অপেক্ষা পর্ব-৩

0
289

অপেক্ষা
পর্ব-৩
__হুমায়ূন আহমেদ
ইমন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে চিকন করে কাটা এক টুকরা শশা। ছোট চাচা বলেছেন কচ্ছপের বাচ্চারা শশা খায়। ইমনের ধারণা কচ্ছপের বাচ্চারা শশা খায় না। সে অনেকক্ষণ ধরেই শশা হাতে বসে আছে তার কাছ থেকে তো খাচ্ছে না। বরং শশার টুকরা মুখের কাছে ধরতেই এরা মুখ হাত পা খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে শশা ওদের জন্যে ভয়ংকর কোন খাবার। মানুষের বাচ্চাদের কাছে দুধ যেমন ওদের কাছে শশাও তেমন।
কচ্ছপের বাচ্চা দুটা ইমনের জন্যে এনেছে তার ছোট চাচা। এরা বেশীর ভাগ সময় থাকে বাথরুমে লাল প্লাষ্টিকের বালতিতে। মাঝে মাঝে ইমনের যখন খেলতে ইচ্ছে করে তখন সে বালতি থেকে তুলে আনে। পানি থেকে তোলার সময় তার একটু ভয় ভয় করে। কামড় দেয় কি-না। এখন পর্যন্ত কামড় দেয়নি। ছোট চাচা বলেছেন–কচ্ছপের বাচ্চাদের দাঁত নেই বলে তারা কামড়ায় না। যখন তারা বড় হবে, দাঁত উঠবে তখন কামড়াবে। তখন তাদের আর বালতিতে রাখা যাবে না–নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। যে নদীতে কচ্ছপ ফেলা হবে সেই নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। ঢাকা নগরী বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত।
ইমনের আজ স্কুল নেই। সে সকাল থেকেই কচ্ছপের বাচ্চা নিয়ে খেলছে। এদের সে নামও দিয়েছে—বড়টার নাম টম, ছোটটার টমি। এরা দুজন একসঙ্গে থাকলেও দুজনের মধ্যে কোন মিল নেই। শুকনায় ছেড়ে দেয়া মাত্র দুজন দুদিকে হাঁটতে থাকে। ইমন বই এ পড়েছিল কচ্ছপরা আস্তে হাঁটে। এখন সে জানে এটা মিথ্যা কথা। এরা চারপায়ে বেশ দ্রুত হাঁটে। মুহুর্তের মধ্যে ঘরের কোনায় চলে যায়। তাদের তখন খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়। সবচে বেশী দ্রুত হাটে টমি। ইমন ভেবে রেখেছে তার ছোট বোনটা যখন আরেকটু বড় হবে তখন তাকে সে একটা কচ্ছপের বাচ্চা দিয়ে দেবে। ইমনের ছোট বোনের নাম— সুপ্ৰভা। মা বলেছেন, সুপ্ৰভা নামের মানে হচ্ছে—সুন্দর সকল! Good Morning, কিন্তু ছোট চাচা বলেছেন সুপ্ৰভা মানে সুন্দর আলো। কারটা ঠিক সে জানে না। ইমন ঠিক করে রেখেছে কোন একদিন সে তাদের মিসকে জিজ্ঞেস করবে।
সুপ্ৰভা এখনো খুবই ছোট। বেশীর ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে তখন সে কাদার জন্যে জাগে। খানিকক্ষণ কেঁদে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ইমন তার সারা জীবনেও এমন কাদুনে বাচ্চা দেখেনি। সবচে মজার ব্যাপার হচ্ছে সুপ্ৰভা কারো উপর রাগ করে বা ব্যথা পেয়ে কাঁদে না। কোন রকম কারণ ছাড়া কাঁদে। সুপ্রভার কান্না দেখতে ইমনের খুব ভাল লাগে। সে মাঝে মাঝে সুপ্রভার কান্না দেখতে যায়। কিন্তু বেশীক্ষণ দেখতে পারে না, কারণ তার মা কঠিন গলায় বলেন, এখানে কি করছ? যাওতো—অন্য খানে যাও। আশ্চর্য, এত বিরক্ত করে।
আগে ইমন কখনো তার মাকে ভয় পেত না, এখন পায়। কারণ মার মেজাজ। সারাক্ষণ খারাপ থাকে। আগে মা তাকে পড়াতে বসতো—এখন বসায় না। সে যদি বই খাতা নিয়ে মার কাছে যায়—ম বলে, অনেক বিরক্ত করেছ। এখন যাও তো। অথচ সে কাউকেই বিরক্ত করে না। এমন কি কচ্ছপগুলিকেও না। কোন কচ্ছপ যদি দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে—সে তাকে লুকিয়ে থাকতে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বের করে আনে না। ওরা কচ্ছপ হলেও ওদেরও হয়ত লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছা করে। সে কেন ওদের খেলা নষ্ট করবে?
