#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ
শেষ পর্ব (প্রথমাংশ)
ওয়াহিদ ফিরেছে গতকাল সন্ধ্যেয়। দু’সপ্তাহের টানা ঘুরাঘুরিতে ও যে কতটা ক্লান্ত সেটা বুঝেছে বাসায় পা দিয়ে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় যেতেই ঘুমে কখন তলিয়ে গিয়েছিলো বলতে পারবে না।
ফ্লাইট থেকে নেমে একবার, বাসায় ঢুকে আরেকবার ফোন দিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছানোর কথা জানিয়েছিলো অপরাজিতাকে। এরপর ঘুমেই রাত পার করেছে। ফোন, মেসেজ দেওয়ার সুযোগ হয়নি। এখন বাজে সকাল দশটার মতো। শুক্রবার যেহেতু, অপরাজিতার ক্লাস নেই আজকে। বাসায়ই থাকবে। চাইলেই দেখা করতে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু দুপুরে জুম্মায় মসজিদে যেতে হবে। ওইটুকু সময়ে অপরাজিতা কোথায় আবার অপেক্ষা করবে! তারচেয়ে দুইটার দিকে দেখা হলে সব থেকে ভালো হয়। ভেবেচিন্তে অপরাজিতাকে ফোন দেয় ও। ঘুম ঘুম কন্ঠে ভেসে আসে অপরাজিতার প্রশ্নভরা কথা, “হ্যালো! ওয়াহিদ। এতো সকালে উঠেছেন! আমি তো ভাবলাম অনেকক্ষণ ঘুমাবেন আজকে।”
ওয়াহিদ সহসা জবাব দিতে পারলো না। ঘুম ঘুম কন্ঠে যে এমন মাদকতা থাকতে পারে সেটা অপরাজিতার সঙ্গে প্রতিদিন সকালে কথা বলতে গেলে টের পায় ও। সকালে হেঁটে এসে অপরাজিতাকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে জাগানো রীতিমতো অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। সন্তপর্ণে শ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলায় ও। হাসিমুখে বলে, “গুড মর্নিং, অপরা। অনেকক্ষণই ঘুমিয়েছি। প্রায় এগারো ঘন্টার মতো।” হাই চেপে ছোট্ট করে অপরাজিতার বলা ‘ওহ’ শুনে ওয়াহিদের হাসি দীর্ঘ হয়। ও এবারে জিজ্ঞেস করে, “দেখা করবে আজকে? দুপুরে?” অপরাজিতা ভেবে উত্তর দেয়, “সেটা করতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। সাড়ে চারটায় পড়াতে যেতে হবে। এন্ড বিফোর ইউ সে এনিথিং, নো! টিউশন ক্যানসেল করা যাবে না।” অপরাজিতার বলার ধরনে ওয়াহিদ শব্দ করে হাসে। অনুরোধের সহিত প্রশ্ন করে, “টিউশনটা কি তিনটায় নেওয়া যায়? তাহলে ছয়টায় দেখা করতে পারতাম।” অপরাজিতা স্টুডেন্টকে ফোন দিয়ে, ওকে শিওরলি জানাবে বলে ফোন রাখে। ওর কন্ঠে ঘুমের রেশ এখনও রয়ে গেছে। আরও খানিকক্ষণ বোধহয় ঘুমাবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।
ওয়াহিদ রুম ছেড়ে বেরোয়। ঘিয়ে ভাজা পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ করেই। ছুটির দিনে সকালের নাস্তা ওদের বাসায় সবাই একসাথে করার চেষ্টা করে। আজকেও আম্মু ডেকেছিলো ওকে নয়টার পর পর। কিন্তু আলসেমিতে উঠতে ইচ্ছে করেনি। এখন ঘিয়ে ভাজা পরোটার কথা বললে পরোটার সাথে দুই-একটা বকাও ফ্রিতে পাওয়া যাবে! অবশ্য আম্মুর বকা খাওয়া-ই যায়। ও চটজলদি মা’কে গিয়ে বললো পরোটার কথা।
জোহরা সুলতানা শুনলেন ছেলের কথা। কোনো উচ্চবাচ্য না করে ছেলেকে টেবিলে বসতে বলে ডিপ ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন পরোটা বের করলেন। চা বসিয়ে, ঘি দিয়ে পরোটা ভাজলেন সময় নিয়ে। নিজের মনে চলতে থাকা কথাগুলো গুছিয়ে নিলেন ছেলেকে বলবেন বলে। চা-পরোটা, গরুর মাংস নিয়ে ছেলের সামনে রেখে নিজেও বসলেন ওর মুখোমুখি চেয়ারে। ওয়াহিদ মায়ের থমথমে চেহারা তখনও খেয়াল করেনি। পরোটার সঙ্গে চা দেখেই মন খুশি হয়ে গেছে ওর। খেতে শুরু করে গরুর মাংস কতটা মজা হয়েছে সেটা বলতে গিয়েই টের পেলো মায়ের মন মেজাজ ঠিক নেই। সহসাই খাওয়া থেমে গেলো ওর। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু হয়েছে আম্মু? তোমার মুড অফ কেনো?” জোহরা সুলতানা গম্ভীরস্বরে জবাব দিলেন, “মুড অফ হওয়াটা কী স্বাভাবিক না? তুই, তোর আব্বু আমাকে কিছুই বলছিস না। আকদের প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো অথচ বউ এখনও বাসায় আসলো না। ক্লিয়ার করে বল সমস্যাটা কোথায়?”
