অপেক্ষা
পর্ব -২
__হুমায়ূন আহমেদ
ইদানীং ফিরোজের একটা সমস্যা হচ্ছে—রিকশায় চড়তে পারে না। রিকশায় চড়লেই মনে হয় কান্ত হয়ে রিকশা পড়ে যাবে। সে ছিটকে পড়বে রিকশা থেকে। তাকে রাস্তা থেকে টেনে তোলার আগেই পেছনে সমগ্র বাংলাদেশ সাত টন লেখা একটা ঘাতক ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। মৃত্যুর আগ মুহতে সে পট-পট জাতীয় মুড়িভাজার মত শব্দ শুনবে। শব্দটা ট্রাকের চাকার নিচে তার মাথার খুলি ভাঙ্গার শব্দ। মৃত্যুর আগের মুহুর্তে যে গন্ধ তার নাকে ঢুকবে সে গন্ধটা হল— পেট্রোলের গন্ধ এবং ট্রাকের চাকার গন্ধ। শেষ দৃশ্য হিসেবে দেখবে ট্রাকের মাডাগার্ড।
ফিরোজ বুঝতে পারছে তার মানসিক কিছু সমস্যা হচ্ছে। সমস্যাটা মনে হয় বাড়ছে। রিকশায় উঠেই সে সারাক্ষণ পিছন দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি ট্রাক এল। বিদেশে এ জাতীয় সমস্যা হলে লোকজন আতংকে অস্থির হয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে চলে যেত। বাংলাদেশে এরচে ভয়াবহ সমস্যা নিয়ে লোকজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো ঘোরাফেরা করে। সে যেমন করছে। ফিরোজের ধারণা সে পুরোপুরি না হলেও অস্বাভাবিক একজন মানুষ যে রিকশা পছন্দ করে না, তারপরেও প্রায় সারাদিনই রিকশার উপর থাকে। রিকশা ভাড়া করে ঘণ্টা হিসেবে। সারাদিনের জন্যে ভাড়া করলে সস্তা পাওয়া যায়। সূর্যোদয় থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাড়া ২০০ টাকা। দুপুরের খাবার, বিকেলের নাস্তা এবং মাঝে মধ্যে চা এই ২০০ টাকার বাইরে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ফিরোজ সারাদিনের জন্যে রিকশা ভাড়া করেছে। আজও করেছে। গত কয়েক মাস ধরে তাকে বিচিত্র সব জায়গায় অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে যেতে হচ্ছে। আজ দুপুর দুটািয় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে সে দেখা করবে। ভদ্রলোকের নাম রকিব। তিনি নাকি থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য। বিখ্যাত মিডিয়াম। হারানো মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারেন। অনেকের অনেক হারানো ছেলে পুলে সম্পর্কে নির্ভুল সংবাদ দিয়েছেন। ভদ্রলোক ফ্রড না, কারণ তিনি টাকা পয়সা নেন না। তবে ফ্রড না হলেও বিরক্তিকর মানুষতো বটেই। কয়েকদিন পর পর আসতে বলেন, এবং অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে আসতে বলেন। দুপুর দুটা, বিকাল সাড়ে তিনটা। ভদ্রলোক কথা বলতে পছন্দ করেন। সব কথাবার্তাই পরকাল, মন্ত্র-তন্ত্র, ভূত-প্ৰেত বিষয়ক। দুপুর বেলা ভূত-প্রেতের কথা শুনতে ভাল লাগে না। ফিরোজ গম্ভীর মুখে শুনে যায়। গরজটা তার।
গত কয়েক মাসে ফিরোজের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার ধারণা এই অভিজ্ঞতা না হলেও কোন ক্ষতি ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হল— মানুষের মূল্য খুবই সামান্য। দশ হাজার টাকা হারিয়ে গেলে কুড়ি বছর পরেও সেই টাকার শোকে মানুষ কাতর হয়। মানুষ হারিয়ে গেলে কুড়ি দিন পরই আমরা মোটামুটিভাবে তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে হারানো মানুষ খুঁজে বের করার কোন পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই। থানায় গেলে পুলিশ অফিসার বিরক্ত মুখে বলেন– জিডি এন্ট্রি করুন। বলেই তিনি হাই তুলেন। মানুষ হারানোর সংবাদ পুলিশের কাছে হাই তোলার মত ব্যাপার। ফিরোজ থানার সেকেন্ড অফিসারের হাই অগ্রাহ্য করেই জিডি এন্ট্রি করিয়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, এখন কি?