হোম ওয়ার্ক করার জন্যে সে এখন যায় ছোট চাচার কাছে। ছোট চাচা তাকে মোটামুটি আদরই করেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন—হার্ড নাট। হার্ড মানে হচ্ছে শক্ত, আর নাট হল বাদাম। হার্ড নাট হল শক্ত বাদাম। ছোট চাচা তাকে কেন শক্ত বাদাম বলে তা সে জানে না। কখনো জিজ্ঞেস করে নি। কোন একদিন জিজ্ঞেস করবে। ছোট চাচা পড়াতে পড়াতে প্রায়ই বলে—কিরে হার্ড নাট, মন খারাপ?
সে বলে, না। কারণ তার মন খারাপ থাকে না, আবার মন ভালও থাকে না। সুপ্রভার সঙ্গে সে যদি গল্প করতে পারত। তাহলে তার মন ভাল থাকতো। বা মার সঙ্গে গল্প করতে পারলেও মন ভাল থাকতো। মা গল্পতো করেই না, সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও বলে–যা ভাগ। সামনে থেকে যা। শুধু বিরক্ত শুধু বিরক্ত। একদিন ঠাশ করে একটা চড় ও মারলেন, আচমকা মারলেন বলে সে মেঝেতে পড়ে গেল। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে লাগল। তারপরেও সে একটুও কাঁদে নি, শুধু ডাক্তার যখন ঠোঁট সেলাই করতে গেলেন—তখন কাঁদল। তারপরেও ডাক্তার বললেন, বাহ দারুণ ছেলেতো। ছেলের খুব সাহস। ছোট চাচা বললেন, সাহস হবে না, এ হল হার্ড নাট! এ মোটেই সহজ জিনিস না।
রিকশায় ফেরার পথে ছোট চাচা তাকে আইসক্রিমের দোকানে নিয়ে গেলেন। কাপ আইসক্রীম কিনে দিয়ে বললেন, শোন হার্ড নাট। তোর মার মেজাজতো এখন খুব খারাপ থাকে। এখন তাকে বিরক্ত করবি না।
ইমন অবাক হয়ে বলল, আমিতো তাকে বিরক্ত করি না।
জানি তুই বিরক্ত করিস না। তারপরেও যখন বিরক্ত হয় তখন আমাদের উচিত একটু দূরে দূরে থাকা।
মার মেজাজ কখন ঠিক হবে চাচা?
তোর বাবা ফিরে এলেই মেজাজ ঠিক হবে।
বাবা কখন ফিরবে?
এখনো ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে ফিরবেতো বটেই। কত দিন আর বাইরে থাকবে?
বাবা এখন কোথায়?
আমরা এখনো ঠিক জানি না।—মনে হয় ইণ্ডিয়ায়।
ইণ্ডিয়াতে?
হুঁ। ইণ্ডিয়ার মধ্যপ্রদেশে। সেখানে খুব জঙ্গলতো। আমার মনে হয় বনে জঙ্গলে ঘুরছে। বাসার কথা একসময় মনে পড়বে তখন হুট করে চলে আসবে।
ইমনের ধারণা ছোট চাচা ঠিক কথা বলছেন না। বাবা ইণ্ডিয়ার মধ্যপ্রদেশে থাকলে ছোট চাচা গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসতেন। বাবা অন্য কোথাও আছেন। খুব কাছেই কোথাও। ইমন যখন রিকশা করে স্কুলে যায় তখন তিনি হয়ত আড়াল থেকে দেখেন। তাদের স্কুলে যখন টিফিনের ছুটি হয় তারা মাঠে খেলতে থাকে তখনও তিনি দেখে যান। একদিন তিনি • চলে আসবেন এ ব্যাপারে ইমন নিশ্চিত। এত দেরী হচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে। না। বেশী দেরী হলে কচ্ছপগুলি দেখতে পারবেন না। কচ্ছপগুলি বড় হয়ে যাবে। তাদের ফেলে দিয়ে আসতে হবে বুড়িগঙ্গায়। ওরা নদীর পানির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে সমুদ্রে। বঙ্গোপসাগরে। সেখান থেকে ভারত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগর থেকে প্ৰশান্ত মহাসাগরে। ছোট চাচা তাই বলেছেন।
বাবা সম্পর্কে লোকজন প্রায়ই তাকে জিজ্ঞেস করে। তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভাল লাগে না। ভাল না লাগলেও সে সহজ ভাবেই জবাব দেয়। তাদের ক্লাসের মিস (মিস ফারজানা, দেখতে খুব সুন্দর।) একদিন টিফিন টাইমে তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইমন তোমার বাবা না-কি তোমাদের ছেড়ে চলে গেছেন?