ওয়াহিদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আম্মু এতো ক্ষেপে আছে জানতো না। কিছু বলার আগেই জোহরা সুলতানা আবার বলেন, “কোন নতুন বউয়ের সঙ্গে তার শাশুড়ীর একবারও কথা হয় না? বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যখনই হোক, এতোদিনে একবার কথা বা দেখা হওয়া কী উচিত ছিলো না?” ওয়াহিদ মায়ের আক্ষেপ বুঝলো। মা’কে শান্ত করতে চাইলো। ওর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি ফের বলে উঠেন, “তোর আব্বু কে কিছু জিজ্ঞেস করলেও লাভ নেই। ভাঙা রেডিওর মতো এক কথা! সময় হলেই নাকি প্রোগ্রাম হবে। সেই সময়টা হচ্ছে না কেনো? তুই আর তোর আব্বু মিলে কি লুকাচ্ছিস?” পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাচ্ছে। সেটা সামলাতেই ওয়াহিদ দ্রুত বলে উঠে , “কিছুই লুকাচ্ছি না আম্মু। বিয়ে টা হঠাৎ হয়েছিলো। তাই বলে প্রোগ্রাম তো হঠাৎ করা যায় না। আব্বুর, অপরাজিতার বাবার কত চেনা-জানা মানুষ! সবাইকে একসঙ্গে করতেও তো সময় লাগে।” ছেলের দেওয়া যুক্তি ভুল না। জোহরা সুলতানা কিছুটা নিভলেন। আগের চেয়ে শান্ত হয়ে বললেন, “সেটা মানলাম। কিন্তু তাই বলে এতো সময়ও লাগে না।” ওয়াহিদ রয়েসয়ে মা’কে বুঝায়, “এতো সময় কোথায়! এখনের বিয়েতে তিন-চার মাস ধরে শুধু প্ল্যানিংই হয় আম্মু। ওয়েডিং প্ল্যানার ঠিক করা, পছন্দের কনভেনশন হলে বুকিং দেওয়া, গেস্ট লিস্ট, শপিং, খাবার মেন্যু এসবে সময় লাগে না?”
জোহরা সুলতানা ভেবে দেখলেন কথা ভুল না। তার ছোট মেয়ের বিয়ের সময়ে যে কনভেনশন হলে প্রোগ্রাম আয়োজন করতে চাইলেন সেটায় বুকিংই দিতে হয় দু’মাস সময় হাতে নিয়ে। দেরি হয়, হোক। তবু মেয়ে আর জামাইয়ের ইচ্ছে ছিলো ওখানেই বিয়ে হবে। সবাই মেনে নিয়েছিলো। দুইমাস অপেক্ষা করেই শেষে বিয়ে হয়েছিলো। অপরাজিতারও এমন ইচ্ছে হতেই পারে। সেটায় কোনো অসুবিধে নেই। তার প্রশ্ন অন্যখানে। তিনি মন খারাপ করে ছেলেকে বলেন, “সব বুঝলাম। তবুও আমার মনে হয় কিছু একটা ঠিক নেই।”
মায়ের দুশ্চিন্তা বোঝে ওয়াহিদ। কিন্তু সিচুয়েশনটা এতোই গোলমেলে, চাইলেই সত্যিটা বলা যায় না। ও অসহায় বোধ করে। মন খারাপটা আটকে রেখে প্লেটের পরোটার দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে। অথচ একটু আগের প্রচন্ড খিদে কোথায় মিলিয়ে গেছে।
জোহরা সুলতানা গভীর চোখে ছেলেকে লক্ষ্য করেন। নিজকে প্রশ্ন করেন, সব যদি বেঠিকই হতো ওয়াহিদ কী শ্বশুরের সঙ্গে ইন্ডিয়া যেতো? তার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে অপরাজিতার সঙ্গে ওয়াহিদের কথা হয় কি না। তবে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখেন। ছেলে বড় হয়ে গেছে। বিয়ে করে ফেলেছে। নিজেরটা ভালোই বোঝে। চাইলেই হাজারটা প্রশ্ন তিনি করতে পারেন না। কিছুদিন পর বউ এলে এমনিতেও নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাবে।
