বিয়েকথন শেখ জারা তাহমিদ ষষ্ঠ পর্ব

0
194

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

ষষ্ঠ পর্ব

ওয়াহিদের কথায় অপরাজিতা চমকালো। থমকে গেলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওয়াহিদ মৃদু হেসে বলে, “অর্ণবের মতো বলছি, তোমায় ঘিরে আমার ভালোলাগা। সেই ভালোলাগা একটুও লুকিয়ে রাখতে চাই না। তুমি করে বলি, প্লিজ?” এতো কাতর শোনালো ওয়াহিদের গলা, অপরাজিতা শুধু কোনোরকমে মাথা দোলাতে পারলো। অথচ ওয়াহিদের চোখেমুখে তখন পাওয়ার আনন্দ। মেইবি এনাদার ম্যাচ পয়েন্ট!

কফিতে চুমুক দিয়ে অপরাজিতাকে প্রশ্ন করে ও, “স্রোতস্বীনী শুনেছো অপরা? ইনকোরের গানটা?” অবাক হয়ে অপরাজিতা মাথা দোলায় আবারও। ওয়াহিদ ফের বলে, “গানটায় একটা লাইন আছে। ‘আমি ভেবে নিলাম তুমি সেই লাল গোলাপ, যারে নিরন্তর পাহারা দেয় এক কাঁটার বাগান’। অপরা, তুমি ছিলে সেই লাল গোলাপের প্রতিবিম্ব। তোমার বাবা হলেন সেই কাঁটার বাগান। নেগেটিভ ভাবে বলছি না কিন্তু। মেটাফোর হিসেবে বলছি। তোমাকে তোমার বাবা এতোটাই আগলে রেখেছেন যে ওই কাঁটার বাগান পার করে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। ভাগ্যিস পারেনি। তাই সুযোগটা আমি পর্যন্ত এসেছে। সুযোগ পেয়েই আমি লুফে নিয়েছি। এন্ড প্রাউডলি বলছি, তোমাকে জিতে নিয়েছি। তবে এর জন্য ঠিক কতবার কতভাবে আমাকে টেস্ট দিতে হয়েছে সেটা আরেক গল্প। আনাম আংকেল অনেক ভেবেচিন্তে তার কাঁটার বাগান পার করে আমাকে সেই লাল গোলাপ পর্যন্ত যেতে দিয়েছেন। সেই লাল গোলাপ বাড়ি ছেড়ে হলে উঠলো, আমি কি জানবো না?” অপরাজিতা যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে! বড় বড় চোখে তাকিয়েই রইলো শুধু। ওকে আরো চমকে দিয়ে ওয়াহিদ বললো, “আংকেল নিজেই ডেকে জানিয়েছেন। এক্সাক্টলি কি বলেছেন সেটা বলা যাবে না। সিক্রেট।” অপরাজিতার চোখেমুখে রীতিমতো অবিশ্বাস। ওয়াহিদ হাসলো সেটা দেখে। কফি মগ এগিয়ে দিয়ে বললো, “খিদে পেয়েছে অপরা। লাঞ্চ করিনি। আরও কিছু অর্ডার দিই?” অপরাজিতার চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো এটা শুনে। কন্ঠে রাগ নিয়ে প্রশ্ন করলো, “লাঞ্চ করেননি, সেটা আগে বলেননি কেনো? রেস্টুরেন্ট ছেড়ে তো আসতাম না তাহলে। এখানে বার্গার-স্যান্ডউইচ ছাড়া আপনি আর কী পাবেন?” এবার ওয়াহিদের অবাক হবার পালা। একটু আগে চুপ করে থাকা, ইমোশনাল হয়ে পরা মেয়েটা কোথায় গেলো! ইন্সট্যান্ট মুড চেইঞ্জ! বউয়ের বকাবকি কী তবে শুরু হয়ে গেলো?

