অপেক্ষা পর্ব-৪

0
182

অপেক্ষা
পর্ব-৪
__হুমায়ূন আহমেদ

পৌষ মাস। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। শীতের সঙ্গে কুয়াশা। ইমন বসে আছে তার বড় মামার বাড়ির দোতলার বারান্দায়। সে অবাক হয়ে দেখছে কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। একটু দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। বাড়ির সামনে কাঁঠাল গাছটাকে মনে হচ্ছে ছোট একটা পাহাড়। তার ছোট চাচা বলেছিলেনকুয়াশা আসলে মেঘ। আকাশের মেঘ যখন মাটিতে নামে তাকে বলে কুয়াশা। ইমনের খুব অদ্ভুত লাগছে এই ভেবে যে সে মেঘের ভেতর বসে আছে। আজ ছুটির দিন, তার বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকার কথা না। ছুটির দিনের সকাল বেলায় এই বাড়িতে নানান ধরণের খেলা হয়। টোকন আর শোভন টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলে। টোকনের খুবই কাদুনে স্বভাব। কিছু হতেই কান্না শুরু করে। আর শোভন মারামারিতে ওস্তাদ। হুট করে মারামারি শুরু হয়ে যায়। শোভন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ধমাধ্যম ভাইকে মারে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কেউ কখনো নালিশ করে না। মারামারি এবং কান্নাকাটি কিছুক্ষণের মধ্যে থেমে যায়। আবার খেলা শুরু হয়। মিতু একা একা রান্না বাটিখেলে। ক্রিকেট খেলায় তাকে নেয়া হয় না, মিতুও রান্নাবাটি খেলায় তাকে নেয় না। একদিন শুধু বলেছিল, এই তুই চাকর হবি? তুই চাকর হলে খেলতে নেব। যা বাজার করে নিয়ে আয়। মনে করে কাঁচা মরিচ, আনবি। আর খবর্দার পয়সা সরাবি না।
ইমনের খেলতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু চাকর হওয়াটা মেনে নিতে পারছিল না বলে খেলে নি। তবে না খেললেও সে বেশির ভাগ সময় আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।
আজি ইমন এখনো নিচে নামছে না। কারণ নিচে নামিয়ে নেয়ার জন্যে মিতু আসেনি। বড় মামার বাড়ির দোতলার সিঁড়ি পুরোপুরি শেষ হয় নি। রেলিং দেয়া বাকি। এ রকম সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে ইমনের অসম্ভব ভয় লাগে। মিতু বয়সে তার সমান হলেও, ঠিক সমান ও না, পাঁচ দিনের বড়। ভয়ংকর সাহসী। একবার সে চোখ বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল। মিতু শুধু যে চোখ বন্ধ করে সিড়ি দিয়ে উঠতে পারে তাই না। তিন তলার ছাদে পা ঝুলিয়ে বসতেও পারে। সেই ছাদেরও রেলিং নেই। ইমনের বড় মামা ছাদে রেলিং দেবেন না— শুধু শুধু বাজে খরচ। ইমনের ধারণা বাজে খরচ হলেও রেলিং দেয়া উচিত। তা না হলে কোন একদিন মিতু ছাদ থেকে পড়ে যাবে। ইমনের ধারণা দোতলার সিঁড়িতেও রেলিং দেয়া উচিত। রেলিং দেয়া না হলে সে নিজেই কোন একদিন পড়ে যাবে।
ইমন!
ইমন চমকে উঠে দাঁড়াল। মা ডাকছেন। আগে মা ডাকলেই আনন্দ হত, এখন হয় না। মার ডাকা মানেই কিছু একটা নিয়ে ধমকা ধমকি হবে। ধমক খাবার মত কিছু অবশ্যি সে করেনি। সকালে বই নিয়ে বসে অনেকক্ষণ পড়েছে। মা যখন বললেন, যথেষ্ট ঘ্যানঘ্যােনানি হয়েছে এখন যাও। তখনি শুধু সে উঠে এসেছে।
ইমন ভয়ে ভয়ে মার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়াল। মার রাতে জ্বর ছিল, এখনো বোধ হয় জ্বর। মা শুয়ে আছেন। সুপ্ৰভা মার পাশে বসে নিজে নিজেই খেলছে। ইমনের কাছে খুবই আশ্চর্য লাগে যে সুপ্ৰভা নিজে নিজে বসতে পারে। হামাগুড়ি দিতে পারে। কিছু দেখলেই দুহাতের দুই আঙুল উঁচু করে বলে—যে যে যে  মানুষ কাউকে কিছু দেখাতে চাইলে এক আংগুল দিয়ে দেখায়–সুপ্ৰভা দুহাতের দু আংগুলে দেখায়। এটাও তার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়।
সুপ্ৰভা ইমনকে দেখা মাত্র দুহাতের দুই আংগুল উঁচু করে তাকে দেখাল এবং ক্রমাগত বলতে লাগল, যে যে যে।
সুরাইয়া বলল, কোথায় ছিলি?