ওনাদের পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের প্রথম দু’তলা ডুপ্লেক্সের আদলে করা হলেও পরের তিন তলায় স্বাভাবিক নিয়মেই এক ইউনিটের ফ্ল্যাট। ওয়াহিদের আব্বু তিন ছেলেকে যথাক্রমে তিন, চার, পাঁচ তলার ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর ছেলেরা বউ নিয়ে যার যার ফ্ল্যাটে উঠে যাবে এমনটাই ঠিক হয়ে আছে। বড় ছেলে ওয়ালিদের পর এবার মেজ ছেলে ওয়াহিদের পালা।
একসময় ভরা সংসার ছিলো জোহরা সুলতানার। চার মেয়ে-তিন ছেলে কখনও মিলেমিশে, কখনও ঝগড়া-মারামারি করে বাড়ি মাথায় করে রাখতো। তাদের এই বিশাল বাড়ি তখন যতোটা মুখরিত থাকতো এখন ততোটাই শব্দহীন হয়ে থাকে। মেয়েদের নিজের সংসার হয়েছে। তারা আসা-যাওয়ার মাঝে থাকলেও, ব্যস্ততায় সেটাও বেশি সম্ভব হয় না। এখন প্রতি শুক্রবার ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার চেষ্টা করেন কেবল। সেটাও সবসময় হয়ে উঠে না। একেকজনের কাজকর্ম, অফিস পার্টি লেগেই থাকে। ছোট ছেলে ওয়াসিফও যখন চলে যাবে নিজের ফ্ল্যাটে তখন এতো বড় বাড়িতে তিনি আর মাজহার সাহেব একা থাকবেন, ভাবতেই বুকের ভেতরে হাহাকার টের পান। কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই জগতের নিয়ম। ছেলেমেয়েরা কেনো জলদি বড় হয়ে যায়? কেনো অতটা বড় হয় যতটা বড় হলে সম্পর্ক ঠিক রাখতে দূরে চলে যেতে হয়?
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। সেই সঙ্গে যেনো ঝেড়ে ফেলেন সকল মন খারাপ, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তাদের। আজীবন ধরে দূরে চলে আসার নিয়ম তিনি যেমন মেনেছেন তার ছেলেমেয়েরাও একইভাবে মানবে। দেখে যাওয়া ছাড়া এখানে তার আর কোনো ভূমিকা নেই।
***
ওয়াহিদ তৈরি হচ্ছিলো নামাজে যাবার জন্য। ঘড়ির কাঁটায় একটা বাজে তখন। ওর মন খারাপের অবসান ঘটিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে অপরাজিতার মেসেজে আসে সেইসময়, “গুড মর্নিং ওয়াহিদ। যদিও দুপুর হয়ে গেছে। তা-ও। স্যরি, তখন ভয়াবহ ঘুম পাচ্ছিলো। আবোলতাবোল কিছু বললেও ওটা কিন্তু আমি নই! সাড়ে পাঁচটায় দেখা করতে পারবো। খিলগাঁওয়ের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে। রিকশায় করে। যাবেন?”
না যাওয়ার কোনো কারণ ওয়াহিদের নেই। বরং এইটুকু কথায় ওর মনের কোনে জমে থাকা সকল বিষাদ ছুটি নিলো। রিপ্লাইয়ে কোনো অসুবিধে নেই জানিয়ে দিয়ে, নিজ মনেই হাসলো।
নামাজ শেষে বাসায় ফিরে, সবার সঙ্গে লাঞ্চ করতে বসলেও আশ্চর্যজনক ভাবে খেয়াল করলো ওর অস্থির লাগছে। খাচ্ছে, কথা বলছে ঠিকই কিন্তু মন চলে যাচ্ছে অপরাজিতার কাছে। এতদিন পর দেখা হবে বলেই কী এই অস্থিরতা? খাওয়ার পাট চুকিয়ে ও দ্রুত তৈরি হয়। টি-শার্ট পরবে ভেবেও মত বদলে জিন্সের সাথে সাদা শার্ট পরে ফেলে। সাদা শার্ট পরলে বউ যে একটু বেশি বেশি তাকায় সেটা ও দেখেছে। বউয়ের চোখের মুগ্ধতার কারণ হতে পারা চাট্টিখানি কথা না!
ওয়াহিদ যখন বাসা থেকে বের হয় তখন সাড়ে তিনটের বেশি বাজে। জ্যামে পরলেও সময়মতো পৌঁছে যেতে পারবে। সিএনজি চলতে শুরু করতেই ওর অস্থিরতাও কমতে শুরু করে। মন-মস্তিস্ক থেকে যেনো সকল ইন্দ্রিয়ে অপরাজিতার দেখা পাওয়ার বার্তা পৌঁছে গেছে!