ওয়াহিদ দু’টো বার্গার অর্ডার দিলো। অপরাজিতা সেটা দেখে বললো ও খাবে না। দু’টো অর্ডার দেয়ার দরকার নেই। ওয়াহিদের চোখেমুখে দুষ্টমি খেলে গেলো সেটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে বললো, “ফিনল্যান্ডে গিয়ে শুরুর দিকে আমি ঠিকঠাক রান্না করতে পারতাম না। তখন বার্গার খেয়ে দিন কাটতো আমার। এতো এতো বার্গার খেয়েছি অথচ একটুখানিও রুচি নষ্ট হয়ে যায়নি। কখনই মনে হয়নি জীবনেও আর বার্গার খেতে পারবো না। বরং প্রত্যেকবার মনে হয়েছে নতুন করে খাচ্ছি। তোমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই, অপরা। যতই ভালোবাসি সেটা ফুরিয়ে যাবে না। তোমার প্রতি যে তীব্র ভালোলাগা সেটা মিলিয়ে যাবে না।” এই কথায় অপরাজিতা কঠিন লজ্জা পেলো! সেটা দেখে ওয়াহিদ অত্যন্ত ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে বললো, “মেটাফোর হিসেবে বলেছি। ডাবল মিনিং করে বলিনি!” ব্যস। অপরাজিতা হেসে গড়াগড়ি খেলো। ওয়াহিদও ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো। বার্গার এলে, খেতে খেতে দুজনে গল্প করলো। অপরাজিতা একটা বার্গারের হাফ খেলো। তারপর যখন বিল দেওয়ার সময় হলো ওয়াহিদ ওয়ালেট বের করতেই অপরাজিতা বলে উঠলো, “আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে, ওয়াহিদ। সেটা যেভাবেই হোক। ইউ আর মাই হাসব্যান্ড। এন্ড আমার হাসব্যান্ডের দায়িত্বও আমার। বিল আমি দেবো, ওয়ালেট বের করছেন কেনো?” সেদিন ওয়াহিদের কথায় অপরাজিতা, আর আজকে অপরাজিতার কথায় ওয়াহিদ বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো!

***

ক্যাফে থেকে ওরা যখন বেরোলো তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। সাড়ে ছ’টার মতো বাজে। ওয়াহিদের ফিরে যাওয়ার তাড়া নেই। অপরাজিতাও ফেরার কথা বলেনি। সুযোগ বুঝে ওয়াহিদ তাই একসঙ্গে ডিনার করার আব্দার করলো। অপরাজিতার মনে তখনও অনেক প্রশ্ন। ও তাই চট করে রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু ডিনারের সময় হতে দেরি আছে। কোথাও না বসে ততক্ষণ ওরা ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো।

অপরাজিতার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা জামা, কামিজে আর চলছে না। কাল-পরশু ও শপিংয়ে যেতো। এখন যেহেতু শো-রুম গুলোয় ঘুরছেই, ওর মনে হলো শপিং করে ফেলা যাক। ওয়াহিদের ধৈর্যের একটা ছোট্ট পরীক্ষাও নিয়ে ফেলা যাবে! নিজের ভাবনায় নিজেই মিটিমিটি হাসলো ও। কিন্তু অপরাজিতা যদি জানতো ধৈর্যের পরীক্ষা ওকে দিতে হবে তবে কেনোভাবেই ওয়াহিদকে নিয়ে শপিংয়ে যেতো না!

