#হৃদয়ে_লাগিল_দোলা 🫶
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব৩৪
গতকাল সারাটা দিন ভ্যাপসা গরমের পর শেষরাতের দিকে দমকা হাওয়া আর ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এখন ঘড়ির কাঁটা নয়টা পেরিয়ে দশটার ঘর অতিক্রম করেছে তবুও সূর্যি মামার আর দেখা মিলল না আজ! আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে এখনো। মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়া বইছে নয়তো এক পশলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির প্রকোপ নাকি আরও বাড়বে। পরবর্তীতে আবহাওয়ার নিউজে দেখলাম ‘ঘূর্ণিঝড়’ হবে।
ঘুম থেকে উঠেছি খানিক আগেই। আজ সকালটা একটু অন্যরকম! কেননা আগে ছিলাম এই বাড়ির নয়নের মণি আর আজ থেকে বউরাণি! কতো দায়িত্ব আমার উপর! কাল বিলম্ব না করে তাই একেবারে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের পথে পা বাড়ালাম।
নিত্যদিনকার মতোই মা আর মামনি যথারীতি হেঁশেল সামলাতে ব্যস্ত! আমায় দেখে তারা অমায়িক হাসলেন। কাছে এসে মামনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-‘ কিরে ঘুম ভালো হয়েছে তো?
মামনির কথায় মাথা নেড়ে সায় জানালাম শুধু। হাতে হাতে কাজ করার জন্য উদ্যত হতেই আমার হাত আঁকড়ে ধরে তিনি শাসনের সুরে বললেন
-‘ এই মেয়ে একটা মাইর দিব কিন্তু তোকে। শোন কোনো কাজ করতে হবেনা তোর। যা ঘরে গিয়ে আমার ছেলেটার সেবা যত্ন কর। আর হ্যাঁ, নাস্তা প্রায় শেষের পথে। তো ডাইনিং টেবিলে খাবি নাকি ঘরে গিয়ে খাবি?
-‘ ডাইনিং টেবিলেই তোমাদের সাথে বসে একসঙ্গে খাব মামনি। দাঁড়াও আমি ওনাকে ডেকে আনছি।
এতোটুকু বলেই চলে এলাম আদ্রিশের কক্ষে। এসে দেখলাম আদ্রিশ এখনো উবু হয়ে শুয়ে পরে পরে ঘুমাচ্ছে! কয়েকবার ডাক দিলাম কিন্তু তার ওঠার নামগন্ধ নেই। শেষমেশ উপায়ান্ত না পেয়ে বেড সাইড টেবিলের উপরে থাকা জগ থেকে কিছুটা পানি নিয়ে আদ্রিশের চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলাম। এতে কাজ হয়। আড়মোড়া ভেঙে, চোখ ডলতে ডলতে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল
-‘ এতো সকাল সকাল ডাকছ কেন? আরও কিছুক্ষণ ঘুমাতে দাও আমায়!
আমি একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে আবারও আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আলগোছে আদ্রিশের মাথার ঘনকালো চুলগুলো টেনে দিয়ে বললাম
-‘ বলি ক’টা বাজে খেয়াল আছে কোনো? উঠে পড়ো। দশটা ওভার হয়ে গেছে, এরপরে খাবে কখন?
আদ্রিশ তবুও উঠল না। উল্টে একটানে আমায় নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল
-‘ খাওয়ার ইচ্ছে নেই এখন। আপাতত এই রোমান্টিক ওয়েদারে বউয়ের সাথে একটু রোমান্স করতে চাই!
আমি এবার দুম করে কিল বসিয়ে দিলাম আদ্রিশের বুকে। কপট রাগ দেখিয়ে বললাম
-‘ তোমার মুখে আজকাল কিছুই আটকায় না! দিনদিন অভদ্র হয়ে যাচ্ছ!
আদ্রিশের চোখের ঘুম এবার পুরোপুরি উবে যায়। হাতের বাঁধন আরো জোড়ালো হয়ে আসে তার। ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। সে এবার শিষ বাজিয়ে গাইল
-‘ অভদ্র হয়েছি আমি তোমারই প্রেমে তাই…
আদ্রিশের মুখ চেপে ধরলাম আমি এবার। ঘুম থেকে উঠেও মানুষের এতো প্রেম কোথ থেকে আসে! এই লোক প্রচন্ড রকমের অসভ্য হয়ে যাচ্ছে! আড়াই বছর আগের আদ্রিশের সাথে তো এর কোনো মিল-ই নেই! দুবছরের মাথায় ঢাকা থেকে ফিরতে গিয়ে আবার এক্সচেঞ্জ হয়ে যায়নি তো কারো সাথে! হায় সর্বনাশ! চট করে তাই বলেই বসলাম
-‘ আপনি হুট করে নিরামিষ থেকে এমন আমিষ হয়ে গেলেন কিভাবে?
