#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶 #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব২১

0
231

#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব২১

কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে আদ্রিশ। দুই নেত্রের মাঝে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই বললে চলে। গুরুগম্ভীর মুখশ্রীতে তার লেপ্টে রয়েছে একরাশ বিষণ্ণতা! মেহরুনের জ্বর বেড়ে ১০৪ এ গিয়ে ঠেকেছে। জ্বরের ঘোরে কিসব প্রলাপ বকছে সে। আদ্রিশ আর সেসব শোনার চেষ্টা করেনি অবশ্য। খানিক আগেই ওকে দেখে এসে নিজের কক্ষে চলে এসেছিল সে। কিন্তু চিন্তায় চিন্তায় নেত্রের মাঝে ঘুমের ঠাঁই মিলল না আর।

বিরক্ত হয়ে নিজের কক্ষে থাকত পারল না আদ্রিশ। মেহরুনকে দেখার জন্য মনটা কেমন যেন ছটফট করছে তার। আদ্রিশের কক্ষ থেকে অবশ্য মেহরুনের কক্ষ খুব একটা দূরে নয়। কয়েক কদম পা ফেলে তাই চলে এলো মেহরুনের কক্ষের সামনে। ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়েও কি মনে করে আর করল না। আড়ালে দাঁড়িয়ে তাই নিজের প্রেয়সীকে এক ঝলক দেখে নেয় আদ্রিশ।

এতোরাতে একটা মেয়ের ঘরে যাওয়া উচিত হবে না বলে মনে করে আদ্রিশ। যতই সম্পর্কে সে চাচাতো বোন হোক না কেন! আজ বাদে কাল এ নিয়ে কথা উঠতে পারে। আদ্রিশ কখনোই চাইবেনা তার প্রেয়সীর সম্মানে কোনোভাবে আঘাত লাগুক। আর তাই তো এতো বছর ধরে নিজেকে সংযত রেখেছে সে। মেহরুনকে নিজ থেকে দূরে রাখার জন্য ধমক দিতে বিন্দুমাত্রও কার্পন্য করেনি সে। এজন্য অবশ্য সে গুমরে গুমরে মরেছে! যদিও এসব কথা একমাত্র রিশতা ছাড়া আর কেউ জানেনা। এমনকি মেহরুনও সবটা জানেনা। জানতে দেয়নি আদ্রিশ।

-‘ মেহুকে এক ঝলক না দেখতে পেলে ঘুম আসছে না বুঝি, ভাইয়া?

কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে নিয়ে খানিকটা রসিকতার সহিত উক্ত কথাটা বলে উঠল রিশতা। অধরের কোণে লেপ্টে আছে তার ফিচালো হাসি।

আচমকা পেছন থেকে এমন বাক্য কর্ণকুহুরের ঠেকতেই চমকে যায় আদ্রিশ। চলে যাওয়ার পরিবর্তে ভ্রু কুচকে পেছন ফিরে তাকল সে।

তা দেখে একগাল হেসে রিশতা বলে ফেলল

-‘ আপনি কি আমার কথায় বিব্রত বোধ করেছেন ভাইয়া? না মানে একটু আধটু মশকরা করছিলাম আমি আপনার সাথে আরকি। ভাই বোন থেকে দুদিন পর শালী দুলাভাই হতে চলেছি, একটু মশকরা না করলে কি চলে বলেন তো?

আদ্রিশ মুখের ভাবভঙ্গিতে বুঝতে দিলনা যে রিশতার এমন কথায় সে সত্যিই বিব্রত হয়ে পড়েছিল একটু আগে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তাই গমগমে গলায় জবাব দিল

-‘ এখানে আবার বিব্রত বোধ করার মতো কি আছে? একজন ডাক্তার হিসেবে রোগীকে দেখতে আসাটা কি আমার দায়িত্বের কাতারে পড়ে না?

আদ্রিশের এহেন বাণিতে রিশতা বোকা বনে যায়। ভেবেছিল সুযোগ পেলেই লোকটাকে নিয়ে একটু মশকরা করে নিবে কিন্তু তা আর হলো কই? উল্টে তাকাকেই বোকা বানিয়ে ছাড়ল যে। রিশতাও কম যায় না। পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে, বাঁকা হেসে বলল

-‘ আমি কিন্তু আপনার ব্যাপারে সব জানি ভাইয়া। তারপরও সত্য গোপন করতে চাইছেন আপনি?

