উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৬১: অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ||

0
510

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬১: অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ||

১২৮।
হাতে টান অনুভব করলো আহি। হাত ছাড়ানোর জন্য সে ভ্রূ কুঁচকে পিছন ফিরলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আফিফের দিকে। কিন্তু অন্ধকারে আফিফ আহিকে দেখতে পাচ্ছে না। আফিফ কাতর স্বরে বলল,
“আমার কথা শুনবে না?”

আহি পাল্টা জিজ্ঞেস করলো
“আমার কথা শুনতে চেয়েছিলে কখনো?”

“শোধ তুলছো?”

আহি হাসলো। তার হাসির শব্দ আফিফকে ভীষণ মুগ্ধ করলো। এবার তার সাহস বাড়লো কয়েক গুণ। আহিকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আহি আফিফের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তোমার সময়-সু…”

আফিফ আহিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। পাশের দেয়ালে আহির পিঠ ঠেকিয়ে তার অধরে অধর ছোঁয়ালো। আহি চোখ বন্ধ করলো। সে আফিফের কাঁধে হাত রাখলো। তার গলায় লাগিয়ে দিলো তার হাতে লেগে থাকা রঙ। আফিফ আহিকে ছেড়ে দিলো। আহির কপালে কপাল ঠেকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এখনো অনেক সময় আছে, আহি। আমি আমার পুরো জীবনটাই তোমার নামে লিখে দেবো।”

আহি মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা?”

“হুম।”

“আফিফ, তোমার মনে আছে সেই বর্ষার রাত!”

আহির গলা ভারী হয়ে এলো। আহি বলতে লাগলো,
“সেদিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি ভিজে যাচ্ছিলাম। তোমাকে কতোবার ডাকলাম। কিন্তু তুমি এলে না। সেদিন বলেছিলে, তুমি পদ্মকে ভালোবাসো। আর এখন এতো সহজে আমার নামে তোমার জীবন লিখে দিচ্ছো?”

আফিফ আহিকে ছেড়ে দিলো। আহি সাথে সাথেই আফিফের হাত ধরে বলল,
“বলো, আফিফ। তুমি কি তখন আমাকে ভালোবাসতে না?”

আফিফ নিশ্চুপ। হঠাৎ আহি অনুভব করলো, গরম পানির মতো কিছু একটা তার হাতে এসে পড়েছে। আহি অন্য হাত দিয়ে সেটা স্পর্শ করে বুঝলো আফিফ কাঁদছে। সে আফিফের গাল ছুঁয়ে দিলো। আফিফ মুখ ঘুরিয়ে নিতেই আহি বলল,
“কাঁদছো কেন?”

