#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৫.
স্বরূপরা সবাই চলে যাবার পর সে রাতে তনয়ার অদ্ভূত এক অনুভূতি হচ্ছিল। কাউকে বলে সে সেই অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে পারবে না৷ মনে হচ্ছিল তার বুকের ভেতরটা রাতের আকাশের মতো আঁধার। তার ভেতর হঠাৎ একটা দুটো তারা জ্বলজ্বল করে উঠছে৷ শীতল, মিষ্টি কিংবা ঝিমঝিম করা একটা রাত তার জীবনে এসেছে৷ স্বরূপের সাথে এরপর আর কথা হয়নি৷ ওর শেষ কথাটা শুনে তনয়ার রাগ হয়নি। হাসি পেয়েছে। স্বরূপের সাথে কি তাকে সারাজীবন এভাবে ঝগড়া করে যেতে হবে? নাকি কোনোদিন সেও তাকে গুছিয়ে, যত্ন করে ভালোবাসবে? স্বরূপ নিশ্চয়ই ভাবছে সে আর কোনো ছেলে খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে তাকে বিয়ে করেছে! এই ভুলটা কি তার ভাঙানো উচিত?
রাত একটার দিকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। তনয়া ঘুম চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধরবে কি ধরবে না ভেবেও ধরে ফেলল। কোনো ইমারজেন্সি হতে পারে।
“হ্যালো।”
ওপাশ থেকে স্বরূপ বলে উঠল, “তুমি তনয়া তো?”
“ওহ তুমি! কেন গলা শুনে চিনতে পারোনি?”
“তুমি আমাকে হঠাৎ তুমি বলতে শুরু করলে কেন?”
“বাঃ! বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি বলব না?”
“হু, তা বলতে পারো। ঠিক আছে রাখলাম।”
“কিন্তু এত রাতে ফোনটা করলে কেন?”
“আমার কাছে তোমার নাম্বার ছিল না৷ এবং যতদূর মনে হয় তোমার কাছেও আমার নাম্বার ছিল না। এখন নিলাম মায়ের কাছ থেকে।”
“এখন ক’টা বাজে খেয়াল আছে?”
স্বরূপ ঘড়ি দেখে বলল, “একটা! খেয়াল ছিল না৷ ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?”
“হুম। আমি বারোটার আগে ঘুমাই।”
“সিন্ডারেলা!”
“কেন আপনি কখন ঘুুমান?”
“আবার আপনিতে চলে গেলে?”
“অভ্যাস নেই যে তুমি বলার তাই।”
“আপনিই ঠিক আছে। বেশ একটা ডমিনেটিং ভাইব পাওয়া যায়৷ তুমি করে বললে মনে হয় তুমি আমাকে ঠিকঠাক সম্মান করছ না।”
তনয়া হেসে ফেলে বলল, “ঠিকঠাক সম্মান দেয়ার জন্য আর কী কী করতে হবে?”
“ক’দিন পর তো আমার বাসায়ই এসে থাকবে। তখন লিস্ট করে দেব।”
“আপনার বাসা তখন আমারও বাসা হবে।”
“ভুল। ওমেন এম্পাওয়ারমেন্টের যুগ চলছে। এখনকার মেয়েরা হাজবেন্ডদের সাথে সব খরচ শেয়ার করে। তুমি আগে সেরকম করবে, তারপর তোমারও সমান সমান অধিকার হবে।”
“কী বলেন এসব!”
“মোটেও এসব আমি বলি না। এসব নারীবাদী আপুরা বলে।”
“আপনি নারীবাদীদের দেখতে পারেন না?”
“আমি নারীদেরই তেমন একটা দেখতে পারি না।”
“গ্রেট। তাহলে মাঝরাতে একটা নারীকে ফোন করে কথা বলছেন কেন?”
“আমি প্রথমেই রেখে দিতাম। তুমি কথা বাড়িয়েছ।”
“ওকে। সব দোষ আমার। মাথা পেতে নিলাম৷ কিন্তু প্রশ্নটার উত্তর তো পাইনি।”
“কোন প্রশ্ন?”
“এখনো ঘুমাননি কেন?”
“কারন আমি সিন্ডারেলা না। ড্রকুলা।”
“রক্তখেকো?”
“হ্যাঁ।”
“কাদের রক্ত খান?”