ইমন বলল, উনি বেড়াতে গেছেন।
বেড়াতে গেছেন? কোথায় বেড়াতে গেছেন?
ইণ্ডিয়াতে— মধ্যপ্রদেশে।
মিস ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, মধ্যপ্রদেশে? এত জায়গা থাকতে মধ্যপ্রদেশে কেন?
মধ্যপ্রদেশে অনেক বড় বড় জঙ্গল। বাবা জঙ্গল দেখতে গেছেন।
ও আচ্ছা, খুব ভাল কথা। উনি কি তোমার মার সঙ্গে রাগ করে চলে গেছেন?
জ্বি-না। বাবা কারোর সঙ্গে রাগ করে না।
তোমার মা, তিনি রাগ করেন?
জ্বি করেন।
কার সঙ্গে রাগ করেন?
বুয়ার সঙ্গে করেন, ছোট চাচার সঙ্গে করেন। মা রোগাতো এইজন্যে মার অনেক রাগ। রোগা মানুষদের খুব রাগ থাকে।
রোগা মানুষদের খুব রাগ থাকে এটা কে বলল?
ছোট চাচা বলেছেন। উনিও রোগা এই জন্যে উনারও খুব রাগ।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।
ইমন মার রাগের জন্যে খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। টিভিতে কার্টুন দেখার সময় সাউণ্ড খুব কমিয়ে দেয়। মা খুব যখন হৈ চৈ করতে থাকেন তখন সে টিভির সাউণ্ড পুরোপুরি অফ করে দেয়। সাউন্ড ছাড়া কার্টুন দেখতে তার খারাপ লাগে না। সাউন্ডগুলি ভেবে নেয়। কোন দৃশ্যে কি রকম সাউন্ড হবে এখন সে মোটামুটি জানে।
মা যখন অন্যদের উপর রাগ করে তখন ইমনের তেমন খারাপ লাগে না, কিন্তু যখন সুপ্রভার উপর রাগ করেন তখন খুব খারাপ লাগে, কাঁদতে ইচ্ছা করে। সুপ্রভার উপর মা প্রায়ই রাগ করেন।
সুপ্ৰভা কেঁদে গলা ফাটিয়ে ফেলছে–মা ফিরে তাকাচ্ছেন না। বুয়া এসে যদি বলে—আপু কানতাছে। তখন মা তীব্রগলায় বলেন, কাঁদছে। কাদুক তুমি তোমার কাজ কর। কাজ ফেলে চলে এসেছ কেন? ছোট চাচা এক সময় উঠে এসে বলেন, ভাবী বাচ্চাটার কি হয়েছে? মা তখন বিরক্ত গলায় বলেন, জানি না কি হয়েছে। ওর মনের খবর আমি জানব কি ভাবে?
কাঁদতে কাঁদতেতো গলা ভেঙ্গে ফেলছে।
গলা ভেঙ্গে মরুক।
ভাবী এইসব কি কথা বলছেন?
আমার যা মনে আসছে বলছি, তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে?
হ্যাঁ, অসুবিধা হচ্ছে। বাচ্চাটা পেটের ক্ষিধেয় কাঁদছে, আপনি ফিরে তাকাচ্ছেন না, এটা কেমন কথা।
তুমি এমন চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলছি কেন? তোমার ভাইতো কখনো মুখ শক্ত করে এমন ভাবে কথা বলেনি।
চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলার জন্যে আমি সরি। ভাবী শুনুন, ফর গডস সেক, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার চেষ্টা করুন।
ভাইজানের জন্যে কষ্ট শুধু আপনি একা পাচ্ছেন আর কেউ পাচ্ছে না। এটা আপনি কি করে ভাবছেন? কষ্ট পাচ্ছেন ভাল কথা-কিন্তু একটা দুধের শিশুকে কষ্ট দেবেন। কেন? তার অপরাধটা কোথায়?
খবৰ্দার, তুমি আমার সঙ্গে চোখ লাল করে কথা বলবে না।
ভাবী আমি চোখ লাল করে কথা বলছি না, আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি— ওকে দুধ খেতে দিন।
নাটক করবে না। নাটক আমার ভাল লাগে না—একে তোমরা নিয়ে কোথাও পালক দিয়ে দাও।
আচ্ছা ভাবী ঠিক আছে, তাই করব। আপাতত আপনি একে সামলান।
এই পর্যায়ে মা সুপ্ৰভাকে কোলে নেন। সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না থেমে যায়। তখন কান্না পেয়ে যায় ইমনের। সে ছোট চাচার ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করে। ছোট চাচা গম্ভীর গলায় বলেন, ইমন তোকে কেউ মেরেছে?
ইমন ফোঁপাতে ফোপাতে বলে, না। মারে নি।
তোকে কেউ বকা দিয়েছে?