একটা নামকরা দেশী ব্র্যান্ডের শো-রুমে গেলো ওরা প্রথমেই। অপরাজিতা কিছুক্ষণ দেখেশুনে একটা কামিজ পছন্দ করলো। ওয়াহিদকে কেমন জিজ্ঞেস করতেই ওয়াহিদ বললো, “ভালো। কিন্তু এটা ফুল স্লিভ হলে বেশি ভাল্লাগতো।” সেই থেকে শুরু। কোনোটাই ওয়াহিদের পারফেক্ট লাগে না। কোনোটার ডিজাইন ভালো লাগে না! কোনোটার রং ওর চোখে বেশি লাগে! অপরাজিতা বিরক্ত হয়ে শেষে শো-রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। একজন মানুষ জামাকাপড় পছন্দ করতে এতো খুঁতখুঁতে হয় কীভাবে! যার জামাকাপড় পছন্দে এতো সময় লাগে সে মানুষ পছন্দ করতে কতদিন সময় নেয় কে জানে! ওয়াহিদকে সে কথা বলতেই ও হেসে বললো, “ইনডাইরেক্টলি জিজ্ঞেস করছো তোমাকে পছন্দ করতে কতসময় লাগলো? ট্রাস্ট মি অপরা, তুমি আর জামাকাপড় এক না।” অপরাজিতা খুব চেষ্টা করলো বিরক্তি ভাবটা চেহারায় ধরে রাখতে। কিন্তু ওয়াহিদের আকুতিভরা সহজ, সরল স্বীকারোক্তিতে বরাবরের মতোই এবারও পারলো না। একরাশ মায়া নিয়ে প্রশ্ন করলো, “আপনি আমাকে ভালোবাসলেন কখন? যেদিন ছবি দেখলেন, সেদিনই?” ওয়াহিদ সময় নিলো উত্তরটা দেয়ার আগে। ব্যস্ত মেইনরোড ছেড়ে গলির নিরিবিলি রাস্তায় পা চালালো। মাঝে মাঝে রিকশার আনাগোনায়, স্ট্রিট লাইটের আলোয় আর দূরের কোনো এক বিল্ডিং থেকে ভেসে আসা অচেনা গানের মৃদু শব্দে মুহূর্তটা বিশেষ হয়ে উঠলো। সেই বিশেষ মুহূর্তে ওয়াহিদ শোনালো ওর মুগ্ধতার গল্প।

সাবলীল কন্ঠে শুরু করলো, “আব্বু তোমার ছবি আমাকে দেখালো প্রায় মাস দু’য়েক আগে। আগামী দু’বছরেও আমার যে বিয়ের কোনো প্ল্যান নেই, সেটা আব্বু জানে। কিন্তু পাত্তা দেয়না। নিয়ম করে মেয়ের ছবি, বায়োডাটা পাঠায় ভাবীকে দিয়ে। অথচ! সেদিন নিজে এলো! খুব আগ্রহ নিয়ে ফেইসবুকে তোমার ছবিটা দেখালো। দেখলাম। বিশেষ কিছু অনুভব হলো না। তুমি সুন্দরী। একবার দেখলে আবারও যে কেউ ঘুরে তাকাবে। আমিও দ্বিতীয়বার দেখলাম। এইবার মনে হলো সুন্দর হলেও তুমি সিম্পল। ব্যাপারটা এখানেই থেমে যেতে পারতো। কিন্তু আব্বুর আগ্রহে আমি অবাক হলাম। প্রিয় বন্ধুর মেয়ে বলেই এতো আগ্রহ হবে কেনো? কৌতুহল হলো। ফেইসবুকে আংকেলকে খুঁজে বের করলাম। তোমাকে নিয়ে লেখা আংকেলের জন্মদিনের বার্তায় আরো অবাক হলাম। মেয়েকে তিনি ভালোবাসেন সেটা বোঝা গেলো ৪/৫ লাইনের ওই বার্তায়। তবে আমাকে আকর্ষন করলো তোমার নাম। অপরা কারো নাম হতে পারে সেটা প্রথমবার দেখলাম! তখনও পুরো নাম জানি না। আংকেল লেখেনি। তোমাকে তার পোস্টেও ট্যাগ করেনি। কমেন্ট সেকশনও অফ করা। কোনোভাবেই খুঁজে পেলাম না। দুদিন বাদে ভাবীকে গিয়ে বললাম অপরার ফেইসবুক আইডি লাগবে। ভাবী কী বুঝলো কে জানে! সে আরেকধাপ উপরে। টিজ করলো কতক্ষণ। তারপর বললো, আজমীরা হাসনাতকে খুঁজে না পাওয়ার কী আছে!”