“যারা আগে আগে ঘুমায় তাদের।”
“ধুর!”
“রাখছি।”
“শেষ প্রশ্ন!”
“আগে ভেবেছিলাম তুমি আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করবে৷ এখন দেখছি ভুল ভাবছিলাম।”
“তো এখন কী ভাবছেন?”
“এখন মনে হচ্ছে সর্বপ্রথম নষ্ট হবে আমার কান৷ তোমার বকবক শুনতে শুনতে…”
“উফ!”
“প্রশ্নটা করবে নাকি রাখব?”
“আপনি কি সিরিয়াস ওই ব্যাপারটাতে?”
“কোন ব্যাপার?”
“ওইযে বললেন, খরচ সমান সমান বহন করতে হবে..”
“হুম। সিরিয়াস।”
“কিন্তু আমি তো এখনো কোনো চাকরি করি না। পড়াশুনাই শেষ হয়নি।”
“সেটা তোমার সমস্যা। সেজন্য আমার সাথে আগে কথা বলে নেয়া উচিত ছিল। তা তো বলোনি৷ এবার তুমি কী করবে সেটা তুমি ভেবে বের করবে।”
“ওহ, ওকে!”
“বাই। গুড নাইট।”
তনয়া পাল্টা কোনো অভিবাদন জানাল না। সত্যি কথা বলছে নাকি এই লোক?
ফোন রাখার পর স্বরূপ হো হো করে কিছুক্ষণ হাসল। ভয় পাওয়ানো গেছে মেয়েটাকে। এত সহজে ভয় পেয়ে যাবে কে জানত! এত শখ করে বিয়ে করেছে এখন বুঝুক কাকে করেছে!
*****
স্বরূপের ফ্ল্যাটে আসর বসেছে বহুদিন পর। সব বন্ধুরা একত্র হয়েছে, শুধু সজীব বাদে। সে এখানকার পড়াশুনা শেষ করেই পাড়ি জমিয়েছে ফিনল্যান্ড৷ এখন আরও পড়ছে, পড়েই যাচ্ছে। বাকিদের মোটামুটি গোছানো সংসার হয়েছে। স্বরূপ বাদে সবারই বিয়ে থা হয়ে গিয়েছিল৷ এখন তারও হলো। আজ তারা শুধু বন্ধুরা একত্র হয়েছে। সংসার, বাচ্চা সব রেখে ইউনিভার্সিটির জীবনে ফেরার একটা সাময়িক চেষ্টা।
এমনিতেও বিয়ে উপলক্ষে কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন। মহিলারা বসার ঘরের মেঝেতে বসে পিঠা বানানো আর গল্পগুজবে ব্যস্ত। কেউ কেউ রান্নাঘরে চুলার পাশে খুন্তি নাড়ছে ব্যস্তভাবে। স্বরূপের মনেও অনেকদিন পর একটা উৎসব ভাব হচ্ছে। মা এলে এমনিতেও তার কাছে বাড়ি ভরা ভরা মনে হয়। আজ তো খালা, চাচী আর মামীরাও এসেছেন। সবার ভীষণ আদরের স্বরূপ। সবাইকে খুশি দেখে তার ভেতরকার বিতৃষ্ণাটা কিছুটা হলেও কেটেছে।
রান্নাঘর থেকে আরেক প্রস্থ চা আর মাংস পিঠা এসে হাজির হতেই অঙ্কুর দুটো পিঠা নিয়ে মুখে পুরল। খাদক বলে তার সুনাম এখনো সে অক্ষুন্ন রেখেছে। বরং পাল্লা দিয়ে ভুড়ি বাড়ছে। তার বউয়ের রান্নার হাতও নাকি অসাধারণ। অঙ্কুরের ধারণা তার মতো সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। যদিও রোগ ইতিমধ্যে তাকে ধরে ফেলছি ফেলছি করছে।
মিলি পিঠায় হাত দিল না। এমনিতেই মজা পেয়ে চারটা খেয়ে ফেলেছে। এর বেশি হলে ডায়েটের বারোটা বেজে যাবে। তার জীবনটা ঠিক সরল নয়৷ স্বামীর সাথে বনিবনা নেই। লোকটা বিয়ের তিন বছরের মাথায় কেমন বদলে গেল! অফিসের সুন্দরী কলিগের সাথে দিনরাত এত কথা তার! মিলি যথেষ্ট সুন্দরী। তাও এখন নিজের দিকে আরও বেশি নজর দেয়। কেউ যেন বলতে না পারে স্বামী তার আটপৌরে দশা দেখে বিরক্ত হয়ে পিঠটান দিয়েছে।
অন্যরা খেতে খেতে গল্প করছে। কেউ নিজের সংসারের, তো কেউ অতীতের।
তবে আজ সবার মূল আকর্ষণ স্বরূপের দিকেই। সে আজকের হিরো। বিয়ের পাত্র বলে কথা! কায়েস জিজ্ঞেস করল, “স্বরূপ, হানিমুনে কোথায় যাবি?”
