ছায়া নীল !
২০.
আমি দৌড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু পারছি না। মনে হচ্ছে কেউ আমার পায়ে পাথর বেধে দিয়েছে। আমি দৌড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছি আর মানুষ না কী বলবো বুঝতে পারছি না, আমার দিকে উল্টো হেটে এগিয়ে আসছে।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ভয়ে।জিনিষ টা কাছে আসলেই আমি মারা যাবো। এটা কখনো নীল হতে পারেনা। নীল আমাকে অনেক ভালবাসে। ও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা।
মনে হলো কেউ আমার হাত ধরলো। আর বলল
– শারলিন তুমি এখানে কেনো?
আমি সেই কণ্ঠস্বরের দিকে তাকিয়ে দেখি নীল। ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবলাম ওটাই এদিক দিয়ে এসেছে নাকি?
আমি হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে গিয়ে বললাম
– আপনি কে?
– আরে আমি সৌরভ। তোমাকে রুমে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে আমি এখানে এসে দেখি তুমি রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছো।
ভয় কিছুটা কমাতে ওর কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম
– তুমি তো এখানে নিয়ে এলে!
– আমি? আমি তো বাথরুমে ছিলাম।
– তাহলে দরজা খুলতে দেখলাম, আমাকে ইশারায় ডাকলে। তুমি এই পানিতে নামলে।
– শারলিন পানিতে নামলে আমার শরীর ভেজা থাকবে কিন্তু আমার শরীর তো শুকনা।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম তাই সহজে বুঝতে পারলাম যে ওর শরীর শুকনা।
আমি বুঝতেই পারছি না কী হচ্ছে?? আশেপাশে সব অন্ধকার হয়ে গেলো, আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। মাটিতে লুটিয়ে পরলাম। চোখ যখন ভাঙলো তখন বুঝলাম আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আমাদের রুমে লাইট জ্বালানো। এখনো সকাল হয়নি। সৌরভ বিছানার উপর আমার পাশে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। আমি বললাম
– ঘুমাও তুমি।
ও চমকে উঠে বলল
– নাহ তুমি কোথায় না কোথায় চলে যাও।
আমি উঠে বসলাম তারপর বললাম
– তুমিই নিয়ে গিয়েছিলে।
সৌরভ বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল
– আমি তোমাকে নিয়ে যাবো কেনো? আর নিয়ে গেলেই বা তোমাকে ভয় কেন দেখাবো?
– সেটাই তো আমার প্রশ্ন।
– আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি তুমি বিছানায় নাই। ভাবলাম পানি পান করতে গিয়েছো। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর যখন তুমি এলেনা তখন রুম থেকে বেড়িয়ে দেখি মেইন দরজা খোলা। আমি খুঁজতে খুঁজতে আধমরা হয়ে গেছি। পরে ভাবলাম তুমি পুকুরপাড় এর কথা বলেছিলে।
– তুমি সত্যি বলছো তো? আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি নীল অনেক…
– শারলিন তুমি অনেক ভয় পেয়ে আছো। যেভাবেই হোক তোমার ভয় কাটানো দরকার।
– কীভাবে??
– ওই জিনিষ টার কাছে গিয়ে তোমার ভয় কাটাতে হবে।
– তুমি কীভাবে জানলে আমি কী দেখেছি?
– তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবার পর থেকে জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অনর্গল একই কথা বলছিলে। কিছুক্ষণ পর পর ভয়ে কেপে উঠছিলে।
– আমি কী করবো??
– এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে আমাদের। কিন্তু…… বাসা বদলানো হলেও এটা পিছু ছাড়বে না।অফিসের পাশের রুমেও তুমি ভয় পেয়েছিলে তাই না?
– হুম। আমি যা দেখেছি তুমিও দেখেছো?
– নাহ, আমি শুধু দেখেছি তুমি রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছো।
– তুমি ভয় পাও নাই এতো রাতে একা এই জংগলে মানে এরকম ঝোপঝাড়ে?
– শারলিন আমি অনেক সাহসী। তবে এখন সাহস কমেছে। কারণ এখন আমি একা নই। আমার নিজের প্রতি কোনো ভালবাসাই নাই কিন্তু শারলিন তুমি আমার যতোটা কাছে এসেছো ততটাই আমি ভিতু হয়ে যাচ্ছি। সবসময় একটা ভয় একটা ভীতি কাজ করে তোমাকে ঘিরে। আসলেই এটা সত্যি * ভালবাসার মানুষের খুব কাছে যাওয়া ঠিক না। * হুমায়ূন স্যার ঠিকি বলেছেন।
আমি দূরে যেতে পারবো না। না হয় আমি এর শেষ দেখেই দম ছাড়বো আর তা না হলে আমি এর একটা বিহীত করবো।
– তুমি কী করবে?
সৌরভ বলল
– সেটা সকালে দেখা যাবে। এখন ঘুমাও।
– তোমার অফিস আছে না?
– হ্যা। আমার খুব ঘুম আসছে।
– তাহলে তুমি ঘুমাও আমি জেগে থাকি।
সৌরভ হাম ছাড়তে ছাড়তে বলল
– দুজনে ঘুমাই তা না হলে ঘুমের অভাবে আমরা দুটাই পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।
– যদি আবার সেইটা আসে?
