,#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩২
রুশা চেনটার দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত গভীর ভাবে ভাবল। সেলিমের কথা শুনে তার আগেই মনে হয়েছিলো সে বিবাহিত নয়। কারণ স্ত্রীর কথা উঠলেই তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যেতো। আর মেয়েটির সাথে কথা বলেই সে বুঝে গেছে আর যাই হোক তাদের মাঝে স্বামী স্ত্রী জাতীয় কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সেটা তো আর সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায়না তাই কথার পৃষ্টে কথা বের করতে হলে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। রুশা নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েই ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে বলল
–গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ের প্রচলন আছে বুঝি? তুমি তো যথেষ্ট সুন্দরী একজন মেয়ে। আর বয়সটাও অল্প। তাহলে তোমার পরিবার কেন এই সিদ্ধান্ত নিলো? তাছাড়াও সেলিম সাহেবের প্রথম স্ত্রীও যথেষ্ট কম বয়সী একজন মেয়ে। সেলিম সাহেব আবারো বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলো কেন?
ঝুমের মুখ ভঙ্গী পরিবর্তন হয়ে গেলো। ফর্সা মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠলো। সেদিকে তাকিয়ে রুশা চাপা হাসল। তার টোটকা কাজে দিয়েছে। ঝুমের মাধ্যমেই পুরো সত্যিটা খুঁজে বের করতে পারবে সে। ঝুমকে থমথমে চেহারায় গভীর ভাবতে দেখে আবারো বলল
–তুমি কেন এই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে?
ঝুম নির্বাক তাকাল। মাথা ভনভন করলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল
–আপনে কি কইতাছেন আমি তো কিছুই বুঝতাছিনা? আপনের ভুল হইতাছে? আপনে কারে দেখছেন আমি জানিনা। তয় হের বউ নাই। হেয় অবিবাহিত।
রুশা এবার সরাসরি প্রশ্ন করে বসল
–তাহলে অনামিকা হাওলাদার কে? একজন মেয়ে ওনাদের বাড়িতে থাকেন। কাল রাতে আমার সাথে ওনার কথাও হয়েছে। সেলিম সাহেব ওনাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন। আর উনিও আমাকে নিজেই বলেছেন উনি সেলিম সাহেবের স্ত্রী।
ঝুম আকাশ পাতাল ভেবেও খুঁজে পেলনা এমন নামের কেউ আছে কিনা। সে আগে কখনো এমন নাম শোনেনি। ভীষণ হতাশা নিয়ে বলল
–এমন নামে কেউ এই গেরামে আছে আগে তো শুনি নাই। এই গেরামের সব্বাইকে আমি চিনি। এই নামের কেউ এইহানে থাকে না।
রুশা এবার মৃদু হেসে বলল
–ওহ! তাহলে তোমার কথাই ঠিক। হয়তো আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। হয়তো কোন অতিথি এসেছে শহর থেকে।
ঝুম অন্যমনস্ক হয়ে বলল
–হইতে পারে।
ঝুম সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতেই রুশা বিশ্ব জয়ের হাসি দিলো। তার কাছে এখন পুরো বিষয়টা পরিষ্কার। শুধু খোলাসা হওয়াটাই বাকি। দ্রুত বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। হন্তদন্ত করে দো তলায় উঠেই দেখল হিমেল টেবিলে বসে আছে। রুশা পাশের চেয়ারে বসে হাপাতে লাগলো। হিমেল ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–কোথা থেকে আসলে? আর এভাবে হাপাচ্ছ কেন?
রুশা নিজেকে স্থির করে নিয়ে বলল
–তুমি কোথায় গেছিলে? আমি তোমাকে খুঁজতে গেছিলাম বাইরে।
হিমেল কিছুটা অবাক হয়ে বলল
–আমাকে খুঁজতে? কই দেখলাম না তো তোমাকে। আমি বাসায় কথা বলছিলাম। তাই একটু বাইরে গিয়েছিলাম।
রুশা নড়েচড়ে বসলো। হিমেলের চেহারায় বিরক্তি দেখা গেলো। সে বুঝতে পারলো রুশা আবারো তার সেই রহস্য নিয়ে কথা বলতে এসেছে। নিশ্চয় আবার কারো উপরে সন্দেহ হয়েছে। সে হিমেলের কিছুটা কাছে এসে ফিসফিস করে বলল
–এই ব্যাটা চেয়ারম্যান বহুত ধুরন্ধর। তোমাকে বলেছিলাম আগেই। আমার ওর কথায় সন্দেহ হয়েছিলো। কাল রাতে মেয়েটাকে দেখেও আমি সব বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু সিওর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।
–আবার কি করেছে চেয়ারম্যান?