না।
জানি না। পুরুষ মানুষ কি কাঁদতে পারে?
না।
ফোঁস ফোঁস করতে পারে?
না।
হেঁচকি তুলতে পারে?
না।
তুইতো একই সঙ্গে কাঁদছিস, ফোঁস ফোঁস করছিস এবং হেঁচাকি তুলছিস। তিনটা নিষিদ্ধ জিনিশ করছিস। চোখ মুছে কচ্ছপ নিয়ে আয়—একটা মজা দেখাব।
কি মজা?
আগে নিয়ে আয়, তারপর দেখবি।
ইমন কচ্ছপ নিয়ে এল। ফিরোজ কচ্ছপ দুটা উল্টা করে মেঝেতে রেখে দিল। এরা খোলসের ভেতর থেকে মাথা এবং পা বের করে সোজা হবার চেষ্টা করছে, পারছে না। ফিরোজ হৃষ্ট চিত্তে বলল, এই হচ্ছে মজা।
কি মজা?
যত চেষ্টাই করুক, এরা এখন আর সোজা হতে পারবে না। ছটফট করবে। কিন্তু পারবে না। বাইরের কোন সাহায্য লাগবে। তুই বা আমি যদি সোজা করে দি, তাহলেই সোজা হতে পারবে। মজাটা এইখানেই। মানুষেরও মাঝে মাঝে কচ্ছপের মত অবস্থা হয়। মানুষ উল্টে যায়। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করতে থাকে, ঠিক হতে পারে না। বাইরের সাহায্য ছাড়া ঠিক হওয়া তখন সম্ভব না। তোর মার এখন এই অবস্থা চলছে। সে উল্টে গেছে। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করছে, কিন্তু পারছে না। কাজেই তোর মার উপর রাগ করেও কোন লাভ নেই। মার উপর তোর রাগ নেইতো?
না নেই।
ভেরীগুড। আরেকটা কথা–যদি কোন কারণে খুব মন খারাপ হয় তখন কচ্ছপ উল্টে দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবি–তখন দেখবি মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।
কেন?
কেন কেন করবি না। চড় খাবি।
আচ্ছা করব না।
 
আজি ইমনের মন সামান্য খারাপ। বেশী না সামান্য। এই সামান্য মন খারাপ নিয়ে কচ্ছপ উল্টানো যায় না বলে সে উল্টাচ্ছে না–শশার টুকরা কেটে খেতে দিচ্ছে। এরা খাচ্ছে না। হাতে ধরে থাকলে এরা খায় না, কিন্তু পানিতে ছেড়ে দিলে মুখ বের করে কুট কুট করে খায়।
ইমন। এদিকে শুনে যাও।
ইমনের বুক ধ্বক করে উঠল। আগে মা ডাকলে আনন্দ লাগতো, এখন মা ডাকলেই বুক ধ্বক করে উঠে। ইমন কচ্ছপ দুটা বালতিতে রেখে মার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়াল। মা সুপ্রভার গায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। তিনি চোখ সরু করে তাকালেন। ইমনের বুক শির শির করতে লাগল।
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কাছে আস।
ইমন ঘরে ঢুকল।
হাত ভেজা কেন? আবার কচ্ছপ নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করছিলে? হাত ধুয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছ?
ইমন সাবান দিয়ে হাত ধোয়নি-তারপরেও ভয়ে ভয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সে জানে এই মিথ্যা মাথা নাড়ার জন্যে তার বা কাধের ফেরেশতা পাঁচটা বদি লিখেছে। ফেরেশতার নাম কেরামান কাতে।বিন। তার কাজ মানুষের খারাপ কাজগুলি লেখা এবং কোন খারাপ কাজের জন্যে কয়টা বদি হয়েছে তার হিসাব রাখা। দাদীজান তাকে বলেছেন।
দেখি হাত কাছে আন। সাবানের গন্ধ আছে কি-না দেখি।
ইমন হাত এগিয়ে দিল। মা গন্ধ শুকলেন। মনে হল তিনি সাবানের গন্ধ পেয়েছেন। কারণ কিছু বললেন না। সাবানের গন্ধ পাওয়ার কথা না। সে হাতে সাবান মাখে নি। কচ্ছপ ঘাটা ঘাটি করেছে। মনে হয় কচ্ছপের গায়ে সাবানের গন্ধ আছে। কচ্ছপ শুকে দেখতে হবে।
সুরাইয়া  বলল, তোমার বোনটা দেখতে কি রকম হয়েছে? কার মত হয়েছে?
ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, ছোট বাচ্চাদের মত হয়েছে।
বোকার মত কথা বলছ কেন? ছোট বাচ্চাতো ছোট বাচ্চার মতই হবে। বুড়োদের মত হবে নাকি? দেখতে কার মত হয়েছে? তোমার মত, না আমার মত, নাকি তোমার বাবার মত?
