গল্পঃ_হৃদয়ে_লাগিল_দোলা_ #পর্বঃ_৩৭ #লেখিকাঃ_নুসাইবা_জান্নাত_আরহা_

0
80

#গল্পঃ_হৃদয়ে_লাগিল_দোলা_
#পর্বঃ_৩৭
#লেখিকাঃ_নুসাইবা_জান্নাত_আরহা_

ব্যাগপত্র সব গোছগাছ করে, নিজেও তৈরি হয়ে নিলাম। উদ্দেশ্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যাওয়া। হুট করেই আদ্রিশের খেয়াল চাপল আজই কক্সবাজার যাওয়ার। তাছাড়াও তার ছুটির আর অল্প কিছুদিন বাকি রয়েছে, আবার আজকের এমন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া দেখে তার মনোবাসনা আরও প্রগাঢ় হয়। অগত্যা আর কাল বিলম্ব না করে আমাদের হানিমুনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে টিকিটটা তাই কেটেই ফেলল আদ্রিশ!

ঘুরতে শুধু আমরাই যাবোনা, সঙ্গে আরাভ ভাইয়া-অরনী, আলভি ভাইয়া-আয়ুশী ভাবিও যাবে। যেহেতু ওদের বিয়ে হওয়ার পরে কোথাও আর ঘুরতে যাওয়া হয়নি তাই ভাবলাম তিন জুটি মিলে ছোট-খাটো একটা ট্যুর দেওয়া গেলে খুব একটা মন্দ হয়না! আনন্দ ফূর্তিও হবে আবার নিজেরা নিজেরা একান্ত মুহুর্তও কাটানো যাবে!

এদিকে আমাদের এহেন তোড়জোড় দেখে রিশতাও বায়না জুড়ে দেয় আমাদের সঙ্গে যাবে বলে। হুট করে ওর এমন বায়না দেখে আমি এবার কিছুটা বিরক্তির সুরে বললাম

-‘ একমাস পর তোর ভার্সিটি এডমিশন পরীক্ষা। আর তুই কিনা পড়া বাদ দিয়ে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিস! ঘুরাঘুরি পরেও হবে, এসব বাদ দিয়ে চুপচাপ পড়তে যা।

আমার কথায় রিশতা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল

-‘ আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে থাকতে থাকতে তুইও তো ওনার মতো হয়ে গেছিস, দেখছি! একমাস তো এখনও অনেক সময়! দু’টো দিন যেয়ে একটু ঘুরে আসলে কি আর এমন হবে? দরকার পড়লে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে না পড়ে ন্যাশনালে পড়ব, তবুও আমি তোদের সাথেই যাব।

আমি রিশতাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, মেয়েটা ঐ পূর্বের ন্যায় নাছোড়বান্দাই রয়ে গেল! শেষমেশ অরনী তাই চুপ না থেকে বলে বসল

-‘ এই তুই আমাদের কাপলদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হবি কেন? তোর বিয়ে হলে তো তুই সুদ্ধ তোর জামাই নিয়ে ঘুরে আসতাম! কিন্তু আফসোস আমাদের সবার বিয়ে হয়ে গেলেও তোরটা আর হলো না!

এতোটুকু বলেই মুখ টিপে হাসে অরনী। ওর সাথে তাল মিলিয়ে আমিও হেসে ফেললাম। সময় পেলেই আমি আর অরনী মিলে রিশতাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা জুড়ে দেই। আমাদের টিপ্পনীতে, অস্ফুটস্বরে রিশতা বিড়বিড়িয়ে বলল,

-‘বিয়ে হয়ে গেছে বলে বাঁদরগুলো আমায় নিয়ে মশকরাও করছে। হায় কপাল আমার! জামাই তুমি কই, বিয়াত্তা বেডি হয়েও এসব সহ্য করতে হচ্ছে আমার!’