হিমেলের কৌতূহলী প্রশ্নর উত্তরে রুশা বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল
–ফুটফুটে কম বয়সী একটা মেয়েকে এঙ্গেজ করে রেখে অন্য একজনকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। মেয়েটার নাম ঝুম। আমি তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে তাদের দুজনকে দেখে ফেলি। তারপর মেয়েটার সাথে কথা হয়। তখনই কৌশলে সবটা জেনে নেই। আসলে ঐ অনামিকা হাওলাদার আর সেলিম হাওলাদার প্রকৃত পক্ষে স্বামী স্ত্রী নন। তাদের মধ্যে কোন সম্পর্কই নেই। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে অনামিকা হাওলাদার নামেই কেউ এক্সিস্ট করেনা।
হিমেল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনছিল রুশার কথা। সে তার ভেতরের মনোভাবটা চোখ মুখে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। সে এই রহস্য উদঘাটন করতে পেরে কতোটা উত্তেজিত সেটা তার কথার ধরন বলে দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে হিমেল তার এই উত্তেজনায় পানি ঢেলে একদম ঠাণ্ডা করে দিলো। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে স্বাভাবিকভাবে বলল
–আচ্ছা? তাহলে আসল নাম কি?
রুশা অনেক বিরক্ত হল। এমন একটা উত্তেজনাপূর্ণ খবর হিমেলের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারলো না। তার মধ্যে কি কোন অনুভূতি নেই? রুশা একটু বিরক্ত হয়ে বলল
–আসল নাম আমি এখনো জানি না।
–তাহলে আর কি জানলে। আসল নামটাই তো এখনো বের করতে পারলে না।
হিমেলের এমন ভাবলেশহীন কথা শুনেই রুশার মেজাজ চটে গেলো। রাগী চেহারায় তাকিয়ে বলল
–বিষয়টা কি তোমার কাছে অস্বাভাবিক মন হচ্ছে না?
হিমেল পাশের চেয়ারটাতে পা তুলে বসলো। আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল
–মনে হওয়ার মতো এটা কোন ঘটনা না। আমাদেরকে যখন স্বামী স্ত্রী হিসেবে গ্রামে পরিচয় দিতে বলেছে তখন ওনার কাছে এইসব পরিচয়ের বিষয় গুলো তুচ্ছ। হয়তো উনি এমন কেউ যার পরিচয় দিতে পারছে না। কোন সমস্যায় পড়েছে হয়তো।
রুশা একটু গভীর ভাবে ভাবল। আসলেই তো তাই। হিমেলের স্বাভাবিক ভাবে নেয়ার কারণটা যথাযথ। তাই রুশাও মেনে নিলো। একটু অন্য মনস্ক হয়ে বলল
–মেয়েটার সাথে কাল রাতে কথা বলে মনে হয়েছিলো সে এখানকার নয়। আর অনেক শিক্ষিত। স্মার্ট বটে।
হিমেল ভ্রু কুচকে বলল
–তোমার সাথে আবার কখন দেখা হল?
–তুমি যখন গান গাচ্ছিলে তখন তোমার গান শুনে ছুটে এসেছিলো। এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। আমি ওকে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষন কথা বলেছি। ওর আচরন খুব অস্বাভাবিক ছিল। কেমন অস্থির লাগছিল মেয়েটা। আমার যতদূর মনে হয়েছে তোমার গান ওর মনে ধরেছে।
হিমেল হেসে ফেললো। বলল
–শেষ পর্যন্ত গ্রামের চেয়ারম্যানের ছদ্মবেশী স্ত্রী আমার গান শুনে আবার প্রেমে পড়ে যায়নি তো?
