কাছে এসে বলল,” মন হচ্ছে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছো। আমাকে কী এখন বলাতে চাচ্ছো যে, বউ কান্না করো না আগামীকাল তো নিয়েই আসবো। আমার কিন্তু কথাগুলো বলতে কোনো সমস্যা নাই।”

তূর্যের কথা শেষ হতেই সারাঘরে হাসির রোল পড়লো।
নয়না কটমট চোখে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্যের এই মুহূর্তে ফাজলামো করতে ইচ্ছে করছে! নয়নার দুঃখ বুঝতে চাইছে না! তূর্য দাঁত বের করে হেসে বলল,” চলো বউ!”

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। নয়না নাক টেনে টেনে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। তূর্য নয়নার দুঃখে ঘি ঢালার জন্য টিস্যু এগিয়ে দিলো। নয়না তাতে তেতে উঠে তূর্যের পিঠে কিল বসিয়ে বলল,” মজা হচ্ছে! আমার দুঃখে আনন্দ পাচ্ছো? থাকবো না তোমার সাথে। গাড়ি থামাও, আমি থাকবো না তোমার সাথে।”

চলন্ত গাড়ি জোরে ব্রেক কষলো তূর্য। চোখ মুখ তার রক্তিম হয়ে গেলো মুহূর্তেই। নয়নার দিকে ফিরে দুই বাহু শক্তকরে ধরে বলল,” তুমি কী চাও, আমি নিঃশেষ হয়ে যাই! এই মেয়ে, আমাকে বুঝো না কেনো! তোমাকে সময় কাটানোর জন্য সাথে রাখিনি, তোমাকে ভালোবাসি, সারাজীবনের জন্য নিজের করে রাখতে চাই, ড্যাম ইট!”

তূর্যের উঁচু আওয়াজ শুনে চমকে উঠে নয়না। আঁখি জোড়ায় নেমে আসে অবাধ্য অশ্রুকণা! হেঁচকি তুলে কান্না করতে থাকে মেয়েটা। তূর্য স্টিয়ারিংয়ের উপর হাত দ্বারা আঘাত করে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো। সে নয়নাকে এভাবে কষ্ট দিতে চায়নি। নয়না তাকে ছেড়ে চলে যাবে শুনেই তো রাগ হয়েছিল। নয়নার দুই গালে হাত রেখে কান্না থামাতে চেষ্টা করলো তূর্য,” আ’ম সরি, লক্ষীটি! রাগটা কন্ট্রোল করতে পারিনি। আমি কী করবো, জড়িয়ে ধরবো? না থাক, তুমি কী মনে করবে। কান্না থামাও নাহলে, নাহলে!”

নয়না তূর্যে হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাতে কপাল ঠেকালো। ক্ষনে ক্ষনে হেঁচকি তুলছে সে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মাথা তুলে বলল,” এতো সুখ আমার কপালে সইবে না,তূর্য! আমাকে কেন এতো ভালোবাসেন, বলবেন? আমি তো সাধারণ একজন মেয়ে, আপনার মতো ডাক্তারের জন্য অন্য কেউ…..!

নয়না কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না তার আগেই তার ঠোঁট জোড়ায় তূর্য আঙুল রেখে বলল,” হুঁশ! আমার অন্য কাউকে নয়, তোমাকে প্রয়োজন নয়ন! প্লিজ আমার হয়ে যাও, নয়ন!”

নয়না অপলক দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সময়ের হিসাব তার অজানা, আপাতত এভাবেই সময় চলুক। কে জানে! আগামীকাল যদি এই সময় না পাওয়া যায়!

প্রায় বিশ মিনিট পর নয়না দেখতে পেলো গাড়ি ভাবনার বাড়ির রাস্তায় না ঢুকে অন্যদিকে যাচ্ছে। প্রশ্নবোধক চাহনিতে নয়না তূর্যের দিকে তাকালে হেসে ফেললো তূর্য। ডান পাশে মোড় ঘুরিয়ে বলল,” তোমার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি, নয়ন।”