অস্ফুটস্বরে রিশতার প্রথমদিকের কথাগুলো কর্ণগোচড় হয়না তা আমার। ফলে আমি খিলখিলিয়ে হেসে ফেললাম। আমাদের সাথে এসে এবার যোগ দেয় আয়ুশী ভাবিও। মেয়েটা দু’দিন হলো আমাদের বাড়িতে অথচ এই মেয়েটা কতো আপন করে নিয়েছে আমাদের সবাইকে!

-‘ কি গো ননদিনী, কি এতো ভেবে হাসছো? বলি হানিমুনে গিয়ে আমাদের আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে কি কি করবে তা ভেবেই কি এতো খুশি?

আয়ুশীর কথায় আমার মুখের হাসি উবে যায়। যথারীতি এবারও একরাশ লজ্জায় মাথা নুইয়ে পড়ল আমার। গতরাতের কথা মনে পড়তেই আবারও অজানা শিহরণে শিউরে উঠলাম আমি। আদ্রিশকে লাল টুকটুকে বানাতে গিয়ে আমার-ই যে লাল,নীল,বেগুনি হবার উপক্রম হয়ে উঠেছিল! এসব ছাইপাঁশ ভাবনার মাঝেই অন্য এক ভাবনার আবির্ভাব ঘটে। ফলে আমার মুখের হাসি প্রগাঢ় হয় এবার। চট করে তাই মাথা তুলে, আয়ুশী ভাবির প্রশ্ন উপেক্ষা করে রিশতার উদ্দেশ্যে বললাম

-‘ চল তবে যাওয়াই যাক!

আচমকা আমার সম্মতি পেতেই খুশিতে নেচে ওঠে রিশতার মন। তবে অরনী আর আয়ুশী ভাবির ভ্রু কুণ্ঠিত হয় এতে। অরনী সন্দিহান চিত্তে বলে উঠল

-‘ এসব কি মেহরুন! তোর মাথা ঠিক আছে তো? আমরা কাপলরা মিলে হানিমুনে যাচ্ছি। আর তুই এর মধ্যে ওকে কেন টানছিস?

অধরের কোণে বাঁকা হাসির রেখা প্রশস্ত করে বললাম

-‘ হানিমুন নয়, আমরা চারজন মিলে ট্যুর দিব!

-‘ তাহলে হানিমুন! আর আমার জামাইটার ই-বা কি হবে?

-‘ তুই আছিস তোর জামাই নিয়ে। বলি বিয়ের পর কি আর আগের মতো আমরা তিনজন মিলে কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছি না একসাথে আর গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে। আর এখন তো আরও একজন সদস্য আই মিন আয়ুশী ভাবিও আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে। তাই ভেবে দেখলাম আমরা চারজন মিলেই ঘুরতে গেলে মন্দ হয়না বিষয়টা।

আমার সাথে একমাত্র রিশতাই সম্মত হয় তবে ওদের দুজনের মুখটা ভার হয়ে যায়। আয়ুশী ভাবি মন খারাপ করে বলল

-‘ আমাদের চাইতেও বেশি তোড়জোড় আমাদের জামাইদের। বেচারাগুলো চেয়েছিল বউ নিয়ে হানিমুনে যাবে আর তুমি কিনা ওদের আশায় জল ঢেলে দিতে চাইছো! এগুলো কি উচিত হচ্ছে ননদিনী?

-‘ ওরাও যাবে, আমরাও যাব। শুধু ওরা ওদের মতো যাবে আর আমরা আমাদের মতো। আর তাছাড়া জামাই খুব বেশি আহামরি কিছুই না, ছেলেরা রাতের বেলা ঘুমাতে ভয় পায় বলেই আমরা মেয়েরা বিয়ে করি, এছাড়া আর কিছুই না। আর একদিনেরই তো ব্যাপার। এতো মন খারাপ করো না তো ভাবি।

