#রাঙিয়ে_দাও
#পর্ব(০৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
—আফা আপনে কারে বদদোয়া দিলেন?
ফুলবানুর গলার স্বরে পাশে তাকালো প্রান্তি।গোয়েন্দা নজরে তারদিকে তাকিয়ে আছে আছে সে।সেটা দেখে প্রান্তি ভাব দেখিয়ে বললো–তোমাকে বলবো ক্যান?
—আমি জানি আপনি কারে কইছেন।
তা-কি আর প্রান্তি বুঝতে পারছে-না।খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে যে তার বলা কথাগুলো ভাইজানের সৎ নিষ্ঠাবান দূত শুনে ফেলেছে তবুও ফুলবানুকে ভেঙ্গিয়ে তার মতো করে কথা বলে প্রান্তি বললো–কারে কইছি?
—ভাইজানরে।
—তাহলে আবার জিগাও ক্যান?সত্যি করে কও-তো আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য তোমার ভাইজান মাসে আলাদাকরে তোমারে কতো টাকা করে মাইনে দেয়।
—আপনি আমারে ভেঙ্গিয়ে কথা কইতাছেন আফা?আর ভাইজান আমারে আলাদা কোনো মাইনে দেয়না।ভাইজান খুব ভালো মানুষ তাই আমি ভাইজানের হইয়া কথা কই।আপনে-ও একদিন বুঝবেন।
সে-কি আর প্রান্তি জানে-না।তবে ভাইজান ভালো এটা তো তাকে মানলে চলবে-না।আর ভাইজানের এই সৎ- নিষ্ঠাবান দূতের তার রাজার হয়ে কৃতজ্ঞতার আচারন এবং গুনাগুন সত্যায়িত বলে মেনে নিলেও তাকে চলবে না।বরং তার সামনে তার ভাইজানের নামে উল্টোপাল্টা কথা বলে তাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে।তবেই না প্রান্তির প্রশান্তি।তাই প্রান্তি পূর্বের ন্যায় আবার-ও ফুলবানুকে ভেঙ্গিয়ে বললো।
—হ তোমার ভাইজানতো দূধে ধোঁয়া।আর আমরা সব কাঁদামাটি।ভাইজান এক্কেবারে ভালা মানুষ।
—আপনি আমারে আবারও ভেঙ্গিয়ে কথা কইতাছেন।
আপনি ভাইজানরে বদদোয়া দিছেন কি,আমি আপনের বদদোয়া দিতাছি।আপনি তো ভাইজানের পছন্দ করেন না তাই আপনার ঠিক ভাইজানের মতো এখখান বর হইবো।মিলাইয়া নিয়েন এই ফুলবানুর কথা।
ফুলবানু কথাটা বলে আর দেরি করলোনা।হাতে থাকা খাবারের ট্রেটা নিয়ে কেটে পড়লো।সে রান্নাঘর থেকে বের হতেই প্রান্তির মুখের কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো।তার ভাইজান ভালো মানুষ আর ভালো মানুষরে বদদোয়া দিচ্ছে।এখানে কথা কাটা-কাটি না করলে কি চলে?তার চলেনা তাই সে কথা কাটাকাটি তো করলো সঙ্গে বদদোয়াও দিয়ে দিলো।এখন যদি সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে তবে তারসহ তার ভাইজানের চৌদ্দগুষ্টি সব উদ্ধার হয়ে যাবে।তাই দাঁড়িয়ে না থেকেই কেটে পড়াই শ্রেয় মনে করলো সে।ফুলবানুর যাওয়ার পথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো প্রান্তি।
ফুলবানুকে বকবে কি ফুল বানু তাকে ঠিক কি বদদোয়া দিয়ে গেলো সেটাই ভাবতে আর বুঝতে ব্যস্ত।ফুলবানুর ন্যায় আগের দিন বুবুমনিও ঠিক এরকম একটা কথা বলেছিল তাকে।এই প্রিয় মানুষগুলো তাদের কথারদ্বারা মূলত চাইছে টা কি? ইচ্ছুকূৃত তাকে বাঘের আহার বানাতে।কিন্তু কেনো?মনেমনে কথাগুলো ভেবে অযথা মনখারাপ হলো প্রান্তির।ফের বিড়বিড়িয়ে অভিমানীস্বর বললো—কেউ ভালো না।কেউ আমাকে ভালোবাসে না।
.