সৌরভ বালিশে মাথা রেখে বলল
– ভূতের ভয়ে এখন ঘুম বাদ দিবো। প্রবাদ আছে একটা। শুনবা?
– না।
– চোরের ভয়ে ন্যাংটো হয়ে থাকা। আমাদের দশা এখন তাই হয়েছে।
– ছিঃ এগুলা কী বলো?
– আমি তো বলেছি আর তুমি তো স্বয়ংবর ন্যাংটো ভূত দেখে এসেছো।
ভয়ে এতোটাই অস্থির ছিলাম যে ভূত বস্ত্র ছাড়া না সহ সেটা আমার উপর প্রভাব ফেলতে পারেনি।
ঘুম ভাঙল যখন তখন আশেপাশে ও নেই। ঘড়িতে দেখলাম সকাল ১১ টা। ওর বালিশের উপর চিরকুট রাখা। লেখা
– দয়া করে রান্না করে রাখবেন। দুপুরবেলা বাসায় খাবো।
চিরকুট পেয়ে তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। খাবার টেবিলে নাস্তা রাখা। ফুপুকে পেলাম না বাসায়। এর অর্থ বাসায় আমি একা!
এই বাড়িতে একা থাকার কোনো মানে হয়না। নাস্তা করে রান্নায় মনোযোগ দিলাম। রান্না করার মতোন তেমন কিছুই বাসায় নাই। ভাত রান্না করলাম আর ডিম ছিলো তাই ডিম আলু দিয়ে ঝোল রান্না করলাম। কোনো মশলাপাতিও নেই। কেউ কি বিশ্বাস করবে যে এই বাসায় খাবার মতো কিছুই নেই।
রান্না শেষ করলাম ১.৩০ এ। ড্রয়িংরুম এ বসে বসে মোবাইলে গেমস খেলছি। এই বাড়িটা ডুপ্লেক্স কিন্তু আজব ব্যাপার হচ্ছে দোতলায় কেউ যায়না। কেনো যায়না??
দোতলার দিকে তাকাতেও কেমন লাগে। মোবাইলে গেমস খেলছি হঠাৎ আওয়াজ হলো। ভাবলাম ইঁদুর বিড়াল হবে। কিন্তু আওয়াজ টা ক্রমাগত বাড়ছেই। তারপর দরজা খুলে যাওয়ার আওয়াজ হলো। আওয়াজ টা দোতলা থেকে এসেছে। ড্রয়িংরুম এ বসলে দোতালা টা দেখা যায় খুব ভালো ভাবে। আমি যেখানে বসে আছি ঠিক সেই বরাবরের একটা রুমের দরজা খুলে গেলো।
তারপর দরজাটা বারবার ধাক্কা লাগছিলো। বাতাসে দরজা খুলে গেছে। এই আওয়াজে মাথা ব্যথা করছে। তাই মোবাইল রেখে দোতালায় উঠে এলাম। এতো ময়লা জমেছে যে দেখেই মনে হচ্ছে অনেক দিন যাবত পরিষ্কার করা হয়না। দোতালায় উঠার পর কেমন একটা গন্ধ নাকে আসছে। আমি একবার কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি তে ঢুকেছিলাম ফ্রেন্ডের সাথে। কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি তে কেমিকেল এর গন্ধ প্রচুর। ঠিক সেই রকমের গন্ধ নাকে আসছে। বুঝলাম না এখানে এই ধরনের গন্ধ কীভাবে আসলো।
দরজা আটকাতে যাবো তখন রুমের মধ্যে চোখ গেলো। মাকড়শারজাল দিয়ে ভরা। অন্ধকার আর কেমন সেই কেমিকেল গন্ধ দিয়ে পরিপূর্ণ। দরজা আটাকাতে পারছি না। এতো শক্ত দরজা কীভাবে খুললো? আর এতো জং ধরেছে স্ক্রু নাটে যে দরজা নড়ছেই না। কিন্তু আমি নিচে থেকে তো দেখলাম দরজা বারবার ধাক্কা খাচ্ছে।
মনে হয় দৃষ্টি ভ্রম হয়েছিলো। আমার ওড়না দরজার সাথে এমন ভাবে আটকালো যে বাধ্য হয়ে রুমের মধ্যে ঢুকতে হলো।
রুমের দক্ষিণ পাশে বিশাল আলমারির মতো যার চার দেয়াল কাচের। সেই কাচের মধ্যে একজন মধ্যবয়সী পুরুষের দেহ। যার দুটো চোখই খোলা। মনে হচ্ছে চোখ দুটো কোটর থেকে বের হয়ে যাবে। দেহটা তরল পদার্থ এর মধ্যে রাখা। কারণ চুল গুলো নড়ছিলো। জানি না কার দেহ। কী ভয়াবহ জিনিষ দেখছিলাম সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না।তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে এখান থেকে আমার চলে যাওয়া উচিৎ।
আমি ওড়ানা রেখেই দৌড়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। কিন্তু হোচট খেয়ে পরে গেলাম।
চলবে…….!
~ Maria Kabir