নয়না কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এই লোকটা এতোটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের কেনো? ভালোভাবে বললে কী হচ্ছিলো না! বলতেই তো পারতো যে,’ নয়না, আমাদের বাড়ি,গাড়ি, দেয়াল, ড্রায়ার সব দেখাবে নিয়ে যাচ্ছি।’ তা না বলে ডিরেক্ট শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথা! অসভ্য, নির্লজ্জ ডাক্তার। মনে মনে শত কথা আওড়ালেও জোরে বলতে পারলো না নয়না।
গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সাত কিলোমিটার দূরে মারতা বাজার অবস্থিত। বাজার থেকে ডানে মোড় টানলো তূর্য। প্রায় দুই মিনিট পর সবুজে ঢাকা একটি বাড়ির গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামালো সে। ইশারার নয়নাকে নামতে বলে নিজেও নামলো।

তূর্য এগিয়ে এসে নিজেই গেইট খুলে দিলো। নয়না তূর্যের পিছু পিছু হাঁটছে। বাড়ির আশপাশ দেখে মনে হচ্ছে, বাড়িটি একদম নতুন তৈরি করা হয়েছে। তিন তলা বিশিষ্ট বাড়ির সম্মুখে ছোট ছোট গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় কিন্তু কে করে? নয়না আশেপাশে দেখতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে তূর্য তাকে রেখে অনেকটাই সামনে এগিয়ে গেলো। নয়না একপ্রকার দৌড়ে তূর্যকে ধরে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো।
বাহির থেকে যতোটা সাধারণ মনে হয়েছে বাড়ির ভেতরটা ততোই অসাধারণ। আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ির আসবাবপত্র দেখে নয়না মুখ হা করে রইলো। ডুপ্লেক্স বাড়ি নয়নার প্রথম দেখা, মাথার উপর বড়ো ঝাড়বাতি দেখে বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলো। তূর্য সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপর উঠে গিয়েছিল। নয়নাকে থামতে দেখে পিছনে ফিরলো। নয়নার বিস্ময়কর তাকানো দেখে বেশ লাগছিলো তার কাছে তাইতো মুঠোফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
নয়নার নড়চড় না দেখে বলল,” দেখা হয়েছে? চাচ্চু অপেক্ষা করছে।”

লাজুক হেসে নয়না সিঁড়িতে পা দিলো। তিনলায় পৌঁছে তূর্য সরাসরি দক্ষিণ পাশে চলে গেলো, যেখানে মাহবুব শিকদার বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। নয়না তখনো মাহবুব শিকদারের ব্যপারে অজ্ঞ। ঘরে প্রবেশ করতেই তূর্য ডেকে বলল,” এবার তো কথা বলবে আমার সাথে,চাচ্চু? নাও, তোমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি।”

মাহবুব শিকদারকে দেখে নয়নার অবাকের অন্ত নেই। মুখে হাত রেখে বলল,” ডাক্তার আঙ্কেলই তূর্যের চাচা?”

মাহবুব শিকদার এগিয়ে এসে বলল,” হ্যাঁ রে মা! তূর্য তোকে আমার কথা বলেনি?”
নয়না আড়চোখে তূর্যকে দেখে বলল,” বলেছে কিন্তু আপনিই যে চাচ্চু তা বলেনি।”

তূর্যের দিকে মিছে রাগ নিয়ে মাহবুব শিকদার তাকালে সে মাথা চুলকে বলল, ” সেভাবে জিজ্ঞেস করেনি তাই!”

মাহবুব শিকদার বেশি কথা বাড়ালো না। নয়নার উদ্দেশে বলল,” তুমি গিয়ে রেস্ট করো। আমাকে একবার হাসপাতালে যেতে হবে। কিছু লাগলে, তূর্যকে বলো কেমন!”

তূর্য নয়নাকে নিয়ে পশ্চিম পাশটায় এসে দাঁড়ালো। পাশাপাশি দুইঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ঘরটার দিকে ইশারা করে বলল,” আজ থেকে এই ঘরে থাকবে, কিন্তু তা কিছুদিনের জন্য।”

নয়না বোকার মতো উত্তর দিলো,” তারপর কী ভাবনা আপুর বাসায় চলে যাবো?”

তূর্য দুষ্ট হেসে নয়নার উদ্দেশে বলল,” না গো, কলিজা! তারপর তো তুমি আমার সাথে থাকবে; বিয়ের পর!”

