#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব৮

0
719

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব৮
-Farhina Jannat

৮.
কে শুনে কার কথা? সিদ্রার চিল্লাচিল্লি আর অজস্র কিলঘুষি খেয়েও লোকটা ওকে কাঁধ থেকে নামালোনা। দ্রুত পা চালিয়ে চালাঘরের বারান্দায় এসে থামল। তখনও কিন্তু সিদ্রার পা থেকে শিকল ঝুলছে। ঘরের ভেতর ঢুকে ধপাস করে ওকে মেঝেতে ফেলল লোকটা। অন্ধকার ঘরে ভয়ে দম আটকে গেল সিদ্রার। তবে লোকটা আর কিছু করলনা, শুধু নিচু হয়ে পা থেকে শিকলটা খুলে নিল। বের হওয়ার আগে বলল,
“ফারদার কোন চালাকি করার আগে আশা করি আজকের কথাটা মনে থাকবে”।

“মনে থাকবে, কিন্তু আমার সাথে এমন আচরণ করার জন্য আপনি একদিন পস্তাবেন, ক্ষমা চাইবেন আমার কাছে, মিলিয়ে নিয়েন কথাটা” স্বর উঁচু করে বলল সিদ্রা, কারণ লোকটা ততক্ষণে বের হয়ে গেছে।

প্রায় সাথে সাথেই ওই মহিলাটা একটা তেলের বাতি আর কয়েকটা কাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকল। বাতিটা ট্রাংক এর ওপর আর কাপড়গুলো বিছানায় রেখে ইশারা করল। ওকে কাপড় চেঞ্জ করতে বলছে, এটা বুঝল সিদ্রা। দরজা লাগিয়ে মহিলা চলে গেলেও সিদ্রা সাথে সাথে উঠতে পারলনা। সারাদিনের ধকলে শরীর মন এত ক্লান্ত যে ওর নড়তেও ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু সারাদিনের কাজা নামাজের কথা চিন্তা করে কষ্ট করে উঠল সিদ্রা। উঠে দেখল, এক সেট শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট আর সাথে একটা গামছা। শাড়িটা অনেক পুরনো, এই বাতির আলোতেও সেটা বোঝা যাচ্ছে, এমনকি জায়গায় জায়গায় ছেঁড়াও। মনে হচ্ছে ওই মহিলারই পুরনো শাড়ি হবে।

মনটা খারাপ হয়ে গেল সিদ্রার। ওই লোকটা যখন তখন চলে আসছে, আমি কিভাবে এই ছেঁড়া শাড়ি পরে থাকব, ভাবল ও। লোকটা যখন ওকে তুলে আনছিল, তখন স্কার্ফটাও বনের ভেতরে কোথাও পড়ে গেছে। কিন্তু এখন পোশাকও তো পাল্টাতে হবে, কি করি? আইডিয়া! পেয়েছি বুদ্ধি।

শাড়িটার তুওলনামূলক ভাল একটা পাশ ওড়নার সাইজ করে ছিড়ে ফেলল সিদ্রা। পুরনো শাড়ি, একটানেই ছিড়ে গেল। বাতিটা ফু দিয়ে নিভিয়ে দিল, কারণ জানালাগুলো খোলা আছে, লোকটা আশেপাশে থাকতে পারে। গামছা দিয়ে শরীর মুছে বাকি শাড়ির অংশটুকু ব্লাউজ পেটিকোট এর সাথে গুঁজে কোনমতে পরে নিল। তারপর ছিড়ে নেয়া অংশটা দিয়ে ওড়না পরে নিল। কি বুদ্ধি বের করেছি! নামাজ পড়ে নিয়ে বোরকাটাও পরে ফেলব। এর আগে যেন লোকটা না আসে আল্লাহ, মনে মনে প্রার্থনা করল সিদ্রা।

এসময় মহিলাটা আবার আসল। খাটের ওপর কিছু একটা রেখে নিভে যাওয়া বাতিটা নিয়ে গেল। আবার বাতিটা দিয়ে যেতেই সিদ্রা তাকিয়ে দেখল থালা ভর্তি মুড়ি আর এক টুকরা গুড়। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা, সারাদিন উপবাসের পর গুড়মুড়ি! আর কি কি আছে আমার কপালে?