জানি না মা।
জানবে না কেন? দেখতে হয়েছে অবিকল তোমার বাবার মত। তোমার বাবার নাক অনেকটা চাপা। এই দেখ এর নাকিও চাপা! চাপা না?
ইমন বুঝতে পারছে না, নাক চাপা কি চাপা না। তার কাছেতো নাকটা সুন্দরই লাগছে। তারপরেও বলল, হুঁ।
সুরাইয়া ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখন তোমাকে আমি কি বলব। মন দিয়ে শুনবে। আমরা এই বাড়িতে থাকব না।
ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, কোথায় যাব?
তোমার বড় মামার বাড়িতে গিয়ে থাকব। তোমার বড় মামা তার বাড়ির একটা ঘর আমাকে দিয়েছেন। একটা ঘরইতো আমাদের জন্যে যথেষ্ট। কি, যথেষ্ট না?
হুঁ।
এ রকম মুখ শুকনা করে ই বলছি কেন? বড় মামার বাড়িতে থাকতে তোমার অসুবিধাটা কি? আর যদি অসুবিধা থাকেও কিছু করার নেই। তোমার বাবার কোন খোঁজ নেই–কাজেই তোমাদের কপাল ভেঙ্গেছে। আমাদের জীবন কি ভাবে কাটবে জান? আজ এই বাড়ি, কাল ঐ বাড়ি।
ইমন ভয়ে ভয়ে বলল, এই বাড়িতে কেন থাকবনা মা?
এই বাড়িতে থাকব না, কারণ তোমার ছোট চাচার কোন চাকরি বাকরি নেই। এতদিন সংসার চলেছে গ্রামের বাড়ির ধানী জমি বিক্রি করে। এই ভাবে আর কতদিন চলবে? তাছাড়া তোমার ছোট চাচা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। চোখ লাল করে আমার দিকে তাকায়। তার এত সাহস কেন হবে? যেখানে তোমার বাবা কোনদিন আমার দিকে চোখ লাল করে তাকায় নি–সেখানে সে তাকাবে কেন?
বড় মামার বাসায় কবে যাব মা?
এক সপ্তাহের মধ্যেই যাব। তোমার বই খাতা তুমি নিজে সব গুছিয়ে নেবে। ঐখানে গেলে তোমার ভালই লাগবে। খেলার সঙ্গি-সাথী পাবে। তোমার বড় মামার দুই ছেলে আছে। টোকন আর শোভন। ওদের সঙ্গে খেলবে। এখানে একা একা থাক, তোমার বড় মামা তোমাকে পছন্দও করেন। করেন না?
ইমন বুঝতে পারছে না তার বড় মামা তাকে পছন্দ করেন কি-না। তার বড় মামার চেহারাটা রাগি রাগি। চশমা পরেন। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকান। কেমন করে জানি তাকান। তিনি বাসায় এলেই ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। সেই গন্ধে গা কেমন জানি ঝিম ঝিম করে। পরে সে জেনেছে এটা ফুলের গন্ধ না। জর্দার গন্ধ। বড় মামা পান খান না-শুধু শুধু জর্দা খান। তিনি যখনই এ বাসায় আসেন এক প্যাকেট বিসকিট নিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলেন-ইমন নিয়ে যা। ইমন বিসকিট নিয়ে যায়, কিন্তু তার কোন আনন্দ হয় না, কারণ বিসকিট তার পছন্দ না। শুধু চায়ে ড়ুবিয়ে বিসকিট খেতেই তার ভাল লাগে। অন্য সময় ভাল লাগে না। বিসকিট খাবার জন্যে কেউতো আর তাকে চা বানিয়ে দেবে না। সে ছোট মানুষ। কলেজে যখন পড়বে তখনই সে শুধু চা খেতে পারবে।
সুরাইয়া বললেন, কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন? তোর বড় মামা তোকে পছন্দ করে না?
হুঁ।
মুখ এমন শুকনা করে ইহঁ বলছি কেন? মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। যাও, এখন সামনে থেকে যাও। সারাক্ষণ ভোতা মুখ দেখতে ভাল লাগে না।
ইমন মার ঘর থেকে বের হল। বড় মামার বাড়িতে কি কচ্ছপ দুটা নিতে দেবে? মনে হয় দেবে না। কচ্ছপ দুটা এ বাড়িতেই রেখে যেতে হবে। মাকে একবার বলে দেখলে হয়। অবশ্যি বললেও লাভ হবে না। বড় মামার ছেলে টোকন আর শোভন হয়ত তার কাছ থেকে কেড়ে কচ্ছপ দুটা নিয়ে নেবে। একটা লাভ হয়তো হবে রাতে মার সঙ্গে ঘুমুতে পারবে। তাদের একটা ঘর দেয়া হবে। তারা সবাই সেই ঘরেই থাকবে। এখানে বেশীর ভাগ সময় তাকে ছোট চাচার সঙ্গে ঘুমুতে হয়। সে যখন ঘুমুতে যায়। তখনো ছোট চাচা বাইরে। একা একা ঘুমুতে তার খুবই ভয় লাগে। তবে অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে যখন সে দেখে ছোট চাচা ঘুমুচ্ছেন তখন তার খুবই ভাল লাগে। সে যদি খুব নরম গলাতেও ডাকে-ছোট চাচা! তাহলেও ছোট চাচা উঠে বসেন, গম্ভীর গলায় বলেন, কি হয়েছেরে হার্ড নাট। বাথরুমে যাবি?