***
অপরাজিতা টিউশনটা এগিয়ে তিনটায় নিয়ে এসেছিলো। পড়ানো শেষ করে সাড়ে চারটায় বের হতে পারলেও বাসায় আসতে সময় লেগেছে ওর। ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বিশ বাজতেই ওয়াহিদ ফোন কলে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে।
নিজেকে তাড়া দেয় অপরাজিতা। চোখেমুখে পানি দিয়ে, দ্রুত তৈরী হওয়ার চেষ্টা করে। ডেনিম ওয়াইড লেগ জিন্সের সাথে বটল গ্রীন ফ্লেয়ারড টপসে নিজেকে সাজায়। ফ্লোরাল ওরনা গলায় পেঁচিয়ে, এলো চুলে লুজ পনিটেইল করে। ডাইনিংরুমে বেসিনের সামনে থাকা আয়নায় একবার উঁকি দেয়। কিছু একটা মিসিং মনে হতেই বারগান্ডি রেড লিপস্টিক ঠোঁটে ছোঁয়ায়। এবার ঠিক লাগছে কি না সেই ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন, ব্যাগ, চাবি নিয়ে দরজা লক করে বের হয়।
ওয়াহিদ দাঁড়িয়েছিলো বাসার সামনের রোডে গলির মুখে। অপরাজিতাকে দেখে নিঃসংকোচে স্বীকার করে, “ইউ আর সিস্পলি বিউটিফুল!” ওয়াহিদের সরল স্বীকারোক্তি, চোখের উন্মাদনায় অপরাজিতা লাজুক হাসে। সমস্ত তনু-মনে অদ্ভুত ভালোলাগা হুটোপুটি খায়। নিজের মধ্যে এক ঝাঁক প্রজাপতির অস্তিত্ব খুঁজে পায়। মনে হয় ইংরেজিতে বলা ‘বাটারফ্লাইস ইন স্টোমাক’ কথাটা একবিন্দুও মিথ্যে নয়!
ওরা যাচ্ছে খিলগাঁও তালতলায়। ধানমন্ডি থেকে রিকশায় ওখান পর্যন্ত যাওয়াটা বেশ সময়ের ব্যাপার। তবে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো মূল উদ্দেশ্য হলে এই সময়টা বেশ উপভোগ্য। রিকশায় বসে ওরা পুরোটা সময় গল্প করলো। ইন্ডিয়ায় দু’সপ্তাহ কেমন ছিলো সেটা ওয়াহিদ চমৎকার গুছিয়ে বললো। অপরাজিতা কে সঙ্গে করে আবার যেতে চায় সেটাও অকপটে বলে ফেললো। অপরাজিতা বললো দু-তিন দিন আগে মাঝরাতে ঝুম বৃষ্টির কথা। ও আর মুনিরা মিলে তখনই কেমন খিচুড়ি রান্না করে খেয়েছে সেই গল্প করলো হাসিমুখে। ওয়াহিদ তখন জানালো ওর মনের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছে। সে অপরাজিতা কে সঙ্গে নিয়ে হুড খোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভিজতে চায় কোনো এক সন্ধ্যেয়। সেটা শুনে অপরাজিতা খুব হাসলো। হাসির তোরে ভেসেই প্রশ্ন করলো কেনো সন্ধ্যেয়? কেনো বিকেলে বা দুপুরে না? ওয়াহিদ তখন খুব সিরিয়াস হয়ে বললো, “এজ অ্যা পারসন আই অ্যাম ভেরি পজেসিভ! আর তোমাকে নিয়ে ঠিক কতটা পজেসিভ সেটা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না।” অপরাজিতা এই কথাতেও হাসলো। মজা করে জানতে চাইলো, “শুধু পজেসিভ? একটুও জেলাস না?” ওয়াহিদ খুব ভাব নিয়ে বললো, “উহু। জেলাসি আমার কখনোই হয়না কোনো ব্যাপারে।” অপরাজিতা তখন ওকে শিহাব ভাইকে কেন্দ্র করে ঘটা কাহিনী শোনালো। সবটা শুনে ওয়াহিদ চোখমুখ কুঁচকে বললো, “প্রেমে পড়ে ছেলেরা মোটামুটি গাধা টাইপ কাজকর্ম করে ফেলে। রিপা পাগল-ছাগল ডেকে ভুল করেনি।” অপরাজিতা অবাক হয়ে গেলো ওর রিয়াকশনে। ও ভেবেছিলো ওয়াহিদ জেলাস হবে! এমন উদ্ভট একজনকে বাবা কোথায় পেলো!
তালতলায় এসে ওরা আগে তালতলার বিখ্যাত কফিশপের হট ক্যাপোচিনো কফি খেলো। এরপর তালতলা মার্কেটের মাঝখানে বসা ফুটপাথের ছোট ছোট দোকান ঘুরে অপরাজিতা নোজপিন, কাঁচের চুরি কিনলো। মার্কেটের পেছনে থাকা ভেলপুরির স্টল থেকে দুজনে ভাগাভাগি করে ভেলপুরি খেলো। আরেকটু সামনে এগিয়ে ঘুরে ঘুরে বাসায় পরার জন্য আরাম আরাম টাইপ টি-শার্ট কিনতে চাইলে ওয়াহিদ পছন্দ করে দিলো। মার্কেট থেকে বেরিয়ে ওখানেই এক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেলো। ওয়াহিদের ফুচকা অতটা পছন্দ না। ও এক পিস টেস্ট করলো কেবল।
এরপর হেঁটে হেঁটে তালতলার মেইন রেস্টুরেন্টের এরিয়াতে এসে, এতো এতো রেস্টুরেন্ট দেখে কোথায় বসবে সেটা নিয়ে কনফিউশানে পরে গেলো। সি থ্রু রেস্টুরেন্ট গুলোর জানলায় দেখলো কোনোটাই তেমন খালি না। সবখানেই মানুষের এতো আনাগোনা দেখে ওরা কিছুক্ষণ হাঁটলো। শেষে পাস্তা খাবে ঠিক করে একটা রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসলো। অপরাজিতার স্পাইসি নাগা পাস্তার বিপরীতে ওয়াহিদের সুইট পাস্তা বাস্তার কম্বিনেশনে ওয়েটার কী অবাক হলো একটুখানি? কী জানি!