আমার কথায় হয়তো বেশ মজাই পেয়েছে আদ্রিশ! বিগলিত হেসে তাই জবাব দিল
-‘ আগে আমার শরীরে প্রোটিনের অভাব ছিল তাই নিরামিষ ছিলাম! এখন সেই অভাবটা আর নেই তাই একেবারে আমিষের ভাণ্ডার হয়ে গিয়েছি।
তার এহেন রসিকতায় আমি থম মেরে আগের মতোই রইলাম। সে এবার আমার গাল টেনে দিয়ে বলল
-‘ আমি জানি তুমি কি বলতে চাও। সত্যি বলতে কি, মানুষ রোমান্টিক-আনরোমান্টিক হয়ে জন্মায় না। রোমান্টিক হয় তার সামনে থাকা মানুষটার জন্য। ঠিক তেমনই তোমার জন্য আমার এই আমূল পরিবর্তন! বুঝলে বউ?
-‘ আমি আবার কি করলাম?
-‘ কি করোনি তুমি! গতরাতে যে আমার সব ইজ্জত লুটে নিলে, তার বেলায়!
এবার আমার কান গরম হয়ে যায়। যে করেই হোক এই লোকের মুখ বন্ধ করতে হবে নয়তো জ্বালিয়ে মারবে। উপায় না পেয়ে তাই শেষমেশ তার পেটে আমার ধারালো নখ দিয়ে দুটো চিমটি কেটে দিলাম। আদ্রিশ এবার ব্যাথাতুর শব্দ করে আমায় ছেড়ে দেয়। হাতের বাঁধন আলগা হতেই আমি সরে পড়লাম। সে করুণ সুরে বলে উঠল
-‘ সারাদিন পর একটা ধলা ইঁদুররে বিয়ে করছিলাম বোধহয় নইলে কেউ এভাবে চিমটি দেয়! জ্বলে গেল রে বাপ! ইচ্ছায় তোর জামাইরে নিয়ে এতো চিন্তায় থাকতাম, আমার জীবনটা তেজপাতা করার জন্য এই মেয়ে-ই যথেষ্ট!
এতোটুকু বলেই সে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ। আর এদিকে আমি তার এমন অবস্থা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। আমার হাসি শুনে সে ওয়াশরুম থেকে থ্রেট দিয়ে বলল
-‘ এখন যত পারো হেসে নাও। এরপর আমার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করেও কিন্তু লাভ হবেনা কোনো!
তার এমন থ্রেটে ভয় পাওয়ার বদলে আরও জোরে হেসে উঠলাম। আদ্রিশ ব্যাটাকে শায়েস্তার জন্য এখন অন্য বুদ্ধি উঁকি দিচ্ছে! যদিও এসব ভাবার সময় নেই, এখন আমার অনেক কাজ। আলভি ভাইয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যেইভাবা সেইকাজ! অগত্যা আর কাল বিলম্ব না করে তাই ডাইনিং রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
ডাইনিং রুমে ইতোমধ্যে বাবা, চাচ্চু, অরনী, রিশতা, আরাভ ভাইয়া, আলভি ভাইয়া আর আয়ুশী এসে হাজির হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া জন্য আজ কেউ-ই বাসা ছেড়ে বের হতে পারেনি। নয়তো এসময় তাদের দেখা পাওয়া দূর্লভ! আমায় দেখতেই বাবা বলে উঠলেন
-‘ গুড মর্নিং মাই প্রিন্সেস!
-‘ গুড মর্নিং, বাবা।
এতোটুকু বলেই একহাতে জড়িয়ে ধরলাম বাবাকে। বহুদিন পর আজ একসাথে বসে সকালের ব্রেকফাস্টটা করার সৌভাগ্য হলো! পাশ বসে থাকা চাচ্চুকে বললাম
-‘ গুড মর্নিং, কেমন আছো চাচ্চু?
আমার কথায় তিনি গম্ভীরভাবে ‘ভালো’ বললেন। ভ্রু কুচকে এলো এতে আমার। তিনি এবার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থমথমে গলায় বললেন
-‘ আমি এখনো তোমার চাচা হই মেহরুন? আমার একমাত্র ছেলের বউ কিনা এখনো আমায় শশুর আব্বু বলে ডাকতে পারল না!
চাচ্চুর কথা শুনে হেসে ফেললাম আমি। মানুষটা বরাবরই গম্ভীর, তবে তার সাথে আমার সম্পর্কটা বাবা মেয়ের মতোই। আদ্রিশের উপর রাগ থাকলেও এখন আর সেই রাগটা নেই তার। ছেলে এখন একজন কার্ডিওলজিস্ট, নিজস্ব একটা পরিচয় আছে। ছেলের এমন সাফল্যে কোন বাবা রেগে থাকতে পারে! তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি এর। বর্তমানে বাবা ছেলের মধ্যে আবারও আগের মতো সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেছে। যদিও আমারও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি এরজন্য। তাছাড়াও বাবা, চাচ্চুর পাশাপাশি এখন আমার ভাই ব্যবসাটা দেখছে, তাই রাগের রেশটাও ফিকে হয়ে এসেছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আদ্রিশ এসে তার জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারটাতে বসে পড়ল। তার পাশের চেয়ারটা খালিই পড়ে ছিল তবে লজ্জার কারণে আর তার পাশে না বসে রিশতার পাশে বসে পড়লাম আমি। এতে রেগে যায় আদ্রিশ। সরু চোখে একবার চেয়ে সেই যে খাওয়ায় মনোনিবেশ করল তারপর আর ঐ খাবারের অপরূপ সৌন্দর্য থেকে চোখই ফেরাতে পারল না!