“নো হানিমুন।”
“মানে কী?”
“কোথাও যাচ্ছি না আমি। বিয়েটা করছি তাই বেশি, আবার হানিমুন!”
রূপা বিরক্ত গলায় বলল, “তোর ইচ্ছে নাই থাকতে পারে। আমার বোনের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম দিবি না?”
স্বরূপ সরু চোখ করে বলল, “তুই হচ্ছিস ভিলেন৷ তুই তনয়াকে কী খাইয়ে রাজি করিয়েছিস সত্যি করে বল তো?”
“কিচ্ছুই না।”
স্বরূপ ছাড়বার পাত্র নয়। সে এবার ভালো করে কথা ধরল, “তুই কোনোভাবে ওকে আমার অতীতের কথা বলিসনি তো?”
রূপা আমতা আমতা করে বলল, “না না, তা কেন বলব?”
“সত্যি করে বল।”
“সত্যিই!”
স্বরূপ মোটেও বিশ্বাস করল না। বলল, “মেয়েটা কি তাহলে আমাকে সিম্প্যাথি দেখাতে বিয়ে করল? কথাটা এতদিন মাথায়ই আসেনি। তোকে দেখে মনে পড়ল। যদি ভিলেনগিরি করে থাকিস, তোর বোনের খবর আছে।”
রূপা একটু মন খারাপের সুরে বলল, “স্বরূপ, আমি অনেক ভরসা করে ওকে তোর জন্য সিলেক্ট করেছি। ওর মতো ভালো মেয়ে লাখে একটাও হয় না। তুই যদি ওকে কষ্ট দিস তাহলে আমি সারাজীবনের জন্য ওর কাছে ছোটো হয়ে যাব।”
স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি কেন কষ্ট দিতে যাব? তোর দোষ। তোর উচিত ছিল তোর ওয়ান ইন আ মিলিয়ন বোনকে সুযোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দেয়া।”
কঙ্কা দুই হাত তুলে বলল, “গাইজ, বিয়ে হয়ে গেছে। এখন এই ফালতু বকে কোনো লাভ নাই। স্বরূপ পাস্ট ভুলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তুই সামনে এগিয়ে যেতে না পারলে কেমন মানুষ বল!”
“পাস্টের কথা আসছে না৷ আমার কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।”
রূপা বলল, “তোর কিছু করতে হবে না। তুই শুধু ওকে কষ্ট দিস না।”
“ওকে।”
“প্রমিজ?”
স্বরূপ ভেবে রেখেছিল আজ রাতে সবাই চলে গেলে মাঝরাতে ফোন করে তনয়াকে আরেকটু ভড়কে দেবে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা বাতিল করতে হলো। বলল, “প্রমিজ!”
“থ্যাংস দোস্ত।”
“তোরা আমাকে বন্ধু বলিস কেন আল্লাহ জানে। তোরা হলি একেক পিস শত্রু।”
সবাই হেসে উঠল। চায়ে চুমুক দিয়ে আড্ডা চলতে লাগল অন্য বিষয়ে। কিন্তু বেশিক্ষণ আর চলল না৷ বাড়ি থেকে সবারই কমবেশি ফোন চলে এলো। বিশেষ করে মেয়েদের দ্রুত বাড়ি যাবার তাড়া। বাচ্চা রেখে এসেছে তারা।
সবাই এক এক করে বিদায় নেবার পর শুধু মিলি রয়ে গেল। তার তাড়া নেই। তাকে কেউ কল করে বলেনি, এখনো কেন আসছ না? তবুও বাড়ি ফিরতেই হয়। সে উঠল ধীরেসুস্থে।
স্বরূপ মিলির বিষয়টা জানে। সে বলল, “চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
মিলি রাজি হলো। রিকশা পেতে কিছুদূর হাঁটতে হয়। ব্যস্ত শহরেও শীতের রাতটা থমথমে হয়ে আছে। স্বরূপ বলল, “সাফাত ভাই এখনো ঠিক হয়নি?”