—বউমা এলো না যে কবির?
—হ্যাঁ আম্মা।আসলে আপনি যেদিন খুব অসুস্থ হলেন সেদিন আমার সাথে গিয়েছিলো হসপিটালে আপনাকে দেখতে।তারপর বাড়িতে ফিরার পথে ফোন এলো,ওর আম্মাও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।তাই সেখান থেকেই ওকে নিয়ে ওবাড়িতে গিয়েছিলাম।ও এখনো ও-বাড়ি থেকে ফেরেনি।তাই আসতে পারিনি,আমি একাই এসেছি আম্মা।
—ওহহ!কেমন আছেন উনি এখন?
—এইতো আজ সকালেই শুনলাম আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি ভালোই আছেন।
দুজনে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন।ফের ফুল বানুকে নাস্তার ট্রে নিয়ে ঢুকতে দেখে কথা ভঙ্গ হলো দু জনের।দু’জনের নাস্তা দিয়ে ফুলবানুও কেটে পড়লো।নাস্তা খাওয়ার একপর্যায়ে রাবেয়া খাতুন বললেন।
—আমি প্রান্তির বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কবির।
ভদ্রলোক চায়ের কাপথেকে নজর সরিয়ে শাশুড়ির মুখ পানে চাইলেন।ফের সহজ গলায় বললেন—সেটা আমাকে কেনো বলছেন আম্মা?আপনারা ওর বিষয়ে যখন তখন যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।সেই হক আপনাদের আছে।ওর জীবনে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার হক আমার থেকে আপনাদের আর-ও বেশি।
সেখানে আমাকে জিজ্ঞেসা করা বা অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই তো।সেই হক তো আপনাদের মেয়ে-সহ আমি কবেই আপনাদের উপর সঁপে দিয়েছি।
—তবুও তুমি ওর বাবা।ওর থেকে দূরে থাকলে-ও ওর দায়িত্বে তো কখনো অবহেলা করোনি।সেখানে ওর জীবনের ভালো মন্দের যেমনটা তুমি স-বসময় খোঁজ রেখেছো।আর রাখো-ও সবসময়।তেমনটা আমাদের নেওয়ার ওর জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্তের উপর ভালোমন্দ কথা বলার হক সম্পূর্ণ তোমার আছে।আর জানারও পূর্ণ অধিকার আছে।আর আমি যে সিদ্ধান্তের কথা তোমাকে জানাতে চাইছি।বাবা হয়ে সেটা জানার অধিকার এবং অগ্রাধিকার তোমারই বেশি।
ব্যবহার আর বিবেচবোধে এমনকি সকল আচার নিষ্ঠায় বরাবরই শাশুড়ীমার আচারন কৃতজ্ঞপূর্ন।শুধু শাশুড়ীমা নয় এবাড়ির সবার আচার ব্যবহার মুগ্ধ হওয়ার মতোন। যেটা উনার সৌভাগ্যে বেশিদিন জুটলোনা।পারুল মারা যাওয়ার পরে সম্পর্ক নষ্ট না-হলেও সেই আগের ন্যায় আসা যাওয়াটা নেই।বিধায় সম্পর্কের মুগ্ধতা নেই।তবে এবাড়ির মানুষ তিনি আসলে আপ্যায়ন বা আতিথেয়তা করতে কখনো ত্রুটি করেন না।কেবল নিজেরই বিষয়টা কেমন লাগে।হয়তো নিজের জীবনে পারুলের জায়গায় অন্য কাউকে ঠাঁই দিয়েছেন বিধায় বারবার এই বাড়ির সবার সম্মুখীন হতে এই জড়তা।
—কিছু বলছো না যে কবির?