আফিফ ভেজা কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, তোমাকে ওভাবে ভালোবাসতে পারি নি, যেভাবে তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। আমি হয়তো তোমার যোগ্য নই। কিন্তু আমি যেই পরিস্থিতিতে ছিলাম, তোমার ভালোর জন্য এটাই আমার কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল। তোমার চিরকুটগুলো বাসায় এসে কতোশত বার পড়তাম। তুমি জানো না, আমার অবুঝ মনে তোমার ওমন করে ভালোবাসা প্রকাশ করাটা কতোটা প্রভাব ফেলেছিল। আমি তখন রাত-দিন তোমাকে কল্পনা করতাম। একদিনও চারুশিল্পে যাওয়া বাদ দেই নি। প্রতিদিন তোমার চিরকুট পড়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে খাতা খুলেছি। তুমি আমার জন্য অদেখা প্রেয়সী ছিলে। যাকে আমি দেখি নি, শুধু অনুভব করেছি। তোমাকে না দেখে যতোটা ভালোবেসেছি, ততোটা আমি দেখেও পদ্মকে ভালোবাসি নি। তবে এটা ঠিক, আমি পদ্মকে ভালোবাসতাম। অস্বীকার করবো না এই কথা। তবে বিয়ের আগে কখনোই না। তাজওয়ার খান আমাকে থ্রেট দেওয়ার পর আমি বুঝেছি, তোমাকে পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই। আমি আমার আপাকে বাঁচাতে পারি নি। তোমাকে কীভাবে বাঁচাবো? বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে কোথায় রাখবো? তাজওয়ার আমাকে বাধ্য করেছিল তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে। আমার সামর্থ ছিল না, তবুও আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মা রাজি ছিলো না। সবার মনে হয়েছিল পদ্মকে ভালোবাসি তাই তাড়াহুড়ো করছি। সত্য এটা ছিল না। সত্য ছিল, আমাকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তাই কোনোভাবে মাকে রাজি করিয়েছি। পদ্মের বাবা ওর জন্য ছেলে খুঁজছিলেন। আমার ওকে দেখে মনে হয়েছিল ভালো মেয়ে। আর ওর হাবভাব দেখে বুঝতে পেরেছি, আমাকে পছন্দ করে। আমি তো ছেড়ে দেওয়ার জন্য সংসার করি নি। তাই পদ্মকে বিয়ে করেছি। এরপর ওর সাথে কথা বলতে বলতে ওর প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল। স্বামী হিসেবে স্ত্রীকে ভালোবাসা আমার দায়িত্ব। আর পদ্ম এতোটা ইনোসেন্ট ছিল, আমাকে কখনো অভিযোগ করার সুযোগ দেয় নি। আমি তো জানতাম না, মেয়েটাই আমাকে সবচেয়ে বড় ধোঁকা দিয়েছিল।”

“আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমাকে কি তখন ভালোবাসতে না?”

“প্রেয়সী সবসময় প্রেয়সীই থাকে। আর দায়িত্ব থেকে মায়ার সৃষ্টি হয়। প্রেয়সীকে সবসময় মনে পড়ে। কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। যারা স্পর্শ করতে চায়, তারা কলুষিত হয়। সাথে কলুষিত হয় প্রেয়সীও। আমি আমার প্রেয়সীকে কলুষিত করতে চাই নি। আহি, সংসার খুবই শক্ত একটা সম্পর্ক। এটা সহজে ভেঙে যায় না। তোমার জন্য পদ্মকে ছেড়ে দিলে, পদ্মের কোনো ক্ষতি হতো না। তোমার আর আমার ক্ষতি হতো। আমাদের ভালোবাসা কেউই বুঝতো না। সবাই দেখতো আমরা প্রতারণা করেছি। আমি আমার সম্পর্কে সৎ ছিলাম। কারণ আমারও বোন আছে। আর আমার মা এমন অসৎ ছেলে জন্ম দিয়ে মানুষের কথা শুনুক, এটা আমি চাই নি। তোমাকে পাওয়াটা একদম দুঃসাধ্য ছিল। এর বড় কারণ তোমার আর আমার স্ট্যাটাস ভিন্ন। আমি তোমার যোগ্য নই। আমি তোমাকে নিয়ে একটু ভাবতে গেলেই আমার ভাবনায় আসে তোমাকে ভালোবাসলে সবাই প্রশ্নবিদ্ধ করবে আমার ভালোবাসায়। সমাজ তো আমার অনুভূতি পড়ে দেখে নি। তোমাকে নিয়ে আমি যা অনুভব করতাম, এটা খুবই স্পেশাল ছিল। আমি আমার ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষকে সমাজের কাছে ছোট করতে চাই নি। তাই ভাগ্য মেনে নিয়েছিলাম। পদ্মকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। ভালোবাসা আর মায়ার মধ্যে কী পার্থক্য তা আমি জানি না। কিন্তু মায়া সৃষ্টি হয়েছিল, এটাই জানি। আমার জায়গায় তুমি থাকলে এমনটাই করতে। রাদের সাথে যদি কখনো তোমার বিয়ে হয়ে যেতো! তুমি কি ওকে কখনো ছাড়তে পারতে? পারতে না। আমি তোমার সামনে এলে তোমার খুব কষ্ট হতো। কিন্তু তবুও তুমি রাদকে ছাড়তে পার‍তে না। বলো, তুমি কি রাদকে ভালোবাসো? না-কি রাদের প্রতি তোমার মায়া ছিল?”