আদ্রিশ এবার কিছু সময় থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। নিরবতা ভেঙে ধরা গলায় সে বলে উঠল

-‘ তো সব জানিস বিধায় কি এখন আমায় ব্ল্যাকমেইলও করতে চাইছিস? চাইলে করতে পারিস, সমস্যা নেই আমার তাতে। যেখানে নিজের বাবা-ই সব দায় আমার উপর বর্তাতে চায় সেখানে তুই তো সামান্য ব্ল্যাকমেইল-ই করেছিস।

আদ্রিশের কথাগুলো শুনে চোখটা ছলছল করে ওঠে রিশতার। সে তার বড় ভাই সমতুল্য মামাতো ভাইয়ের সাথে এতোক্ষণ যাবত মশকরা করছিল। এভাবে আঘাত দিয়ে তো সে কথা বলতে চায়নি। রিশতা করুণ গলায় বলে উঠল

-‘ ভাইয়া সরি! আমি আপনাকে আঘাত করে কথা বলতে চাইনি, বিশ্বাস করেন!

আদ্রিশ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চোখ বুঁজে আলতো হেসে বলে

-‘ না না আমি কিছু মনে করিনি। এমনি বললাম আরকি।

দুজনের মাঝে আবারও পিনপতন নীরবতা। হুট করে আদ্রিশ এবার কিছুটা গম্ভীর গলায় বলে উঠল

-‘ রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলল! তুই ঘুমাবি না রিশতা? নিশাচর প্রাণী হয়েছিস নাকি? এমন চলতে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। মেহুর পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড় যা।

রিশতা বাধ্য মেয়ের ন্যায় কক্ষে চলে যেতে নেয়। দু কদম এগিয়ে কি ভেবে আবারও পেছন ফিরে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল

-‘ আপনি ঘুমাবেন না ভাইয়া?

রিশতার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আদ্রিশ তাচ্ছিল্য হেসে বলল

-‘ আমার আর ঘুম!

আদ্রিশকে অনুরোধ করে রিশতা বলল

-‘ এমন করবেন না ভাইয়া। আপনি শুধু শুধু কেন নিজেকে এতো বেশি কষ্ট দিচ্ছেন। বাবা ছেলের মধ্যে ওমন একটু আধটু হয়, তাই বলে আপনি এমন করবেন! আপনি তো যথেষ্ট বুঝদার, তাহলে? আর আপনার কিছু হয়ে গেলে মেহুর কি হবে, একবার ভেবে দেখুন তো?

আদ্রিশের টনক নড়ে। রিশতা ভুল কিছু বলেনি। মেয়েটাকে দেখলে তো ভোলা ভালা মনে হয়। অথচ এই মেয়ে কতোটা বুদ্ধি বহন করে চলে। আমরা আসলে মানুষকে বাইরে থেকে দেখে যেমনটা ভাবি, ভেতরে ভেতরে মানুষটা হয় একেবারেই ভিন্ন। যদিও সবার ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়। মানুষের ভেতরের সত্তাটা তো আর দেখা সম্ভব নয়। তবে সত্যি কথা বলতে কি যে যাকে যেমন ভাবে রিপ্রেজেন্ট করে আমরা তাকে তেমনই মনে করি আসলে। এই মেয়েটার প্রতি আদ্রিশ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। তার জন্যই তো আদ্রিশের একটা বদ্ধমূল ধারণা ভেঙেছিল।

আদ্রিশের ধারণা ছিল, “সে যে মেহরুনকে ভালোবাসে এটা কোনোভাবে মেহরুন জানতে পারলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে আকাশে উড়তে শুরু করবে, নিজের লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়বে, এমনকি পরবর্তীতে এ নিয়ে নানান রকম সমস্যারও উৎপত্তি ঘটতে পারে। এজন্য সে সবসময় মেহরুন হতে দূরে দূরে থাকত। তবে এতে যে হিতে বিপরীত হবে, মেহরুন কষ্ট পাবে। এটা কখনো ভাবেনি সে।” তার এই ধারণাটাই ভেঙেছিল রিশতা। মেহরুনকে নিয়ে হয়তো সবটা এভাবে আদ্রিশের সামনে উপস্থাপন না করলে আদ্রিশ জানতেই পারত না কখনো। আদ্রিশের ওমন আচরণের কারণে হয়তো মেহরুনকেও হারিয়ে ফেলত হতো চিরতরে। তাই তো আর বেশি ভণিতা না করে বৃষ্টির রাতেই মেহরুনকে চট করে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলে ফেলেছিল সে। যদিও নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল তার। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলেই দিয়েছিল সে। এর পরে আদ্রিশের বুকটা কেমন ধুকপুক করছিল। তবে পরবর্তীতে আর এমন মনে হয়নি, সকল অনুভূতি নিজের মাঝে চেপে রাখতে রাখতে আজকাল বড্ড হাঁপিয়ে উঠছে সে। এসব ভেবে রিশতার দিকে সে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়।