তখনের ফাস্ট্রেশন ওয়াহিদের কন্ঠে এখনও যেনো ঝরে পরছে! অপরাজিতা সশব্দে হেসে উঠলো। ওয়াহিদ সেদিকে তাকিয়ে বললো, “হেসো না। তুমি যে অপরাজিতা সেটাই জানতাম না আমি! আজমীরা হাসনাত তো সিলেবাসের বাইরে!” অপরাজিতার হাসি থামলো না। অনেকদিন পর প্রাণখুলে যেনো হেসে উঠলো ও। ওয়াহিদের এতো ভালো লাগলো। ও অপরাজিতার হাসি থামার অপেক্ষা করলো। অতঃপর আবার শুরু করলো, “তোমাকে খুঁজে পেলাম। ইংরেজিতে অনার্স করা মেয়েটার টাইমলাইন ভর্তি শেক্সপিয়ার-ওয়ার্ডসওয়ার্থ। বাবার সাথে হাসোজ্জল ছবি। আম্মুর সাথে মিলিয়ে সেইম শাড়ি পরা ছবি। কাজিনের বাচ্চাদের নিয়ে আহ্লাদী ছবি। বন্ধুদের সাথে ট্যুরের ছবি। ছবিগুলো আমি কতবার যে দেখেছি, হিসেব নেই। সব ছবিতে কমন হলো হাসিমুখের অপরা। আমার খুব ভালো লেগে গেলো। এই হাসিমুখের অপরাকে এতোটাই ভালো লেগে গেলো যে আব্বুকে জানালাম বিয়ে করবো! আব্বু কীভাবে আংকেলকে রাজি করালেন জানি না। একদিন বললেন আংকেল দেখতে চাইছেন আমাকে। আংকেলের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হলো। কঠিন যাচাই-বাছাই হলো আমার। পাশ করার পর তোমাদের বাসায় ফাইনালি ডাক পরলো! যদিও আন-অফিশিয়ালি। গেলাম। তোমাকে প্রথমবার সামনে থেকে দেখলাম। নীল শাড়িতে, স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানো তোমাকে দেখে গলা শুকিয়ে আসছিলো আমার। পুরোটা সময় মনে মনে বলছিলাম, এই মেয়েটা আমার হয়ে যাক!”

নিয়ন আলোয় একধ্যানে বলে চলা, পাশে হাঁটতে থাকা ওয়াহিদকে দেখে অপরাজিতা। মানুষটা এতো গুছিয়ে কী করে বলে? ওয়াহিদের অবশ্য এতসবে খেয়াল নেই। ও বিভোর সেদিনের অপরাজিতায়, যেদিন প্রথমবার ভালোবাসা এসেছিলো, “লাঞ্চে যখন বসলাম, তুমি এলে ড্রইয়ংরুমে। বাচ্চাদের খাবারে মনিটর করলে। ওদের সাথে ওইটুকু সময়ের মাঝে গল্প জমিয়ে ফেললে। ওরা সব আমার বোনেদের বাচ্চাকাচ্চা। আমি খেলাম কম তোমাকে দেখলাম বেশি। খাওয়া শেষে আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোমাকে কেমন লেগেছে। ভালো লাগলে, আংকেলকে প্রস্তাব দেয়া হবে। আংকেল রাজি হবেনই এমন না৷ তবুও একটা চান্স নেয়া আর কি। আমি চান্সটা নিলাম। আংকেল প্রস্তাব শুনলেন। ভাবলেন। আমাকে আলাদা করে ডেকে কথা বললেন। এরপর তোমাকে জানাতে গেলেন। সাড়ে চারটের দিকে যে গেলো, পাঁচটা পার করেও যখন কোনো খবর এলো না, তোমার ফুপি উঠে গেলেন। ততক্ষণে, তুমি ‘না’ বলেছো সেটায় আমি শতভাগ নিশ্চিত। কিন্ত অপরা, তুমি আমার ভাগ্যে ছিলে। ফুপি যাওয়ার দশ মিনিটের মাথায় সবাই বেরিয়ে এলো। আংকেল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাগরিবের আগেই বিয়ে! কাজী আনতে গেলো কয়েকজন। সবাই দারুন আনন্দে এটা-সেটা করছে। শুধু আমি স্ট্যাচু হয়ে বসে রইলাম। তুমি আমার সঙ্গে কথা না বলেই রাজি হয়ে গেলে। এটাকে আমি পজিটিভলি নিবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। কাজী এলো। তোমাকে নিয়ে আসা হলো। অলওয়েজ হাসতে থাকা তোমার মুখে কোনো হাসি নেই। রিয়েলাইজ করলাম ভুল হয়ে গেছে। তক্ষুনি বিয়েটায় তুমি হ্যাপী না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ওয়াহিদ। অপরাজিতা চুপ করে থাকে। সেদিনের সন্ধ্যে আরেকবার ভেসে উঠে ওর মানসপটে। ওয়াহিদ আবার বলতে শুরু করেছে, “কবুল পড়ে তুমি আমার বউ হয়ে গেলে। নতুন বউয়ের চোখেমুখে খেলা করা লজ্জারা, চাপা আনন্দরা তোমার মধ্যে অনুপস্থিত। বিয়ের নীল শাড়ি যেনো তোমার মনের বিষাদেরই ছাপ। একহাত দূরত্বে বসে থাকা সেই বিষণ্ণ, সুন্দর তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেললাম।”