—বলুন আম্মা।
রাবেয়া খাতুনও হয়তো জামাইয়ের হঠাৎ অন্যমনষ্কতা হওয়ার কারন বুঝলেন।সেদিকে আর কথা না বাড়িয়ে তিনি সরাসরি প্রান্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রসঙ্গ তুললেন।বেশ গম্ভীর্য হয়ে বললেন।
—আমি প্রান্তির বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি কবির।
মেয়ের বিয়ের বয়স নাহলেও শাশুড়ী মায়ের মুখে এমন প্রস্তাব শুনে অস্বাভাবিক হলেন না কবির সাহেব।বরং বেশ স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
—পাত্রটা কে আম্মা?প্রহান।
—হুম।সিদ্ধান্তটা আমি নিয়েছি।এখনো এই বিষয়ে কেউ কিছু জানেনা।সবার প্রথম আমি তোমাকে জানালাম।আর তুমিতো জানো মৃত্যুর আগে পারুল নিজের মেয়ের
নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে বড় বউমার কোল বেছে দিয়ে গিয়েছিল।আর বড় বউমার কাছে চেয়ে গিয়েছিল জেনো পারলে সারাজীবন বড় বউমার নিরাপদ ছায়ায় মেয়েটাকে গুচ্ছিত রাখে।আর তুমি-তো প্রান্তি সম্পর্কে জানো।মেয়েটা কিছুটা একগুঁয়ে স্বভাবের।আর বড় বউমার আদর পেয়ে পেয়ে মেয়েটা আরও জেদি আর একগুঁয়ে স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
রাবেয়া খাতুন একটু থামলেন।ধীরে কথা বলছেন তবুও শ্বাস লেগে যাচ্ছে উনার।যদিও ডাক্তারে আপতত কথা কম বলতে বলেছেন।তবুও তিনি বলছেন।বিষয়টা উনি সমাধান না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না জেনো।বিধায় কথা উনাকে বলতে হচ্ছে।একটু থেকে তিনি আবার-ও বলতে শুরু করলেন।
—আর আমার অবস্থাটা-তো দেখছো।বৃদ্ধ বয়স পার করছি।বলা তো যায় না হায়াত মউতের কথা।এই আছি এই নেই।আমি চলে যাওয়ার পরে বড় বউমা যদি প্রান্তি বুবুমনিকে না মানাতে পারে।ওর বাচ্চামো সিদ্ধান্তে বড় বউমার মন যদি গলে যায়।সিদ্ধান্ত নিতে যদি ভুল করে!
জানো-তো বড় বউমা ঠিক কি রকম ওকে ভালোবাসে।এসব ভেবেই সিদ্ধান্তটা নেওয়া আমার।আমি চাই প্রান্তি বুবু-মনিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বড় বউমার নিরাপদ ছায়ার আশ্রয়স্থলে স্থায়ী করে দিয়ে যেতে।আর দাদুভাইকে তো তুমি জানো।আমার বিশ্বাস দাদুভাইয়ের কাছে প্রান্তি বুবুমনি খুব ভালো থাকবে।
—প্রহান রাজি?
—আমার বিশ্বাস দাদাভাই আমার কথা ফেলবেনা।আর যে তোমার মেয়ের অবুঝপনা পাগলামো এতোটা বছর চুপচাপ মেনে এসেছে।সে রাজি হবেনা বলছো?
—তবে প্রান্তি রাজি থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই আম্মা।আর প্রহানের মতো ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসাবে পাওয়া সৌভাগ্যর ব্যাপার।এখানে অমত পোষন করার প্রশ্নই আসে না।
আরও কিছুটা সময় নীরবতায় চলে গেল।কবির সাহেব আবারও চায়ের কাপে ঠোঁট ডুবালেন।রাবেয়া খাতুনও জেনো কিছু ভাবতে থাকলেন।ফের কিছুটা সময় পার হতেই বললেন।
—তুমি৷ যখন সিদ্ধান্ত জানিয়েছো এবার আমি বাড়ির সবার সাথে কথা বলবো।যতসম্ভব তাড়াতাড়ি কাজটা সম্পূর্ণ করতে চাইছি আমি।
কথাটা বলে আবারও কিছুটা সময় নিশ্চুপ থাকলেন রাবেয়া খাতুন।তারসাথে নিরবতা পালন করলেন কবির সাহেব ও।তবে তিনি কিছু ভেবে চলেছেন।ফের শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকে ডেকে উঠলেন।
—আম্মা।
রাবেয়া খাতুনও কিছু ভাবছিলেন হয়তো।কবির সাহেব ডেকে উঠতেই তিনিও মুখ উঁচু করে তাকালেন।ফের বললেন।
—কিছু বলবে?
—আম্মা, প্রান্তি আর প্রহানের সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত নিয়েই তারপর সিদ্ধান্তটা ফাইনাল করবেন।দু’জনেরই সারাজীবনের ব্যাপার।আপনার কাছে এটাই শুধু আমার আবেদন।অনুরোধও বলতে পারেন।এটা ছাড়া এই বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।আর দু’জনে রাজি থাকলে আপত্তি করার তো কথাই নেই।
—তা তো অবশ্যই।আমি তোমাকে বলার আগে প্রান্তি বুবুমনির সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু হয়ে উঠে নি।আর তার-মধ্যে তুমি এসে পড়লে,তাই তোমাকেই কথাটা আগে জানালাম।আর আমাকে এতো অবিচক্ষণ বলে মনেহয় তোমার?যে আমি ওদের সিদ্ধান্ত না নিয়েই স্বামী স্ত্রীর মতো এতো ভারী একটা সম্পর্ক চাপিয়ে দেবো।আমি শুধু ভালেমন্দটা বুঝিয়ে সিদ্ধান্তটা জানবো শুধু।তারপর ওরা যা সিদ্ধান্ত জানাবে তারউপরে ভিত্তি করেই কাজ করবো।
—আপনি বিচক্ষণ মানুষ সেটা আমি জানি আম্মা।আমি বলতে চাইছি,দু’জনের কারও জেনো মনে নাহয় আপনি বা আমরা জোরকরে ওদের উপর আমাদের সিদ্ধান্তটা চাপিয়ে দিচ্ছি।
–হুমম!
রাবেয়া খাতুন গভীর ভবানায় ডুব দিলেন।উনার যতো ভয় প্রান্তিকে নিয়ে।মেয়েটা বিয়ে করগে মানলেও প্রহান দাদুভাইকে বিয়ে করতে মানবে বলে মনেহচ্ছেনা উনার।কি বলে যে মানাবেন মেয়েটাকে নিজেও জানেননা।তবে চেষ্টা করবেন।উনার গভীর ভাবনা কাটলো কবির সাহেবের কথায়।
—আম্মা, এখন তাহলে আমি উঠি?
ভাবনারত মুখ উঁচু করে কবির সাহেবের দিকে রয়েসয়ে তাকালেন রাবেয়া খাতুন।ফের বললেন।–বউমা যখন বাড়িতে নেই বলছো।তবে আজ আর তুমি বাড়িতে ফিরো-না কবির।রাতে এখানে থেকে যাও।সন্ধ্যার পরে এই বিষয়ে আমি সবার সাথে কথা বলতে চাই। সেখানে তোমার থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
কবির সাহেবও নিজের সহজ সরল স্বভাবের সহজমনা উক্তি দিলেন—ঠিক আছে আম্মা।আপনি এসব নিয়ে বেশি চিন্তা করবেননা।ডক্টরে নিষেধ করেছেন।আপতত বিশ্রাম নিন।ওদের ভাগ্য যা আছে ওটাই হবে।ওটা নিয়ে চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ বাড়াবেন না।
আরও দুই একটা কথা বলে কবির সাহেব শাশুড়ীর ঘর থেকে বের হলেন।শাশুড়ীর ঘর থেকে বের হতেই ড্রয়িং রুমে প্রান্তিকে দেখতে পেলেন।প্রান্তিও বাবা দেখে উঠে দাঁড়ালো। ফের শুধালো।
—তুমি কখন এসেছো বাবা।
মেয়ের কথায় মিষ্টি করে হাসলেন কবির সাহেব।মেয়ের মুখের মায়াবী আদলখানা হয়েছে উনার মতোন।কিন্তু মায়াবী চোখজোড়া নিয়েছে মায়ের মতোন।কি মায়ার ছড়াছড়ি সে নজরে।মেয়ের দিকে এগোলেন কবির সাহেব।কাছে যেতেই মেয়ের মাথায় হাত রেখে কপালে স্নেহময় আদর দিলেন।ফের বললেন।
—এইতো আম্মা,আসরের একটু আগে এসেছি।এসে শুনলাম তুমি ঘুমিয়ে আছো তাই আর ডাকিনি।
প্রান্তিও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো।এই নামক মানুষটা তার থেকে দূরে থাকলেও বাবার দায়িত্ব আদর ভালোবাসা তাকে দিতে ভোলেনি।হয়তো বাবার আদর ভালোবাসাটা সম্পূর্ণ পায়নি সে।তবুও যেটুকু সে পেয়েছে কম নয়।তাতেই সন্তুষ্ট সে।নিজের মা বাদে বাবার যখন দ্বিতীয় সংসার হয়ে যায়।এতটুকুও বা পায় কে?তার তুলনায় সে অনেক পেয়েছে।আর পাচ্ছে-ও।আর এই বাড়ির সবার ভালোবাসা তার কাছে পৃথিবীর অন্যত্র সব ভালোবাসার উর্ধ্বে।বিধায় অন্যসব ভালোবাসার ভালোমন্দটা সে এতোটাও খুঁজতে যায়না।
যদি-ও বাবাকে সবসময় কাছে পেতে মন চায়।কিন্তু বাস্তবতা যে অন্যরকম হয়।সে তুলনায় সে অনেক বেশ ভালো আছে।
—তুমি একা এসেছো?মুনিয়াকে নিয়ে আসোনি কেনো?
—তোমার ছোটো নানু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই মুনিয়া আর তোমার ছোটআম্মা উনাকে দেখতে গিয়েছেন।তাই আজ আর আসতে পারেনি।
—ওহহ।তো উনি কেমন আছেন?
—আলহামদুলিল্লাহ এখন মোটামুটি ভালো আছেন?
দু’জনের কথার একপর্যায়ে মাগরিবের আজানের মধুর ধ্বনি ভেসে এলো।প্রান্তির সাথে কথা শেষ করে কবরি সাহেব নমাজের জন্য বেরিয়ে পড়লেন।
.
মাগরিবের নামাজ শেষ হতেই প্রান্তিকে ডেকে পাঠালেন রাবেয়া খাতুন।প্রান্তিও ডাক পড়তেই নানুআম্মার কাছে চলে এলো।নানুআম্মা এখনো নামাজের বিছনায় বসে দোয়া দরূদ পড়ছেন।হাতে তসবিহ।সেটা অনবরত আঙুল নেড়ে দোয়া দরূদ যপে যাচ্ছেন।প্রান্তি ধীর পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।সেটা দেখে তসবিহের দিকে তাকালেন রাবেয়া খাতুন।আর কয়েকটা পোলা আছে একশ একটা হতে।সেটা শেষ করে তিনি তসবিহটা উনার মাথার বালিশের কাছে নিদিষ্ট জায়গাটায় রেখে দিলেন।ফের প্রান্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
—বুবুমনি নামাজ পড়েছো?
প্রান্তির মুখ ছোটো হয়ে গেল।নামাজ সে পড়েনা এমনটা নয়।নামাজ সে পড়ে।কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তার ঠিকঠাক পড়া হয়ে উঠে-না।এবাড়ির সবাই তাকে খুব ভালোবাসলে কি হবে নামাজ নিয়ে অবহেলা এটা নিয়ে ছাড় দেয়না কেউ।এমনকি বড়আম্মা-ও।তিনি যতোই তাকে ভালোবাসুক না কেনো এই ঠিকঠাক নামাজ পড়া না নিয়ে খুব বকা দেয়।
—কি হলো বলছো না যে?
—মাগরিবের নামাজটা পড়া হয়নি নানুআম্মা।
সত্যি বলতে আসরের নামাজটাও পড়া হয়নি তার।ঘুমিয়ে পার করে দিয়েছে যা তার মোটেও ঠিক হয়নি। কিন্তু শয়তান তাকে ঘুমানোর জন্য চেপে ধরে রাখে।যদিও সে শয়তানকে পাত্তা দিতে চায়না কিন্তু হয়ে যায়।
—এটা কোনো কথা হলো বুবুমনি।নামাজে এতো অবহেলা করলে চলে?আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন কিসের জন্য?অবশ্যই তার ইবাদতের জন্য।তুমি তার কতো নেয়ামত ভোগ করছো।অথচ তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাবেনা,তার ইবাদত করবেনা।এটাতে তিনি নিশ্চয় সন্তুষ্ট থাকবেন না।থাকার কথা?তুমি বলো?যাই করো না কেনো,নামাজে কোনোক্রমে অবহেলা করবেনা।এমনকি কোনো কারন ছাড়া সহজে নামাজ ছাড়বেনা।
একটু থামলেন রাবেয়া খাতুন। ফের বললেন।—যাও।এখনো সময় আছে।আমার ওয়াশরুম থেকে ওযু করে আমার এখানে নামাজ আদায় করে নাও।
প্রান্তি বিনাবাক্যবয়ে নানিআম্মার কথা মেনে ওযু করতে চলে গেলো।ওযু করে এসে নানিআম্মার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে নিলো।ফরজ নামায শেষে নানিআম্মা তাকে তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ,তেত্রিশবার আল্লাহ আকবার এবং শেষে একটা দোয়া পড়ার জন্য শিখিয়ে দিলেন।যা বড়আম্মা তাকে অনেক আগেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন।যা তার মনে আছে এবং নামাজ আদায় করলে এগুলো সে অবশ্যই পড়ে।নানিআম্মার কথামতো তসবিহগুলো সে একনিষ্ঠ ভাবে পাঠ করলো।নামাজ শেষে কথা পাড়লেন রাবেয়া খাতুন।
—আমি কিছু কথা বলার জন্য তোমাকে ডেকেছি।তুমি কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনবে,কথাগুলো শুনে উত্তেজিত হবেনা এমনকি রাগান্বিতও হবে-না।কথাগুলো শোনার পর তোমার যদি মনেহয় নানিআম্মা যেটা বলছে সেটা আমার জন্য মানা সম্ভব নয়।তখন তুমি যেটা বলবে সেটাই হবে।
নানিআম্মার কথাগুলো অর্থ ঠিকঠাক বুঝলো’না প্রান্তি।তবু-ও পাল্টা প্রশ্ন করলো-না উনাকে।শুধু নানিআম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনে গেলো।তিনি ঠিক কি বলতে চাইছেন সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো।রাবেয়া খাতুন শান্তস্বরে আবারও বলা শুরু করলেন।
—তোমার বয়স তখন একবছর ছুঁইছুঁই।পূর্ণ হয়নি।তখন তোমার মা মরণব্যাধি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হন।প্রায় ষোলো বছর আগের কথা।এখন ক্যানসার রোগের উন্নত চিকিৎসা থাকলেও তখন ওতোটাও ছিলোনা।তবুও রোগ ধরা পড়ার সাথে সাথে তোমার মা’কে তখনকার সময়ের ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হলো।কিন্তু কোনো কিছুতেই সুস্থতার দিকে গেলো না।বরং দিনকে দিন আরও অবনতি হলো।ডাক্তারও ভরসা দিলেন না।সেখন থেকেই কিছুদিন পর তোমার মা আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন।
এই কথাগুলো প্রান্তির জানা।তবুও মায়ের কথা উঠতেই মনটা কেঁদে উঠলো তার।চোখের কোণেও পানি জমলো তবে নানিআম্মা সামনে সেটা প্রকাশ করতে না দিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলো।এই নানিআম্মা নামক মানুষটাও যে তার মায়ের জন্য কষ্ট পায়।এটা সে জানে।তবে নানিআম্মা এই কথাগুলো আবার কেনো তাকে বলছেন বুঝতে পারছেনা।প্রান্তির ভাবনাকে ছাড়িয়ে রাবেয়া খাতুন আবারও বলতে শুরু করলেন।
—তোমার মা মারা যাওয়ার আগে,তোমার বড়আম্মাকে প্রায় বলতেন।ভাবি আমি মারা যাওয়ার পর আমার মেয়েটাকে আপনি আপনার কাছে রাখবেন।হয়তো-বা আমি মারা যাওয়ার পরে মেয়ের সম্পূর্ণ অধিকার তার বাবার।কিন্তু আমার মারা যাওয়ার পরে নিশ্চয় উনাকে আবারও বিয়ে বসতে হবে।আমি চাই তিনি অবশ্যই বিয়ে করুন,এই হক থেকে আমি তাকে বঞ্চিত রাখতেও চাইনা।কিন্তু সেই দ্বিতীয় মা নামক মানুষটা ভালো মন্দ কেমন হবে আমি জানিনা। কিন্তু এটা বলতে পারছি আপনার কাছে আমার বাচ্চাটা থাকলে ভালো থাকবে।
তাই আমি চাই আমার বাচ্চাটা আপনার আশ্রয়স্থলে থাকুক।তবে আমি মরে-ও শান্তি পাবো।ভাবি কথা দিন আপনি আমার মাহারা বাচ্চাটাকে আপনার কাছে রেখে দিবেন।সেদিন তোমার বড়আম্মা কথা দিয়েছিলেন।কেননা তোমার মা তোমার বাবার কাছ থেকে-ও কথা দিয়ে নিয়েছিলো।তোমার বাবাকে বলেছিলো।
—-আপনার সাথে সংসার জীবনে আপনি আমাকে অনেক দিয়েছেন।যা চেয়েছি তাই দিয়েছেন।হয়তো তার থেকে বেশিও।আর মরার আগে একটাই চাওয়া।আমার জীবনের শেষ চাওয়া আপনি আমার পূর্ন করুন।আমি মারা যাওয়ার পরে আমার বাচ্চাটাকে ভাবিকে দিয়ে দিবেন।আমি উনাকে চিনি, খুব ছোটো বয়সে উনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন। এই বাড়িতে আসার পর আমাদের জন্ম।কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন আমাদের।কখনো আমাদের উপর বিরক্ত প্রকাশ করেন নি।বরং দ্বিতীয় মা হয়ে আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়ে আমাদেরকে আগলে রেখেছেন।সেই মানুষটার কাছে আমাদের বাচ্চাটা কেমন থাকবে এটা আমি কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারছি,বুঝতে পারছি।তাই আমি চাইছি আমার বাচ্চাটা ভাবির মমতাময়ী ছায়ার স্থলে মানুষ হোক। আমার এটাই আপনার কাছে আমার শেষ চাওয়া।আমি মরে গেলে আমার বাচ্চাটাকে ভাবির কাছ থেকে নিয়ে নিবেন না।যদিও এটা হয়তো সন্তুষ্ট হওয়া কথা নয়,তবুও সন্তুষ্টচিত্তে আমাকে কথা দিন।সেদিন তোমার বাবারও তোমার মা’কে কথা দিয়েছিলেন।
