শ্রাবন আধারে তুমিপার্ট :৯
লেখিকা : আফরিন ইসলাম
তিনমাস পার হয়ে গেছে ৷
আবরার এখন আগের থেকে সুস্থ ৷আবরার হাতে একটু ব্যাথা আছে ৷এখন নিজের কাজ নিজেই করতে পারে ৷ আবরার পা এখন অনেকটাই ভালো হয়ে গেছে ৷কিন্তু লাঠিতে ভর দিয়ে হাটতে হয় ৷আজ রাই আবরারকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে ৷ডাক্তার বলেছে আবরার আর একমাসের মধ্যে একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে ৷রাইয়ের সেবার জন্য যে আবরার এত সুস্থ তা ডাক্তারও বলেছে ৷ যদিও আবরার এর বিপরীতে কিছু বলেনি ৷
রাই গাড়ীর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ৷ রাইয়ের মনটা খুব একটা ভালো না ৷ ড্রাইভার গাড়ী চালাচ্ছে ৷ আবরার ফোনে কথা বলছে আর রাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে ৷আবরার কথা বলা শেষ করলো ৷কিন্তু রাই কোনো কথা বলছে না ৷ আবরার এবার নিরবতা ভেঙ্গে বলল
তোমার না দুই দিন ধরে জ্বর ছিল ৷ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ কি খেয়েছো ৷
রাই আবরার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল হুমম খেয়েছি ৷
আজকাল খুব একটা কথা বলো না তুমি ৷তোমার কি কিছু হয়েছে রাই ৷
রাই একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে আবরার দিকে তাকালো ৷তারপর বলল আমার আকাশে মেঘ জমেছে আবরার ৷সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে রূপ নেবে যে কোনো সময় ৷আর আমি ভেসে যাব কোনো এক না ফেরার দেশে ৷আমার মন কিভাবে ভালো থাকবে বলুন তো ৷
তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না ৷
থাক বুঝতে হবে না ৷কিছু কথা না হয় অজান্তেই রয়ে যাক ৷কিছু কথা না হয় একান্তই আমার হয়ে থাক ৷
আজকাল রাই কি বলে আবরার বুঝে ওঠে না ৷আবরার রাইকে বুঝতে চায় ৷কিন্তু কোথাও একটা বাধা পায় সে ৷আবরার চায় না অভিমানের দেয়াল পার করে রাইয়ের কাছে যেতে ৷
আবরার আর রাই বাড়ী ফিরে এসেছে ৷আফজাল খান ছেলের কাছে যেয়ে বলল ডাক্তার কি বলেছে আবরার ৷সব ঠিক আছে তো ৷
আবরার বলল হ্যা বাবা সব ঠিক আছে ৷আর একমাস পরে আমি একেবারে ঠিক হয়ে যাব ৷ যদি ঠিক মতো নিয়ম অনুযায়ী চলি ৷
আনিলা বেগম রাইয়ের কাছে আসলেন ৷রাইয়ের কপালে চুমু দিয়ে তিনি বললেন
আমার মেয়ের জন্য আজ তুই সুস্থ ৷আমার মেয়েটা রাত দিন এক করে সেবা করেছে ৷এমন সোনার টুকরো মেয়ে যার ঘরে আছে ৷তার সংসারে কি কিছু হতে পারে ৷ আল্লাহ নিজের হাতে এমন হিরার টুকরা আমার কাছে দিয়েছে ৷
আবরার ফুপু কটাক্ষ করে বলল আনিলা এতটাও প্রশংসা কর না এই মেয়ের ৷এই মেয়ে সংসারের অলক্ষী ৷দেখলে না আবরার আসতে না আসতেই দূর্ঘটনা ঘটলো ৷ঘরে কাল সাপ রাখছো তুমি ৷
আবরার বেশ বিরক্ত হয়ে বলল উফফ ফুপু বাজে কথা বলো না তো ৷এই সব কথা শুনতে একদম ভালো লাগে না আমার ৷রাই আমি ঘরে যাব ৷আমার হাতটা ধরো একটু ৷
রাই আবরারকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল ৷তারপর আবরারকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো ৷আবরার চুল নিজের হাতে মুছে দিল রাই ৷তারপর আবরারকে টিশার্ট পড়িয়ে দিল আর চুল আচড়ে দিল ৷আবরারকে ফ্রেশ করে দিয়ে রাই নিজেও ফ্রেশ হয়ে আসলো ৷
রাই ডিভানে দাড়িয়ে চুল মুছে নিল ৷আর আবরার জানালা দিয়ে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ৷মেয়েটা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ৷খুব একটা কথা বলে না ৷মাঝে মাঝে একা কিছু একটা ভাবে ৷অনেক সময় আবরার ডাক দিলে কেপেঁ ওঠে ৷রাইয়ের চোখ হঠাৎ জানালার দিকে পড়তেই দেখলো আবরার তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷আবরার নিজের চোখ ফিরিয়ে নিল ৷