আদ্রিশকে আশ্বস্ত করে হালকা হেসে রিশতা বলে ফেলল

-‘ ভয় নেই, আপনার বউয়ের খেয়াল রাখার জন্য আপনার বোন এই রিশতাই কাফি হে। আপনার বউ আমাদের কাছে আমানত স্বরূপ, তাই ক্ষতির সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। সো চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়েন ভাইয়া। শুভরাত্রি ভাইয়া।

আদ্রিশ নিশ্চিন্ত মনে নিজের অবস্থান থেকে সরে পড়ে। তা দেখে আলতো হাসে রিশতা। মনে মনে আওড়াল,
“আর নয় দূরত্ব, তোমরা এবার একত্রিত হতে চলেছে। খুব বেশি দূরে নয় সেইদিনটা। আমি তোমাদের এক করেই ছাড়ব। দুজনকে একসাথে না দেখা অবধি কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না আমার।”

কথাটা মনে মনে বলতে বলতেই মেহরুনের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রিশতা। মেয়েটার জ্বর এখনো নামেনি। চিন্তা তারও বেশি বইকি কম হচ্ছেনা! ওর পাশেই ঘুমিয়ে আছে অরনী। সারারাত ধরে মেহরুনের মাথায় জ্বরপট্টি দিতে দিতে শেষরাতের দিকে চোখের পাতাটা একটু লেগে এসেছে। রিশতা তখন গিয়েছিল খাবার খেতে। পেটে দানাপানি পড়েনি বলে খিদায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছিল তাই অরনীকে দায়িত্ব দিয়ে সে খেতে যায়। হুট করে মনে কামড় দিয়ে ওঠল তার, “আচ্ছা আদ্রিশ ভাইয়া কি খেয়েছিল? মেহুকে ফেলে তাকে তো শুধু নিজের ঘরেই যেতে দেখেছে, খাবার তো খেতে দেখল না! তবে কি সে খায়নি।” রিশতার চোখটা হঠাৎ ছলছল করে ওঠে। মেহরুনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অস্ফুটস্বরে বলে ফেলল,

“মেহু, কখনো কষ্ট দিস না আমাদের আদ্রিশ ভাইয়াকে। এমনিতেও তার কষ্টের শেষ নাই। আদ্রিশ ভাইয়ার মতো তোকে এতোটা কেউ কখনো ভালোবাসবে না রে বইন!”

মেহরুনের কক্ষের সামনে থেকে এখনো যায়নি আদ্রিশ। মেহরুনকে রেখে নিজের কক্ষে গিয়েও দুদণ্ড শান্তি মিলছে না যেন তার। চোখ বুঁজলেই মেয়েটার অসুস্থ মুখশ্রী ভেসে উঠছে তার দুই নেত্রের মাঝে। আর ঐদিকে বাবার সাথে তার বিশাল কথা কাটাকাটি হয়েছে। সব মিলিয়ে একেবারে বিষিয়ে উঠেছে সবকিছু। মেহরুন ব্যতিত এখন আর কোনো কিছুতেই মন টানেনা তার। মাঝেমধ্যে তো মনে হয় দুনিয়া ছেড়ে পালাতে পারলেই বোধহয় সে বেঁচে যেত! কিন্তু পরক্ষনেই মেহরুনের কথা মনে পড়তেই পুরো দুনিয়াই থমকে যায় যেন তার জন্যে।

-‘ কবে বড় হবি রে তুই? কবে বুঝবি আমায়? তোকে কবে নিজের করে নিব আমি? কবে কবে হবে এসব? সত্যিই আর ধৈর্য্যে কুলাচ্ছে না আমার। আই নিড ইউ ভেরি ব্যাডলি ইয়ার! কবে যে তোকে আমার মিসেস বানিয়ে নিজের ঘরে তুলবে রে মেহুরাণী?

অস্থির চিত্তে কথাগুলো আওড়ালেও খুবই করুণ শোনা যায় কথাগুলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে আদ্রিশ চলে যায় নিজের কক্ষে। অলক্ষ্যে তার নেত্র হতে দুফোঁটা দূর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে ঝরে পড়ে যা সবার নজরে এড়িয়ে যায়!

#চলবে~

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here