“ও আমার বন্ধু।”

“বন্ধু সবাই হতে পারে। লাবীবও তোমার বন্ধু। তাহলে রাদ স্পেশাল কেন?”

“রাদ আমার মেডিসিন। আমার জন্য অনেক করেছে। ওর প্রতি আমার আলাদা মায়া জন্মে গিয়েছিল।”

“হুম, পদ্মও আমার জন্য এমনই ছিল। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হলেও সে প্রথমে আমার বন্ধু হয়েছিল। ওর প্রতি আলাদা মায়া জন্মেছিল। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, আমার আপার মৃত্যু। একটা মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে আত্নহত্যা কতোটা মানসিক চাপ, তুমি হয়তো বুঝবে না। আত্মীয়-স্বজন কারো সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না আমাদের৷ আপার আত্মহত্যার কারণ তো তুমি জানোই। বাবা মারা যাওয়ায় দাদার পরিবারের সবাই আমার মাকে দোষারোপ করছিল। আমাদের সবার চরিত্র, আমাদের সবার শিক্ষায় প্রশ্ন উঠছিল। তুমি জানো না, আমরা কতো বছর ধরে এসব সাফার করেছি। পদ্ম ওই সময়টাতে আমার মানসিক শক্তি ছিল। এজন্যই হয়তো আমি ওর মায়ায় পড়েছিলাম। আমি এই মুহূর্তে চাই না, তোমাকে পদ্ম আর আমার সংসারে কি কি হয়েছিল তা বলতে। কারণ সবটাই এখন মিথ্যে। যেখানে মানুষটাই শুরু থেকে আমাকে মিথ্যে বলে গেছে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আফিফ বলল,
“আমি তোমাকে আর জোর করবো না। তোমার যদি মনে হয়….”

আহি আফিফের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল,
“তোমাকে আমি কখনো কোনো সময় দিয়ে বিচার করি নি। কোনো যোগ্যতা দিয়ে বিচার করি নি।”

“তাহলে বলছো না কেন কিছু?”

“কি বলবো?”

“ভালোবাসি, আহি।”

আহি নিরবে হাসলো। আফিফ আহির আরেকটু কাছে এসে বলল,
“তুমি শোধ তুলছো, তাই না!”

“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে শতবার এই একটা কথা বললেও আমার চৌদ্দ বছরের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে না।”

হঠাৎ আলোকিত হয়ে গেলো এ আর টি গ্যালারি। আহি সাথে সাথেই ধাক্কা দিলো আফিফকে। এরপর দৌঁড়ে চলে গেলো পাশের রুমে। আফিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে পেছনে তাকালো। চোখ পড়লো কাচের দেয়ালে। বিদ্যুৎ আসায় এখন বাইরে থেকে সব দেখা যাবে। আফিফ আনমনে হাসলো। ধীর পায়ে হেঁটে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি আমার সাথে আর কথা বলবে না?”

আহি ভেতর থেকে বলল,
“বাসায় যাও। কাল সেই হোটেলে চলে এসো।”

“আহি, তুমি সত্যিই উজ্জ্বলকে বিয়ে করছো?”

“আমি তো অনেক বেহায়া হয়েছি। তুমি এই বিয়ে ভাঙার জন্য কতোটা বেহায়া হও, এটাই দেখবো এখন।”

“তুমি আমার হবে তো, আহি?”

“এর নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”

কথাটি বলেই আহি মুখ চেপে হাসলো। আফিফ মলিন হেসে বলল,
“আমি তোমাকে রাজী করানোর সব চেষ্টা করবো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো। ভাগ্যে থাকলে, তুমি আমারই হবে।”

(***)

ঘড়িতে রাত বারোটা। আহি বাসায় ঢুকতেই দেখলো সালমা ফাওজিয়ার মুখোমুখি সোফায় বসে আছে পদ্ম। অন্য সোফায় লিনাশা আর নায়ীব। আহি পদ্মকে দেখে বেশ অবাক হলো। আর আহিকে দেখে আরো বেশি অবাক হলো পদ্ম। আহির সারা গায়ে রঙ মাখানো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের এই অবস্থা দেখে বললেন,
“আহি, তোমার গায়ে রঙ লেগেছে কীভাবে?”

