ছায়া নীল পর্ব-১৯

0
190

ছায়া নীল !

১৯

সৌরভ বলল
– চোখ নামালে কেন?
– মুগ্ধতা দেখে, এতো মুগ্ধতা আমি কখনো তোমার চোখে দেখিনি।
– কখনো বিয়ের শাড়ীতে এতো কাছ থেকে দেখিনি বলে।
কখনো এই আলো ছায়ার খেলাতে এতো কাছ থেকে আমার স্বপ্নময়ীকে তো দেখিনি বলে!
ওর এসব কথায় আমার মাঝে নতুন আশা জেগে উঠছে। মনে হচ্ছে, পুরোনো কথা থাক না।
ও মোমবাতি নিভিয়ে দিলো। পুরো অন্ধকার নেমে এলো আমাদের মাঝে।
সৌরভ বলল
– ভয় করছে?
– হুম, কিছুটা।
– অন্ধকার ভীতি আছে নাকি?
– জানি না।
– তাহলে?
– জানি না। তোমাকে হারানোর ভয় করছে। মনে হচ্ছে এই ঘোর অন্ধকারে তুমি হারিয়ে যাবে।
– এটা সাময়িক অন্ধকার। ইচ্ছে করে করেছি।
– জানি তো।
– তাহলে?
– জানি না।
– আচ্ছা তুমি জানোটা কী?
– তোমাকে আমার চাই এটুকু জানি।
– পেয়েছো তো ।
– হ্যা কিন্তু….
– কিন্তু কী?
নিশ্বাস ভারী হতে শুরু করেছে…….
সৌরভের ডাকে ঘুম ভাঙলো। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে খুব হাসিখুশী মুডে দেখলাম। আমি বললাম
– কয়টা বাজে নীল?
ও একটু হেসে বলল
– ১১ টা বাজে। খুব খিদে পেয়েছে বলেই তোমার ঘুম ভাঙালাম।
– তুমি খেয়ে নিলেই তো পারতে বা আমাকে ডাকলেও পারতে।
– নাহ, কতোদিন পর শান্তিতে ঘুমালে তাই ডাকতে ইচ্ছে করছিলো না।
– তুমি অফিসে যাবে না?
– না। এখন বাসায় যাবো। ফার্নিচার আর মালপত্র নিতে হবে।
– কেনো?
– বাসার সবকিছুই পুরাতন মডেলের তাই নতুন মডেলের কিছু ফার্নিচার কিনলাম।
– করো টাকাপয়সা খরচ। তাছাড়া আর কী করবা?
– বাদ দাও লেকচার। নাস্তা করে সবকিছু গুছিয়ে রাখো।
নাস্তা করার ইচ্ছে নাই। রীতিমত জোড় করে।
সবকিছু গুছিয়ে আবার জার্নি করতে হবে। জায়গা আর পায়নি বাড়ি করার। ভুতুড়ে বাড়ি আর বিশাল বিশাল গাছে ভরপুর।
বিকালবেলা বাসায় পৌঁছালাম। ও ফার্নিচার এর সাথে ৫-৬ জন লোক এনেছে। তারাই সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছে। আমার বাধ্য হয়ে ফুপুর রুমে বসে থাকতে হচ্ছে। ফুপু কোনো কথা বলছেনা। আসার পর থেকে তার মুখে একটাও কথা শুনিনি। তার মুখে কোনো বিরক্তি নেই কিন্তু স্বস্তিও নেই। আমি নিজেই কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় পড়েছি। কোনো উত্তর পাইনি।
সন্ধ্যার পর সৌরভ এসে আমাকে বলল
– লোকজন চলে গেছে, তুমি আসো।
আমি রুম থেকে বের হবার পর সৌরভ বলল
– শারলিন রান্না করা আছে নাকি দেখো তো?
– যদি না থাকে?
– তুমি কষ্ট করে শুধু ভাত রান্না করে দিও।
– কষ্ট হবেনা।
আমি রান্নাঘরের দিকে গেলাম। খাবার রাখার র‍্যাক খুঁজে দেখলাম রান্না করা নাই।