খাওয়া শেষে ধানমন্ডি ফিরতে এবার ওয়াহিদ সিএনজি ঠিক করলো। একটা গাড়ি থাকলে এখন কতো ভালো হতো সেটা ভেবে একটু মন খারাপ হলো ওর। সেটা লক্ষ্য করে অপরাজিতা অবাক হলো। জানতে চাইলো কি হয়েছে। ওয়াহিদ বলবে কি না বুঝতে পারছিলো না। তারপর মনে হলো অপরাজিতার নিজের যুদ্ধটা এখনও বাকি। সেখানে ওর কেনো গাড়ি নেই, বা ওর গাড়ি কেনার প্ল্যানিং নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। ও কথা ঘুরিয়ে বললো, “তোমাকে ড্রপ করার সময় হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।” অপরাজিতার বিশ্বাস হলো না সেটা। তবে সিএনজিতে বসে আর কথা বাড়ালো না। পুরো রাস্তা দু’জনেরই কাটলো নিঃশব্দে।
ধানমন্ডি এসে পৌঁছাতে দশটা চল্লিশের মতো বাজলো। অপরাজিতার মনে অলরেডি প্রশ্ন জমে ছিলো। একটু আগে আরো প্রশ্ন যোগ হয়েছে সেখানে। এতোসব প্রশ্ন নিয়ে ও কোনোভাবেই বাসায় যেয়ে শান্তি পাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তটাও কথা বলার জন্য পারফেক্ট না। তার উপর গেইট বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে নেয়। কয়েক মুহূর্ত ভেবে আগামীকাল দেখা করতে পারবে কি না জিজ্ঞেস করে ওয়াহিদকে। ওয়াহিদ রাজি হয় সানন্দে। অপরাজিতার সঙ্গে দেখা করতে ওর কোনো না নেই।
***
অনেক ভেবেচিন্তে অপরাজিতা ঠিক করেছে ওয়াহিদকে বাসায় আসতে বলবে। রেস্টুরেন্টে বসে এতো সব কঠিন প্রশ্ন করা যায় না। একচুয়েলি হয়ে উঠে না। গতকাল দেখা করতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ও ভেবেছিলো সুযোগ করে কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে পারবে। কিন্তু এতো মানুষ, হৈচৈয়ের ভীড়ে সম্ভব হয়নি। আজকেও সেরকম কিছু যেনো না হয় তাই ওর এই ডিসিশন। মুনিরা সকালে বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের আগে ফিরবে না। তারপরও অপরাজিতা ওকে বিষয়টা জানিয়েছে। মুনিরা খুশি মনে বলেছে তার কোনো প্রবলেম নেই। বরং ওরা যেনো আরাম করে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করে! হাহ! যদি মুনিরা জানতো কি সব জটিল সমীকরণ নিয়ে অপরাজিতা দিন পার করছে তবে এই উইশ নিশ্চয়ই করতো না। অপরাজিতা আরেকটা কাজ করেছে। বাড়িওয়ালাকেও ব্যাপারটা জানিয়েছে। এই বাসাটায় ফ্যামিলি থাকে দুই/একটা ফ্ল্যাটে। বাকি সবটাতেই স্টুডেন্ট অথবা কর্মজীবী মেয়েরা থকে। সেখানে হুট করে ওয়াহিদকে নিয়ে আসাটা দৃষ্টিকটু। কোনোরকম কনফিউশান চায় না অপরাজিতা। তাই আগেই সতর্ক হয়েছে।
সকাল থেকে ভেবেচিন্তে করা এতোকিছুর মধ্যে ওয়াহিদকে জানাতেই সবচয়ে দেরি হয়েছে। এগোরাটার দিকে যখন ফোনে জানালো ও বেশ অবাক হয়েছিলো। কীভাবে, কেনো, কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে হাজারটা প্রশ্ন করছিলো। অপরাজিতা তখন বলেছে সব প্রশ্নের উত্তর বাসায় এলেই পাবে। ওয়াহিদ মেনে নিয়েছে। স্বভাবসুলভ হাসিতে জিজ্ঞেস করেছে, “আমার জন্য স্পেশাল কী রান্না করবেন, ম্যাডাম?” এরপরে অপরাজিতার খেয়াল হয়েছে দুপুরে শুধু গুরুগম্ভীর আলোচনা করলেই হবে না লাঞ্চও করতে হবে! সেই থেকে এখন অব্দি ও রান্নাঘরেই। রান্নাটা মোটামুটি কাজ চালানোর মতো ভালোই জানে ও। কিন্তু প্রথমবার ওয়াহিদকে রান্না করে খাওয়ানোটা এক্সট্রা টেনশন দিচ্ছে ওকে। যদিও ভাত, ডাল, মুরগী ভুনা, মাছ ভাজার মতো সহজ রান্নাই করেছে। তারপরও চিন্তা হচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে ঝাল বেশি হয়ে গেলো! আবার কখনো মনে হচ্ছে আইটেম কম হয়ে গেলো! এদিকে দেড়টা বাজে, ওয়াহিদের আসতেও দেরি নেই। জলদি শাওয়ার নিয়ে ফেলা দরকার। নিজেকে প্রেজেন্টেবলও তো লাগতে হবে। সকাল থেকে করা এতোসব কাজে অপরাজিতার মনে প্রশ্ন জেগেছে সংসার কী এভাবেই শুরু হয়? এক’পা-দু’পা করে?