আহি লাজুক হাসলো। বলল,
“মা তেমন কিছু না। তুমি এখনো ঘুমাও নি?”

“তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আচ্ছা, আমি উপরে যাচ্ছি। তোমার নানুকে দেখে আসছি। পদ্ম এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে।”

সালমা ফাওজিয়া চলে যেতেই লিনাশা হেসে বলল,
“বাহ, তেমন কিছু না?”

পদ্ম অবাক হয়ে লিনাশার দিকে তাকালো। আহি তার গালে হাত রেখে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা বাক্যেই কতো রহস্য লুকোনো থাকে!”

নায়ীব উঠে দাঁড়িয়ে লিনাশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আচ্ছা, আমি ইয়াশের কাছে যাই। তুমি আসো।”

নায়ীব চলে যেতেই লিনাশা বলল,
“বাহ! মিস্টার এআর তো দেখছি, আমাদের ভাবনার চেয়েও বেশি এগিয়ে গেছেন!”

পদ্ম চমকে উঠলো লিনাশার কথায়। সে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এআর! আহি, তুই আফিফের সাথে ছিলি? তোর গায়ে আফিফ রং লাগিয়েছেন? উনি তোকে স্পর্শ করেছেন?”

লিনাশা পদ্মের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ওলে আমার পদ্মফুল, তোমার কেন এতো কষ্ট হচ্ছে, বলো তো দেখি! এদিকে তোমার স্বামী রাত জেগে মশার কামড় খেয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে, তুমি কোথায় তার মশারি হয়ে তাকে পাহারা দেবে, আর তুমি পড়ে আছো, আমার বেস্টির প্রেমিকের দিকে। ক’জন লাগে বলো তো দেখি?”

“চুপ কর, লিনু।”

লিনাশা রাগী স্বরে বলল,
“ডোন্ট কল মি লিনু। তোমার সেই অধিকার নেই।”

আহি লিনাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“বাদ দে, লিনু। আমি আমার মুড স্পয়েল করতে চাই না। আজকের রাতটা আমার জন্য খুব স্পেশাল ছিল। আমি তথাকথিত মানুষের জন্য আমার মনটা ভারী করতে চাই না। আচ্ছা, আমাকে ফ্রেশ হতে হবে। কাল সকালে অনেক কাজ আমার। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

আহি এবার জোরে কথাকে ডাকলো। কথা আসতেই আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কথা, আমার খাবার গরম করে আমার রুমে পাঠিয়ে দিও। আর… আশেপাশে কীট পতঙ্গ দেখলে একটু তুলে বাইরে ফেলে দিও। আমার হোয়াইট প্যালেসে কীটপতঙ্গ শোভা পায় না।”

কথাটি বলেই আহি লিনাশাকে হাত নাড়িয়ে বলল,
“গুড নাইট।”

এরপর লিনাশা মুচকি হেসে চলে গেলো, আহিও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। আর পদ্ম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে অশ্রু ভীড় করছে। আহি আর আফিফ কি তাহলে একে অপরের কাছে এসেছে? সহ্য হচ্ছে না পদ্মের। সে মনে মনে বলল,
“আফিফ, তুমি এতো সহজে আহিকে পেয়ে যাবে? আর আমি তোমাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবো?”

১২৯।

বেল বেজে উঠতেই রেনু এসে দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশে রঙে মাখামাখি আফিফকে আপাদমস্তক দেখে রেনু মুচকি হাসলো। রেনুকে হাসতে দেখে বেশ লজ্জা পেলো আফিফ। সে কপাল চুলকে ভেতরে ঢুকতেই ওয়াসিফ তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। আফিফ ওয়াসিফকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যাবে, তখনই ওয়াসিফ বলে উঠলো,
“তোমার গায়ে কে রং লাগিয়েছে, মামা?”