ইমন ভীত গলায় বলল, বারান্দায়।
রান্নাঘরে গিয়ে বলতো আমাকে চিনি দুধ ছাড়া লিকার দিয়ে এক কাপ চা দিতে। লেবু যেন না দেয়। চায়ের মধ্যে লেবুর গন্ধ—অসহ্য।
তোমার জ্বর কমেছে মা?
সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, আমার জ্বরের খবর তোকে নিতে হবে না। যা করতে বলছি কর। তোর গলা খালি কেন? মাফলার যে একটা দিয়েছিলাম সেটা কই? ঠাণ্ডা লাগিয়ে রাতে যদি খুক খুক করে কাশিস তাহলে গলা চেপে ধরব। তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল। যা এখন সামনে থেকে।
ইমন দোতলা থেকে এক তলায় নামছে। নামতে গিয়ে সে লিজায় মরে যাচ্ছে কারণ সে নামছে বসে বসে। কেউ দেখলেই হাসবে। বিশেষ করে মিতু যদি দেখে তাহলে সর্বনাশ হবে। খুব হাসোহাসি করবে। এমিতেই মিতু তাকে নিয়ে খুব হাসোহাসি করে। তাকে ডাকে ক্যাবলা বাবা। এই অবস্থায় দেখে ফেললে হয়ত আরো ভয়ংকর কোন নামে ডাকবে।
ইমন ঠিকমতই নামল। কেউ তাকে দেখল না। রান্নাঘরে বুয়াকে চায়ের কথা বলল। বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, আমার হাত বন্ধ, এখন চা দেওন যাইব না। বুয়ার কথা শুনে ইমনের ভয় ভয় লাগছে। বুয়া যদি চা না পাঠায় মা বুয়ার উপর রাগ করবে না। তার উপরই রাগ করবে। চড় মারবে বা চুলে ধরে ঝাকুনি দিবে। ইমন বিড় বিড় করে বলল, বুয়া মার খুব জ্বর। সকালে কিছু খায়নি—এই জন্যে চা চাচ্ছে। দুধ-চিনি-লেবু ছাড়া শুধু লিকার।
কইলাম না হাত বন্ধ।
ইমন মন খারাপ করে রান্নাঘর থেকে বের হল। বড় মামার বাড়িতে তারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে। কেউ তাদের কোন কথা শুনে না। ইমন যদি কোন কাজের লোককে বলে এই আমাকে এক গ্রাস পানি দাও। সে অবধারিত ভাবে না শোনার ভান করে চলে যাবে। কিংবা দিতেছি বলে সামনে থেকে সরে যাবে কিন্তু আর ফিরে আসবে না। আগে এই নিয়ে তার খুব মন খারাপ লাগত। এখন লাগে না।
ইমন বারান্দায় এসে দেখে মিতু বারান্দার পিলারে হেলান দিয়ে কমলা খাচ্ছে। এই শীতে তার গায়ে পাতলা একটা ফ্রক। খুব যারা সাহসী মেয়ে তাদের বোধ হয়। শীতও কম লাগে। ইমনের খুব ইচ্ছা করছে মিতুর কাছে যেতে— তবে এখন সে যাবে না, একটু পরে যাবে। মিতুর কমলা খাওয়া শেষ হবার পর যাবে। এখন মিত্র পাশে গিয়ে দাড়ালে মিতু ভাবতে পারে সে কমলার লোভে কাছে এসেছে।
মিত্র কমলা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবে। এমন ভাব করবে যেন খুব মন দিয়ে কিছু দেখছে।
এই ক্যাবলা, এই।
মিতু ডাকছে। মিতুর কমলা শেষ হয়নি। হাতে এখনো কয়েকটা কোয়া রয়েছে। ইমন কাছে গিয়ে দাড়ালে–একটা দুটা কোয়া হয়ত তার হাতে দেবে। তখন ইমনকে লোভীর মত লাগবে। আবার নাও দিতে পারে। মিতুর কোন কিছুই ঠিক নেই। ইমন কাছে গেল।
মিতু তাকে কমলার কোন কোয়া দিল না। পুরো কমলা শেষ করে বলল, ক্যাবলা, আজ তোর ছোট চাচা আসবে না?
ইমন বলল, আসতে পারে।
ছোট চাচার কথা ওঠায় ইমনের মন ভাল হয়ে গেল। সে একটু হেসেও ফেলল। আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। ছুটির দিনে ছোট চাচা আসে। গত শুক্রবার আসেনি। আজ হয়ত আসবে।
তোর ছোট চাচাকে দেখতে কেমন লাগে জানিস?
