গল্পঃ_হৃদয়ে_লাগিল_দোলা_ #পর্বঃ_৩৫ #লেখিকাঃ_নুসাইবা_জান্নাত_আরহা_ki

0
247

#গল্পঃ_হৃদয়ে_লাগিল_দোলা_
#পর্বঃ_৩৫
#লেখিকাঃ_নুসাইবা_জান্নাত_আরহা_

ড্রয়িং রুমে থমথমে ভাব বিরাজমান। মা বাবার সিদ্ধান্তের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি আর আলভি ভাইয়া। পাশেই মাথা নত করে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, শক্ত করে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বসে আছে আয়ুশী।

বাবার কথায় ধ্যান ভাঙল আমাদের। চকিত ফিরে তাই তার পানে চেয়ে রইলাম। গলা পরিষ্কার করে তিনি বললেন

-‘ আমি মেনে নিলাম। এখন তোমাদের কি অভিমত?

বাবার থেকে সম্মতি পেতেই আমি একপ্রকার লাফিয়ে উঠলাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে তাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললাম

-‘ ইউ আর দ্যা বেস্ট ফাদার ইন মাই ওয়ার্ল্ড!

আমার কথায় বাবা মুচকি হেসে পরম যত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমরা দুই ভাই-বোন যখন যা চেয়েছি তা দেয়নি এমন কখনো হয়নি! বাবার সাথে সাথে এবার মা-ও সম্মত হলেন। ওরা সেম এজের এই ব্যাপারটা শুনে প্রথম প্রথম তারা মানতে নারাজ হলেও এবার সম্মত হলো। যদিও এসবই হয়েছে আদ্রিশের জন্য, ও না থাকলে হয়তো সবকিছু এতো সহজে হতো না কখনোই। ফলে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ফিরে চাইলাম আদ্রিশের পানে। আমাদের চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আদ্রিশ। বুঝলাম সকালের ব্যাপারটায় লোকটা বেজায় চটে আছে!

আলভি ভাইয়া আর দেরি না করে চট করে বলে বসল

-‘ তবে আজ-ই আয়ুকে বিয়ে করে নিতে চাই আমি।

-‘ আজ! এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? আমরা তো মেনে নিয়েছি। আর আয়ুশীও তো পালিয়ে যাচ্ছেনা, তবে?

-‘ আমাদের বিয়েতে ওসব ঝই ঝামেলা করতে হবেনা বাবা। ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলেই বাঁচি। আর তাছাড়া আমরা তো মেহুর বিয়েতে হৈ হুল্লোড় করেছিই! তাই শুধু শুধু আর দেরি না ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হলেই হয়!

পুনরায় সবাই নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। ভাইয়া ভুল বলেনি কিন্তু আমার একটামাত্র ভাই বলে কথা, তার বিয়েটা এমন সাদামাটা হবে এটাই মানতে পারলাম না। তাই তীব্র প্রতিবাদের সহিত বললাম

-‘ তোর বিয়ে আমি ধুমধাম করেই দিব, ভাইয়া!

ভাইয়া এবার আমার পাশে এসে বসল। মিনমিন করে বলল

-‘ তোর বিয়েতে করা রিচুয়াল্সগুলো আমি আর আয়ুও মেইনটেইন করেছিলাম, মেহু। এখন শুধু বিয়ে করাটাই বাকি পড়ে আছে।

-‘ ওরে বাঁদর, তুই দেখি কয়েক ধাপ এগিয়ে! বলি তুই কি আমার ভাই নাকি ঐ খারুশটার ভাই?

আলভি ভাইয়ার কথার পিঠে উক্ত কথাটা বলে থামলাম আমি। ভাইয়া এবার শাসনের সুরে বলল

-‘ ভাইকে নিয়ে বাজে কথা বলবিনা মেহু! আদ্রিশ ভাইয়ের শালাবাবু হয়ে কিছুতেই এসব মানবোনা আমি! এমনকি তুই আমার আপন বোন বলেও কিন্তু চলবে না!

ভাইয়ের কথায় আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এ-ই না এসে আদ্রিশের নামে কতো সমালোচনা করত আমার সাথে। আর আজ এ-ই আদ্রিশের দলে পাল্টি খেয়ে গেল! কি জাদু করল আমার ভাইটার উপর ঐ খারুশটা!

.

বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর, কাজী ডাকা হয়। আলভি ভাইয়ার কথামতোই একেবারে জাঁকজমকহীনভাবে ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। ছোট বোনের বিয়ের পরের দিনই হুট করে বড় ভাইয়েরও বিয়ে হয়ে যাওয়াটা একটু অন্যরকম বইকি! এছাড়াও ঝড়বৃষ্টির সুবাদে আমাদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরাও রয়ে গিয়েছিল, ফলে তাদেরও আলভি ভাইয়ার বিয়েটা উপভোগ করার সৌভাগ্য হলো! মানে একে ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’ বলা চলে আরকি! অবশেষে আবারও পূর্ণতা পেল দুটি মানব-মানবীর ভালোবাসা! চোখের নিমেষেই সবটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে বলার বাইরে।

আমি, অরনী আর রিশতা মিলে ওদের বাসর ঘর সাজাতে ব্যস্ত! বিয়েটা সাদামাটাভাবে হলেও, বাসর ঘর তো আর সাদামাটাভাবে সাজানো যায়না। ফুলের পাপড়িগুলো দিয়ে বিছানা সাজাচ্ছিল, এমন সময় অরনী বলে উঠল

-‘ আচ্ছা আয়ুশী ভাবির কি মা বাবা বা কোনো গার্ডিয়ান নেই! মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল অথচ ওর কোনো আত্মীয়ের দেখা নেই, বিষয়টা কেমন হয়ে গেল না?

অরনীর কথায় ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বললাম

-‘ জন্মের পূর্বেই মেয়েটা বাবাকে হারিয়েছে আর জন্মের পর মাকে। ছোট থেকে বড় হতে হয়েছে নানাবাড়িতে। নানা-নানী যতদিন বেঁচে ছিল ততদিনই তার জীবনটা সুন্দর ছিল, আর যখনই তারা চোখ বুজলেন তখন থেকেই শুরু হয় তার মামির অত্যাচার। কোনোরকমে পড়াশোনা করে এই অবধি এসেছে। পরবর্তীতে তারাও আর খোঁজ নেয়নি আর ভাবিও ভার্সিটির হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। আর এখন সেই যোদ্ধা মেয়েটাই আমার ভাবি! আমার একমাত্র ভাইয়ের বউ সে!

আয়ুশী ভাবি সম্পর্কে অরনী বা রিশতার কেউই জানত না এসব। আমার কাছ থেকে শুনে তাই অরনী কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলল

-‘ ইশ! ভাবির কতো কষ্ট। আচ্ছা মামিরাও এমন হয় বুঝি? কই আমরাও তো মামাবাড়ি থেকে মানুষ হয়েছি, আমাদের সাথে তো দুই মামির একজনও খারাপ ব্যবহার করেনি কখনো। উল্টে তারা আরও নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখত আমাদের। আমার মনে পড়েনা যে কোনোদিন মেহরুন আর আমাদের আলাদা নজরে দেখেছে মামিরা!

রিশতা এতোক্ষণ চুপ করে শুনছিল আমাদের কথোপকথন। ও এবার চুপ না থেকে উৎফুল্ল হয়ে বলল

-‘ আমাদের মামিরাই পৃথিবীর সেরা মামিমা!

রিশতার সাথে তাল মেলায় অরনী। তা দেখে আমি অভিমানী সুরে বললাম

-‘ হুহ, মামা-মামি, মামাতো ভাই সবাই ভালো শুধু আমিই ভালো না।

আমায় এমন করতে দেখে ওরা দুজনে আমায় জাপটে ধরে বলল

-‘ তুই তো সবচাইতে ভালো মেহু। আমরা শুধু তিনবোনই না আমরা তিনজন বেস্টফ্রেণ্ড! দোয়া করি, আমাদের সম্পর্ক চিরকাল এমন অটুট থাকুক।

আমিও জড়িয়ে ধরলাম ওদেরকে। ওদের সঙ্গ পেয়ে আমার শৈশব-কৈশোর খুব আনন্দ উল্লাসে কেটেছিল। হাসি মজা করেই দিনগুলো পার করতাম আমরা। আর এখন সেসব মনে পড়লে খারাপই লাগে ভীষণ। অরনীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, আমি আর রিশতা একা হয়ে পড়েছি। প্রতি মুহুর্তে ভীষণভাবে মিস করি অরনীকে। এইযে পরশু সকালেই চলে যাবে মেয়েটা, ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে আমার!

-‘ এই আজ তো আবার আলভি ভাইয়া আর আয়ুশী ভাবির বাসর রাত! তো মশারী টানিয়ে বা কয়েল জ্বালিয়ে দে নয়তো দেখা গেল মেহুর মতো আয়ুশী ভাবিকেও মশায় কামড় দিয়ে বসল!

রিশতার কথায় ধ্যান ভাঙে আমার। অরনী ভ্রু কুচকে বলল

-‘ মেহুকে মশায় কামড় দিয়েছে! কই আমাদের বাড়িতে তো মশা নেই বললেই চলে।

-‘ আরে এটা কোনো সাধারণ মশা নয়, এটা অন্যরকম মশা। যে মশা শুধু বাসর রাতেই কামড়ায়! কি ঠিক বলিনি মেহু?