হুঁ।
আয় যাই। ঠিক সময় ডাক দিয়েছিস আমারো বাথরুম পেয়েছে। ছোটটা। তোর কি বড়টা না-কি?
আমারও ছোটটা।
চল যাই। কে আগে যাবে তুই না। আমি? বড় থেকে ছোট না ছোট থেকে বড়?
তুমি যা বলবে তাই।
তাহলে তুই বরং আগে যা। কোলে করে নিতে হবে না-কি?
হুঁ।
বাথরুম থেকে ফেরার পর ঘুম না। আসা পর্যন্ত ছোট চাচা গল্প বলেন। তাঁর গল্পের কোন আগা মাথা নেই, শুরু নেই শেষ নেই। তবু ঘুম ঘুম চোখে শুনতে এত ভাল লাগে। ছোট চাচার সব গল্পই শুরু হয় মাঝখান থেকে
তারপর ব্যাঙটা বলল, পানিতে থেকে থেকে আমার সিরিয়াস সর্দি হয়েছে। নাক ঝাড়তে ঝাড়তে অবস্থা কাহিল। অষুধ পত্র কিছু দিয়ে আমাকে বাঁচান ডাক্তার সাহেব। তবে আপনার কাছে একটা রিকোয়েষ্ট তেতো অষুধ দেবেন না। মিষ্টি অষুধ দেবেন। আবার বেশি মিষ্টিও দেবেন না। অষুধ বেশি মিষ্টি হলে আমার বাচ্চারা মেঠাই ভেবে খেয়ে ফেলবে।
ডাক্তার বলল, অষুধ দেব। তবে আমি খুবই অবাক হচ্ছি। কারণ ব্যাঙের কখনো সর্দি হয় না বলে বই পত্রে পড়েছি। আপনার কি সত্যি সর্দি হয়েছে?
ক্রমাগত হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো করছি তারপরেও বিশ্বাস হচ্ছে না?
তা হচ্ছে। যাই হোক অষুধ দিচ্ছি। ভিজিটের টাকা এনেছেন?
এনেছি। এই নিন। আধুলি। আমার শেষ সম্বল— ব্যাঙের আধুলি।…
 
বড় মামার বাড়িতে কেউ তাকে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনাবে না। রাতে বাথরুম পেলে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যাবে না। কি আর করা। বড় মামার বাড়িতেও নিশ্চয়ই অনেক মজার মজার ব্যাপার হবে। কিছু কিছু মজা সব বাড়িতেই থাকে। বড় মামার দুই ছেলে টোকন আর শোভনের সঙ্গে তার হয়ত খুবই ভাব হবে। ওদেরও একটা বোন আছে নাম মিতা, সবাই ডাকে মিতু। তার সঙ্গে ভাব হবে কিনা কে জানে। মনে হয় হবে না। মেয়েদের সঙ্গে হয় মেয়েদের বন্ধুত্ব। ছেলেদের সঙ্গে ছেলেদের।
 
গায়ে তেল মাখানোর ব্যাপারটায় সুপ্ৰভা মনে হয় খুব আরাম পায়। তেল মাখানোর মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়ে। আশ্চর্যের ব্যাপার ঘুমের মধ্যে আবার নাকও ডাকে। এইটুকু ছোট বাচ্চা নাক ডাকিয়ে ঘুমাবে কেন? তার উপর মেয়ে মানুষ। সুরাইয়ার খুব রাগ লাগে। এখনো রাগ লাগছে। চড় দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। রাগ সামলে সুরাইয়া বারান্দায় গেল। ফিরোজ বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। তার সামনে গম্ভীর মুখে ইমন বসে আছে। ফিরোজ বলল, কেমন আছেন ভাবী?