সেকেন্ড অফিসার বিস্মিত হয়ে বললেন, এখন কি মানে?
জিডি এন্ট্রিতো করানো হল— এখন আপনারা কি করবেন?
আমরা একশান নেব।
কি একশান নেবেন?
কি একশান নেব সেটাতো আমাদের ব্যাপার। আপনার কিছু না।
ফিরোজ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল— আমি আসলে জানতে চাচ্ছি।–নিখোঁজ মানুষের বিষয়ে আপনারা কি করেন।
সব থানায় ইনফর্ম করা হয়।
তারপর?
তারপর মানে?
সব থানায় আপনারা জানালেন-তারপর থানাগুলি থেকে কি করা হয়।
সেকেন্ড অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন, সত্যি কথা জানতে চান? কিছুই করা হয় না।
কিছুই করা হয় না?
কি করা হবে? আপনার কি ধারণা থানার স্টাফ হারিকেন জ্বলিয়ে আপনার ভাইকে খুঁজতে বের হবে? খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি দেখেই এরা কুল পায় না মানুষ খুঁজে বেড়াবে কখন?
রেকর্ডের জন্যে দেই! একটা রেকর্ড থাকল। থানার রেকর্ডের গুরুত্ব অনেক বেশী। এই রেকর্ড থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বের হয়ে আসে। এমনওতো হতে পারে যে আপনি আপনার ভাইকে খুন করে ডেডবডি গুম করে থানায় এসে জিডি এন্ট্রি করালেন ভাই মিসিং। হতে পারে না?
জ্বি না, হতে পারে না।
আপনার কাছে হতে পারে না, কিন্তু অনেকের কাছে হতে পারে। আমার চাকরি বেশীদিন হয় নি—এর মধ্যেই এ ধরনের কেইস গোটা দশেক দেখেছি।
বলেন কি?
খুব বেশী দুঃশ্চিন্তা করবেন না। অল্প বয়েসী মেয়ে-টেয়ে হারিয়ে গেলে টেনশানের ব্যাপার থাকে। মেয়েরা ব্রেথেলে চলে যায়। বিদেশে চলে যায়। যৌনকামী হিসেবে বিদেশে বাংলাদেশী মেয়েদের সুনাম আছে।
কি বলছেন এসব?
শুনতে খারাপ লাগছে? সত্যি কথা শুনতে সব সময় চিরতার পানির মত লাগে। চিরতার পানি খেয়েছেন? না খেলে খাবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খেতেন। শরীরের জন্যে ভাল। শরীরটা ভাল রাখুন—Health is Wealth.
তাহলে আমি কি ধরে নেব— আপনারা আমার নিখোজ ভাই সম্পর্কে কিছু করবেন না?
কিছুই ধরে নেবেন না। একটা ভাল উপদেশ দেই শুনুন— ভাইয়ের ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে থাকুন। চালু পত্রিকাগুলিতে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দিন। খবৰ্দার, কোন পুরস্কার ঘোষণা করবেন না। পুরস্কার ঘোষণা করেছেন কি মরেছেন। জীবন অতিষ্ট হয়ে যাবে। ভাল একটা উপদেশ ফি ছাড়া আপনাকে দিলাম।
গত কয়েক মাসে ফিরোজের অন্যতম ও প্রধান কাজ হয়েছে উপদেশ শোনা। এবং প্রতিটি উপদেশ মানার চেষ্টা করা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। শুরুতে প্রতিদিন। তারপর সপ্তাহে একদিন। তারপর একটি পত্রিকায় প্রতি পনেরো দিনে একবার। শুধু দেশী পত্রিকায় না—একজনের উপদেশ শুনে কোলকাতার আনন্দবাজার এবং স্টেটসম্যানেও বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
আরেকজনের উপদেশ শুনে জাতিসংঘের মিসিং পারসন বুরোতে কুড়ি ডলার খরচ করে নাম এন্ট্রি করিয়েছে। এরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চল এবং শরণার্থী মিসিং পারসনের তালিকা তৈরী করে।