“নাহ। আমি আর কিছু বলি না এখন। যা করছে করুক।”
“তুই ওর সাথে এখনো আছিস কেন? খারাপ লাগে না?”
“চাইলেই সম্পর্ক ভাঙা যায় না স্বরূপ।”
“কেন যায় না? তোর বাবা মা যথেষ্ট সাপোর্টিভ।”
“তাতে কী? বাবার দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে৷ আমি সাফাতকে ডিভোর্স দেব শোনামাত্র তার হার্ট চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। মায়েরও হাই প্রেশার। একবার ঝগড়া করে বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমি না ফেরা পর্যন্ত তার প্রেশার নরমাল হয়নি। তুই বল, আমি কী করতে পারি?”
“কিন্তু আছিস কেমন করে? এভাবে থাকা যায়?”
“জীবনটাই এডজাস্টমেন্টের। এখন তো মনের কষ্টের সাথে লড়াই করে থাকছি। ডিভোর্স হলে পুরো সমাজের সাথে লড়তে হবে।”
স্বরূপ হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধরা গলায় বলল, “আচ্ছা মিলি, তুই যখন প্রথমবার ব্যাপারটা ধরতে পারলি তখন তোর কেমন লেগেছিল?”
মিলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর স্বরূপের হাত ধরে বলল, “সেটা বিষয় না। আসল বিষয় কী জানিস, আমার সাথে যাই হোক, আমার ভেতরকার বিশ্বাস কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়নি। আমি এখনো বিশ্বাস করি পৃথিবীতে বিশ্বাসযোগ্য পুরুষ মানুষ আছে। তার উদাহরণ আমার বাবা, ভাই, তোরা। তেমনই তোরও এটা মেনে নেয়া উচিত যে পৃথিবীতে বিশ্বাসযোগ্য নারীও আছে। তোর মাও নারী। মাকে এত ভালোবাসিস, তবু নারী জাতির প্রতি এত বিদ্বেষ কেমন করে ধরে রেখেছিস বল তো?”
স্বরূপ কিছু বলল না। একটা খালি রিকশা দেখতে পেয়ে ডাক দিল। মিলি চলে গেল।
স্বরূপ আস্তে আস্তে ফিরতি পথ ধরল। মোবাইল পকেটে, অথচ স্বরূপ শুনতে পেল তৃতীয় কলটা। এর আগে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল! তনয়া ফোন করেছে।
“কেমন আছেন?”
“ভালো। তুমি?”
“আমিও ভালো। কী করছেন?”
“হাঁটছি।”
“কোথায়?”
“রাস্তায়।”
“এই শীতের রাতে? কেন?”
“ইচ্ছে বলে।”
“ঠান্ডা লাগবে তো। বাসায় চলে যান।”
“ফোন করেছ কেন?”
“কথা বলতে।”
“বলা শেষ?”
“না। বাড়িতে কী চলছে? মা কী করছেন?”
“জানি না। তনয়া, রাখছি।”
“খুব খারাপ লাগে আমার সাথে কথা বলতে?”
“না, এখন ইচ্ছে করছে না।”
স্বরূপ ফোন রেখে দিল।
তনয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু কথা বললে কী হতো? কাবিন হবার পর থেকেই তার স্বরূপের জন্য একগাদা মায়া জন্মে গেছে। সারাক্ষণ তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। তার কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে। অথচ দেখা তো দূরে থাক, স্বরূপ ঠিকমতো কথাও বলে না। যাকগে, আর মাত্র দু’দিন। তারপরেই সে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হবে।
ভাবনাটা মনে আসতেই ভেতরে ভেতরে লজ্জা পেয়ে যায় সে। সবাই যদি জানতে পারে সে শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য পাগল হয়ে আছে, তাহলে কী লজ্জার একটা ব্যাপার হবে ভাবা যায়! বাইরে বাইরে তো খুব ভাব ধরে আছে সবাইকে ছেড়ে যাবার কষ্টে মরে যাচ্ছে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু