#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#পর্ব |৩০|
#লেখাঃ_নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
দেয়াল ঘড়ির ঘন্টা মিনিটের কাঁটা টিকটিক করে আওয়াজ তুলে জানান দিচ্ছে এখন রাত দশটা ছুঁই ছুঁই!
আজ সারাটা দিন নানান রকম ব্যস্ততার দরুণ, ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। রাতের আহারটা অতি সত্তর সেরে যে যার কক্ষে বিশ্রাম নিতে চলে এলাম তাই।
এদিকে আমার ঘরে পড়েছে আমার সকল কাজিনদের ঢল, সেই সাথে আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলেরও ভীর জমেছে! তারা ইতোমধ্যে নানারকম হাসি-ঠাট্টা, মজা-মশকরায় জমিয়ে ফেলেছে আসর! তাদের জমে ওঠা গল্পের আসর শেষ হতে হতেই প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। আড্ডায় ওরা এতোটাই মশগুল ছিল যে সময়ের দিকে খেয়ালই করা হয়নি। যখন ওদের টনক নড়ে তখন ওরা যে যার বরাদ্দকৃত কক্ষে ফিরে যায়। কক্ষে পড়ে রইলাম শুধু আমি, রিশতা আর আয়ুশী ভাবি। অরনী অবশ্য থাকতে চেয়েছিল আমাদের সাথে তবে আরাভ ভাইয়ার জন্য আর তা হলো কই! ঠিকই এসে ধরে বেঁধে নিয়ে গেল তার বউকে! আমার এতে ভীষণ মন খারাপ হয়, কেননা অরনীর বিয়ের পর ওর সাথে এভাবে আর কখনো থাকা হয়ে ওঠেনি।
..
-‘ এই আরাভ, আমাকে এভাবে নিয়ে এলে কেন? ইশ কতদিন আমার বোনদের সাথে একসাথে থাকা হয়না! আগের দিনগুলো ভীষণ মিস করি আমি।
বিছানার এককোণে বসে গাল ফুলিয়ে উক্ত কথাগুলো এলোমেলোভাবে বলে ওঠে অরনী। বউয়ের এমন অবস্থা দেখে মুচকি হেসে, এক টানে অরনীকে নিজের একদম কাছাকাছি নিয়ে এলো আরাভ। অরনীর নাকে নাক ঘষে আদুরে ভঙ্গিতে বলল
-‘ সাতটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র বউ! তাকে ছাড়া থাকি কি করে আমি?
-‘ একটা দিনও কি থাকা যেত না!
-‘ আচ্ছা পরে থেকো কোনো এক দিন! তবে আজ না। তোমায় ছাড়া সত্যিই ঘুম আসে না আমার। কাছে এসো। মাথাটা একটু টিপে দাও। ঘুমাই আমি।
অরনীর রাগ এবার সপ্ত আসমানে চড়ে বসে। সামান্য মাথা টিপে দেওয়ার জন্য তাকে এভাবে ধরে বেঁধে নিয়ে এলো আরাভ! ইচ্ছে করছে মাথার সব চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে দিতে! আরাভ হয়তো বুঝল অরনীর মনোভাব, তবুও নির্বিকার ভঙ্গিতে শুয়ে রইল সে।
অরনী এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলে
-‘ মাথা নয়, একেবারে গলাটা টিপে দেই তোমার।
শোয়া থেকে আবারও উঠে বসে আরাভ। অবাক হয়ে বলল
-‘ তুমি কি সেচ্ছায় এই বয়সে বিধবা হতে চাইছো অরনী?
অরনী চোখ পাকিয়ে তাকায় আরাভের দিকে। আরাভ ভয় পাওয়ার ভান করে বুকে থু থু দেয়। এরপর অরনীর কোমড় জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল
-‘ এমনভাবে তাকিও না অরনী। এমনিতেও শালিকার গায়ে হলুদে তুমি আজ যে সাঁজটাই না দিয়েছ, তাতেই আমি শেষ! এখন এভাবে তাকালে যে নির্ঘাত পগারপার হয়ে যাব!
আরাভের কথায় অরনী হেসে ফেলে এবার। এক নিমেষেই যে তার রাগটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ইচ্ছায় এই লোকটার প্রেমে পড়েছিল সে! তিন বছর প্রণয়ের পর যেদিন তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছিল সেদিন এই মানুষটা তাকে কোলে নিয়ে ছাঁদে দৌড়েছিল। মনে পড়লে এখনও হাসি পায় ভীষণ! অরনীকে হাসতে দেখে আড়ষ্ট গলায় আরাভ বলল
-‘ ভালোবাসতে চাই একটু। বাঁধা দিবে না তো?
অরনী বুঝে যায় এ কথার মর্মার্থ! লজ্জায় তাই আরাভের বুকে মুখ গুঁজে ফেলল সে। আরাভও বুঝে ফেলে তার বউয়ের সম্মতি! অরনীকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে মিহি স্বরে বলল
-‘ এমন ভালোবাসাময় রাতগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক! আরও জন্ম জন্মান্তর ভালোবাসতে চাই তোমায়!
অরনী ছোট করে ‘হুম’ বলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। আরাভও আর দেরি না করে তার কাজে লেগে পড়ে।
তাদের ভালোবাসা তো পূর্ণতা পেয়েছে বহুআগেই। এখন শুধু একটা ছোট্ট সোনামণির অপেক্ষায়!
..
-‘ আহারে বেচারা আদ্রিশ ভাইয়ার এখন কি অবস্থা কে জানে?
কপালে হাত ঠেকিয়ে আপন খেয়ালে শুয়ে ছিলাম এতোক্ষণ। হুট করে রিশতার এহেন কথায় ওর দিকে ফিরে চাইলাম আমি। ভ্রু কুটি করে তাই জিজ্ঞেস করলাম
-‘ এই মাঝরাতে হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ?
-‘ হলুদের পর বেচারা আদ্রিশ ভাইয়া যে আজ সারাদিন তোর ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। ইশ, ভাইয়ের কথা ভাবলেই খারাপ লাগে ভীষণ!
আসলেই, সকালে আমায় একপ্রকার থ্রেট দেওয়ার পর থেকে তার দেখা মেলেনি আর। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, বিয়ের আগ মুহুর্ত অবধি আমার ধারেকাছেও আসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ তার জন্য। যতবারই নাকি আসতে চেয়েছিল ততবারই আমার গুণধর কাজিনগুলো আঁটকে দিয়েছিল তাকে। এসব শুনে হাসি আর আঁটকাতে পারিনি আমি। ব্যাটা খুব বাড় বেড়েছিল, এখন হয়েছে উচিত শিক্ষা!
-‘ কিরে, কিছু বললি না যে!
রিশতার কথায় আমার ভাবনার সুঁতো ছিড়ল! কিছুটা বিরক্তি দেখিয়ে বললাম
-‘ তোর ভাইয়ের জন্য যখন এতোই খারাপ লাগছে তখন যা না, যেয়ে হিহি করে হেসে আয়। শুধু শুধু আমায় পাশে শুয়ে আমার কানের মাথা খাচ্ছিস কেন?
আমার এমন কথায় রিশতার মুখটা ভার হয়ে যায়!
আমার পাশে আয়ুশী ভাবি শুয়ে থাকলেও এ কথাগুলো তার কর্ণকুহুর অবধি পৌঁছায়নি। সে তো তার আপন খেয়ালে ফোন টিপতে ব্যস্ত! পরক্ষণেই কি একটা কাজ আছে বলে বেরিয়ে পড়ে সে। সন্দিহান চিত্তে চেয়ে রইলাম খানিক সময় আয়ুশী ভাবির প্রস্থানের পানে।
এদিকে আমার তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ! বেড সাইড টেবিল হাতড়ে পানির জগটা হাত নিতেই টের পেলাম, এতে পানির কণার ছিটেফোঁটাও নেই। বুঝতে বাকি নেই পানি পেয়ে সবটুকু গিলেছে বিচ্ছুর দলগুলো। অগত্যা তাই পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে ডাইনিং রুমের পথে পা বাড়ালাম।
আমার কক্ষ থেকে বেরিয়ে করিডোরের পথে ধরে হাটছিলাম। এমন সময় দুটো ছায়ামূর্তি নজরে পড়ে আমায়। আবছা আঁধারে লক্ষ্য করলাম তাদের মাঝে কি বিষয় নিয়ে যেন আলাপ চলছে! আড়ালে দাঁড়িয়ে তাই শোনার চেষ্টা করলাম। এরই মাঝে আমার কর্ণকুহুরে ভেসে এলো কিছু আলাপন…
-‘ চোখের সামনে তোমায় দেখেও সবার সামনে কথা বলার সাহস হয়ে উঠছে না আমার। তাই তো এই রাতের আঁধারে এলাম তোমার সাথে দেখা করতে।
ফিসফিস করে সতর্ক গলায় বলে উঠল নারী অবয়বের ছায়ামূর্তিটি। অপর পক্ষ হতে কোনো জবাব মেলে না। সে জড়িয়ে ধরে তার প্রেয়সীকে। খানিক সময় বাদে ছেড়ে দিয়ে বলল
-‘ কবে যে তোমায় নিজের করে পাবো, জানা নেই আমার। একদিকে আমাদের পড়াশোনাও এখনো শেষ হয়নি, আরেকদিকে তোমার বিয়ের সম্মন্ধও আসছে। কি যে করি? এই সেম এজ রিলেশনশিপগুলো এমনই হয়!