একই বাড়িতে বাস করছে। অথচ দেখা হলে প্রথম বাক্যটি বলছে, কেমন আছেন ভাবী। এর মানে কি এই যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া আপনি ভাল থাকেন না।
সুরাইয়া বলল, ফিরোজ তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।
ফিরোজ খবরের কাগজ ভাজ করে পাশে রাখতে রাখতে বলল, বলুন।
ইমন উঠে চলে যাচ্ছে। সে জানে বড়রা যখন জরুরী কথা বলে সেখানে ছোটদের থাকার নিয়ম নেই। বড়রা তাদের জরুরী কথার আশে পাশে ছোটদের চায় না। অথচ ছোটদের সমস্ত জরুরী কথায় বড়দের থাকতে হয়।
সুরাইয়া বেতের মোড়া এনে ফিরোজের সামনে বসল। ফিরোজ শংকিত বোধ করছে। ভাবীর বসার ভঙ্গি কঠিন। ভাবী। কি বড় ধরণের ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে? কি নিয়ে ঝগড়া করবে?
ভাবী চা খাবেন? চা দিতে বলি—চা খেতে খেতে কথা বলুন।
তোমার সঙ্গে আমার এমন কোন কথা নেই যে চা খেয়ে খেয়ে বলতে হবে। ফিরোজ শোন, আমি এখানে থাকব না। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, আমি তার কাছে গিয়ে থাকব।
ফিরোজ বলল, আমি জানি। ইমন আমাকে বলেছে।
তুমি একটা ঠেলাগাড়ি এনে দাও। আমি কিছু জিনিস পত্র নিয়ে যাব। স্টিলের ট্রাংক, ইমনের পড়ার টেবিল-চেয়ার, আমার বড় কালো ট্রাংকটা।
কবে যাবেন ভাবী?
কবে মানে? আজই যাব। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই ভাল। সবার জন্যেই ভাল। তোমার জন্যেও ভাল, আমার জন্যেও ভাল।
আমার জন্যে ভাল কেন?
তোমার চাকরি বাকরি কিছু নেই, এত বড় সংসার পুষতে হচ্ছে। বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে। গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করতে হচ্ছে। তুমি অকারণে এত কিছু করবে। কেন? তুমি কে?
ভাবী, আমি ইমনের চাচা।
বাপ যখন থাকে না তখন চাচা-ফাচা অনেক দূরের ব্যাপার।
আপনার সঙ্গে আমি কোন তর্কে যেতে চাচ্ছি না। তবে আমার মনে হয়এখানে থাকাটাই আপনাদের জন্যে ভাল হবে।
কেন ভাল হবে?
পরিবেশে অভ্যস্ত হবার ব্যাপার আছে। আপনি এই পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত, ইমন অভ্যস্ত।
তুমি জমি বিক্রি করে করে আমাদের খাওয়াবে!
হ্যাঁ ভাবী।
সেটা কতদিন? তোমাদের কি জমিদারী আছে?
জমিদারী নেই। জমি জমা খুব সামান্যই আছে—ভাবী, আমি ব্যবসা শুরু করেছি। বোতল সাপ্লাইএর কাজ পেয়েছি। সামান্য হলেও কিছু টাকা-পয়সাতো পাচ্ছি। ব্যবসার নিয়ম কানুন বুঝতে শুরু করেছি—আমার ধারণা আমি ভালই করব।
ভাল করলে ভাল। ভাল করতে থাক। কোটিপতি হয়ে যাও। গাড়ি হোক। বাড়ি হোক। তোমরা সুখে থাক। তোমাকে যা বলেছি করা—আমাকে একটা ঠেলাগাড়ি এনে দাও।
ভাবী শুনুন, মার শরীর খুব খারাপ। মা চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসছেন। মা আসুক তারপর যান।
উনার সঙ্গে আমার যাওয়ার সম্পর্ক কি? আমি আজই যাব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তুমি আরেকটা কাজ করবে–সুপ্ৰভাকে আমি পালতে পারছি না–তাকে পালক দেবার ব্যবস্থা করবে।
কি বলছেন বুঝতে পারছি না ভাবী।
বাংলাদেশে অনেক ফ্যামিলি আছে যাদের ছেলে।পুলে নেই, এমন কোন একটা ফ্যামিলীতে ওকে দিয়ে দাও। সেও সুখে থাকবে আমিও সুখে থাকব। এইসব যন্ত্রনা। আমার অসহ্য লাগছে।
ও আচ্ছা।
মেয়েটা হয়েছে অপয়া–ও পেটে আসার পর থেকে যত সমস্যা। আমার আর ভাল লাগে না।
ভাবী আপনি-আজই যাবেন?
হুঁ।
ইমনের স্কুলতো অনেক দূর হয়ে যাবে, স্কুল থেকে ওকে আনা নেয়া কে করবে?