আমার এহেন কথায় ওরা না হেসে পারল না।

জরুরী কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছে যাচ্ছিল আদ্রিশ। এমন সময় তার বউয়ের মুখে উক্ত কথাগুলো কথা শুনে থেমে যায় তার চরণ দু’খানা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাই ভ্রু উঁচিয়ে খানিকটা বিষ্ময় নিয়ে চাইল আমার পানে। চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইল, ‘তাই নাকি?’ তার পানে চেয়ে সূক্ষ্ম হেসে মাথা নাড়ালাম। আদ্রিশ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ধুপধাপ পা ফেলে গাড়ির দিকটায় চলে যায়। তা দেখে আরও একদফা হাসলাম। ভেবেছিলাম, ‘লোকটা হয়তো এর তীব্র প্রতিবাদ করবে কিন্তু কিছু না বলাতে আমার কাজটা সহজই হলো।’

আর কথা না বাড়িয়ে আমরাও চললাম গাড়ির দিকে। গাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব আগে থেকেই রাখা হয়েছে। আমাদের যেতে দেখে বাদ যায়না আহিরও। সে-ও এসে বলে বসল, ‘রিশতা গেলে আমিও যাব!’

আহিরকেও এমন করতে দেখে অরনী দাঁতে দাঁত চেপে বলে

-‘ ভাই, আমরা হানিমুনে যাচ্ছি, তোদের সবডিরে নিয়ে ঘুরতে না। আমাদের মাঝে তোরা দুইটা মিলে কাবাব মে হাড্ডি কেন হচ্ছিস? এমন হলে আমি আর যাব না!

আহির অসহায় ভঙ্গিতে বলল

-‘ তাহলে আমাদেরও কাপল বানিয়ে দাও, তবুও নিয়ে চলো না!

-‘ কি দু’দিনের ছোকরা বলে কি-না কপাল বানিয়ে দিতে! এই তুই এখনও ভার্সিটিতেই উঠিসনি, তুই আবার কারে বিয়ে করবি?

-‘ কেন তোমার বোন রিশতা আছে তো!

বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে উক্ত কথাগুলো বলে ওঠে আহির। এদিকে অরনী কটমট করে তাকায় আহিরের দিকে। ক্রুদ্ধ গলায় বলল

-‘ এই তোর বয়স হয়েছে? নাক টিপলে সর্দি পড়ে, সে কি-না বিয়ে করবে!

-‘ বয়স আমার বিশ হলেও, সার্টিফিকেটে একুশ দেওয়া। অর্থাৎ বিয়ের বয়স হয়েছে আমার। আর তাছাড়াও রিশতার সাথে আমার বিয়ে হয়ে…

এতোটুকু বলতে বলতেই থেমে যায় আহির। দুম করে রিশতার চিমটিতে তার হুশ ফেরে। অরনীসহ আমরা সকলে বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম। দুজনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়।

অরনী এগিয়ে যায় রিশতার দিকে। অতঃপর ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল

-‘ আমাদের সকলের থেকে লুকিয়ে বিয়েও করে নিয়েছিস তোরা?

মাথা নত করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিশতা। পরবর্তীতে আহিরের থেকে জানলাম ওরা নাকি দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছে। অথচ আমরা বুঝতেও পারিনি। একবার জানানোরও প্রয়োজন বোধ করল না ওরা! কাওকে না বলুক অন্তত আমায় তো জানাতে পারত! ফলে আমরা কেউই মেনে নিলাম না।
তবে শর্ত জুড়ে দিলাম, ‘আমরা মেনে না নেওয়া অবধি ওরা দেখাও করতে পারবেনা, একসাথে থাকতেও পারবেনা।’

আমার শর্তে ওরা মাথা নেড়ে সম্মত হয়। তবে আকুতি ভরা গলায় বলল,‘ওদের নিয়ে যেতে।’ শত নাটকীয়তার পর অবশেষে ওদের নিয়ে যেতে সম্মত হলাম আমরা। কেননা সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ আর কবে হবে বলা মুশকিল। এরপরে আদ্রিশের হসপিটালের প্রেসার শুরু হবে, আমারও পড়াশোনা শুরু হবে, তাই দ্বিমত করলাম না আর।

ভাগ্যিস আদ্রিশ, আরাভ আর আলভি ভাইয়ার সাথে কথা বলাতে ব্যস্ত ছিল নয়তো ও জানলে আহিরের আজ খবর ছিল!