সেদিনের করুন গলায় নিভুনিভু চাহুনীর কথাগুলো মনে পড়তেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠলো রাবেয়া খাতুনের।চোখজোড়া তো সেই কখন নোনাজলে ভরে উঠেছে।একটু থেমে তিনি আবার-ও বললেন।—মরে যাওয়ার আগের দিন তোমার মা তোমার বড়আম্মাকে আরও একটা কথা আকুতিমিনতি করে বলেছিলেন।
প্রান্তি ভেজা নয়নে স্থিরহয়ে নানিআম্মার দিকে তাকিয়ে আছে।মনেহচ্ছে নানিআম্মা কথাগুলো তার নয়নযুগলে বাস্তবে ভাসছে।নানিআম্মা কথা থামাতেই মন অধির আগ্রহে প্রশ্ন করতে চাইছিলো,মা কি কথা বলেছিলেন।কিন্তু মুখ ফুটে সেটা বলতে পারলেনা।তবে নয়নজোড়া স্থির রেখে নানিআম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।যে কি বলবপন নানিআম্মা।রাবেয়া খাতুনও হয়তো প্রান্তির চাহুনির না বলা কথাটা বুঝতে পারলেন তাই বললেন।
—ভাবি,পারলে আমার বাচ্চাটাকে আপনি আপনার মমতাময়ী ছায়াস্থল ওর মৃত্যুর আগপর্যন্ত রেখে দিয়েন।
তাইই তো রেখে দিয়েছেন বড়আম্মা।তবে একথা কেনো বলছেন নানিআম্মা।রাবেয়া খাতুনও বুঝলেন উনার কথার মর্মার্থ প্রান্তি বোঝেনি।তাই বললেন।
—তোমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলতে কথাটা বুঝেছো?
কপাল কুঁচকে গেল প্রান্তির।নানিআম্মাতো এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলেন না তবে আজ কেনো বলছেন?তবে কি নানিআম্মার বলা এই কথার মর্মার্থ আলাদা।ভাবনার মধ্যে নানিআম্মার বলা পরবর্তী কথাটা কানে আসতেই সারা শরীর ঝাঁকিদিয়ে কেঁপে উঠলো প্রান্তির।জেনো বৈদ্যুতিক শক্ লেগেছে শরীরে।
—প্রহান দাদুভাইয়ের সাথে তোমাকে বিয়ে দিয়ে, বড়ো বউমার কাছে স্থায়ীকরে রেখে দিতে বলেছিলো তোমার মা।
মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো প্রান্তির।ওই মানুষটার নাম শুনে কানে জেনো তব্দা লেগে গেছে তার।অদ্ভুত ভাবে শরীরের উপশমগুলা কাটা দিয়ে উঠছে বারংবার।
এই অসম্ভব কথাটা নানিআম্মা বললেন কিকরে?আর তার মা-ও না-জেনে না-বুঝে একি কথা বলে গেলেন।যা কখনোই সম্ভব নয়।প্রান্তি মনেমনে বেশ কয়েকবার আওড়ালো।
—এটা কখনোই সম্ভব নয়।আর সম্ভব নয় মানে কোনো মতেই সম্ভব নয়। পুরো অসম্ভব!
চলবে…
গল্প পড়ে আপনাদের অনুভূতি প্রকাশ করবেন।এটা যেকোনো লেখক লেখিকাকে লিখতে উৎসাহ বাড়ায়।না হলে লিখতে মন চায়না।মনেহয় গল্প পাঠকদের ভালোই লাগছেনা।তখন আর লিখতেও ইচ্ছে করেনা।অসুস্থ ছিলাম তাই পর্বটা দিতে দেরি হয়েছে।ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।