চাল কোথায় রেখেছে সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না। সৌরভ আর ফুপুর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। দুজনেই জোড়ে জোড়ে কথা বলছে। কিন্তু কী বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। সৌরভের কণ্ঠস্বরে বুঝতে পারছি যে ও খুব রেগে যাচ্ছে। ফুপুর কণ্ঠস্বর শান্ত কিন্তু অবাক কাণ্ড হচ্ছে তাদের কথা আমি বুঝতে পারছিনা। ফুপুর রুমের দিকে যাচ্ছি তখন সৌরভও বের হয়ে আসলো। ওর চোখ লাল আর শরীর কাঁপছে। আমাকে বলল
– এখানে কী করছো?
– মানে চাল খুঁজে পাচ্ছি না তাই ভাবলাম।
– এসো আমার সাথে….
ওর শরীর কাঁপছে কিন্তু কণ্ঠস্বর শান্ত। একটু আগেও ওর কণ্ঠস্বর এতোটা শান্ত ছিলোনা।
কে স্বাভাবিক আর কে অস্বাভাবিক আমি বুঝতে পারছি না।
এক হাত দিয়ে কাজ করা বেশ কষ্টের। সৌরভ পাশেই টুল নিয়ে বসে আছে। চাল ধুতে গিয়ে ঝামেলায় পরলাম। কাটা হাতে ব্যথা পেলাম। সৌরভ বলল
– কীভাবে কী করতে হবে বলো। আমি করে দিচ্ছি।
– না না থাক আমি পারবো।
– যা বলছি তাই করো।
বাধ্য হয়ে আমাকে মুখে মুখে বলতে হলো আর ও খুব শান্ত ভাবেই করছে। দেখে মনে হচ্ছে এতো শান্ত স্বভাবের ছেলে আমি কখনো দেখিনি।
ভাতের মাড় গালতে গিয়ে ওর হাতের উপর গরম ভাতের মাড় পরলো। হাতে তাড়াতাড়ি করে ঠাণ্ডা পানি ঢেলেও কাজ হলো না। হাত পুড়ে গেছে এমন দাগ হয়ে রইলো। ব্যথায় ওর মুখ কিছুক্ষণ পর পর কুঁকড়ে উঠছে। আমার নিজের কাছেই অপরাধী লাগছে নিজেকে।
ভাত আর ডিম ভাজা দিয়ে রাতের খাওয়া হলো। ফুপু এখনো আমার সাথে কোনো কথা বলছে না।
আমাকে মনে হয় তার পছন্দ হয় নাই। তা না হলে কেউ এভাবে কথা না বলে থাকতে পারে??
সৌরভ ও খুব চুপচাপ।
আসার পর থেকে এখনো রুমে ঢোকা হয়নি।
রুমে ঢুকে আমার চোখ চরখগাছ ! পুরো রুমের চেহারাই চেঞ্জ।
পিছন থেকে ও বলল
– কেমন লাগছে এখন?
– অনেক সুন্দর। তুমি পুরো বাড়ি সাজাতে পারতে।
– মা পছন্দ করবে না।কারণ জানতে চাবা না।
– আচ্ছা। রুমে দেখি টেলিভিশনও আছে।
– হ্যা, আর নতুন মোবাইল সিম কার্ড এনেছি যতো ইচ্ছা আমাকে ফোন করবে। কারণে অকারণে ফোন করবে।
– কী কথা বলবো শুনি?
– কথা বলার দরকার আছে কী? নিশ্বাসের শব্দ শুনতেও ভালো লাগবে।
– আচ্ছা তুমি পুকুরপাড় না কী বলছিলে নিয়ে যাবার কথা?
– এতো রাতে যাবা?
– তুমি সাথে থাকলে আর ভয় কী?
– হ্যা কিন্তু এখন বাইরে না যাওয়াই ভালো।
ওর পোড়া হাতে দেখলাম সাদা রঙের কাপড় বাঁধা।
ও ঘুমিয়ে পড়লো আমিও ঘুমানোর জন্য শুয়ে পরলাম।
শুয়ে পরার সাথে সাথে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো খুব পানি তৃষ্ণায়। এতো পানি তৃষ্ণা মনে হলো কখনো লাগেনি।