কেমন লাগে।
অবিকল রাম ছাগলের মত লাগে। দাড়ি রেখেছেতো এই জন্যে। রামছাগলেরও দাড়ি থাকে। হিহিহি।
ইমনের চোখে প্ৰায় পানি এসে যাচ্ছে। ছোট চাচাকে কেউ খারাপ বললে তার খুব মন খারাপ লাগে। তাছাড়া দাড়িতে ছোট চাচাকে খুবই সুন্দর লাগে।
মিতু বলল, আমি যখন কমলা খাচ্ছিলাম তখন তুই লোভীর মত তাকিয়ে ছিলি কেন?
তাকিয়ে ছিলামনাতো!
অবশ্যই তাকিয়েছিলি। লোভী কোথাকার। আবার মিথ্যা কথা বলে–মিথ্যুক।
আমি মিথ্যুক না। আমি সত্যুক।
অবশ্যই তুই মিথ্যুক। বাবা মারা গেছে আবার মিথ্যা কথাও বলে।
বাবা মরে নি। বেড়াতে গেছেন, চলে আসবেন।
চলে আসবে না হাতী। কোনদিন আসবে না।
আসবে।
তুই বললেই হবে? সবাই জানে আসবে না। তুই একেতো মিথ্যুক তার উপর বোকা।
আমি বোকা না।
অবশ্যই তুই বোকা। বোকা এবং ভীরু। সিঁড়ি দিয়ে বসে বসে পা ল্যাছড়ে নামিস। আমি দেখেছি।
ইমন চোখের পানি সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। মিতু বলল, একদিন তুই যখন সিঁড়ি দিয়ে বসে বসে নামছিলি তখন আমি তোর ইয়েটা দেখে ফেলেছি। দেখতে শাদা কেচোর মত-হি হি হি।
ইমনের চোখে এবার পানি এসে গেল। চোখ মুছে সে রওনা হল রান্নাঘরের দিকে। বুয়াকে আরেকবার অনুরোধ করে দেখবে যেন মাকে সে চা দিয়ে আসে।
মিতু তার ফ্রকের পকেট থেকে আরেকটা কমলা বের করেছে। মেয়েটার মুখ গোলগাল, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। অসম্ভব সুন্দর চেহারা। একবার তার দিকে চোখ পড়লে চোখ ফেরানো মুশকিল। এ হচ্ছে সেই ধরণের মেয়ে যাকে দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। মজার ব্যাপার হল, আজ থেকে ঠিক বিশ বছর পর এই মেয়েটি তার বাবার ঘরে ঢুকে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে বলবে-বাবা আমি ইমানকে বিয়ে করতে চাই।
মিতুর বাবা হতভম্ব হয়ে বলবেন, কি বললি?
যা বলেছি তুমি শুনেছ।
তোর কি মাথাটা খারাপ?
মিতু আগের চেয়েও শান্ত গলায় বলবে, বাবা আমার মাথা খারাপ না। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।
সেই গল্প যথাসময়ে বলা হবে। আপাতত আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইমন তার ছোট চাচার কোলে। সে চাচার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে আছে। নিঃশব্দে কাদছে। ফিরোজ বলছে–কেঁদে তুই আমার ঘাড় ভিজিয়ে ফেলছিস। তোর হয়েছেটা কি বলতো? পনেরো দিন পর এসেছি, কোথায় গল্প গুজব করবি–এ রকম করলে আর আসব না। দোতালা থেকে নিচে ফেলে দেব। দিলাম ফেলে দিলাম। এক মিনিটের মধ্যে যদি হাসির শব্দ না শুনি তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি ফেলে দেব!
ইমন হাসতে না পারলেও হাসির মত শব্দ করল। ছোট চাচার একটু মাথা খারাপের মত আছে। সত্যি সত্যি ফেলে দিতে পারে।
সুরাইয়ার জ্বর আরো বেড়েছে। জ্বরের আঁচে মুখ লালচে হয়ে আছে। চোখ জুল জ্বল করছে। ফিরোজ বসেছে তার সামনে একটা চেয়ারে। ফিরোজ বলল, ভাবী কেমন আছেন?
সুরাইয়া বলল, ভাল। খারাপ থাকিব কেন? খারাপ থাকার মত নতুন কিছুতো হয়নি।
আপনার জ্বর কি বেশী?
জানি না। তোমার খবর বল। ব্যবসা পাতির অবস্থা কি?
অবস্থা বেশী ভাল না। খারাপই বলতে পারেন। ব্যবসা করতে ক্যাশ টাকা লাগে। ক্যাশ টাকাতো নেই।
তোমার ভাইয়ের টাকা পয়সার খোঁজ নিতে বলেছিলাম খোঁজ নিয়েছ?
