#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব১৯ [বৃষ্টি বিলাশ স্পেশাল]
#বোনাস_পর্ব
চোখের পলকেই এর মাঝে কেটে গেছে দুটো দিন। এই দুদিনে আমরা সব কাজিনরা মিলে অনেক আনন্দ উল্লাসে মেতেছিলাম। তবে আজ যখন ওদের ফিরে যাওয়ার পালা, তখনই মনটা আমার কেমন তীব্র বিষন্নতায় ছেয়ে যায়! ওদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে কক্ষে এসে বসে রইলাম খানিকক্ষণ।
গত দুদিনে একবারের জন্যেও আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে আমার আর সাক্ষাৎ ঘটেনি। আমার অবাধ্য দুই নয়ন তাকে খুঁজেছে বারবার কিন্তু তার দেখা আর মিলল কই। থম মেরে সারাক্ষণই গৃহবন্দি হয়ে বসে রইল সে। আমিও তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। সে তার মতো থাকুক আর আমি আমার মতো। হয়তো আমার উপরে চটে আছে খুন্তিপোড়ার বিষয়টা নিয়ে। এজন্যই বোধহয় আর সামনে পড়েনি।
রিশতা আর আহিরের মাঝেও এ কয়দিনে বেশ ভাব জমে উঠেছে। ওদের দুজনের দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া আর খুনসুটি বেশ উপভোগ করি আমি। সবার জীবনেই তো প্রেমের বসন্ত এলো, তবে আমার জীবনে আর এলো কই? এসব মিলিয়ে মনটা কেমন ভারী হয়ে উঠল আমার।
কাঁধে হাত রেখে আমার পাশে এসে বসল রিশতা। আমার মুখটাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, আমার দুই গালে দুহাত রেখে ও বলল
-‘ তোর মন খারাপ মেহু?
আমি মাথা নাড়ালাম। তপ্ত শ্বাস ফেলে রিনরিনে কন্ঠে আবারও রিশতা বলে উঠল
-‘ আমি জানি, তোর মন খারাপ তবে মেহমান চলে যাওয়ায় না, আদ্রিশ ভাইয়ার জন্য। তাই তো?
আমি নির্বিকার চিত্তে সেখানেই ঠায় বসে রইলাম। রিশতা এবার আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদুরে ভঙ্গিতে বলল
-‘ এতো মিষ্টি একটা মেয়ের এমন মুখটা মেঘে ছেয়ে থাকলে কি ভালো লাগে? একটু হাস নয়তো কিন্তু সুরসুরি দিবো আমি।
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু ওর সুরসুরি দিতে দেরি হয়না। আমি না চাইতেও এবার হেসে ফেললাম এবার।
হুট করে ভেসে এলো মেঘেদের গর্জন! এলোমেলো বাতাস বইতে শুরু করে চারপাশে। কিছু মুহুর্তের মাঝেই অন্তরীক্ষ যেন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায়। দীর্ঘ তাপদাহের পর আজ আকাশের বুক চিরে ধরনীর বুকে নেমে আসবে বৃষ্টির ফোয়ারা!
বর্ষণমুখর এমন শীতল পরিবেশ দেখে খুশিতে নেচে উঠল রিশতার মন। হাত ধরে তাই টেনে নিয়ে অতি উচ্ছাসের সহিত রিশতা বলে উঠল
-‘ আজ কতদিন পর বৃষ্টি হচ্ছে, মেহু! আমার তো ভিজতে মন চাচ্ছে। আর আদ্রিশ ভাইয়াও তো ঘাপটি মেরে ঘরে বসে আছে। এটাই তো মোক্ষম সুযোগ! চল আমরা ছাঁদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে আসি।
মুহুর্তেই আমার মনের সকল বিষন্নতা কেটে গেলো যেন। দুজনে হাত ধরে এক ছুটে চলে এলাম ছাঁদে। ঝমঝমিয়ে রহমতের বৃষ্টি বর্ষণে শুষ্ক খাঁ খাঁ করা আমাদের ছাঁদের মেঝে আজ বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর হয়ে উঠেছে! আমি আর রিশতা হাত ধরাধরি করে এক নাগারে বৃষ্টিতে ভিজেই চলছি। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! কি সুন্দর অনুভুতি!