ওয়াহিদ এলো একটু দেরি করে। মিষ্টি, চকলেটস, আইসক্রিমসহ আরো দু’টো ব্যাগে রাজ্যের জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে। অপরাজিতাকে হেসে বললো, “তুমি দাওয়াত দিয়েছো। খালি হাতে আসি কী করে!” ওর কথায় অপরাজিতা কেবল মাথা নাড়লো। এমন আধপাগলা মানুষ বাবা কোথায় পেলো!
খেতে বসে ওয়াহিদ খেলো আরাম করে। সময় নিয়ে। অপরাজিতা যতটা ভয় পাচ্ছিলো তেমন কিছুই হলো না। ওয়াহিদের চেহারায় পরিতৃপ্ত ভাবটা ক্লিয়ারলি বুঝিয়ে দিলো এই মানুষটাকে তুষ্ট করা সহজ। খাওয়া শেষে ওয়াহিদ বারান্দায় গিয়ে বসলো। অপরাজিতা টেবিল গোছগাছে ব্যস্ত তখন।
বারান্দায় বসে ওয়াহিদ দূরের আকাশে নিজের মন খারাপটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। অপরাজিতা হঠাৎ কেনো বাসায় আসতে বললো সেটা সঠিক না জানলেও আন্দাজ করা যায়। ওয়াহিদের কাছে অপরাজিতার প্রশ্নের জবাব আছে। কিন্তু ও নিজে যে ভুলটা করেছে সেটার কোনো উত্তর নেই। আজকে এই বাসায় না এলে ও কখনোই হয়তো বুঝতো না ওর ভুলগুলো কত বিশাল। দু’টো বেডরুমের এই বাসায় দরজা খুলতেই মাঝখানের ডাইনিং স্পেস চোখে পরে। বেডরুমের সাইজ ছোট হলেও অপরাজিতা নিজের মতো সাজিয়েছে। রান্নাঘরটা একজন মানুষের একা কাজ করার জন্য ঠিকঠাক। বড়সড় এই বারান্দায় বসে সহজেই মন খারাপগুলোকে ছুটি দেয়া যায়। কিন্তু সারাজীবন আরাম-আয়েশে, বাবার অতি ভালোবাসায়, আম্মুর আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়া অপরাজিতার জন্য এগুলো কোনোকিছুই ঠিক নয়। ওয়াহিদের এর আগে পর্যন্ত মনে হতো ও ভুল করেছে। হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে অপরাজিতাকে কষ্ট দেওয়ার মতো ভুল করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্যায় করেছে। যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছে, যাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়েছে সেই মেয়েটা কী চায় ও ভাবেনি। একবারও জানার চেষ্টা করেনি। সেদিন বিয়ের গল্পটা ওর জন্য যতটাই আনন্দের ছিলো, অপরাজিতার জন্য ততটাই কষ্টের-হতাশার ছিলো। এই সত্যটা ও আগে টের পায়নি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ অপরাজিতার পাওনা ছিলো। ও যদি অপরাজিতায় মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করতে পাগল হতে পারে অপরাজিতারও ওয়াহিদে মুগ্ধ হয়ে হ্যাঁ বলার অধিকার আছে। অথচ ও এটা কী করলো?
অপরাজিতা বাড়ি ছেড়েছে জানার পর ও বিস্মিত হয়েছে। বিয়ের আসরে বুঝেছিলো, প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলা মেয়েটা, এই বিয়েতে হ্যাপী না। কিন্তু তাই বলে বাড়ি ছাড়বে ওটা ভাবেনি। তারপরও অপরাজিতার বাবা যখন বললো ওর সাথে দেখা করতে তখন ও ভীষণ খুশি হয়েছে। অভিমানীনির অভিমান ভেঙে ফেলতে পারবে সেই বিশ্বাসে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সময় লাগলেও, দেয়াল তুলে দিয়ে নিজের অনুভুতি লুকিয়ে রাখলেও, অপরাজিতা ওর ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছে। কিন্তু অপরাজিতার মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে ওর কারণে সেটার সামনে ও কীভাবে দাঁড়াবে?