একজন ফিরোজকে বলল ( ফিসফিসানি গলায় ) পাসপোর্ট অফিসে খোজ নাও তোমার ভাই রিসেন্টলি কোন পাসপোর্ট করিয়েছে কি-না। মানুষের ভেতরে অনেক জটিলতা থাকে— চট করে বোঝা যায় না। আমি একজনকে জানি ফ্যামিলী ম্যান। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যার জন্যে অসীম মমতা। হঠাৎ সে মিসিং পারসন হয়ে গেল। পাসপোর্ট অফিসে খোজ নিয়ে জানা গেল সে পাসপোর্ট করিয়েছে। সেই পাসপোটের সূত্র ধরে জানা গেল সে চলে গেছে অস্ট্রেলীয়ায়। খুব পাকাপাকিভাবে গিয়েছে ইমিগ্রেশন নিয়ে। অন্য একটা মেয়েকে বউ হিসেবে নিয়ে গেছে। কাজেই আমার মতে পাসপোর্ট অফিসে খোজ নেয়া খুবই জরুরী। অফিসিয়েলী এইসব কাজে অনেক সময় লাগে। দালাল ধরলে এক সপ্তাহের মধ্যে জানতে পারবে। হাজার খানিক টাকা খরচ হবে।
হাজার খানিক না— ফি রোজের তিন হাজার টাকা খরচ হল। তিন হাজার টাকার বিনিময়ে জানা গেল— হাসানুজ্জামানের নামে কোন পাসপোর্ট ইসু হয়নি।
একজন গম্ভীর মুখে বলল— মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্ৰ-ছাত্রীদের জন্যে ডেড বডি কেনা হয় আপনি জানেন? সাধারণত কেনা হয় বেওয়ারিশ লাশ। বেওয়ারিস লাসের একটা ভাল মার্কেট বাংলাদেশে আছে। ঐসব জায়গায় খোজ নিয়েছেন? খোজটা নিতে হবে গোপনে। ডোমদের মাধ্যমে। এইসব বিজনেসে অনেক হ্রস হাস ব্যাপার আছে।
তুস হাস ব্যাপার মানে?
ফিসি ব্যাপার। আমার এক দূর সম্পর্কের রিলেটিভ, সম্পর্কের চাচা-তাঁর বড় ছেলে হঠাৎ হারিয়ে গেল। ওদের টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল না। বিরাট ক্ষমতাবান। এরা প্ৰায় তোলপাড় করে ফেলল। যাকে বলে কম্বিং অপারেশন। শেষে ছেলেটার ডেড বডি কোথায় পাওয়া গেল জানেন?
কোথায়?
মেডিক্যাল কলেজের ডিসেকসান রুমে। ছাত্ৰ-ছাত্রীরা ডেডবডি কাটাকুটি করছে— লিভার এক জায়গায়, কিডনী আরেক জায়গায়। হার্ট আরেক গামলায়। কাজেই খোঁজ খবর যখন করছেন ভালমত করেন— Leave no stone unturned.
ফিরোজ এখন ক্লান্ত এবং বিরক্ত। বিরক্তিটা কার উপর সে জানে না। সম্ভবত তার ভাইয়ের উপর। মানুষটা হারিয়ে গিয়ে সবচে বড় বিপদে তাকে ফেলে দিয়ে গেছে। দুপুর দুটায় ক্ষিধে পেটে পৃথিবীর সবচে বোরিং মানুষটার সামনে তাকে হাসিমুখে বসে থেকে— পরকাল, ইএসপি, ক্লেরিওভান্স, এসট্রেল, প্রজেকসন সম্পর্কে গল্প শুনতে হচ্ছে। কোন মানে হয়? কোন মানে হয় না। ফিরোজের এখন ইচ্ছা করে নিজেরই নিরুদেশ হয়ে যেতে। এক সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খাবে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। তারপর ভাল একটা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে হাসি মুখে ঘর থেকে বের হওয়া এবং আর ফিরে না আসা।
রকিব সাহেব বাসায় ছিলেন। একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলল, আব্ববুর জ্বর শুয়ে আছে। ফিরোজ বলল, আমি কি চলে যাব? ছেলেটি বলল, আপনাকে বসতে বলেছে।
রকিব সাহেব এক ঘণ্টা পর গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে উপস্থিত হলেন। ফিরোজ উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনার নাকি জুর?
রকিব সাহেব বললেন, শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে। পর পর কয়েকদিন রাত জাগলাম। বয়স হয়েছে আগের মতো রাত জগতে পারি না।
ফিরোজ বলল, আমার ভাইয়ের ব্যাপারে কোন ইনফরমেশন কি পেয়েছেন?