ফিরোজ কিছু বলল না, চুপ করে রইল। এই প্রসঙ্গে আলাপ করতে তার ইচ্ছা করছে না। অফিসে তার ভাইয়ের টাকা পয়সা ভালই আছে। টাকাটা পেতে হলে তার মৃত্যু হয়েছে এই মর্মে প্রমাণ সহ কাগজ পত্র দিতে হবে। ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে এ জাতীয় কোন কাগজ তার কাছে নেই। একটা মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে। এই পর্যন্তই। তার আর কোন খোঁজ নেই।
ভাবী, ইমনের পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
জানি না।
সুপ্ৰভাতো দেখতে খুব সুন্দর হচ্ছে।
ও সুন্দর হলেই কি আর অসুন্দর হলেই কি? তুমি কি এখনো মেসেই থাক?
জ্বি।
চিরজীবন কি মেসেই থাকবে? ঘর বাড়ি করবে না, বিয়ে টিয়ে করবে না।
ব্যবসার অবস্থা ভাবী। খুবই খারাপ।
খারাপ হলে কি আর করবে। মেসে মেসে জীবন কাটিয়ে দাও।
ফিরোজ একটু ঝুকে এসে বলল, ভাবী আপনার কাছে আমি একটা আব্দার নিয়ে এসেছি।
সুরাইয়া ভুরু কুচকে বলল, কি আব্দার?
মার শরীর খুব খারাপ, প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। মনে হয়। বাঁচবেন না। আপনাকে খুব দেখতে চাচ্ছেন।
আমাকে দেখে কি হবে?
মনে হয়ত শান্তি পাবেন।
আমাকে দেখে শান্তি পাবার কিছু নেই। আমি কোন শান্তি-বড়ি না।
ভাবী, এই ভাবে কথা বলবেন না। আপনি আমার সঙ্গে চলেন। সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসি। দীর্ঘ দিন একটা জায়গায় পড়ে আছেন, ঢাকার বাইরে গেলে ভাল লাগবে।
আমার ভাল লাগা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
ভাবী, আমি হাত জোড় করছি।
সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, কথায় কথায় হাত জোড় করবে না। এইসব নাটক আমার ভাল লাগে না। আমি কোথাও যাব না।
তাহলে একটা কাজ করি, ইমনকে নিয়ে যাই?
না, ওকে আমি একা কোথাও পাঠাব না?
একা কোথায় ভাবী। আমিতো সঙ্গে যাচ্ছি। নিয়ে যাব, একটা দিন থাকব। তারপর চলে আসব।
না।
অনেক দিনতো হয়ে গেল ভাবী এখন একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করা উচিত না?
আমি স্বাভাবিকই আছি। এরচে বেশী স্বাভাবিক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ফিরোজ, তুমি এখন যাও। শরীর ভাল লাগছে না–কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
আমি যাব বৃহস্পতিবার দুপুরে। সকালবেলা এসে একবার খোঁজ নিয়ে যাব?
কি খোঁজ নিয়ে যাবে?
যদি আপনি যান আমার সঙ্গে, কিংবা ইমনকে দেন।
একবারতো না বলেছি–তারপরেও চাপ দিচ্ছ কেন?
চাপ দিচ্ছি না ভাবী, অনুরোধ করছি। মার শরীর খুবই খারাপ। বাঁচবেন না। ইমনের জন্যে খুব অস্থির। ভাবী আজ উঠি, বৃহস্পতিবার সকালে আসব। যাওয়ার আগে দেখা করার জন্যে আসব। সুপ্ৰভা কি ঘুমুচ্ছে?
হ্যাঁ।
ওকে দিন একটু কোলে নিয়ে আদর করি।
কোলে নিয়ে আদর করতে হবে না। ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ঘুম ভাঙ্গলে বিশ্ৰী করে কাঁদে। অসহ্য লাগে।
সুপ্রভার কান্না শুধু না সুরাইয়ার সব কিছুই অসহ্য লাগে। ইমন যখন পড়ার টেবিলে বসে গুনগুন করে সেই গুনগুন কিছুক্ষণ শুনলেই অসহ্য লাগে। আবার সে যখন নিঃশব্দে পড়ে তখন চারদিকের নৈশব্দও অসহ্য লাগে। সবচে বেশী অসহ্য লাগে তার বড় ভাই জামিলুর রহমানকে।
জামিলুর রহমান মাঝে মধ্যে বোনের ঘরে ঢুকেন। নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেন। দুএকটা কথা শোনার পরই সুরাইয়ার মাথা ধরে যায়। সুরাইয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে ভাইজান প্ৰচণ্ড মাথা ধরেছে। তিনি তারপরেও বসে থাকেন। এক প্ৰসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে যান এবং কথা বলতেই থাকেন। বলতেই থাকেন।
তারপর সুরাইয়া তুই আছিস কেমন বল।
ভাল।
দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা একটা ঘরের ভেতর থাকিস। এর নাম ভাল থাকা? তোরতো পাগল হতে বেশী বাকি নাই।
পাগল আমি হব না ভাইজান, পাগল হলে আগেই হতাম। আগে যখন হই নাই এখনো হব না। আশে পাশের সবাইকে পাগল বানাব, কিন্তু নিজে পাগল হব না।
এইত একটা কথার মত কথা বলেছিস। নিজে ভাল থাকিবি। নিজের ভাল থাকাটাই জরুরী। অন্যের যা ইচ্ছা হোক নিজে ঠিক থাকলে জগৎ ঠিক। শুনে ভাল লাগল। একটা ঘটনা ঘটলে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে হবে না-কি? দুর্ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে না? সব সময় ঘটে।
ভাইজান, আমার খুবই মাথা ধরেছে।
দিন রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে থাকলে মাথা ধরবে না? মাথা ধরবেই।–আমার কথা শোন, মাথা থেকে সব কিছু বাদ দে—আয় আমরা তোর জীবন নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা কবি।
নতুন চিন্তা ভাবনাটা কি? আমাকে বিয়ে দেবার কথা ভাবছেন?