একটু পর আমাদের এই বৃষ্টি বিলাশে এসে যোগ দেয় অরনীও। আমরা একে অপরের গায়ে বৃষ্টির পানির ছিঁটা দিচ্ছি আর খিলখিলিয়ে হেসে চলেছি।
..
কি মনে করে যেন ছাঁদে এসেছিল আদ্রিশ। এসেই নজরে পড়ল বৃষ্টি বিলাশে মগ্ন তিন রমনীকে। এদের মাঝে থাকা বৃষ্টি বিলাসিনী এক রমনীকে দেখে থমকে যায় আদ্রিশ। আদ্রিশ মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে তার বক্ষপিঞ্জরে পাকাপোক্ত ভাবে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলা, নিজের একান্ত ব্যক্তিগত বৃষ্টি বিলাসিনীর দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে জুবুথুবু অবস্থা হয়েছে মেহরুনের। পড়নে থাকা হালকা রঙের সালোয়ার কামিজ ভিজে পুরো শরীরে লেপ্টে আছে তার। ফলে শরীরের আকর্ষনীয় ভাঁজ দৃশ্যমান হয়ে ধরা দিয়েছে তার নেত্রের মাঝে। মেহরুনের প্রতিটি নেত্রপল্লবের ডানা ঝাপটানিতে যেন বুকের মাঝে রীতিমতো তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে আদ্রিশের। আদ্রিশ বেসামাল হয়ে পড়ে মেহরুনের এমন রূপে! প্রতিনিয়ত এই রমনীটির প্রতিটা পদক্ষেপে তাকে একটু একটু করে ঘায়েল করে ফেলছে। শত চেষ্টা করেও আজকাল নিজেকে সামলে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে সে। কি আছে এই মেয়েটার মাঝে যা প্রতিনিয়ত ঘায়েল করে চলেছে তাকে। আজ মনের কোণে নানান অবাধ্য ইচ্ছারা উঁকি দিচ্ছে! আচ্ছা একটু ছুঁয়ে দিলে কি খুব বেশি একটা ক্ষতি হয়ে যাবে?
হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয় আদ্রিশ। বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। তাকে তো এভাবে বেসামাল হয়ে পড়লে চলবে না। মেয়েটা তো এখনো ছোট, ও বোঝে কি এসবের? ইচ্ছায় এই মেয়েটা হতে দূরে দূরে থাকে আদ্রিশ? মেয়েটাকে দেখলেই যে সে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অথচ অবুঝ মেয়েটা সব জেনেও না জানা ভান করে, ইচ্ছে করে চুমু দিয়ে একেবারে সোজা করে দিতে কিন্তু আফসোস মেহরুন তার জন্য বৈধ না হওয়া অবধি তাকে ছুঁয়ে দেখারও সাধ্য যে নেই তার। মনের কোণে সে ইতোমধ্যে এক রঙিন পরিকল্পনার ছক এঁকে ফেলেছে! কিছুটা ভেবে সে বাঁকা হেসে সামনে এগিয়ে যায়।
..
ঝড়ের বেগে কোথ থেকে উড়ে এসে আমার কান টেন ধরল। কান ধরে টানতে টানতে ছাউনির নিচে নিয়ে এলো। চোখ মুখ কুঁচকে সামনে তাকাতেই, আদ্রিশ ভাইয়াকে দেখে হা হয়ে গেলাম আমি। বৃষ্টির পানি তার শরীর ছুঁয়েছে। ঘন কালো চুল বেয়ে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। এক দৃষ্টে চেয়ে আছে সে আমার পানে। তার চোখ যেন আজ কি বলতে চাইছে। বহুরূপি মানবটা আজ অনন্য রূপে ধরা দিয়েছে আমার সামনে। আমি কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতেই আমার ওষ্ঠাধরে হাতের একটি আঙ্গুল ছুঁইয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে সে বলে উঠল
-‘ হুশ চুপ। কোনো কথা নয়।
আমি একবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আরও এক দফা অবাক হলাম। রিশতা, অরনী নেই। ছাঁদ শূন্যই পড়ে আছে। আদ্রিশ ভাইয়া ফিচালো হেসে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল
-‘ মেহুপাখি, বলেছিলাম না, আমার অবাধ্য না হতে। তবুও তুমি বিরাট বড় এক অন্যায় করে ফেলেছো। এর শাস্তি কিন্তু তোমায় পেতেই হবে।
পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম আমি। এই লোকটাকে আমার সুবিধার ঠেকছেনা। এদিকে রিশতা, অরনীও কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে? আমি ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়িয়ে একবার চাইলাম তার পানে। সে পূর্বের দৃষ্টিতেই চেয়ে আছে আমার পানে। আচমকা সে আমার গাল টেনে দিয়ে আলতো করে হেসে বলল
-‘ মেহুপাখি, বৃষ্টিতে ভিজলে তো জ্বর বাঁধিয়ে ফেলবে। তখন তো তোমার এই ডাক্তার সাহেবের তন্বীতেই ফিরে আসতে হবে। যদিও তোমার ডাক্তার সাহেব এখনো পুরোপুরি ডাক্তার হয়নি। তবুও আমারই তো চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলতে হবে তোমায়।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আমি বলে ফেললাম
-‘ স’রি ভাইয়া। আমি আসলে নিজে থেকে ভিজতে চাইনি, ওরাই তো…
-‘ ওরা তোমায় বলল আর তুমিও নাচতে নাচতে চলে এলে মেহুপাখি?