দুপুর দুইটা বাজে রাই খাবার ঘরে নিয়ে এসেছে ৷রাই আবরার খাবার দিল ৷আজকাল নিজের হাতে খেতে একদম ভালো লাগে না আবরার ৷এতদিন রাই খাইয়ে দিত ৷মেয়েটা খুব সুন্দর করে তাকে খাইয়ে দিত ৷মাঝে মাঝে রাইয়ের হাত তার ঠোট স্পর্শ করলে সে কেপেঁ উঠতো ৷কয়েকবার ইচ্ছে করে রাইয়ে হাতে কামড় দিয়েছে আবরার ৷কিন্তু রাই কিছু বলে নি তাকে ৷ মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে জালাতে ভালোই লাগে তার ৷কিন্তু এখন নিজের হাতেই তাকে খেতে ৷রাই আর খাইয়ে দেয় না ৷আবরার খাচ্ছে না তাই রাই বলল
কি হলো আপনি খাবেন না ৷
আবরার আড় চোখে একবার রাইয়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল ৷আমার খেতে ইচ্ছে করছে না ৷
আপনার তো ঔষুধ খেতে হবে ৷আপনি কি অন্য কিছু খাবেন রাই বলল ৷
আবরার আস্তে করে বলল তুমি খাইয়ে দাও ৷নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না ৷
রাই হাসলো ৷আবরার প্লেট নিজের হাতে নিয়ে নিল ৷কয়েক মাস আগেও যে রাইকে দেখতে পারতো না ৷সেই মানুষ এখন রাইয়ের হাতে খাওয়ার জন্য বাহানা করছে ৷কিন্তু আর কত দিন ৷রাই আবরারকে খাইয়ে দিচ্ছে নিজের মতো করে ৷আর আবরার খেয়েই যাচ্ছে ৷রাইকে চমকে দিয়ে আবরার হঠাৎ বলল
তোমার হাতটা অনেক নরম ৷কি দাও হাতে ৷
রাই আবরার দিকে তাকিয়েই আছে ৷কোনো কথা বলছে না ৷আবরার আবারো বলল
কি হলো কিছু বলছো না যে ৷
আপনি কি করে জানলেন আমার হাত নরম ৷আপনি তো কখনো আমার হাত ঐ ভাবে ধরেন নি ৷
আবরার রাইয়ের অনেকটা কাছেই চলে আসলো ৷তারপর আস্তে করে বলল ঐ হাতের একটু খানি স্পর্শই বলে দেয় তা কেমন ৷
রাই আবরার থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ৷ তারপর আবার আবরারকে খাইয়ে দিতে লাগলো আর নিজেও খেয়ে নিল ৷আর আবরার সে তো রাইকে দেখেই চলেছে ৷যেই দেখার কোনো শেষ ৷যেই দেখা এক জীবনে শেষ হওয়ার নয় ৷
পাখিরা নিজেদের বাসায় ফিরে গেছে ৷সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাতের গভীরতা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে ৷মিশকা কথা বলছে নিজের একান্ত মানুষটার সাথে ৷
মিশকা বলল তোমার সাথে সেই কবে দেখা হয়েছে ৷সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ ৷ভালো লাগে না আমার ৷তুমি কবে আসবে আমাদের বাসায় ৷
ওপাশ থেকে জবাব দিয়ে বলল আরে বাবা কাজের অনেক প্রেশার ৷চিন্তা করো না আমি দুই দিন পর যাব ৷ঘড়িতে দেখেছো কয়টা বাজে ৷এখন ঘুমিয়ে পড় তাড়াতাড়ি ৷
ঠিক আছে ৷বাই ৷
হুমম বাই ৷লাভ ইউ ৷
অপর দিকে রাই আবরারকে বিছানা করে শুইয়ে দিল ৷ আবরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পরম যত্নে ৷রাইয়ের হাত নেশার মতো আবরার ওপর কাজ করে ৷হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমিয়ে যায় সে ৷রাই যখন দেখলো আবরার ঘুমিয়ে গেছে ৷ তখন রাই আবরার খুব কাছে চলে গেল ৷রাই আবরার কপালে নিজে ঠোটেঁর স্পর্শ দিল ৷রাইয়ের চোখে পানি ৷ রাই আবরার মুখটা নিজের দুই হাতে বন্দি করে বলল
জানেন আবরার আপনার দূর্ঘটনা হওয়ার পর যতটা আমি কষ্ট পেয়েছি ৷ তার থেকেও বেশি খুশি হয়েছি ৷কেন খুশি হয়েছি জানেন আপনি ৷যখন দেখলাম জীবনের শেষ মুহূর্তে আমি আপনার এত কাছে তখন আল্লাহকে হাজার ধন্যবাদ দিয়েছি ৷আমি কি করে অন্য মেয়ে আপনার সেবায় রাখতাম বলুন তো ৷ এই যে আমি আপনার এত কাছে থাকতে পারি প্রতি মুহূর্তে ৷এই যে আমি আপনাকে ছুয়ে দিতে পারি ৷জীবনের শেষ সময় দাড়িয়ে এগুলো আমার কাছে আল্লাহর দেওয়া সেরা উপহার মনে হয় ৷আপনার কি মনে হয় আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে এসেছি ৷একদম না ৷আমি আপনার এই চুলে হাত বুলাতে এসেছি ৷আপনাকে একদম কাছ থেকে দেখতে এসেছি ৷আচ্ছা আপনি কি ভুলে যাবেন আমায় ৷আমি যেই দিন থাকবো না ঐ দিন মনে করবেন আমাকে ৷ নাকি আপনিও ভুলে যাবেন সবার মতো ৷রাই আর কথা বলতে পারছে না ৷কান্না গুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে ৷
চলবে