অবুঝ মনের প্রশ্ন, অথচ শুনতে বেশ উদ্ভট লাগলো। রেনু ছেলের প্রশ্নে শব্দ করে হেসে উঠলো। আফিফ তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে গেলো। ওয়াসিফ ভাবুক কন্ঠে বললো,
“মামা দৌঁড়ে পালালো কেন?”

রেনু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার মামার মনে রং লেগেছে, তাই রং দিয়ে গোসল করে এসেছে।”

“সত্যি? মনে আবার রং লাগে কীভাবে? রং খেয়ে ফেললে কি রং লেগে যায়?”

রেনু হাসলো। ওয়াসিফ বলল,
“এবার বুঝেছি, মামা ফুড কালার খেয়েছে। আচ্ছা, মা। এখন যদি মামার পেট ব্যথা করে?”

“আদ্য, যাও ঘুমিয়ে পড়ো। রং নিয়ে গবেষণা করতে হবে না।”

“মামার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আমার।”

“ওরে বাবা, আমার ভাইয়ের কতো চিন্তাশীল ভাগ্নে!”

এদিকে আফিফ রুমে ঢুকতেই তার দৃষ্টি পড়লো আয়নায়। মুহূর্তেই মনে পড়লো আহির স্নিগ্ধ মুখখানি। আজ এতো বছর পর সে তার খেয়ালীকে বাস্তবে অনুভব করেছে। যেই অনুভূতি এতো বছর শুধু কল্পনা ছিল, তার বাস্তব রূপ আজ দেখেছে আফিফ। আফিফ আনমনে হেসে বলল,
“আমার খেয়ালী, তোমার অভিমান ভাঙাবো আমি।”

ফোন বেজে উঠতেই আফিফের ভাবনায় বাঁধা পড়লো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“কল কেটে দিবেন না, আফিফ। শেষ একটা কথা জানানোর ছিল।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পদ্ম বলল, “আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”

আফিফ নিরবে হাসলো। পদ্ম বলল, “আপনি কি খুশি হয়েছেন?”

“হুম, শুনে ভালো লাগলো।”

“একটুও কষ্ট হচ্ছে না আপনার?”

“একদম না।”

“এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলেন?”

“আর কিছু বলার আছে?”

“আহিকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছেন, তাই না?”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি কি ভুলে গেছো, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে?”

“আপনি দিয়েছেন। আমি তো নিতে চাই নি।”

“হ্যাঁ, তুমি বাধ্য করেছিলে।”

“ভুল করেছিলাম। ক্ষমা করা যায় না?”

“পাগল হয়ে গেছো তুমি?”

“ভালোবাসি আপনাকে।”

“আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”

“কেন, আফিফ?”

“তুমি কি করেছিলে মনে নেই?”

“আমি রেনু আর আহির সাথে অন্যায় করেছি। কিন্তু আপনি আহিকে কেন ভালোবাসছেন? ও কি আপনার বড় আপার সাথে অন্যায় করে নি?”

আফিফ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি ইচ্ছে করে করেছো। আর ওসব তাজওয়ার করেছে। আহি এসব জানতোই না। কার সাথে কার তুলনা করছো তুমি?”

“আচ্ছা, এসব বাদ দিন। আগে বলুন, আজ কি আপনি আহির সাথে ছিলেন? আপনি কি ওকে স্পর্শ করেছেন?”

“তুমি আমাকে বরাবরই অবাক করে দাও, পদ্ম। শুনো, নিজের সংসারে মন দাও। আমার বিষয়ে নাক গলাবে না। আমার যা ইচ্ছে আমি করবো। তুমি কেউ নও আমাকে প্রশ্ন করার!”

