গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায় #পর্বঃ_২৭ #লেখাঃ_আফসানা_মিমি সুহাসিনী

0
224

#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_২৭
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি সুহাসিনী
——–
কখনো কী শুনেছেন, বিয়ের পর বউকে নিয়ে কাজে যেতে? শুনেননি তো! তবে আজ শুনুন। কাজটা কে করেছে ইতিমধ্যে বুঝতেও পেরেছেন হয়তো! তূর্যের কেবিনে মুখ ফুলিয়ে নয়না বসে রয়েছে। তার বরের মতো পাগল ডাক্তার এই জনমে কোথাও দেখেনি সে।
বিয়ের পরেরদিন সে বউ ছাড়া হাসপাতালে আসবেই না। ইমারজেন্সী বিভাগ থেকে বারবার কল আসছিলো। এদিকে নয়নাও জিদ ধরে বসেছিল যে, সে আজ বাহিরে কোনোক্রমে বের হবে না। লাজ শরম কিছু থাকতে হবে তো! এমনিতেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের লাজ একটু বেশিই থাকে। এই পরিস্থিতিতে চাইলেও তারা লোকসমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, পুরুষরা কী তা বুঝবে?
অগত্যা নয়না তূর্যের সাথে হাসপাতালে আসতে বাধ্য হয়। বর্তমানে নয়না তূর্যের কেবিনে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সময় এখন দুপুর বারোটা বাজে নয়না এখানে এসেছিল সকাল আটটায়। এই কয়েকঘন্টা সময়ের মধ্যে একবারও তূর্যের দেখা পায়নি সে কিন্তু বউয়ের খোঁজ খবর ঠিকই রেখেছেন তিনি। কখনো কফি কখনো জুস আবার কখনো হালকা নাস্তা দিয়ে পাঠাচ্ছে তূর্য। দরজার কড়াঘাতে নয়না উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তার মন বলছে এবার তূর্য এসেছে। মন কী আর ভুল বলবে! অর্ধ খোলা দরজার হাতলে ধরে তূর্য কারো সাথে হেসে কথা বলছে। নয়না তার বরের হাসি দেখছে। সে ভাবছে, প্রাণোচ্ছল ছেলেটাই কী তার স্বামী? পরক্ষণে মনে মনে বলল, হ্যাঁ! এই সুদর্শন দুষ্ট মানবটা শুধু তারই। নয়না লজ্জায় দাড়িয়ে গেলো,সে কী বলবে সেটাও মনে মনে সজিয়ো নিলো। এদিকে দরজা আটকে তূর্য ঘরে প্রবেশ করে সরাসরি নয়নার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। মাঝে মাঝে নয়না তূর্যকে দেখে বুঝতে পারেনা যে তার মনে কী চলছে! প্রায় পাঁচ মিনিট নয়নাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রাখলো তূর্য। ফিসফিস করে বললো,” মিস ইউ সো মাচ, মাই লেডি!”

নয়নার মান গলে পানি হয়ে গেলো কিন্তু মিছে অভিমান করে রইলো। তূর্যের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,” মিস না ছাই! কতো সময় ধরে একা বসে আছি। এখন আসার সময় হলো!”

তূর্য নয়নাকে নিয়ে চেয়ারে বসলো। নয়নাকে কোলের উপর বসিয়ে বলল,” ইমারজেন্সীতে আজ একজন মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে। বয়স কতো হবে, আঠারো কী ঊনিশ! বিষ খেয়েছিল, ওয়াশ করিয়ে কেবিনে শিফট করতে দেরী হয়ে গেছে। এজন্যই আসতে দেরী হলো, রাগ করে না বউ!”

নয়না নিজের কথা ভাবছে, সেও তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল কিন্তু তার পাশে তূর্য ছিলো বিধায় বেঁচে ফিরতে পেরেছে। মেয়েটাও নিশ্চয়ই তার মতো নরকে পা দিয়েছিল,তাইতো আত্মহত্যার মতো খারাপ পথ বেছে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না। নয়না মনে মনে সিদ্ধান্তঃ নিলো সে মেয়েটাকে দেখতে যাবে, সুখ দুঃখের কথা বলবে। কারণ সে জানে, এই পরিস্থিতিটা কতোটা ভয়াবহ। নয়না তূর্যের কাছে আবদার জুড়ে বসলো,” আমাকে মেয়েটার কাছে নিয়ে যাবে, তূর্য? ”

তূর্য দেখতে পেলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে, তারমানে নয়না মেয়েটাকে সত্যি সত্যিই দেখতে যাবে। তূর্য নয়নার এই ইচ্ছেটাও অপূর্ণ রাখবে না তাই মুচকি হেসে বলল,” লাঞ্চটা সেরেই নিয়ে যাবো। এবার চলো।”