যদি ভাবি–অসুবিধা কোথায়? তোর বয়স অল্প, সারাটা জীবন পড়ে আছে সামনে।
সুরাইয়া হতভম্ব গলায় বলল, ইমনের বাবা বেঁচে থাকতেই আমি আরেকটা বিয়ে করে ফেলব?
বেঁচে আছে তোকে কে বলল?
মরে গেছে সেটাই বা কে বলল? তা ছাড়া আমি জানি বেঁচে আছে। আর যদি নাও থাকে–বিয়েতো আমি করব না।
খুব ভাল একটা ছেলে পেয়েছিলাম। ইণ্ডেটিং-এর ব্যবসা করে। বয়স অল্প। রোড অ্যাকসিডেন্টে স্ত্রী মারা গেছেন।
আপনি চান আমি আমার দুই বাচ্চা নিয়ে তার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ি?
ভাইজান যখন আপনার মনে হবে আমাদের আর পালতে পারছেন না, অসুবিধা হচ্ছে, তখন বলবেন আমি চলে যাব।
কোথায় যাবি?
কোথায় যাব সেটা আমার ব্যাপার। ভাইজান এখন আপনি যান, আমার এমন মাথা ধরেছে যে ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকি।
জামিলুর রহমান সাময়িক ভাবে উঠে চলে যান। তবে কিছুদিন পর আবারো আরেকটি ছেলের সন্ধান নিয়ে উপস্থিত হন—
বুঝলি, ভদ্রলোকের বয়স সামান্য বেশী। মনে হয়। ফিফটি ক্রস করেছে তবে ভাল স্বাস্থ্য। চেহারাও সুন্দর। দেখলে মনে হয় বয়স থাটি ফাইভ, থাটি সিক্স। হাইলি এড়ুকেটেড। ইলীনয় ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এস. করেছে। আমেরিকান এক মেয়ে বিয়ে করেছিল। বিয়ে টিকে নি। আমেরিকান মেয়ে বুঝতেই পারছিস–বিয়েটা ওদের কাছে একটা খেলা। কিছু দিন Honey Honey বলা তারপর সোপ-নেউলের খেলা।
মেয়ে না, আমি বাঙ্গালী মেয়ে এবং বিয়েটা আমার কাছে খেলা না। আমার একবার বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী আমাকে তালাকও দেয় নি—মরেও যায় নি। আমি আবার বিয়ে করব কেন?
কোন স্বামী যদি দুই বছর তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে নিরুদেশ থাকে তাহলে সেই বিয়ে অটোমেটিক্যালি তালাক হয়ে যায়।
কে বলেছে?