রকিব সাহেব হাসি মুখে বললেন—— চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে পেয়ে যাব। আমাদের ইনফরমেশন গোদারিং টেকনিকটা একটু আলাদা। আমাদেরতো ফ্যাক্স মেইল, ই মেইল নেই। আমাদের যোগাযোগটা হয় মানসিক ভাবে সময় লাগে।
জ্বি, বুঝতে পারছি।
না, বুঝতে পারছেন না। বোঝাটা এত সহজ না। একটা ঘটনা বলি শুনুন। ঘটনা শুনলে আমাদের যোগাযোগ পদ্ধতিটা সম্পর্কে আপনার ধারণা হবে।
রকিব সাহেবের যোগাযোগ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা নেবার কোন ইচ্ছা! ফিরোজের নেই। সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত পুরো ব্যাপারটাই ভাওতাবাজি। ক্ষিধেয় তার নাড়িভুড়ি হজম হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। তার উচিত এই বাড়ি থেকে বের হয়েই সোজা কোন রেস্টুরেন্টে ঢুকে গরুর ভুনা মাংস এবং গরম গরম পরোটার অর্ডার দেয়া। সঙ্গে কাটা পেয়াজ থাকবে। মাঝে মধ্যে পেয়াজে কামড়। প্রচন্ড ক্ষিধের সময় হঠাৎ হঠাৎ কিছু খাবার খেতে ইচ্ছে করে। আজ পরোটা গোসত খেতে ইচ্ছা করবে। অন্য কোনদিন অন্য কোন খাবার খেতে ইচ্ছে করবে।
ফিরোজ সাহেব!
জ্বি।
আপনার কি শরীর খারাপ না-কি? চেহারা কেমন যেন মলিন লাগছে।
জ্বি না, শরীর ভাল আছে।
চা খান। চা খেতে খেতে গল্প করি। আপনার মনের শান্তির জন্যে বলে রাখি–আপনার ভাই-এর ব্যাপারে। আমি অনিতাকে বলেছিলাম। অনিতা আমাদের থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য, অত্যন্ত পাওয়ারফুল মিডিয়াম। সে আমাকে জানিয়েছে এক সপ্তাহের মধ্যে পজিটিভ কিছু বলতে পারবে।
আমি কি এক সপ্তাহ পরে আসব?
আসুন। আগামী বুধবারে আসুন। রাত দশটার পর আসুন। অসুবিধা হবে নাতো?
জ্বি না।
ঐ রাতে আমাদের একটা সিয়েন্সও হবে। ইচ্ছে করলে অবজার্ভার হিসেবে থাকতে পারেন। সোসাইটির বাইরের কারোর থাকার অবশ্যি নিয়ম নেই। তবে আপনার ব্যাপারে আমি বলে টলে ব্যবস্থা করে রাখব।
জি আচ্ছা।
এখন শুনুন, আমার জীবনের একটা অদ্ভুত ঘটনা। চার বছর আগের কথা। অক্টোবর মাস। তারিখটা হল ৯ তারিখ। সন্ধ্যাবেলা এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন। বছর দুই আগে তাঁর একটা মেয়ে মারা গেছে। কিছুদিন হল রোজ মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখছেন। মৃতা মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। আমরা কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারি কি-না। তিনি সঙ্গে করে মেয়ের কিছু ব্যবহারী জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। মেয়ের ছবি এনেছেন। তার হাতে লেখা ডাইরী এনেছেন। আমি বললাম, রেখে যান দেখি কিছু করা যায় কি-না। মৃত মানুষের আত্মাকে চক্রে আহবান করা কঠিন কিছু না। তবে অল্প বয়সে মারা গেলে সমস্যা হয়। প্লানচেটে বা চক্রে শিশুদের আহবান করার নিয়ম নেই।
আহবান করলেও তারা আসে না।
ফিরোজ জড়ানো গলায় বলল— ও। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে সোফায় সে এলিয়ে পড়বে এবং তার নাক ডাকতে শুরু করবে। ভদ্রলোক একটা ভয়ংকর গল্প ফেদেছেন, এরমধ্যে নাক ডাকানো ভয়াবহ ব্যাপার হবে। ঘুম কাটানোর কিছু পদ্ধতি সে ব্যবহার করছে – লাভ হচ্ছে না। উল্টা আরো ঘুম পাচ্ছে। সব পদ্ধতিই কোন না কোন সময়ে ব্যাক ফায়ার করে–উল্টো দিকে চলা শুরু করে। তার বেলায় এখন তাই হচ্ছে।
ভয়ংকর কোন ঘটনার কথা ভাবলে ঘুম কেটে যায়। সে ভাবছে— বাসায় পৌঁছেই দেখবে তার মা আকলিমা বেগম আঁকা বঁকা অক্ষরে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন–চিঠির প্রতিটি সংবাদই দুঃসংবাদ। বাবা ফিরোজ, তুমি জমি বিক্রি করিয়া টাকা পাঠাইতে বলিয়াছ। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছি। লোকজনের হাতে এখন টাকা নাই। জমি কিনিবার ব্যাপারে কাহারো আগ্ৰহ নাই। তুমি মহা বিপদে পরিয়াছ ইহা আমি জানি– কিন্তু কি করিব আমি নিরুপায়।…
ফিরোজ সাহেব!