ক্ষুধা তো লেগেছেই কিন্তু খাবার দেখে সেটা আরো প্রকট ভাবে অনুভূত হল। এদিকে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে গোসল তো হয়েই গেছে। সেক্ষেত্রে আগে নামাজটা পড়ে ফেলা দরকার। কারণ অজু ভেঙে গেলে এই বৃষ্টির মধ্যে অজু করতে বের হতে কাহিনী করতে হবে, মহিলা দরজা না খোলার চান্স আছে। আজ ভোররাতে অনেক ডাকাডাকি করেও দরজা খোলাতে পারেনি সিদ্রা। বাধ্য হয়ে খাওয়ার পানি দিয়ে অজু করেছে। কিন্তু এতগুলো নামাজ পড়ার জন্য শক্তিও তো লাগবে। তাড়াতাড়ি করে কয়েক মুঠো মুড়ি পানি দিয়ে গিলে নিয়ে নামাজে দাঁড়াল সিদ্রা।

হাতটা বেঁধেছে কি বাঁধেনি, এমন সময় “হ্যাঁচ্চো!” এরপর পুরো নামাজে হাঁচি দিতে দিতে নাজেহাল হয়ে গেল সিদ্রা। বাতিটা বাতাসে প্রায়ই নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছিল, অবশেষে এক দমকা বাতাস পুরোপুরি নিভিয়েই দিল। ইবাদত যত আঁধারে করা যায়, ততই আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করা যায়। আজকের ঘটনায় আরো দুর্বল হয়ে গেছে সিদ্রার মন। নামাজের ভেতরেই তাই ভেতরের দলাপাকা কষ্টগুলো চোখ বেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। নামাজ শেষে জোরে জোরে কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করতে লাগল সিদ্রা। মোনাজাত যখন শেষ হল বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে, শুধু বাতাস বইছে। একটু শীত শীত লাগছিল সিদ্রার, উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মনে হল, কেউ একজন সরে গেল জানালার সামনে থেকে। হায় হায়, লোকটা নাকি? শুনে ফেলল নাতো আমার কথাগুলো, কেমন বিব্রত লাগল সিদ্রার। কিন্তু একি? জানালার পাল্লা আছে, কিন্তু আটকানোর মত কিছু নেই। এখন কি হবে? অনেক শীত করছে তো, তার ওপর ঠাণ্ডাও লেগে গেছে!!

ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে, তাই শীতের চিন্তা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি করে খেতে বসল সিদ্রা। গতকাল রাতেও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল ওর। তখনি মনে পড়ে ঘরের আলমারিটার কথা, ওখানে কিছু থাকতে পারে। অন্ধকারে আন্দাজে হাতড়ে একটা চাদর পেয়েছিল। ওটা দিয়েই কাল রাতে ঠাণ্ডা আর মশার কামড় থেকে রেহাই পেয়েছিল।

এখন ওটাই ডাবল করে গায়ে পেঁচাল, একটু আরাম লাগল। বিছানায় বসে আবার মুড়ি খেতে শুরু করল। কিন্তু ততক্ষণে ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সিদ্রা, মুড়ি চিবানোর মত শক্তি আর ওর শরীরে অবশিষ্ট নেই। থালা ফাঁকা করার আগেই ঘুমে ঢলে পড়ল সিদ্রা।

এরপরের দুটো দিন ঘরেই বন্দী থাকতে হল সিদ্রাকে। লোকটা আর কেন যেন আসেনি। দিনে দুবার খাবার দিয়ে গেছে মহিলা, কখনো শুকনো রুটি আবার কখনো গুড় মুড়ি। এক বেলাও ভাত খেতে দেয়নি।

মহিলাটাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছে সিদ্রা, কথা নাহয় বলতে পারেনা, ইশারায়ও তো উত্তর দিতে পারে। না, পাথর মুখ করে থাকে সবসময় আর মাঝেমাঝে ঠাণ্ডা চোখে তাকায়। ওই চোখ দেখলে মনে হয়, মহিলা জাদুটোনা করে। কি করে আল্লাহ জানে, কিন্তু ওই লোকের কথা যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এতে কোন সন্দেহ নেই। অনেকবার বাথরুমে যাওয়ার উসিলায় পালানোর চিন্তা করেছে সিদ্রা, কিন্তু মহিলা এত শক্ত করে ওকে ধরে রাখে, ও কেন ওর বাপেরও সাধ্য নেই ওই হাত ছুটিয়ে পালায়।

সেদিন রাতে আরেক ঝামেলা হল। ডায়রিয়া হয়ে গেল সিদ্রার। হবেনা কেন? উল্টাপাল্টা খাবার, তারও আবার কোন নিয়মনীতি নেই। শরীরটাও দিনকে দিন দুর্বল হয়ে গেছে দুবেলা করে খাবার খেয়ে। সন্ধ্যার পর থেকে ঝম ঝম করে বৃষ্টিও নামল। আর এই বৃষ্টির মধ্যে বারবার করে বাথরুম যেতে হচ্ছে ওকে। আর মহিলাও একটা ছাতা নিয়ে বারবার ওকে বাথরুমে আনা নেওয়া করছে। সিদ্রাতো বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছে, আর সে মহিলা দরজার বাইরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিচ্ছে ওকে। এতে করে ভিজেও যাচ্ছে বারবার। সিদ্রা অনেকবার উনাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল যে, এই বৃষ্টির মধ্যে ও পালাবে না, পালাতে পারবেনা। উনাকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা। কিন্তু উনি মানলে তো!

যে ওকে বন্দী করে রাখছে, খেতে দিচ্ছেনা, তার প্রতি কোন সহানুভূতি আসার কথা না, কিন্তু মহিলাটা বোবা বলেই হয়ত ওর একটু মায়া লাগছে। তাছাড়া উনি যে শুধু ওই লোকের হুকুম তামিল করছেন, সেটা তো পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে। আর মালিক যা বলবে উনি তাই বিশ্বাস করবেন ওর সম্পর্কে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই উনার ওপর তেমন রাগ হচ্ছেনা সিদ্রার।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল সিদ্রার। শরীরে এক ফোটাও শক্তি নেই। ট্রাংক এর ওপর কয়েক প্যাকেট ওরস্যালাইন আর একটা থালায় ভাত তরকারি চোখে পড়ল সিদ্রার। নিশ্চয় ওই মহিলা রেখে গেছে। হাত দিয়ে দেখে তখনো হালকা গরম আছে ভাতটা। তাড়াতাড়ি করে আগে গ্লাসে স্যালাইন গুলিয়ে খেয়ে ভাত খেতে বসল সিদ্রা। কয়দিন পর এই সামান্য তরকারী দিয়ে ভাত খেতে যেন অমৃতের মত লাগল সিদ্রার। যেন কতকাল ভাত খেতে পায়নি, এমন মনে হচ্ছে ওর। বুঝল, ওর পেটের অবস্থা দেখেই ভাত রান্না করেছে মহিলা। উনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসল সিদ্রার।

খাওয়া শেষ করে “খালা, খালা” করে ডাক দিল সিদ্রা, ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু খালা আসলনা। কোথাও গেছে মনে হয়, ভাবল সিদ্রা। কিছুক্ষণ পর আবার ডাকল, তাও আসলনা। তখন জানালার কাছে গিয়ে জোরে জোরে ডাকল, তাও কোন সাড়া নেই। অদ্ভুত তো, এমন তো কখনো হয়নি, ভাবল সিদ্রা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here