মওলানা সাহেব বলেছেন।
মওলানা সাহেবদের বিয়ে হয়ত তালাক হয়ে যায়। ইমনের বাবাতো মাওলানা না।
ইমনের বাবা বেঁচে আছেন, তিনি একদিন ফিরে আসবেন এই বিষয়টা সুরাইয়া মনে প্ৰাণে বিশ্বাস করে। সুরাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন বিশ্বাস করে সে সুরাইয়ার ভাবী–ফাতেমা।
জামিলুর রহমান যেমন অতিরিক্ত চালাক, তার স্ত্রী ফাতেমা তেমনি অতিরিক্ত বোকা। জগতের বোকারা ভালমানুষ ধরনের হয়। ফাতেমা বেগম তা না। ভােলমানুষী কোন ব্যাপারই তার মধ্যে নেই। সুরাইয়া তার পুত্র কন্যা নিয়ে এই সংসারে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছে–এই ব্যাপারটা তার কাছে অসহনীয় লাগে। বোকা মানুষ বলেই তিনি মনের ভাব গোপন রাখেন না–সরাসরি বলেন। পানের পিক ফেলে গম্ভীর গলায় বলেন, একটা কিছু ব্যবস্থাতো নেওয়া দরকার। আর কত দিন। আমার ছেলেপুলে বড় হচ্ছে।
তারপরেও সুরাইয়া তার ভাবীকে খুব পছন্দ করে কারণ ফাতেমারও ধারণা ইমনের বাবা বেঁচে আছে। কোন একদিন ফিরে আসবে।
সেই কোন একদিনটা কবে? সেটা ফাতেমা জানেন না। সুরাইয়াও জানে না। সুরাইয়ার কেন জানি মনে হয় লোকটা ফিরবে গভীর রাতে। হয়ত ৰূপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যেই ভিজতে ভিজতে উপস্থিত হবে। সুরাইয়া দরজা খুলে দেবে। সে ঢুকবে খুব সহজ ভাবে। যে কোন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকা হচ্ছে লোকটার স্বভাব। সে তার স্বভাব মত বলবে, দেখি, একটা তোয়ালে দেখি। মাথাটা ভিজে গেছে। সুরাইয়া তোয়ালে এগিয়ে দেবে। মানুষটা মাথা মুছতে মুছতে বলবে, তুমি কেমন আছ?
সে বলবে, ভাল।
এত রোগা লাগছে কেন, শরীর খারাপ?
সেও সহজ ভাবেই বলবে, না শরীর ঠিকই আছে। যে যেমন তার সঙ্গে সে রকম আচরণই করতে হয়। মানুষটা এক পর্যায়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে বলবে, ইমনের পাশে শুয়ে আছে। এই ছোট মেয়েটা কে?
ওর নাম সুপ্ৰভা।
সুপ্ৰভা কে?
সুপ্ৰভা হল ইমনের ছোট বোন।
বল কি? সুন্দর হয়েছে।তো!
হ্যাঁ সুন্দর হয়েছে। ওকে ডেকে তুলব, কোলে নেবে?
না থাক, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দরকার নেই। ইমানতো দেখি অনেক বড় হয়েছে।
বড়তো হবেই। তুমি কি ভেবেছিলে যে রকম রেখে গেছ ফিরে এসে সে রকম দেখবো?
মানুষটা কথা ঘুরাবার জন্যে বলবে, ঠাণ্ড লেগে গেছে, চা খাওয়াতে পারবে।
অবশ্যই পারব। কেন পারব না। তুমি ভাত খাবে না?
হ্যাঁ খাব। ভাতও খাব। গোসল করতে হবে, সাবান দাওতো।
ভাত খাবার আগেই চা খাবে, নাকি ভাত খাবার পর চা খাবে?
চা খেয়ে গোসল খানায় ঢুকব। আচ্ছা, এই বাড়িটা কার?
বাড়িতো বেশ বড়।
মানুষটা চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকবে–সুরাইয়া যাবে চা বানাতে। শুধু চা বানালে হবে না। ভাত চড়াতে হবে। গরম ভাত। ভাতে এক চামচ ঘি, ডিম ভাজা। ডিম ভাজার সঙ্গে শুকনো মরিচ ভাজা। নতুন আলু ডোবা তেলে মচমচে করে ভাজা! মানুষটার খুব প্রিয় খাবার।
সুরাইয়া রোজ রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে কাল্পনিক কথোপকথন চালায়। একেক রাতের কথা বার্তা হয় একেক রকম। রাতের এই কথোপকথন অংশটা তার বড় ভাল লাগে।
ইমন অন্ধকারে সিঁড়িঘরের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। জায়গাটা বিশ্রী রকমের অন্ধকার, সেই কারণে তার ভয় লাগছে। আবার অন্ধকার থেকে বারান্দায় আলোতে আসতে পারছে না। সে পেনসিল হারিয়ে ফেলেছে। স্কুলের ব্যাগ গুছাতে গিয়ে ধরা পড়েছে পেনসিল নেই। এই দুঃসংবাদ মাকে না দিয়ে উপায় নেই। সে মাকে বলল।
সুরাইয়া ধমক ধামক কিছুই দিল না। শান্তগলায় বলল, যেখান থেকে পার পেনসিল খুঁজে আন। পেনসিল না। এনে আজ ঘুমুতে পারবে না।
ঘন্টা খানিক আগে সে মার সরে উঁকি দিয়েছিল। সুরাইয়া তাকে দেখেই বলল, পেনসিল পেয়েছ?