চোখ খুলে দেখি ও আমার পাশে নেই। কোথায় গেলো? বাথরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলাম লাইট জ্বলছে। যাক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
পানি খাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হলাম। রান্নাঘরের দিকে এগোবো আর দেখি সৌরভ মেইন দরজা খুলছে। ও আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে কাজটা করছে।
তারপর ও বের হয়ে গেলো। মনে হলো ও আমাকে হাতের ইশারায় ডেকেছে ওর পিছুপিছু যাওয়ার জন্য।
ওকে বলেছিলাম পুকুরপাড় এ যাওয়ার কথা। ও মনে হয় রাজি হয়েছে।
আমিও ওর পিছুপিছু হাঁটছি। ও একবারো আমার দিকে তাকালো না।
আমি যন্ত্রের মতো ওর পিছুপিছু হেটেই যাচ্ছি। মনে হচ্ছিলো নেশারঝোঁক এ আছি। বাহিরে একদম অন্ধকার না। চাঁদেরহাট মনে হয়েছে বসেছে আজ এই বাড়িতে।
একসময় ও থেমে গেলো। আমিও থেমে গেলাম। এতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এখন চোখ পড়লো সামনের বিশাল পুকুরে না না এতো বিশাল জলাশয়কে পুকুর বলা চলেনা। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখ ওর দিকে স্থির হয়ে গেলো। ঘুমানোর সময় দেখেছিলাম ওর পোড়া হাতে সাদা কাপড় বাধা কিন্তু এখন কোনো হাতেই দেখছি না।
ও মনে হয় খুলে রেখেছে। আবার তাকিয়ে দেখি হাতে সাদা কাপড় বাধা। কেবলি দেখলাম হাতে কাপড় নেই আবার এখনি কীভাবে??
তারপর যা হলো সেটা আমি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। ও কাপড় চোপড় খুলে পুরো খালি গায়ে পানিতে নামলো। আস্তে আস্তে ও পানির মধ্যে হারিয়ে গেলো। কাপড় চোপড় যে খুলেছে সেটা তো পাশেই থাকবে কিন্তু তাও নাই।আর ও যা যা করছে সব আমার দিকে পিছন ফিরে করছে।
খেয়াল করলাম আমার শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। আমার ভেতর থেকে কেউ বলছে
– চলে যা এখান থেকে।
আমি বললাম
– না
আবারো ভেতর থেকে কেউ বলল
– শোন আশেপাশে না তাকিয়ে এক দৌড়ে বাসায় উঠবি।
– নাহ।
– যা বলছি শোন !
আমি এক পাও নড়াতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর মনে হলো পানিতে কিছু একটা ভেসে উঠেছে। আস্তে আস্তে সেটা ডাঙার দিকেই আসছে। যখন এটা বেশ কাছে চলে আসলো তখন খেয়াল করলাম একজন মানুষের দেহ। সৌরভ পানিতে নেমেছিলো ওর নাকি?
ঘামছি খুব আমি। চোখের পলক পরতেই খেয়াল করলাম পানিতে আর সেটা নেই। এখন আমার দিকে পিছন ফিরেই দাঁড়িয়ে আছে ও। মনে হচ্ছে আমার দিকে এগিয়ে আসছে তবে উল্টো হেটে। হাটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে উল্টো হাটাতেই এক্সপার্ট।

চলবে………!

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here