রিশতার পাশে বসতেই রিশতা আমায় ধাক্কা দিয়ে মিনমিন করে বলল
-‘ কি ব্যাপার আদ্রিশ ভাইয়ার পাশে বসলিনা যে, লজ্জা পাচ্ছিস বুঝি?
আমি আমার মতো নির্বিকার বসে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলাম। রিশতা পুনরায় বলে উঠল
-‘ অবশ্য লজ্জা পাওয়ারই কথা! আচ্ছা তোর গলায় ওটা কিসের দাগ মেহু?
রিশতার কথায় আমার সংবিৎ ফেরে, অতি সত্তর তাই ওড়না দিয়ে গলাটা ঢেকে নিলাম। রিশতা ব্যতিত ভাগ্যিস অন্য কেউ দেখেনি নয়তো লজ্জায় আজ পটল তুলতে হতো আমার! ওর দিকে ফিরে এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললাম
-‘ এতোদিকে নজর না দিয়ে দয়া করে একটু খা। আর ওটা মশার কামড় ছিল!
-‘ জানিনা বাপু, আমারে তো আর কখনো মশায় কামড়ায়নি তাই বলতে পারিনা।
রিশতা ভালোই টিপ্পনী কাটছে আমায়। চোখ গরম করে তাকাতেই ও মিইয়ে যায়। এই মেয়েটার স্বভাব আর পাল্টাবেনা বোধহয়! অরনীর মুখে এ নিয়ে কোনো কথা নেই, কেননা ও জানে আমি এতো পার্সোনাল ম্যাটার নিয়ে কথা বলাটা খুব একটা পছন্দ করিনা। এজন্যই ওকে বেশি ভালো লাগে আমার। যদিও ও কম যায়না মাঝেমধ্যে।
মা মামনি যথারীতি সবার প্লেটে খাবার পরিবেশন করে নিজেরাও এখন খেতে বসলেন। যদিও আমি বার কয়েক বলেছিলাম তবে মামনির নিষেধের কারণে দমে যেতে হয় আমায়।
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই যে যার মতো কক্ষে চলে যায়। বসে রইলেন শুধু মা, আলভি ভাইয়া। এটাই মোক্ষম সময়। তাই এবার আমি বলেই ফেললাম
-‘ মা, আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। এবার ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারেও একটু দেখো।
আমার কথায় তারা চকিত ফিরে তাকায়। মা আমায় বললেন
-‘ হ্যাঁ তাতো ভাবতেই হবে। তবে পাত্রী…
-‘ ওসব নিয়ে চিন্তা নেই, পাত্রী তো আমাদের হাতের কাছেই।
মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চট করে এতোটুকু বলে আয়ুশীকে সামনে নিয়ে এলাম। আয়ুশী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। মুখে তার রা টিও নেই।
মা এবার গম্ভীর গলায় বললেন
-‘ নাম কি তোমার? বাসায় কে কে আছেন?
আয়ুশী নিচু গলায় জবাব দেয়
-‘ আমি আয়ুশী রহমান সাফা। আমায় আপনি আয়ুশী বা সাফা, যেকোনো একটা নামে ডাকতে পারেন। তিনকুলে আমার কেউ নেই বললেই চলে। এখানে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি।
মা আর কিছু শুনতে চাইলেন না আবার কিছু বললেনও না। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন
-‘ ঠিক আছে তোর বাবার সাথে কথা বলে ভেবে দেখব।
মা চলে যেতেই ভাইয়া এসে আমার হাত চেপে বলল
-‘ তুই আমার জন্য যা করেছিস, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে যা বুঝলাম মা বাবা হয়তো না-ও রাজি হতে পারে!
ভয় যে আমারও হচ্ছেনা, তা না! তবুও ওদের আশ্বাস দিলাম। হুট করে এমন সময়…
#চলবে~
এই গল্পটা বড়জোর ১০-১৫ পর্বের মধ্যে শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একবার লেখা শুরু করলে হাত চলতেই থাকে শুধু। চলতে চলতে এখন এটা ৩৪ পর্ব ছুঁয়েছে। জানিনা আর কত চলবে! তবে আমি শেষ করার জন্য একপ্রকার উঠেপড়ে লেগেছি। জানি আপনাদের কাছে এটা এখন বোরিং লাগছে। তাই দ্রুতই ইতি টানার চেষ্টায় আছি।