ইমন বলল, না।
পেনসিল পাওনি তাহলে এসেছ কেন? বললাম না, পেনসিল না পেলে আসবে না। কথা কানে যায় না? বাঁদর ছেলে।
রাত দশটার মত বাজে। অন্যদিন এই সময়েও বাড়ি গমগম করে, আজ মনে হয় সবাই শুয়ে পড়েছে। বাড়ি নিঝুম। ইমন কি করবে বুঝতে পারছে না। এ বাড়িতে যদি ছোট চাচা থাকতেন তাহলে তাকে কানে কানে বললেই–যত রাতই হোক তিনি দোকান থেকে পেনসিল কিনে আনতেন। ছোট চাচা নেই। এখন যে সে কাঁদছে, ভয়ে কাঁদছে না–ছোট চাচার জন্যে কাঁদছে। কান্দতে কাঁদতেই তার মনে হল–বাবা থাকলে বাবা কি তার পেনসিল কিনে আনতেন? বলা যাচ্ছে না। বাবা কেমন ছিলেন, তিনি কি করতেন সে দ্রুত ভুলে যাচ্ছে। বাবার চেহারাও এখন তার মনে নেই, শুধু মনে আছে। বাবা খুব ফর্সা ছিলেন। আগের বাড়িতে বাবা-এবং মার একটা ছবি ছিল ড্রেসিং টেবিলে সাজানো। সেই ছবিটা এ বাড়িতেও নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু মা ট্রাংকে রেখে দিয়েছেন। ছবিটা সাজানো নেই। ছবি সাজানো থাকলে সে মাঝে মাঝে দেখত।
কে? কে বসে আছে?
ইমন চমকে উঠল— মিতু। অন্ধকারে পা টিপে টিপে কখন যে সামনে এসেছে সে বুঝতেই পারেনি।
ক্যাবলা, তোর কি হয়েছে?
চোখ মুছতে মুছতে ইমন বলল, পেনসিল হারিয়ে ফেলেছি।
পেনসিল হারিয়ে ফেললে এখানে বসে কাঁদছিস কেন?
ইমন জবাব দিল না। মিতু বলল, ফুপু বকা দিয়েছে?
হুঁ।
কি বলেছে পেনসিল না পেলে ঘরে ঢুকতে পারবি না!
হুঁ।
কি রঙের পেনসিল?
হলুদ।
আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি। একটা কথা শোন, তোর যদি কিছু হারিয়ে যায় আমাকে বলবি আমি এনে দেব। একা একা বসে কাঁদবি না।
ইমন ধরা গলায় বলল, আচ্ছা।
মিতু দুটা পেনসিল এনে দিল—একটা হলুদ, একটা সবুজ। হলুদটা স্কুল ব্যাগে রাখবে, সবুজটা কোথাও লুকিয়ে রাখবে। যদি আবারো পেনসিল হারায় তখন কাজে লাগবে।
সুরাইয়া ইমনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, পেনসিল পাওয়া গেছে? ইমন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সুরাইয়া বলল, আবার যদি কিছু হারায় টেনে তোমার কান আমি ছিড়ে ফেলব, বাঁদর ছেলে। আমি বাবার নাম ভুলিয়ে দেব। বাবা নেই, বাবার নাম মনে রেখে কি হবে? যাও হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে আস।
ইমন বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে এল। আগে মাঝখানে ঘুমুতেন। সুরাইয়া, তারা দুই ভাই বোন দুপাশে ঘুমুতো। এক রাতে সুপ্ৰভা গড়াতে গড়াতে খাট থেকে পড়ে গেল। তার পর থেকে সুপ্ৰভা মাঝখানে শোয়। শোয়ার এই ব্যবস্থােটা তার খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে সুপ্ৰভাকে হাত দিয়ে ছোয়া যায়। সুপ্ৰভা যখন জেগে থাকে তখন তাকে হাত দিয়ে ছুলে খুব মজার একটা কাণ্ড হয়, সুপ্ৰভা খিল খিল করে হাসতে থাকে। সেই হাসি আর থামে না। যে কেউ হাত দিয়ে ছুলে সুপ্ৰভা এমন করে না। শুধু ইমান হাত দিয়ে ছুলেই এমন করে। যেন তার হাতে হাসির কোন ওষুধ আছে। ইমন নিজে যখন সুপ্রভার মত ছোট ছিল তখন সেও কি এরকম করতো? মাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। ছোট চাচাকে জিজ্ঞেস করতে
হবে।
ইমন।
জ্বি মা।
স্কুলে পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
ভাল।
আকাশ ইংরেজী কি?
স্কাই।
বানান কর।
এস কে ওয়াই।
আকাশ নীল ইংরেজী কি?
দ্যা স্কাই ইজ ব্লু।
মাঝে মাঝে যে আমি তোমার উপর খুব রাগ করি তখন কি মন খারাপ হয়?
না।
মিথ্যা কথা বলছি কেন? যদি মন খারাপ হয় বলবে, মন খারাপ হয়। কি হয়?