নয়নাকে নিয়ে তূর্য গাজীপুরের রাজবাড়ী মাঠ থেকে একশ গজ দূরে অবস্থিত চিকেন চিলি রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসলো। দুপুরের খাবার খেয়ে বের হতে নিলে নয়না হাঁটার গতি থামিয়ে দিলো। নয়নার শরীর কাঁপছে, ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে আসছে। সে নিজেকে তূর্যের পিছনে আড়াল করে রেখেছে। তূর্য নয়নার ভাবভঙ্গি লক্ষ করে সম্মুখে তাকালে বাশারকে দেখতে পেলো। মুহূর্তেই তূর্যের হাসিমুখ পরিবর্তন হয়ে লালা আভা ভেসে উঠলো। বাশার তাদের দিকেই এগিয়ে আসলো। নয়নাকে ভালোভাবে দেখে বলল,” এই শহরেই তোর এতো নাগর থাকলে আমাকে কী আর মনে ধরবে? এজন্যই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস,তাই না? অবশ্য তুই তো তোর মায়ের দিক পেয়েছিস, তোর মা যেমন বাজারী ছিলো তুইও তেমন হয়েছিস।”

তূর্যের সামনে তার স্ত্রীকে অপদস্ত করছে তাও বিশ্রী ইঙ্গিতে! ব্যাপারটা সহ্য করার মতো নয়। তূর্য তেড়ে এসে বাশারের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিলো। একটা নয় দুইটা নয় পরপর কয়েকবার ঘুষি মেরে নাক থেকে র’ক্ত বের করে ফেলল। নয়না তূর্যকে বাঁধা দিচ্ছে বারবার অনুরোধ করছে যেন আর না আঘাত করে। এদিকে বাশার যেন তার পরিকল্পনায় সফল হয়েছে। তূর্যের থেকে ছাড়া পেয়ে নাকে হাত দিলয়ে র’ত মুছে নিলো। আশেপাশে ভালোভাবে লক্ষ করে জোরে চেচামেচি শুরু করলো,” আমার বোনরে ফিরাইয়া দেন, ভাই! আমার মা বোনের জন্য কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই যে, ভাইয়েরা দেখে যান! ডাক্তার বলে আমার মতো সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করছে। আমার বোনকে পালিয়ে এনে রক্ষিতা করে রেখেছে। এই দেখেন, আমি প্রতিবাদ করায় মেরে কী অবস্থা করে দিয়েছে।”

রেস্টুরেন্টের সামনে বিরাট বড়ো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলল বাশার। লোকজন সমবেত করে মনগড়া কাহিনী বলে দিলো সে। আর আমাদের দেশের মানুষ সবসময়ের মতো একপাক্ষিক বক্তব্য শুনে তাই বিশ্বাস করে নিলো। কয়েকজন তূর্যের দিকে আঙুল তলতে ভুল করলো না।বাশার এসব দেখে বিশ্রী হাসলো। নয়নার দিকে বাজে ইঙ্গিত করলো। তূর্য নীরব দর্শকের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে চাইছে নয়নয় কিছু বলুক, তূর্য তার জীবনের কতোটা অংশ জুড়ে আছে সবাইকে বলুক। তূর্যকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, লোকজনের সামনে নয়না স্পষ্ট গলায় বলতে শুরু করলো,” ইনি আমার স্বামী। আমরা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। দয়াকরে এই লোকের কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না।”

বাশারের হাস্যজ্বল মুখ নিমিষেই চুপসে গেলো। থমথমে পরিবেশে নয়নার কথা কানে বাজতে লাগলো। কিন্তু বাশার তবুও বেঁকে গেলো না, পুনরায় প্রশ্ন তুলল,” কী প্রমাণ আছে? নির্লজ্জ মেয়ে, কোন পাড়ায় তোকে নিয়ে যায় যে নিজেকে এই ছেলের বউ বলতেও লজ্জা পাচ্ছিস না!”

বাশার বলতে বলতে নয়নার কাছে আসছিল। তূর্য তখন বাঁধা দিয়ে বলল,” আর এক পা আগালে তোমার পা ভেঙে দিব, শালা সাহেব!”
এরপর সমবেত লোকজনের উদ্দেশে বলল,” আজকাল কী বিয়ের রেজিস্টার প্যাপার সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে? আমাদের মুখের কথা কী বিশ্বাস হচ্ছে না! একজন মেয়ের হাত,নাক,কানের অলংকার কখন পরে? অবশ্যই বিয়ের পর! এখন অনেকেই বলবেন, আজকালকার মেয়েরা বিয়ে ছাড়াই অলংকার পরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের উদ্দেশে বলছি, বিয়ে হচ্ছে পবিত্র বন্ধন যারা এই বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাদের বাহ্যিক অভ্যন্তরীণ দিক লক্ষ করলেই বুঝা যায়। আর সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার হচ্ছে, এই লোকের ভাষা! দেখুন তো, আমি তার মতো কোনো মেয়েকে অপমান করেছি কী না!”