রুশাও হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল
–সে চান্স নেই। কারণ আমি বলেছি তুমি আমার হাসবেন্ড।
হিমেল সরু চোখে তাকাল। রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–এমনটা বলার কি দরকার ছিল? সত্যিটা তো সেলিম সাহেব জানে। আর উনি নিজেই তো মেইলটা পাঠিয়েছে। তুমি সত্যিটা বলতে পারতে।
রুশা আবার দাঁত কেলিয়ে তাকাল। বলল
–কি ব্যাপার এতো উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ কেন? নিজেকে বিবাহিত বলে পরিচয় দিতে অসস্তি হচ্ছে নাকি ঐ মেয়ের মন ভাঙ্গায় কষ্ট পাচ্ছ। কোনটা?
রুশার কৌতুকপূর্ণ কথা শুনে হিমেল নিজেও কৌতুক করে বলল
–এসবের কোনটাই না। তোমায় বউ বলে মেনে নিতে পারছি না। তোমার মতো মেয়ের জামাই বলে নিজেকে পরিচয় দেয়ার চেয়ে সারাজীবন সিঙ্গেল থাকাই শ্রেয়।
রুশা রেগে গেলো হিমেলের উপরে। হিমেল বুঝতে পেরেই হেসে ফেললো। রুশা প্রচণ্ড রাগ নিয়ে উঠে গেলো ঘরে।
———–
গভীর রাত। প্রতিদিনের মতো আজও হিমেলের ঘুম আসছে না। রুশা আজ আগেই ঘরে চলে গেছে। চলে গেছে বললে ভুল হবে হিমেল পাঠিয়ে দিয়েছে। তার মনটা ভালো নেই। তাই রুশার জটিল কথা বার্তা তার মাথায় ঢুকছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো হিমেল। রুশার জেদের কাছে হার মেনে চলে তো এসেছে কিন্তু কিছুতেই মন বসছে না এখানে। নিজেকে এই পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। সব সময় মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই। জীবনে শুন্যতার ছড়াছড়ি। বিশাল হাহাকার আর বিষণ্ণতায় বেহাল দশা। ক্ষণে ক্ষণে অসহ্য হয়ে উঠছে। শত শত দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলে মিশে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর কিছুতেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না এতো কিছু। হিমেল তীব্র যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে উঠতেই আকাশের বুক চিরে আলোক রেখা জ্বলে উঠে ভীষণ জোরে বজ্রপাত হল। শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে চাঁদ তারা সব কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। অন্ধকারের মাঝেই অন্ধকার গ্রাস করে ফেললো। হিমেল কয়েক মুহূর্ত সেদিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখটা বন্ধ করে চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ থাকলেও মস্তিস্ক অতীতে নিয়ে গেছে তাকে। দৃশ্য গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বারবার এক পরিচিত মুখশ্রী হেসে উঠছে খিলখিল করে। মাথাটা যন্ত্রণা করে উঠতেই হিমেল হাত পা ছড়িয়ে দিলো। টিনের চালে বৃষ্টি পরার ঝুমঝুম আওয়াজ আসছে কানে। তপ্ত একটা শ্বাস ছেড়ে সমস্ত চিন্তা মিলিয়ে দিয়ে বৃষ্টির শব্দে কান পাতল। ঝুমঝুম শব্দটা এক অদ্ভুত তরঙ্গের সৃষ্টি করছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে হালকা ঘুম ভর করলো। ঘুমিয়েও পড়লো বোধহয়। কতক্ষন কেটে গেছে জানা নেই। এক সময় খেয়াল করলো নরম তুলতুলে একটা হাত সারা মুখে স্পর্শ করছে। নাকে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। সুপ্ত অনুভূতি গুলো হুট করে জেগে উঠলো। এক সময় হাতের স্পর্শ বিলিন হতেই চোখ খুলে ফেললো। চোখের সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে পাশ ফিরে তাকাল। শাড়ী পরা এক রমণী হেটে চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে অন্ধকারে খুব একটা স্পষ্ট না দেখা গেলেও আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে। হিমেল সেদিকে তাকিয়েই গম্ভীর আওয়াজে বলল
–অধিকার ছাড়া কাউকে এভাবে স্পর্শ করা অন্যায়। চরম অন্যায়। এই অপরাধের জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। আর শাস্তি না নিয়ে আপনি এখান থেকে কোথাও যেতে পারবেন না মিস কুমুদিনী চৌধুরী।
চলবে…