হ্যাঁ হয়।
শোন, আমি নিজে নানান দুঃখ কষ্টে থাকিতো এই জন্য এমন ব্যবহার করি। আদর করা কি জিনিস ভুলে গেছি। যে আদর পায় না, সে আদর করতেও পারে না। বুঝতে পারছি?
হুঁ।
তোমার বাবাও কিন্তু আদর করতে পারত না। সব মানুষ সব কিছু পারে না। তোমার বাবা কি ভাবে তোমাকে আদর করত মনে আছে?
না।
সে অফিস থেকে এসে তোমাকে কোলে নিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটাহাঁটি করত— এইটাই তার আদর। চুমু খাওয়া, কিংবা উপহার কিনে দেয়া এইসব তার স্বভাবে ছিল না। তুমি বড় হয়ে কার মত হবে তোমার বাবার মত হবে?
না।
তাহলে কার মত হবে?
ছোট চাচার মত।
কেউ কারো মত হতে পারে না। সবাই হয় তার নিজের মত। তুমি হাজার চেষ্টা করেও তোমার ছোট চাচার মত হতে পারবে না, কিংবা তোমার বাবার মত হতে পারবে না। সব মানুষই আলাদা।
কচ্ছপ, কচ্ছপরাও কি আলাদা?
হঠাৎ কচ্ছপের কথা এল কেন? আর কোন কথা না, ঘুমাও।
আচ্ছা।
ও ভালকথা, তোমার ছোট চাচা তোমাকে নিয়ে দেশের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চায়। তুমি কি যেতে চাও?
আনন্দে ইমনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। তার ইচ্ছা করছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে। এমন চিৎকার যেন সুপ্রভারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভয় পেয়ে সেও যেন কাঁদতে থাকে।
কথা বলছি না কেন, যেতে চাও না?
চাই।
একা একা যেতে ভয় লাগবে না?
না।
আমাকে ফেলে রেখে যাবে কষ্ট হবে না?
না।
সেকি —আমাকে, সুপ্ৰভাকে ফেলে চলে যাচ্ছ, কষ্ট হবে না?
সুপ্রভার জন্যে হবে। সুপ্ৰভাকে তোমার আদর লাগে?
হুঁ।
আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে, এখন ঘুমাও। না-কি একটা গল্প শুনতে চাও?
ইমন গল্প শুনতে চাচ্ছে না, কিন্তু বুঝতে পারছে কোন একটা অদ্ভুত কারণে তার মার মন খুব ভাল। মা গল্প বলতে চাচ্ছেন। সেই অদ্ভুত কারণটা কি?
গল্প শুনতে চাও?
চাই।
একদেশে ছিল এক রাজ কন্যা। রাজকন্যা ছিল বন্দিনী। তার জীবনটা কাটছিল চারদেয়ালের মধ্যে। তার মুক্তির একটাই পথ—যদি কোন সাহসী রাজপুত্ৰ বাঘের চোখ দিয়ে মালা গেথে রাজকন্যার গলায় পরিয়ে দেয়। তবেই রাজকন্যা মুক্তি পাবে। গল্পটা কেমন লাগছে ইমন?
ইমন ফিস ফিস করে বলল, খুব ভাল লাগছে। আসলে গল্পটা তার মোটেই ভাল লাগছে না। বাঘের চোখের মালার কথা ভাবতেই তার ঘেন্না লাগছে। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে—অনেকগুলি বাঘ গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের কারোরই চোখ নেই। ভয়ংকর এক রাজপুত্র তাদের চোখ উপড়ে নিয়েছে। অন্ধ বাঘের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
তাহলে শোন—বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধারের জন্যে এক রাজপুত্র বের হল বাঘের সন্ধানে। তার খুব সাহস। সে দেখতেও খুব সুন্দর।
মা তার নাম কি?
ও আচ্ছা, তার নামতো বলা হয়নি। রাজপুত্র যেমন সুন্দর তার নামটাও খুব সুন্দর–রাজপুত্রের নাম ইমন কুমার। নামটা সুন্দর না।
ইমনের খুব লজ্জা লাগছে। রাজপুত্রের নাম আর তার নাম একই। ইমনের খুব ইচ্ছা করছে মার গায়ে হাত রেখে শুয়ে থাকতে। সেটা সম্ভব নামাঝখানে সুপ্ৰভা শুয়ে আছে।
ইমন।
হুঁ।
বাবা ঘুমাও। আমার গল্প বলতে আর ভাল লাগছে না।
সুরাইয়ার শুধু যে ভাল লাগছে না তা না, তার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। সে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল গল্পের মাঝখানে ইমন বলবে–মা, এই গল্পটা আমি জানি। তুমি অন্য গল্প বল। এই গল্প ইমনের বাবা ইমনকে বলেছিলেন। ছেলের সেই গল্পের কথা মনে নেই। বাবাকে এত দ্রুত সে ভুলে যাচ্ছে। এত দ্রুত?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here