হুট করে রিশতাকে এমন টিপ্পনী কেটে কথা বলতে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। বুঝতে বাকি নেই সকালের বিষয়টা নিয়েই খোঁচা মারছে আমায়। তবুও কিছু বুঝতে না দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম

-‘ তখন থেকে কি কামড়াকামড়ির কথা বলছিস তোরা! কথা না বলে কাজে মন দে।

আমার কথায় ওরা কাজে মন দেয়, তবে অরনী কিছুক্ষণ পর পর আমায় দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। সেসবে পাত্তা না দিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোনিবেশ করলাম আমি।

বেশ সুন্দর করে ঘরটা সাজিয়ে, আমি বেরিয়ে পড়লাম আয়ুশী ভাবিকে নিয়ে আসতে। কোনোরূপ প্রসাধনী বিহীন সাজে বেশ মায়াবী দেখাচ্ছে ভাবিকে। ভাবি হয়তো ওতোটা ফর্সা নয়, তবে তার সৌন্দর্যেরও কোনো কমতি নেই। আমার কাছে মনে হয়, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর রঙ হলো শ্যামলা, ফর্সা রঙ তো বর্ণহীন। তবে বাস্তবে শ্যামলা রঙ বড়োই অবহেলিত! স্রষ্টার এই অপরূপ সৃষ্টিকে নিয়েও মাঝেমধ্যে মানুষেরা কটাক্ষ করতেও দুদণ্ড ভাবেনা! অথচ একদিন তো আমাদের আবারও ঐ মাটিতেই মিশে যেতে হবে, এটা তারা বেমালুম ভুলে যায়!

এসব ভাবতে ভাবতেই আয়ুশী ভাবিকে নিয়ে আলভি ভাইয়ার কক্ষে চলে এলাম। ভাবিকে দেখা মাত্রই ওরা বলে উঠল

-‘ মাশাআল্লাহ ভাবি, আলভি ভাইয়া আজ চোখ ফেরাতে পারবেনা তোমার থেকে!

ওদের কথায় লজ্জায় পড়ে যায় ভাবি। আমি ভাবিকে বসিয়ে দিলাম। ভাবি এবার আমার হাতটা টেনে বলল

-‘ তুমি অনেক ভালো মেহরুন। তোমার মতো এমন একটা মিষ্টি ননদিনী পেয়ে আমি ভীষণ প্রাউড ফিল করছি। সত্যিই তুমি আর আদ্রিশ ভাই না থাকলে হয়তো আর এসব হতো না! খুব ভালোবাসি তোমায় বোন।

-‘ বোন বলেই যখন ডেকেছো তখন আমায় বোনই মনে করো কেমন!

আমার কথায় আলতো করে হাসে ভাবি। আলভি ভাইয়া আসতেই আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম।

.

আলভিকে আসতে দেখে তাড়াহুড়ো করে মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে বসল আয়ুশী। আলভি ছোট ছোট পা ফেলে নিজের প্রেয়সীর দিকে এগিয়ে যায়। বুকের মাঝে ধুকপুক করছে তার। চার বছরের প্রণয়ের পর অবশেষে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে যে! সামনে থেকে ঘোমটা তুলতেই আবারও নজরে পড়ে পরিচিত সেই মায়াবী মুখশ্রীটার পানে। মুগ্ধ নয়নে কিছু সময় চেয়ে থেকে আলভি আড়ষ্ট গলায় বলল

-‘ মাশাআল্লাহ, আমার মায়াবতীকে ভারী মিষ্টি লাগছে তো আজ!

লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেলে আয়ুশী। আলভি আর দেরি না করে নিজের বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে নেয় তার প্রেয়সীকে। আয়ুশীও আলতো হাতে জড়িয়ে নেয় তার কাঙ্খিত পুরুষটিকে। দুজনের ভালোবাসার আলিঙ্গনে মুখরিত হয় চারপাশ। সূচনা হয় আরও একজোড়া মানব-মানবীর জীবনের প্রণয়ের বসন্ত!

.

আমরা বেরিয়ে পড়তেই অরনী আমার হাত টেনে মুচকি হেসে বলল

-‘ কিরে মেহু, আদ্রিশ ভাই অনেক বেশি রোমান্টিক, তাইনা?

আচমকা অরনী হতে এহেন প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে যাই আমি। বিরবির করে বললাম

-‘ বর আনরোমান্টিক হইলে বউয়ের জীবন অর্ধেক তেজপাতা হয়ে যায়, আর রোমান্টিক হইলে পুরোপুরি আওলায় যায় জীবনটা।

এতোটুকু কোনোরকম আওড়িয়ে চলে এলাম আমি।আমার কথা আদৌও ওরা শুনছে কিনা জানিনা তবে পেছন থেকে ভেসে এলো দুই তরুণীর হাসির ঝংকার। একদিকে এদের টিটকারি আর অন্যদিকে আমার জনাবের রাগ। লোকটা ভালোই চটে আছে আমার উপর, এজন্য তো সারাদিনে তার ছায়াও নজরে পড়েনি আমার। ঘরে গেলে কপালে কি আছে কে জানে!

(চলবে)

[পেইজটি ফলো করে রাখুন তাহলে নেক্সট পর্ব পোস্ট করার সাথে সাথে আপনার নিউজফিডে পেয়ে যাবেন]🖤🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here