আইসক্রিম খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে টুলে বসে থাকা অন্যমনস্ক ওয়াহিদ কে দেখে অপরাজিতা থমকে গেলো। গতরাতের মতো অস্থির অনুভব করলো। আলতো স্পর্শে ওয়াহিদের কাঁধে হাত রাখলে ও ফিরে তাকিয়ে মলিন হাসলো। সে হাসিতে ওয়াহিদকে এতো অসহায় দেখালো, অপরাজিতার মনে হলো কিছুই ঠিক নেই। কি করবে বোঝার আগেই ওয়াহিদ ওকে চট করে জড়িয়ে ধরলো। প্রথমবারের জড়িয়ে ধরার অনুভতি অনেক ম্যাজিকাল হতে পারতো। কিন্তু অপরাজিতার ঠেকলো বিষাদময়। এতো কিসের বিষাদ ওয়াহিদের? নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, ওয়াহিদকে টেনে ওর রুমে নিয়ে আসে অপরাজিতা। ফ্লোরিং করা বিছানায় বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও ওর পাশেই বসে। ওয়াহিদকে সময় দেয় খানিকক্ষণ। এতো অসহায়, ক্লান্ত কেনো লাগবে সদা প্রাণবন্ত এই মানুষটাকে?
“অপরা, তোমার সাথে আমি খুবই অন্যায় করেছি। কিন্তু একটু আগে পর্যন্ত সেটা বুঝিনি।”, নিজ থেকে বলতে শুরু করা ওয়াহিদের কথায় অপরাজিতা খেই হারায়। কথার অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে প্রশ্ন করে, “কিসের অন্যায়? কি হয়েছে ওয়াহিদ? আপনি এতো ডিস্টার্বড কি নিয়ে? গত রাতেও খেয়াল করেছি।”
অপরাজিতার হাত আঁকড়ে ধরে ওয়াহিদ নিচু স্বরে বলে, “গত রাতে তোমাকে ড্রপ করার সময় আমার খুব আফসোস হচ্ছিলো। কেনো আমার একটা গাড়ি নেই? গাড়ি কেনার জন্য আমি টাকা সেইভ করছি। সামনের বছর হয়তো কিনে ফেলবো। গতরাতে এটা নিয়ে একটু আপসেট ছিলাম। কিন্তু এটা আমার মন খারাপের কারণ না। ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। বুঝিয়ে বলতে পারছি না।”
অপরাজিতা আদতেই কিছু বুঝতে পারছে না। ওর দু’চোখের বিস্ময় জানান দিলো সেটা। ওয়াহিদ স্মিত হাসে। প্রশ্ন করে, “আগামী দু’বছরেও বিয়ের প্ল্যানিং নেই, বলেছিলাম তোমাকে। মনে আছে?” মাথা নেড়ে অপরাজিতা সায় দিতেই নিচুস্বরে বলতে শুরু করে ওয়াহিদ, “আমি আরো গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। গাড়ি কেনাটা সেই গুছিয়ে নেয়ার মধ্যেই পরে। নিজের ইনকামে গাড়ি কিনবো, পুরো ফ্ল্যাট সাজাবো তারপর বিয়ে, এটাই আমার প্ল্যান ছিলো। এই কারণেই বিয়ে নিয়ে আব্বুর কথায় গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু অপরা, তোমাকে দেখার পর সমস্ত প্ল্যানিং যেনো আমি ভুলে গেছি। বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম। বিয়ে করে ফেললাম। হুটহাট ডিসিশন আমি ইউজুয়ালি নিই না। অথচ তোমার ক্ষেত্রে এটাই করেছি। তোমাকে আমার পছন্দ। কিন্তু তুমি আমাকে পছন্দ করবে কি না সেটা চিন্তাই করিনি। তোমাকে সেদিন হুট করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললাম। তুমি রাজি হলে। কিন্তু কেনো হলে? মন থেকে কি আদোও রাজি হলে? সেটাও চিন্তা করিনি। তোমাকে ভালোবাসি, বিয়ে করলে তোমাকে পাবো এর বাইরে কিছুই ভাবিনি। তুমি আমার হুটহাট করা কাজের জন্য বাড়ি ছাড়লে, আমি তোমার অভিমান ভাঙাতে চলে এলাম। অথচ বুঝলামই না এই সকল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু আমি। তোমার বাবার কাছে আমি বেস্ট চয়েজ হতে পারি। কিন্তু সেই বেস্ট চয়েজকে তুমি গ্রহণ করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত তোমার। আমি, আমরা তোমাকে সেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলাম। তোমার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আজকে এইখানে না আসলে আমি কখনোই ব্যাপারগুলো বুঝতাম না। শুধু বাবার সাথে অভিমান বলেই একটা মেয়ে সম্পূর্ন নতুন একটা জীবন বেছে নিবে? নাহ তো। তোমার অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ বলেই তুমি আজকে এখানে। তুমি আমাকে পছন্দ করেছো। কিন্তু দেয়াল ভাঙছো না। আমি ভাবলাম বাবার প্রতি অভিমান না মিটলে এই দেয়াল ভাঙবে না। অথচ বুঝলামই না অভিমানের দেয়াল বাবার সঙ্গে হলেও তোমার অস্তিত্বের লড়াইটা আমার সঙ্গে!”