অপরাজিতা এপর্যায়ে দাঁড়িয়ে পরে। ওয়াহিদের অনুভূতির তীব্রতা ওকে ছুঁয়ে যায়। কী চমৎকার করে বিয়ের দিনে বউকে ভালাবেসে ফেলার একটা গল্প আছে মানুষটার!

বিয়ে নিয়ে ওদের দু’জনের অনুভূতি এতো অন্যরকম কেনো? ওয়াহিদের টা যেখানে স্নিগ্ধতায়, মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ, অপরাজিতার টা সেখানে দম বন্ধ করা কেনো?

***

ডিনারে ওরা গেলো শংকর রোডের একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। খাবার অর্ডার দিয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসলো। ওয়াহিদ এরমাঝে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে যখন হেঁটে আসছিলো, অপরাজিতার আবারও মনে হলো একটা তালগাছের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে! ওয়াহিদ বসতেই ও জিজ্ঞেস করলো, “আপনার হাইট কতো?” তারপর ওয়াহিদের বলা “বেশি না। মাত্র পাঁচ ফিট এগারো!” শুনে হাঁ হয়ে রইল। যেটা ও পাঁচ ফিট আট ভাবছিলো সেটা পাঁচ ফিট এগারো! এতো লম্বা হওয়া লাগবে কেনো? এই লোকের দিকে ও সরাসরি তাকাবে কী করে! ঘাড় বাঁকিয়ে? তবে মনে মনে স্বীকার করলো ওদের দুজনের হাইট ডিফরেন্স পারফেক্ট। আজকে যখন শো-রুমের আয়নায় দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ালো তখনই মনে হয়েছে সেটা।

খেতে বসে অপরাজিতা ওয়াহিদের নতুন একটা দিক আবিষ্কার করলো। ওয়াহিদ ঝাল খেতে পারে না। অপরাজিতা চিলি চিকেন খায় বলে অর্ডার দিলেও সেটা ওয়াহিদ মুখে তুলে নি। ভেজিটেবলে থাকা ক্যাপসিকামও বেছে খেলো। ব্যাপারটা ওর ইন্টারেস্টিং লাগলো। বিয়ের পর অচেনা মানুষটাকে একটুখানি করে জানতে-বুঝতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এক্সপ্লোর করার অনেক কিছু আছে। এই তো সেদিন ইএলটি পরীক্ষা দিয়ে এসে কফি খেতে খেতে ওয়াহিদের সাথে কথা বলছিলো। তখন জানলো ওয়াহিদের চা ছাড়া দিন চলে না। দুধ চা, রঙ চা, মাল্টা চা সব ফ্লেবার পছন্দ ওর। অথচ অপরাজিতা চা খায় না। একদমই না। এই ছোট্ট মিল-অমিলগুলো ওদের মায়ায় জড়িয়ে দিচ্ছে। যেই মায়ার টানে অনেক বছর সংসার করে ফেলা যায়।