-‘ শান্ত হও আলভি! আমি তো আমার দিকটা ম্যানেজ করছি। তুমিও কিছু একটা করো।
এতোটুকু শুনতেই সরে এলাম আমি। বুঝতে বাকি নেই যে এটা আলভি ভাইয়া আর আয়ুশী ভাবির কথোপকথন। তাদের তো প্রায় চার বছরের রিলেশন।আমরা জানার আরও এক বছর আগ থেকেই তাদের প্রণয় ছিল। পরবর্তীতে অবশ্য আদ্রিশ হতে জেনেছিলাম। চড়ুইভাতির দিন তো এই আয়ুশীকে দেখিয়েই আদ্রিশ বলেছিল, এইটা আমাদের ভাবি। তখন থেকেই তাকে ভাবি বলেই ডাকি আমি। যদিও সেদিন তো বুঝতে না পেরে বেজায় চটে গিয়েছিলাম। তাই তো রিসোর্ট থেকে ফিরে রাগের মাথায় আদ্রিশকে যা নয় তাই বলে বসেছিলাম। যদিও সেসব মনে পড়লে এখন ভীষণ বিপাকে পড়তে হয় আমায়।
মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম তাই, ‘আমার আর আদ্রিশের বিয়েটা হয়ে গেলেই এরপর আলভি ভাইয়ার বিষয়টা নিয়ে ভাববো। দরকার পড়লে যা করতে হয় তা-ই করব, দুজনকে এক করা না অবধি চেষ্টা চালিয়ে যাব।’ ওদেরকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না যে আমার।
এসব ভাবতে ভাবতেই সেখান থেকে সরে এসে ডাইনিং রুমে চলে এলাম। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে গলায় চালান করে নিলাম। যাক এবার শান্তি! এতোক্ষণ তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। পানির গ্লাসটা যেই টেবিলে রেখে চলে আসতে নিব এমন সময় পেছন থেকে এসে একজোড়া শীতল হাত জড়িয়ে ধরে আমায়। যে হাতটা গিয়ে আমার পেট বরাবর ঠেকেছে। শিউরে উঠলাম আমি এতে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই একহাতে আমার মুখ চেপে ধরে শীতল হাতজোড়ার মালিকটি। কানের কাছে মুখ এনে শীতল কন্ঠে সে বলল
-‘ তোমার দেখা না পেয়ে যে একজন শূন্য দশমিক দুই গ্রাম কমে গিয়েছে সে খবর কি রাখো মেয়ে! খালি তো আছো বিয়ের চিন্তায়, এদিকে যে আমি দিনকে দিন শুকিয়ে যাচ্ছি সে খবর তো রাখার প্রয়োজন মনে কর না দেখছি! আজকের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। কালকে থেকে দেখে নিব তোমায়। তোমার সাথে আমার অনেক পুরোনো হিসেব নিকাশ বাকি পড়ে রয়েছে। সেইসব কড়ায় গন্ডায় তুলতে হবে তো! বাকিটা তুমি সামলে নিও কেমন!
#চলবে~
কাল মেহাদ্রিশের বিয়ে! সবার দাওয়াত রইল ওদের বিয়েতে। সবাই গিফ্ট নিয়ে আসবেন। গিফ্ট ছাড়া কিন্তু চলবে না। আর হ্যাঁ যারা মেহাদ্রিশের ঠিকানা জানতে চাইছিলেন, তারা উগান্ডায় চলে আসবেন। কারণ ওরা উগান্ডার বাসিন্দা🌚