জ্বি স্যার।
আপনার জুর-টির আসছে না-কি? চোখ লাল।
বোধ হয় জ্বর আসছে–আজি বরং উঠি।
গল্পের শেষটা শুনে যান। শেষটা না শুনলে মনের উপর চাপ থাকে। এই চাপ মানসিক শান্তির জন্যে ক্ষতিকর। তারপর কি হল শুনুন— আমরা কয়েকটা সিয়েন্স করলাম এবং প্রতিবারই রিডিং পেলাম মেয়েটা জীবিত। মৃত নয়। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?
জ্বি।
আমার নিজের ধারণা হল আমরা কিছু ভুল করছি। আত্মার অনেকগুলি স্টেট থাকে। নানান স্তরে তাদের বাস। পৃথিবীর কাছাকাছি যারা থাকে তাদের
ফিরোজ বাসায় পৌঁছল। জ্বর নিয়ে। তার ঝোঁপে জ্বর এসেছে। জ্বর আসায় একটা সুবিধাও হয়েছে—পরোটা গোসতের ব্যাপারটা মাথা থেকে চলে গেছে। এখন ইচ্ছা করছে কাঁথার ভেতর ঢুকে পড়তে। দরজা জানালা বন্ধ করে কাঁথার ভেতরে ঢুকে কুণ্ডুলী পাকিয়ে যাওয়া। মোটামুটি মাতৃগর্ভের মত একটা পরিবেশ তৈরি করে জন্মের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। এই স্টেটেরও নিশ্চয় কোন নাম আছে। থিওসফিস্ট রকিব সাহেব বলতে পারবেন।
দরজা খুলে দিল ইমন। সে দরজা খোলা শিখেছে। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সিটিকিনি খুলতে পারে। এবং এই কাজটা খুব আগ্রহের সঙ্গে করে। ফিরোজ বলল, খবর কিরে?
ইমন বলল, মা তোমাকে ডাকে।
ফিরোজ বিরক্তমুখে বলল, মা আমাকে ডাকবে কিরে ব্যাটা, আমিতো এইমাত্র ঢুকলাম। ভাবীতো জানেই না। আমি এসেছি।
ইমন আবারো বলল, মা তোমাকে ডাকে।
ইমনের মধ্যে রোবট টাইপ কিছু ব্যাপার আছে। মাথার ভেতর কিছু ঢুকে গেলে সেটাই বলতে থাকে। ফিরোজ বলল, যাচ্ছি। হাত মুখ ধুয়ে তারপর যাই। বুঝলিরে ব্যাটা, শরীর ভাল না। থার্মোমিটার না দিয়েও বুঝতে পারছি— একশ তিন জ্বর।
মা তোমাকে এখনই ডাকে।
ফিরোজ সুরাইয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। খাটে বিছানো শাদা চাদর রক্তে মাখামাখি। চাদর থেকে গড়িয়ে মেঝেতেও ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। সুরাইয়ার মুখ ছাই বর্ণ। প্রচণ্ড ব্যথা সে নিজের মধ্যে চেপে রাখছে তা বোঝা যাচ্ছে শুধু তার কণ্ঠার হাড়ের ওঠানামা দেখে।
ভাবী, কি হয়েছে?