খাওয়ার মাঝপথে ওয়াহিদের ফোনে কল এলো। মায়ের ফোন দেখে, অপরাজিতাকে আর্জেন্ট বলে কল রিসিভ করলো। তবে এবারে উঠে গেলো না। ওর সামনেই কথা বললো। কথা শেষে অপরাজিতা প্রশ্ন করলো, “আজকে উঠে গেলেন না কেনো?” ওয়াহিদ প্রথমে বুঝলো না। পরে বুঝতেই এক্সপ্লেইন করলো, “সেদিনের ওটা অফিশিয়াল কল ছিলো। তোমার সামনে কথা বললে তুমি বিরক্ত হতে। আর আজকে তো আম্মু ফোন দিলো। আমার আম্মু তোমারও তো আম্মু। কোনো সিক্রেট তো নেই। তোমার সামনে কেনো কথা বলবো না?” অপরাজিতার উত্তর পছন্দ হলেও মেজাজ খারাপ হলো। গোমড়া মুখে বললো, “আপনার আম্মু আমার আম্মু। কিন্তু আমার বাবা আপনার আংকেল! সেটা কেনো?” ওয়াহিদ গালভরে হাসলো বউয়ের অভিযোগে। জবাব দিলো, “পারমিশন দাওনি তো, অপরা।” অপরাজিতার আরো মেজাজ খারাপ হলো। পারমিশন দেয়নি মানে কী! পারমিশন লাগবেই কেনো! বিয়ে করার সময় খুব যেনো ওর পারমিশনের অপেক্ষা করেছে! এরা জামাই-শ্বশুর এমন কেনো?

ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো, দশটা পার করে। ওয়াহিদ বললো অপরাজিতাকে পৌঁছে দিয়েই ও উত্তরা ফিরবে। অপরাজিতার বাসায় গেইট বন্ধ হয় এগারোটায়। রিকশায় করে সময়মতোই পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু ওর মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। ওয়াহিদ জানতো ও হলে থাকে। এখন, যখন দেখবে হল ছেড়ে দিয়েছে, এটায় কী সায় দিবে? অবশ্য সায় না দিলেও কিছু করার নেই।

অপরাজিতা রিকশা ঠিক করে উঠে বসলো। ক্রিসেন্ট রোডের নাম শুনে অবাক হলেও ওয়াহিদ কোনো প্রশ্ন করলো না। রিকশা চলতে শুরু করলে, অন্ধকারে ঝলমল করা শহরের দিকে তাকিয়ে অপরাজিতা স্পষ্ট গলায় হল ছেড়ে দিয়ে বাসায় উঠার কথা জানালো।

ওয়াহিদ বুঝেছিলো এমন কিছু হতে পারে। ব্যাপারটা ওর পছন্দ না হলেও কিছু বললো না। কেনো একা একা বাসা ঠিক করলো সেটা নিয়ে রাগ করলে করা যায়। কিন্তু কার সাথে রাগ করবে? এই অভিমানী মেয়ের সঙ্গে রাগ করলে ওকেও দেখা যাবে বয়কট করেছে! কিছু জিনিস ঠিক হতে সময় লাগে, জানে ওয়াহিদ। এই দ্বন্দ্ব কাটতেও লাগবে। ততদিন ও অপরাজিতাকে আগলে রাখতে পারে কেবল। ফিরে যাও অথবা ফিরে যাওয়া উচিত এই টাইপ কথা বলেও কোনো লাভ হবে না। ওর বাবা যতদিন না নিজে আসবেন মেয়ে কোনোভাবেই যাবে না। অপরাজিতা না বললেও, ও বুঝতে পারে সেটা।

চিন্তাভাবনা সরিয়ে রেখে ওয়াহিদ অপরাজিতাকে দেখে। আজকের বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত পুরোটা সময় ওর কাছে অপ্রত্যাশিত। সকালেও কী ও জানতো আজকের দিনটা অপরাজিতা এতোটা সুন্দর করে তুলবে? প্রশ্নটা করা ঠিক না বেঠিক সে ভাবনায় না গিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলে ওয়াহিদ, “অপরা, তোমার প্রেমে পরেছি কখন জানো?”