এতোদিন ধরে লুকিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস সশব্দে ছাড়ে অপরাজিতা। নিচু কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠে, “ঠিক তাই ওয়াহিদ। আপনার বোঝায় কোনো ভুল নেই। গত তিন মাস ধরে আমি আপনাকে একটু একটু করে জেনেছি, দেখেছি, প্রেমে পড়েছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু আপনার ভলোবাসায় সাড়া দেয়া নিজের সাথে অন্যায় করা। আবার না দেওয়াও অন্যায় করা। এই নিদারুন মানসিক সংঘাতে আমি ক্লান্ত। আপনি আমাকে ভালোবাসলেন, আমাকে চাইলেন অথচ তাড়াহুড়ো করলেন। আপনার ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বিয়ের আগেও যদি সামনে এসে দাঁড়াতেন, কথা বলতেন তবে কী মুগ্ধ হতাম না? বাবার চোখেমুখের প্রবল আকুতি আমাকে বিয়েতে হ্যাঁ বলিয়েছে। আপনার ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরি আপনিতে মুগ্ধ হয়ে, আপনাকে ভালোবেসেছি, ভবিষ্যৎে সংসারও করবো। কিন্তু ওয়াহিদ, আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারার অধিকার আছে। এটা আপনারা ভুলে গেলেন কেনো? আপনি বাবার কাছে বেস্ট চয়েজ। আমার কাছেও বেস্ট চয়েজ কি না সেটা ভাবার সুযোগটাই আমি পাইনি। বিয়ের পরে জানলাম, ইয়েস মানুষটা আমার জন্য পারফেক্ট। বিয়ের আগে কী জানতে পারতাম না? আপনার প্রতি প্রগাঢ় যে অনুভূতি আমার হয় সেটা যতটা আনন্দের ততটাই আবার নিজের অস্তিত্ব সংকটে হেরে যাওয়ার মতো কষ্টের। হুট করে বিয়ের প্রস্তাব আপনারা দিলেও আমার বাবা সেটায় রাজি হয়েছে। এখানে আপনার দোষ নেই। এটা বাবার সাথে আমার বোঝাপড়া। বাবার জন্য মন পুড়লেও একারণেই ফিরে যেতে পারিনি। মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে জীবন কাটানো আম্মু আমাকে শেখায় নি। তাই আপনাকে ভালোবাসলেও এই দেয়াল ভাঙুক চাইনি। ভালোবাসার থেকেও ভালোথাকা জরুরি।”
অপরাজিতা থেমে যোগ করে, “মনের মধ্যে এত জটিলতা নিয়ে সংসার করা যায় না ওয়াহিদ। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলতে চাইনি। বিয়ের দিনের দমবন্ধকরা অনুভূতিটা আপনার জন্য এতো অন্যরকম মায়াময় সেটা ভেবে হাজারবার কষ্ট পেতে চাইনি। আপনাকে ভালোবাসলেও কষ্ট হচ্ছে। ভালো না বাসলেও যন্ত্রণা হচ্ছে। মানুষ হিসেবে আপনি যদি আরেকটু খারাপ হতেন তবে বোধহয় এই দ্বিধা-দ্বন্দে আমি জড়িয়ে পড়তাম না। আপনি ভালো বলেই বাবার প্রতি অভিমানটা হালকা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি বাবা আমার জন্য বেস্ট মানুষ টাকে পেয়েছে বলেই হুটহাট বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি বুঝেছি আপনাকে ভালোবাসি সেটা স্বীকার করলেই মানিয়ে নিয়ে জীবন পার করা হবে না। বরং আপনি যে ভীষণ ভালোবাসতে জানেন, সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে জীবন কাটানো হবে। ভালোবেসে ভালো থাকাটাও জরুরি, ওয়াহিদ। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
ওয়াহিদের চোখেমুখে খেলা করা বিভিন্ন অনুভুতির ছটায় অপরাজিতা মিষ্টি করে হাসে। বলে, “বাবাকে জানাবেন, আমার আর সময় লাগবে না। তিনি যেনো জলদি আসেন।”
———————————————————————————–
শেষ পর্বটা বেশ বড়। দ্বিতীয়াংশ তাই আলাদা দিবো আগামীকাল।