নয়না চোখ বড়ো করে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ডাক্তারটা এতো নির্লজ্জ কেনো?
তূর্য হাসতে হাসতে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে করতে বলল,” হাসপাতালে যেতে হবে, নয়ন! ফ্রেস হয়ে এক কাপ কফি আনবে,প্লিজ? নিচ তলায় বাম পাশে রান্নাঘর!”

তূর্যের হুটহাট আবদারে নয়না আলাদা সুখ অনুভব করে। মানুষটা একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের কিন্তু সে জানে তা নিতান্তই নয়নার কাছেই। তূর্য একান্তই তার পছন্দের পুরুষ, ভালোবাসার পুরুষ। কাউকে ভাগ বসাতে দিবে না, নয়না। নিজের ভাবনায় মুচকি হাসলো নয়না। সেও তূর্যের মতো পাগল হয়ে গেছে।
—————

প্রায় দেড় দিনের মাথায় বাশারকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয় বোরহান। লজ্জায় তার মাথা কাটা গেছে। নিজের ছেলের বিয়ের ব্যপারেও সে জানতো না। আকলিমা বিশেষ কিছু কখনে জানায় না। এমন একরা বড়ে কাণ্ড ঘটিয়েছে সেটাও জানাতো না যদি টাকার ব্যাপার না হতো! এদিকে নয়না দুই তিন সপ্তাহ থেকে নিখোঁজ। আদৌও বেঁচে আছে কী না কে জানে?
বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাশার সর্বপ্রথম নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। মাসুদা তখন গুনগুন করে গান গাইছিল আর মাথার চুল আঁচড়াচ্ছিল। বাশার কোনো কথা না বলে মাসুদার চুলের মুষ্টি ধরে বাহিরে নিয়ে আসলো। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে, এক পর্যায়ে বলতে শুরু করলো,” সেদিন ঐ লোককে টাকা দিলি না কেন, মা’গী। আমাকে পুলিশে নিয়ে গেলো তখনো ফিরালি না কেন? এক্ষুণি টাকা দিবি নয়তো তোকে মেরেই ফেলবো।”

কথা শেষ হতেই বাশার মাসুদাকে মারার জন্য উদ্যোগ নিলে বোরহান বাঁধা দেয়। বাশারের হাত থেকে মাসুদাকে ছাড়িয়ে উলটে বাশারের গালে থাপ্পড় বসায়। আকলিমা তেড়ে আসছিল স্বামীর দিকে বোরহান আকলিমার গালেও থাপ্পড় বসিয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো,” তোর জন্য আমার সন্তানরা আজ বিপথে। তোকে করুণা করে বিয়ে করেছিলাম, যেন এই অবৈধ বাচ্চা বৈধতা পায়! নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলাম। কিন্তু আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আগাছা কেটে দিলে যেমন কিছু গাছ পরিষ্কার হয় না তেমন জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয় না। তুই প্রমাণ করেই দিলি, তোর আর তোর ঐ লম্পট প্রেমিকের রক্ত এই ছেলের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। ভাবীর কথায় যদি তোকে বিয়ে না করতাম তাহলে পঁচে গলে মরতি। এজন্যই তুই নয়নাকে দেখতে পারিস না,তাই না? মেয়েটাকে মেরে ফেললি তো? দেখেছিস পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। তোর সামনে তোর পরিবার আজ ছিন্নভিন্ন।”

এতো বছর পর কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়ে আকলিমা দেয়াল ঘেঁষে জমিনে বসে পড়লো। বাশারও স্তব্ধ প্রায়! সে অবৈধ সন্তান, বারবার একথাটাই মস্তিষ্কে ঘুরছে। এতোকিছুর মধ্যে মাসুদা হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। তার আহাজারিতে পড়া প্রতিবেশী এক হয়ে গেলো। কেউ কেউ এসে বাড়ির পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন করলো, ” ব্যাপারটা কী?”
মাসুদা তখন আহাজারি করতে করতে বলল,” আমার স্বামী যৌতুকের টাকা এনে দেইনি বলে, আমাকে বাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইছে।”

পাড়া প্রতিবেশীরা ছি ছি করতে শুরু করলো।বাশার অবাক হয়ে বলল,” আমি কখন বললাম?”

উত্তরে মাসুদা বাঁকা হাসলো।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here