অপরাজিতা অপেক্ষা করছিলো ওর হল ছাড়া নিয়ে ওয়াহিদ কিছু বলবে। তার বদলে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা প্রশ্নে ও অসহায় বোধ করে। কথা জড়িয়ে আসে। ওয়াহিদ সাড়া না পেয়ে নিজ থেকেই বলে, “তোমার প্রেমে আমি প্রতিবার অল্প অল্প করে পরেছি। অপরাকে খুঁজতে খুঁজতে প্রথমবার প্রেমে পরেছি। খুঁজে পেয়ে হাসিতে মুখরিত তোমার প্রেমে আরেকটু পরেছি। আকদের দিন যখন একহাত দূরত্বে বসা তোমাকে দেখলাম তখন প্রেমে পরেছি। আজকে যখন রিকশায় বসে আড়চোখে আমাকে দেখলে তখনও প্রেমে পরেছি। সন্ধ্যেয় যখন শহর ঘুরলে আমার সঙ্গে তখনও একবার প্রেমে পরেছি।” অপরাজিতার খানিক আগের চিন্তা, মন খারাপ অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। মনে হয়, অ্যা ডে ক্যান নট বি মোর পারফেক্ট দ্যান টুডে!

***

রাত জেগে কথা বলা, কাজের ফাঁকে-ক্লাসের গ্যাপে ছোট্ট মেসেজ করা, হুটহাট রিকশায় ঘোরাঘুরি, অপ্রিয় চায়ের আড্ডায় হাসাহাসি- সেদিনের পর ওদের গল্পেরা ডালপালা মেলে ঠিক এইভাবে।

ওয়াহিদকে ভালো লাগে অপরাজিতার। ওর প্রতি ভালোবাসাটাও দরজায় কড়া দিয়ে যায়। ও দমিয়ে রাখে সেটাকে। আবছা একটা প্রাচীর তুলে রাখে।

আকদের মাস পেরিয়েছে। মাস পেরিয়েছে বাড়ি ছাড়ারও। দিন দিন বাড়ি ফেরার তীব্র ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অপরাজিতার। বাবা এ মাসেও ওর অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে। অথচ একবারও ফোন দেয়নি। কিসের জড়তায় বাবা আটকে যায় ও বুঝতে পারে। সেই একই জড়তায় ও নিজেও আটকে যায়। কিন্তু আম্মুর কোনো জড়তা নেই। আম্মুদের বুঝি জড়তা থাকতে নেই। তিনি রোজ ফোন দেন। হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পাঠান। অপরাজিতা পড়ে ঠিকই। বারবার পড়ে। কেঁদে চোখ ভেজায়। তবুও ফিরে যেতে পারে না। ফিরে গেলে এতোদিনের সব যদি ঠুনকো হয়ে যায়?

***

আনাম সাহেবের রাতে ঘুম হয়নি। হচ্ছে না অনেকদিন ধরেই। ঘুম যখন হয়নি, শুয়ে থেকে সময় নষ্ট করলেন না তিনি। ব্যলকনিতে গিয়ে বসলেন। সামনের লনে ফুটে থাকা শিউলিফুলের দিকে তাকালেন। ভোর হতেই ঝরে যাওয়া এই শিউলি ফুল অপরাজিতার অতি প্রিয়। প্রিয় সবকিছু ছেড়ে মেয়ে যেদিন চলে গেলো সেদিন থেকেই ঘুমাতে পারেন না তিনি।

মেয়ের সব খবরই রোজ পেয়ে যান। ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় হাত পুড়িয়ে রান্না থেকে শুরু করে মিডে নাম্বার মন-মতো না হওয়া পর্যন্ত সবটাই তিনি জানেন। তবুও মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে যান নি। মেয়ের প্রতি অভিমানে দ্বগ্ধ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কিসের অভিমান? তারও কী অভিমানের গল্প আছে? আছে বৈকি। আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়া অপরার বাবারও একটা গল্প আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here