দরিয়া পর্ব – ৮ (শেষ পর্ব)

0
346

দরিয়া
পর্ব – ৮ (শেষ পর্ব)
আমিরাহ্ রিমঝিম

তুরাগ মারা গিয়েছিলো নয়দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর। মাথায় খুব বাজেভাবে আঘাত লেগেছিলো তার। প্রথমে স্থানীয় এক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়, তারপর নেয়া হয় ঢাকায়। কিন্তু লাভ হয়নি। তুরাগ চোখ মেলেনি আর।

আফিয়ার কাছ থেকে এটুকুই জানা গিয়েছিলো যে তুরাগ ছাদের রেলিংয়ে বসে ছিলো। সবাই আফসোস করলো, আহারে, ছেলেটা এভাবে বেখায়ালে ছাদ থেকে পরে মারা গেলো? আফিয়া সবার কথা শুনে যেতো চুপচাপ। সারাজীবন নিজেকে সাহসী ভেবে আসা আফিয়ার সেসময় সত্যটুকু স্বীকার করার সাহস হয়নি।

একটা ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিলো আফিয়া। এটা কি হয়ে গেলো ওর দ্বারা? অনুশোচনা, আফসোস, অপরাধবোধ যেন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলো ওকে। কি করলো সে? কি করলো?

সময়ের সাথে সাথে নাকি যন্ত্রণা কমে। কিন্তু দিন যত গেলো, আফিয়া যত বেশি উপলব্ধি করতে পারলো, তত যেন যন্ত্রণা বাড়তে লাগলো ওর। যে আচরণ গুলো করতো সে মানুষের সাথে, বিশেষ করে তুরাগের সাথে, সেটাই সারাজীবন অনুশোচনার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আর ও তো…….ও তো……….

দিন দিন আফিয়ার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। মেয়ের চিন্তায় আফিয়ার বাবাও অসুস্থ হয়ে যান। মালতীর বেশ ভালো এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছিলো, কিন্তু আফিয়াকে সে এই অবস্থায় রেখে যেতে চাইলো না। সেই বিয়েটা ভেঙে গেলো।

এক সময় আফিয়ার বাবা মারা গেলেন। আফিয়াকে ওর চাচা এসে নিয়ে গেলেন নিজের বাসায়। মালতীও চলে গেলো বাবা মায়ের কাছে। এরপর থেকে চাচার কাছেই রয়েছে আফিয়া।

…………………………………………………………………………

রাত্রিবেলা। চোখ মেলে তাকিয়ে আফিয়ার প্রথমে মনে হলো ও সেই বাড়িটাতে রয়েছে, সমুদ্রের কাছে তাদের সেই বাড়িটাতে। কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো ও একটা রিসোর্টে আছে। সেই বাড়িটা তো ওই ঘটনার তিন বছর পর বিক্রি করে দিয়েছিলেন আফিয়ার বাবা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে আফিয়া। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পৌনে দশটা বাজছে। প্রায় তিন ঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে তার মানে। ঘড়ি থেকে সরে বারান্দায় চোখ যায় ওর। বারান্দার দরজাটা খোলা। এখান থেকে সমুদ্র দেখা না গেলেও ঢেউয়ের মৃদু আওয়াজ কানে আসছে।

আজ এতোদিন পর কেন সমুদ্রে এসেছে ও? উত্তরটা নিজেও জানেনা আফিয়া। ওই জলভরা দরিয়া তো ওর সেই দুঃখগুলোকেই মনে করিয়ে দেয়। কি ভীষণ যন্ত্রণার ছিলো সেই দিনগুলো।

নিজেকেই অসহ্য লাগতো আফিয়ার। যত দিন যাচ্ছিলো, অনুশোচনা, অপরাধবোধ, আফসোস আর লজ্জা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো ওকে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী আফিয়া প্রচন্ড হীনমন্য হয়ে গিয়েছিলো। নিজের কাজগুলো মনে পড়লে প্রচন্ড যন্ত্রণা হতো মাথায়। কাঁদতো আফিয়া, খুব কাঁদতো। নিজের ভেতরের কথাগুলো বলতেও পারতোনা কাউকে। দিন দিন অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিলো যে একটা সময় পর মনে হতো ও বেঁচে আছে কিভাবে?

অনেকগুলো বছর লাগলো ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে। তারপর ওর জীবনের সবচেয়ে ভালো ঘটনাটা ঘটলো। ও হেদায়াত পেলো। এতোদিন নামাজ রোজা পড়লেও ইসলামকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি ও। হিদায়াত পাওয়ার পর ও এমনভাবে জীবন নিয়ে ভাবতে শিখলো যেটা ও আগে জানতোই না যে এভাবেও ভাবা যায়।

আফিয়া মেনে নিয়েছে এখন সবকিছু। নিজের ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত সব ভুলই মেনে নিয়েছে। আগের মতো এখন আর নিজেকে পাগল পাগল লাগে না। শান্ত হয়ে গেছে ওর মনটা। ক্ষমার আশা নিয়ে আখিরাতের অপেক্ষায় আছে এখন ও। তবু নিজের কৃতকাজগুলো ওকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। এখনো আগের কথা মনে পড়লে মাথায় যন্ত্রণা হয়।

আচ্ছা, এখন তো ও চাচার বাসায় আছে, এরপর কি হবে? ব্যবসায় অনাগ্রহী চাচার সেই বড় ছেলেই এখন সম্পুর্ন ব্যবসা সামলাচ্ছে, নির্দিষ্ট সময় পরপর আফিয়াকে ওর অংশের লাভও বুঝিয়ে দিচ্ছে। উনি যদি জানতে পারেন তুরাগ মারা যাওয়ার পেছনে আফিয়া দায়ী, তাহলে কি আর ব্যবসায় আফিয়ার অংশটুকু দেখবেন? ওর চাচা কি আর ওকে নিজের বাড়িতে রাখবেন? তুরাগ যখন মারা যায় ইমা তখন খুব ছোট, চাচা ভীষণ ভক্ত ছিলো সে। ইমা যদি একথা জানতে পারে তাহলে কি আফিয়াকে এখনের মতো ভালোবাসবে আর?

দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙে আফিয়ার। তাকিয়ে দেখে ইমা এসেছে।
“ওহ ফুপি উঠে গেছো? আমি ডাকতে আসলাম তোমাকে রাতের খাবারের জন্য। খাবে না?”
“হ্যাঁ খাবো, নামাজটা পড়ে নেই।”
“আচ্ছা। আমি বসবো এখানে?”
“ইচ্ছা তোমার।”

ইমা খাটের উপর গিয়ে বসে। তারপর কিছু একটা মনে পড়তে বলে, “ ওহ ফুপি আরেকটা কথা, খাওয়ার পর সবাই আবার সমুদ্র সৈকতে যেতে চাইছে। তুমি কি যাবে?”

আফিয়া ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“হ্যাঁ, যাবো।”

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here