সুরাইয়া ফিস ফিস করে বলল— বুঝতে পারছি না। বোধ হয় এবোরশন হয়ে যাচ্ছে।
কি সর্বনাশের কথা। ভাবী আমি এক্ষুনি এম্বুলেন্স নিয়ে আসছি। তুমি আর কিছুক্ষণ। এইভাবে থাক।
সুরাইয়া জবাব দিল না। ঘোলাটে চোখে তাকাল। সেই ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে ফিরোজের মনে হল— এম্বুলেন্স আনতে গিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। এত সময় হাতে নেই। তাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে ভাবীকে পাজাকোলা করে নিয়ে এক্ষুনি রাস্তায় চলে যেতে হবে।— কোন একটা বেবী টেক্সিতে উঠে বেবী টেক্সীওয়ালাকে বলতে হবে–তাড়াতাড়ি মেডিকেলে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি।
কোলে নিয়ে বসে আছে। ফিরোজের পাশে ইমন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না–সে খুব ভয় পাচ্ছে। সে অবশ্যি তার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছেও না। সে বেবীটেক্সীর সাইডের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে আছে। এই আয়নায় বেবীটেক্সীওয়ালার মুখ দেখা যাচ্ছে। বেবীটেক্সীওয়ালার মুখ দেখতে ভাল লাগছে। কেমন গোল মুখ। চোখ দুটিও মার্বেলের মত গোল। এর মধ্যে একবার সে শুধু তার ছোট চাচার দিকে তাকিয়েছে। ছোট চাচা খুব কাঁদছেন। শব্দ করে কাঁদছেন না–তবে তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ছোট চাচার কান্না দেখে তার মনে হচ্ছে— মা মারা গেছেন। এখন থেকে সকালে কে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে? ছোট চাচা? স্কুল থেকে ফেরত নেবার সময় ছোট চাচা সময় মত আসবে তো? দেৱী করে এলে তার খুব খারাপ লাগবে। কষ্ট হবে।
সুরাইয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল সন্ধ্যা ছটায়। রাত তিনটায় ডাক্তাররা তাকে অপারেটিং রুমে নিয়ে গেলেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল না। রুগী সম্পর্কে তারা খুব আশাবাদী। কিছু একটা করতে হয় বলেই অপারেটিং রুমে নিয়ে যাওয়া।
ইমন একটা বেঞ্চে একা একা বসেছিল-এত রাত হয়েছে তারপরেও সে জেগে আছে। ঘুম পাচ্ছে না। ছোট চাচা তাকে একটা কলা একটা বনরুটি কিনে দিয়েছেন। সে কলা এবং বনরুটি হাতে বসে আছে। ছোট চাচা খুব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছেন। একবার ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন, একবার ওষুধ কিনতে যাচ্ছেন, একবার যাচ্ছেন রক্তের জন্যে। তবে কিছুক্ষণ পর পর এসে ইমানকেও দেখে যাচ্ছেন।
ভোর চারটায় ছোট চাচা এসে ইমানকে বললেন–ইমন তোর একটা বোন হয়েছে। তোর বোনটা ভাল আছে, তোর মাও ভাল আছে। আর কোন চিন্তা নেই।
ইমন বলল, বোনটার নাম কি?
নাম এখনো রাখা হয় নি।
নাম রাখা হয় নি কেন?
ছোট চাচা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন— আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। তুই কলাটা এখনো খাস নি?
না।
আমাকে দে খেয়ে ফেলি–ক্ষিধেয় চোখে অন্ধকার দেখছি।
ফিরোজ কলা খেয়ে বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল। ইমন ছোট চাচার মাথার কাছে জেগে বসে রইল। তার মনে হচ্ছে জেগে থাকাটা খুব দরকার। বেঞ্চটার পাশে চওড়া কম। ছোট চাচা যে কোন সময় গড়িয়ে পড়ে যেতে পারেন। পাহারা দেয়ার জন্যে তাকে জেগে থাকতে হবে।
তার একটা বোন হয়েছে। অথচ তার নাম রাখা হয় নি এই চিন্তাটাও তাকে অভিভূত করছে। সবারই নাম আছে শুধু তার বোনটার কোন নাম নেই। যদি নাম রাখতে ভুলে যায়, যদি কোনদিনই তার নাম না রাখা হয় তাহলে কি হবে? মন খারাপ করে বেচারী ঘুরে বেড়াবে। কেউ তাকে খেলতে ডাকবে না— কি করে ডাকবে, মেয়েটারতো নামই নেই।
চোখে এক ফোঁটা পানি আসে নি—এখন এই ভোর রাতে বোনটার দুঃখে। তার চোখে পানি এসে গেল। সে যতবারই সার্টের হাতায় চোখ মুছে ততবারই চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। তার একটা বোন হয়েছে সেই বোনটার নাম নেই কেন?
চলবে…