তূর্যের কথায় সকলে সহমত পোষণ করলো। কেউ কেউ বলল,” এই লোকের মনেই শয়তানী, সাধারণ পাবলিকদের সহায়তায় আপনাকে হেনস্তা করতে চেয়েছে।”

রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ততক্ষণে এসে উপস্থিত হলো। তূর্যের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পরে দারোয়ান দিয়ে বাশারকে পথ দেখিয়ে দিলো।

পুরো ঘটনায় নয়না খুব ভয় পেলো। তূর্যের শার্ট খামছে ধরে বলল,” হাসপাতালে চলো, তূর্য!”

তূর্য কথা বাড়ালো না। নয়নাকে শক্তকরে ধরে গাড়িতে উঠলো।
————————————

সন্ধ্যা হয়ে আসলো। তূর্যের ডিউটির সময় শেষের পথে। এবার সে নয়নাকে একা রাখেনি, রাউন্ডের সময়ও নয়নাকে পাশে রেখেছে। তূর্য ও নয়না যখন বিষপান করা মেয়েটির কেবিনে প্রবেশ করছিল তখন তারা শুনতে পেলো, মেয়েটির মা বলছে,” আমি পুলিশের কাছে যাবো, ঐ ছেলেকে জেলে ঢুকাবো। আমরা গরীব বলে, মানুষ না! আমার মেয়েটার আজ এই অবস্থার জন্য ঐ কুলাঙ্গার দায়ী।”

তূর্যের আগমনে মেয়েটির মা থেমে গেলো। তূর্য ফাইল চেক করতে লাগলো।নয়না এক ধ্যানে মেয়েটির নিস্তেজ শরীর দেখছে, মায়াবী চেহারার অধিকারী মেয়েটার জীবনে কী এমন ঘটেছিল যার কারণে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিল! নয়না সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটির মায়ের উদ্দেশে বলল,” আত্মহত্যা কেন করতে গিয়েছিল, আন্টি। সঠিক সময়ে নিয়ে না আসলে কী হতে পারতো, ভাবতে পারছেন?”

কিছু সময় আমরা মনের দুঃখ প্রকাশ করাতে অপারগ হয়ে যাই, দায়িত্বের ভাড়ে নিজেদের পাথর বানিয়ে ফেলি। কিন্তু যখন কেউ আমাদের কাঁধে ভরসার হাত রাখে, তখন মন প্রাণ উজার করে দুঃখ বিলাপ করতে থাকি। মেয়েটির মায়ের অবস্থাও তেমন। একাকী মেয়েকে নিয়ে লড়তে থাকা পাথর হৃদয় গলে গেলো নিমিষের।চোখের কোণে অশ্রু এসে ভীড় করলো। মেয়ের হাত ধরে বিলাপের সুরে বলল,” কোন এক ছেলের সাথে কথা বলতো, কাঁকন। দুইদিন ধরে মেয়েটা আমার কাছে এসে বলল, তার কীসের ভিডিও ছেলের কাছে আছে। দুই লাখ টাকা চাইছে, নইলে ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। মেয়ের সম্মান বাঁচাতে জমানো টাকা ঐ ছেলেকে দিয়ে দেই। আমাদের সম্বল ঐটুকুই ছিলো। মেয়েকে বলছি যেন চিন্তা না করে। কিন্তু কী হয়ে গেলো! আমার মেয়েটা আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো।”

কাঁকনের মা আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো। নয়নার বর্তমান যুগের মেয়েদের বোকামি শুনে বড়োই আফসোস হলো। এই মাকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা নয়নার জানা নেই। সে লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে প্রশ্ন করলো, ” পুলিশকে জানান, আন্টি! আমার স্বামী এবং আমি আপনার পাশে আছি। আমরা সকল ধরনের সহায়তা করব।”

কাঁকনের মায়ের চোখ মুখ চিকচিক করছে। মেয়ের সাথে করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস সঞ্চয় করে সে। তূর্য নয়নাকে দেখে মুচকি হাসে, কে বলবে এক সময় এই মেয়ে অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করেছে! আজও তো ভয়ে তূর্যকে আঁকড়ে ধরেছে। তূর্য কাঁকনের মায়ের উদ্দেশে বলল, ” টাকা কার হাতে দিয়েছিলেন?”

” একটা ছেলের হাতে।”
” দেখতে কেমন ছিল।”

” খাটো, সুন্দর, গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি। গালে একটা কাটা দাগ আছে।”

কাকনের মায়ের কথা শেষ হতেই মুহূর্তেই নয়নার চোখ জোড়া বড়ো হয়ে গেলো। সে বিড়বিড় করে বলল,” এই কাজ বাশার ভাইয়ের নয়তো!”

(চলবে)…
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়

[ আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো এক মৃত্যুপুরীতে অবস্থান করছি। পরপর পরিবারের চারজন মানুষের মৃত্যু হলো। এই শোক পরিবারের কেউ কাটাতে পারছে না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here