আফিফ কল কেটে, সাথে সাথেই সিমটা খুলে ফেললো। এই সিমটা আহির জন্যই খোলা রেখেছিল সে। এখন যেহেতু আহিকে কল দেওয়ার অধিকার অর্জন করতে চাইছে, তাহলে অন্য নম্বর থেকেও সে আহিকে কল দিতে পারবে। অন্যদিকে পদ্ম ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। আফিফকে সে হারাতে চায় নি। আফিফকে ভীষণ ভালোবাসে সে। কীভাবে থাকবে আফিফকে ছাড়া? পাগল হয়ে যাবে পদ্ম। নিজের মাথার চুল আঁকড়ে ধরলো সে। শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আর মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন, আফিফ। আমার আপনাকে ছাড়া চলবে না।”

(***)

ধূসর বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে আহি। চুলে খোঁপা করে লাগিয়েছে কয়েকটা তাজা সাদা পাসকালি। কানে ঝুলছে ধূসর বেগুনি রঙের ঝুমকো। গলার একপাশে লাল হয়ে আছে। আহি হাত রাখলো সেই স্থানে। চোখ বন্ধ করলো সে। শরীর জুড়ে বয়ে গেলো শিরশিরে বাতাস। আহি মুচকি হেসে চোখ খুললো। এরপর চোখে মোটা করে আইলাইনার লাগালো। এরপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দুলিয়ে হাসলো। মনে মনে বলল,
“আজ আবার সেই দিনটি ফিরে এসেছে। সেই বর্ষার মাস, সেই দিন, সেই মুহূর্ত। আমি বর্ষা এলেই এই একটা তারিখ সহ্য করতে পারি না। তোমার আর পদ্মের বিয়ের তারিখ। যেদিন তুমি আমার সামনে এসে পদ্মের হাত ধরে বলেছিলে, পদ্মফুল। আমি সেই দিনটা তোমার আর আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিতে চাই, আফিফ। আজ রাতে বৃষ্টি হোক না হোক, তুমি আসবে আমার কাছে। পদ্মফুলের জায়গায় আমাকে ডাকবে। আমার নাম ধরে ডাকবে। আমাকে ভালোবাসবে। আর যদি আজ বৃষ্টি হয়, তাহলে আমার হাত ধরে আমাকে আগলে নিতে আসবে। আমাকে আর একা ভিজতে দেবে না। আমি আর কখনো নিজেকে নিঃস্ব ভাববো না। আমার ডাকে এবার তুমি সাড়া দিবেই।”

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আহি দরজা খুলে দিলো। দেখলো লিনাশা দাঁড়িয়ে আছে। আহিকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
“আমার বেস্টির সুখে কারো নজর না লাগুক।”

“আফিফ কি শেষ চেষ্টা করবে না?”

“যদি করে, তাহলে তো হলোই। আর যদি না করে, তাহলে বুঝবি, তোর মতো করে ভালোবাসার যোগ্যতা ওর নেই। এতো কিছু করেছিস তুই, ও কি তোর আর উজ্জ্বলের বিয়ে হতে দেবে? যদিও মিথ্যেমিথ্যি বিয়ে।”

“আমি আজ ওকে ফিরিয়ে দেবো না। আমি আমার ভালোবাসাকে আর হারিয়ে যেতে দেবো না। আমি এই জীবনে সব পেয়েছি। মাকে পেয়েছি, তোকে পেয়েছি, ভালো বন্ধু পেয়েছি, ক্ষমতা পেয়েছি। হেরে গিয়েছিলাম ভালোবাসার কাছে। এবার যদি সেই ভালোবাসার প্রাপ্তি হয়, তাহলে তো আমি আমার জীবনে জয়ী হবো।”

“হুম, হোয়াইট প্যালেসের রানী তার রাজাকে জয় করার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছে। এবার তার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে।”

আহি হাসলো। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। কি হবে আজ? আফিফ কি তার জন্য একটু বেহায়া হবে না? আফিফ কি প্রমাণ করবে না, সেও আহিকে ভীষণ ভালোবাসে!

চলবে—

(আগামীকাল রাতে শেষ পর্ব দেওয়া হবে। পর্বটা বেশ বড়, তাই দুই ভাগে দেওয়া হলো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here