জানি না। স্কুল বদলে দিব কিংবা ঘরে বসে থাকবে-বাপ নেই ছেলের আবার স্কুল কিসের? তার কি পড়াশোনা হবে? হবে না। বড় হয়ে ইট ভাঙ্গাবে কিংবা রিকশা চালাবে।
সুপ্রভার ঘুম ভেঙ্গেছে। কাঁদতে শুরু করেছে। সুরাইয়া উঠে চলে গেল। ফিরোজ বসে রইল। পত্রিকা পড়া হয়নি। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। ভাবী যখন চলে যাবে বলে ঠিক করেছে তখন যাবেই। তাকে বুঝানোর কেউ নেই। সে কারো কথা শুনবে না।
ইমন ছোট ছোট পা ফেলে আসছে। ছোট চাচার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। ফিরোজ হাত ইশারায় কাছে ডাকল। ইমন আসছে কিন্তু অন্য দিকে তাকিয়ে এগুচ্ছে। একবারো তার চাচার দিকে তাকাচ্ছে না। ছেলেটা অদ্ভুত হয়েছে। অদ্ভুত কিন্তু অসাধারণ।
খবর কিরে ব্যাটা হার্ড নাট?
ভাল।
বড় মামার বাড়িতে চলে যাচ্ছিস তাহলে?
হুঁ।
গুড়। যাবার সময় কাঁদবি নাতো?
ভেরী গুড। বোকা ছেলেরাই কাঁদে–বুদ্ধিমানরা কাঁদে না। তুই বোকা না বুদ্ধিমান?
জানি না।
আয় পরীক্ষা করে দেখি–বোকা না, বুদ্ধিমান। কোলে এসে বোস। আমি তোর চুলে বিলি কেটে কেটে আদর করব। তখন যদি কেঁদে ফেলিস তখন বুঝব তুই বোকা। আর না কেঁদে থাকতে পারলে বুদ্ধিমান।
ইমন গুটিসুটি মেরে তার চাচার কোলে বসে আছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকানোর, কোন লাভ হচ্ছে না। চোখ ভর্তি করে পানি আসছে সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে ফেলছে। ছোট চাচার কাছে সে বোকা প্রমাণিত হচ্ছে এই দুঃখবোধেও সে আক্রান্ত তবে সে জানে না-ছোট চাচাও তার মতই বোকা। ছোট চাচার চোখ ও ভিজে উঠছে। পানি জমতে শুরু করেছে।
হার্ড নাট!
হুঁ।
যেখানেই থাকিস, যে ভাবেই থাকিস—ভাল থাকবি।
আচ্ছা।
কোন কিছু নিয়েই মন খারাপ করবি না।
আচ্ছা।
গল্প শুনবি?
হুঁ।
একদেশে ছিল এক ব্যাঙ। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ বেচারার সর্দি লেগে গেল। সর্দি এবং কফ। সারাদিন নাক ঝাড়ে আর খ্যক খ্যক করে কাশে। ব্যাঙের স্ত্রী বলল, ওগো ডাক্তারের কাছে যাও। তোমার কাশির শব্দে বাচ্চারা ঘুমুতে পারছে না। ব্যাঙ বলল, ডাক্তারের কাছে যে যাব ভিজিটের টাকা লাগবে না? তার স্ত্রী বলল, আধুলীটা নিয়ে যাও। ব্যাঙ বলল, আধুলীটাই আমাদের শেষ সম্বল সেটা নিয়ে যাব?
হ্যাঁ যাও। শরীরটাতো আগে দেখবে। টাকা গেলে টাকা পাওয়া যায়। শরীর গেলে কি আর পাওয়া যায়?
ব্যাঙ বলল, বউ কথাটাতো ভালই বলেছ। আচ্ছা যাই ডাক্তারকে বরং দেখিয়েই আসি।
ব্যাঙের স্ত্রী বলল, ব্লাড প্রেসারটাও একটু চেক করিও। আমার ধারণা তোমার প্রেসারও বেড়েছে। কাল রাতে বৃষ্টির সময় তুমি যখন ডাকছিলে তখন তোমার গলা কেমন যেন অন্য রকম শুনাচ্ছিল।
ছোট চাচা দম নেবার জন্যে থামতেই ইমন বলল, বাবা কি আর ফিরে আসবে না। চাচা?
বুঝতে পারছি না। ধরে নে ফিরে আসবে না। তাহলে কষ্ট কম পাবি। ফিরে আসবে ভেবে অপেক্ষা করছিস-মানুষটা ফিরছে না-কষ্ট বেশী না?
হুঁ।
তোর মা সারাক্ষণ ভাবছে—এই বুঝি মানুষটা ফিরল। রাতে ঘুমায় না। জেগে থাকে, গোটে সামান্য শব্দ হলে ছুটে আসে—এই অবস্থাটাতো ভয়ংকর।
সুপ্ৰভা খুব কাঁদছে। সুরাইয়া মেয়ের কান্না থামানোর কোন চেষ্টা করছে। না। কাদুক। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় নিজেই থেমে যাবে। সে যখন কাঁদে তখনতো কেউ তার কান্না থামাতে আসে না। সে কোন যাবে? তার এত কি দায় পড়েছে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here