আমি ভড়কে গেলাম। যেভাবে কান টেনে ধরে এনেছিল, আমি তো ভেবেই বসেছিলাম এ লোক নির্ঘাত আমায় মে’রে বসবে। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে হলো ঠিক তার উল্টোটা। আবার সে আমায় তুই থেকে ‘তুমি’ বলেও সম্মোধন করছে? আবার এমন মিষ্টি মিষ্টি বুলিও আওড়াচ্ছেন! হয়েছেটা কি এনার? মামনির হাতের খুন্তি পোড়া খেয়ে কি ইনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে নাকি? এমন অসংখ্য প্রশ্ন প্রতিনিয়ত বিচরণ করছে আমার মস্তিষ্কের করোটিতে। আমি স্বপ্ন ভেবে নিজেকে চিমটি কাটলাম। ‘উহ’ না স্বপ্ন নয় বাস্তব!
আদ্রিশ ভাইয়া আমার এহেন কর্মকান্ডে ঠোঁট চেপে হাসল। আমার একদম গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল
-‘ আমার আচরণে কি চমকে গেলে মেহুপাখি? এরপর আরও চমক বাকি! সবে তো শুরু। শুধু তুমি চমক দিবে আর আমি বসে বসে আঙ্গুল চুষব তা কি করে হয় বলো তো?
আমি হতভম্ব বনে গেলাম। আমায় নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হালকা কেশে আদ্রিশ ভাইয়া পুনরায় বলে উঠল
-‘ তুই কি এখনো স্টাচু হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবি এখানে? কাপড় পাল্টে নে, ঠান্ডা লেগে যাবে তো! নাকি আমি এসে পাল্টে দিয়ে যাব। যদি তোর কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমারও নেই।
শেষোক্ত কথাটা দুষ্ট হেসে বলল আদ্রিশ ভাইয়া। আমার বোধগম্য হতেই একরাশ লজ্জারা এসে ঘিরে ফেলল আমায়। আমি যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আমার হাত টেনে ধরল আদ্রিশ ভাইয়া। আমি পেছন ফিরে উৎসুক হয়ে তার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই, আদ্রিশ ভাইয়া আড়ষ্ট কন্ঠে বলে বসল
-‘ ‘ভালোবাসি’ মেহুপাখি।
আমার চরণ দুখানি থমকে যায়। এক শীতল হাওয়া এসে আমার মনে দোলা দিয়ে যায়। সে হতে এহেন বাক্য শোনার জন্যই তো আমি ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। তাহা হইতে এহেন বাণি আমার কর্ণকুহুর স্পর্শ করতেই যেন আমার #হৃদয়ে_লাগিল_দোলা। মুহুর্তেই আমার হৃদয়ের কোলে বয়ে যায় স্রোত! আমিও অস্ফুটস্বরে বলে ফেললাম
-‘ আমিও।
তারপর আর কিছু বলতে পারলাম না। দুহাতে লজ্জায় রঞ্জিত হওয়া আমার মুখশ্রী ঢেকে এক দৌড়ে নিজের কক্ষে চলে এলাম।
আদ্রিশ শব্দ করে হেসে ওঠে তার প্রেয়সীর যাওয়ার পানে চেয়ে।
#চলবে ~
বিষন্ন মন নিয়ে এর চেয়ে বেশি লেখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি🥹
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/