সবশেষে মা-বাবা, চাচ্চু-মামনির থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
চাচ্চুর গাড়িতে আদ্রিশ, আহির, আরাভ ভাইয়া, আলভি ভাইয়া আর বাবার গাড়িতে আমি, রিশতা, অরনী, আয়ুশী ভাবি উঠলাম। পরবর্তীতে আমি নিজেও ড্রাইভিং শিখেছিলাম, তাই আমাদের ড্রাইভারের কোনো প্রয়োজন পড়ল না আর। গাড়িতে ওঠার আগে অবশ্য আদ্রিশ আহির, রিশতাকে দেখে ঝামেলা করেছিল তবে আমি কোনোমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সামাল দিলাম ব্যাপারটাকে।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দিলাম। আদ্রিশদের গাড়িকে ফলো করে আমিও গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। আমার এমন গুণ দেখে ওরা বাহবা না দিয়ে পারলো না। তা দেখে বিনিময়ে সূক্ষ্ম হাসলাম শুধু।

অবশেষে দীর্ঘ এক পথ পাড়ি জমিয়ে পৌঁছে এলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। এখানেরই এক রিসোর্ট আগে থেকেই বুক করে রাখা ছিল। আমরা ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে চলে এলাম। ততক্ষণে রিশতা, অরনী দুজনেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আমি আর আয়ুশী ভাবি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া সেরে চারপাশটা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। তবে বেশিক্ষণ আর স্থায়ী হলো না তা কেননা ততক্ষণে মাগরিবের আজান পড়ে গিয়েছিল, তাই যে যার কক্ষে চলে এলাম। নামাজ আদায় শেষে আমরা চারজন মিলে আড্ডা দেওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সময় পেরিয়ে গিয়েছে খেয়াল নেই তা। এর মাঝেই কক্ষের বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। ফলে ঘরটা একেবারে জমাট বাঁধা আঁধারে ছেয়ে যায়। আমি হাতড়ে মোবাইল খুঁজতে আরম্ভ করলাম, ফ্লাশ লাইট জ্বালানোর জন্য কিন্তু মোবাইল পেলাম না কোথাও। এদিকে এতোক্ষণ হয়ে যাওয়ার পর ওদের সাড়াশব্দ না পেয়ে তাই বলে উঠলাম

-‘ কিরে তোদের কোনো সাড়াশব্দ নেই যে! তোরা বেঁচে আছিস তো!

না আমি কথা বলাতেও কারো কোনো সাড়াশব্দ এলো না। এবার আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। নতুন জায়গা, কাওকে তেমন চিনিও না, তার উপর আবার এমন অন্ধকার। এবার তাই আমি হাঁক ছেড়ে ওদের ডাকলাম। তবুও সাড়া নেই। গেল কই সব? একটু আগেও তো এখানেই ছিল, তবে!

ম্যাচের কাঠির ঘর্ষণে হুট করেই জ্বলে ওঠে আলো! আলোর সন্ধান পেতে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার আগেই তা আবারও নিভে যায়। আমি এবার কিছুটা চেঁচিয়ে বললাম

-‘ কে কে ওখানে? আলো আঁধারে এমন লুকোচুরি না খেলে, সাহস থাকলে সামনে আসুন আমার!

এরপর কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, চারপাশে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। নিস্তব্ধতা ভেদ করে আমি আবারও বলে উঠলাম, ‘কে ওখানে?’ পূর্বের ন্যায় পুনরায় আলো জ্বলে ওঠে এবার। মোমের আলো তার হলদে মুখশ্রীতে পড়তেই চিনতে অসুবিধে হয়না আমার। অধরের কোণে চমৎকার এক হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল

-‘ ভয় পেও না বউ, আমি তোমার শাশুড়ির ছেলে!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here