#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৭

1
530

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৭
-Farhina Jannat

৭.
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? কি করতে চাইছেন আপনি?” বারংবার জানতে চাইল সিদ্রা।

কোন কথা বলছেনা লোকটা, এগিয়েই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শিকলে এমন টান দিচ্ছে, কোনমতে পড়তে পড়তে বেঁচে যাচ্ছে ও। মনে হচ্ছে যেন ইচ্ছে করে করছে কাজটা। প্রায় পাঁচ মিনিট হাঁটার পর থামল লোকটা। জংগল আগের থেকে ঘন হল না পাতলা, বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। ওকে একটা মোটা গাছের সাথে দুইহাত পিছমোড়া করে শিকল দিয়ে আটকাল লোকটা। বলল, “নে, এবার যত খুশি চিৎকার দে আর বনের পশুপাখিদের শুনা। দেখি, কাউকে পটাতে পারিস কিনা! কপালে থাকলে বাঘ-ভাল্লুক কিছুও তোর প্রেমে পড়ে যেতে পারে”

“কি-ক্কি বলছেন আপনি….. ব ব্বাঘ- ভাল্লুক মানে? আমাকে এখানে আ-আটকে রেখে যাচ্ছেন ক্কেন?” ভয়ের চোটে তোতলাতে লাগল সিদ্রা।

লোকটা আর কোন কথা না বলে যেপথ দিয়ে ওরা এসেছে, সেদিকে হাঁটতে লাগল।

“শুনেন, শুনেন, এই যে……… আপনি একটা পাগল, শুনছেন আপনি, আস্ত একটা সাইকো আপনি” এতবার ডাকল সিদ্রা, পরের কথাগুলো চিৎকার দিয়ে বলল। কোন ডাকই কানে তুললনা লোকটা। একটু পরেই গাছের আড়াল হয়ে গেল।

ঢোক গিলল সিদ্রা, যেদিকে তাকাচ্ছে, সেদিকেই শুধু গাছ আর গাছ। উপরে পাতার ফাঁক দিয়ে বিন্দু বিন্দু আকাশ দেখা যাচ্ছে। ডাক দিয়ে দেখি, কেউ তো শুনতেও পারে। উচ্চকণ্ঠে ডাকতে লাগল সিদ্রা,
“হেলো……. কেউ শুনতে পাচ্ছেন……. আমাকে বাঁচান…… হেলো……. কেউ আছেন…… শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা…… একটা পাগল মাথা খারাপ লোক আমাকে কিডন্যাপ করে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে……… আমাকে বাঁচান প্লি………জ…..”

ডাকতে ডাকতে গলা ব্যাথা হয়ে গেল সিদ্রার। কিন্তু কোন মানুষ তো দূরের কথা, কোন জন্তুজানোয়ারও উঁকি দিলনা। অবশ্য কোন জন্তুজানোয়ার আসুক, সেটাও চাইছেনা। কি করবে বুঝতে না পেরে আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করতে শুরু করল, চোখে পানিও চলে এল মুহূর্ত পরেই।

হঠাৎ করেই মনে পড়ল কথাটা। লোকটা আমাকে হাফেজ সাহেবা বলেছে, মানে আমার সম্পর্কে সবটাই জানে। তাহলে এসব অপবাদ দেয়ার মানে কি! মানছি, কিছু কিছু মাদ্রাসায় পড়া মেয়ে এমনকি কিছুসংখ্যক হাফেজারাও শয়তানের ধোঁকায় আর দুনিয়াবি মোহে ভুল পথে চলে যাচ্ছে বা গেছে, আল্লাহ্‌ তাদের হেদায়াত দান করুন। কিন্তু আমি কেমন মেয়ে সেটাতো আমার আশেপাশের সবাই জানে। তাহলে লোকটা এসব ফালতু কথা কেন বলছে? আমার ছবিও নাকি ফেসবুকে দেখেছে! আমি কোনদিন মেসেজেও নিজের পিক শেয়ার করিনা, ফেবুতে তো দূরের কথা!! তাহলে? ধূর! মাথা কাজ করছেনা আমার। আকাশের দিকে তাকাল সিদ্রা,
“আল্লাহ্‌! এসব কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে? তুমি আমাকে এমন পরীক্ষায় কেন ফেললে আল্লাহ? অন্তত আমি এসব কেন সহ্য করছি, সেটা তো বলে দাও। আমাকে সাহায্য করো, এসব থেকে মুক্ত কর মাবুদ, আমাকে মুক্ত কর।“ অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে ডেকে চলল সিদ্রা।

আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কারো কোন দেখা নেই। সেই রাত থেকে পেটে ওই এক চুমুক বিষ চা ছাড়া আর কোন দানাপানি পড়েনি। পেটের ভেতরে ছুঁচো-ইঁদুর সব একসাথে যুদ্ধ করা শুরু করেছে। এরমধ্যে গাছ থেকে একটা মাকড়শা নেমে এসেছিল সিদ্রার গায়ে।

“আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া………. আল্লাহ্‌ বাঁচাও, আল্লাহ্‌ বাঁচাও” করে এমন চিৎকার দিয়েছিলো যে, আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে কোন মানুষ থাকলে শোনার কথা। কিন্তু কেউ আসেনি। মাকড়শাটা অবশ্য কিছু করেনি, ওর গা বেয়ে শুধু নেমে গেছে।

এখন যত রাত ঘনিয়ে আসছে, সিদ্রার ভয় তত বাড়ছে। লোকটা কি আমাকে সারারাত এখানে আটকে রাখবে নাকি! যেই পাগল লোক, রাখতেও পারে, ভাবল ও। কিন্তু আমি কি করব, ভয়েই তো মরে যাব মনে হচ্ছে। আল্লাহ্‌, তুমি আমাকে সাহস দাও, ধৈর্য দাও আর ওই লোকটাকে সুমতি দাও।

অন্ধকার ঘন হতেই হঠাৎ মেঘ গুড়গুড় করে উঠল, সাথে বাতাসও বইতে শুরু করল। ও আল্লাহ্‌! এর মধ্যে আবার বৃষ্টি হবে নাকি!!

একটু পরেই ঝপ করে যেন রাত নেমে এল বনের মাঝে। আসলেই সন্ধ্যা হল, না মেঘের জন্য, ঠিক বুঝতে পারলনা সিদ্রা। কিন্তু অন্ধকারে ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল ও। মেঘের ডাকও বাড়ছে আস্তে আস্তে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু পর পর। তার আলোয় দেখা যাচ্ছে আশেপাশের গাছগুলো পাগলের মত নৃত্য করছে। দোয়াদরুদ পড়া শুরু করল সিদ্রা। এরকম একটা দিন ওর জীবনে আসবে, ও কি স্বপ্নেও ভেবেছিল! হায়রে নিয়তি, এর খেলা বোঝা দায়!!

যা ভেবেছিল তাই, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। আর কি গর্জন গাছপালা আর মেঘের। মটমট করে ডাল ভাঙারও শব্দ পাচ্ছে সিদ্রা। মাথার উপরে একটা পড়লেই সোজা আল্লাহ্‌র কাছে। আব্বু-আম্মু আর বোনকে আর দেখতে পাবোনা আমি, এভাবেই মৃত্যু লেখা আছে আমার কপালে। জোরেশোরে আল্লাহ্‌ কে ডাকতে লাগল সিদ্রা। বিপদের ষোলকলা পূর্ণ করতেই যেন মনে হল পায়ের উপর দিয়ে সড়সড় করে কি একটা যাচ্ছে।

“আল্লাহ্‌ গো….. সাপ! সাপ!” ভয়ে চিৎকার দিল সিদ্রা। এসময় বিদ্যুৎ চমকাল। তার আবছা আলোয় দেখল সিদ্রা, লোকটা দৌড়ে আসছে।

রাগে দুঃখে কি করবে বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। ওর মনে চাচ্ছে, একটা পাথর টাথর কিছু মেরে লোকটাকে খুন করে দেয়। লোকটা কাছে এসে ওর পায়ের ওপর টর্চ এর আলো ফেলল, “কোথায় সাপ?”

রাগ, ভয়, আতঙ্ক, ঘৃণা সব দলা পাকাল সিদ্রার মাঝে। কথা বলতে পারছেনা সিদ্রা। সারা শরীর কাঁপছে ওর। লোকটা ওর মুখের ওপর আলো ফেলে দেখল ঠোঁট মুখ তিরতির করে কাঁপছে আর দুচোখে এমন এক দৃষ্টি, যা এর মধ্যে ওর চোখে দেখেনি। লোকটা মনে হয় বুঝতে পারল ওর অবস্থা। পেছনে গিয়ে শিকল খুলে দিল।

তারপর প্রথমবারের মত আলতো করে সিদ্রার থরথর কম্পমান হাতটা ধরল লোকটা, যেন অভয় দিতে চাইছে। রাগে ঘৃণায় রি রি করে উঠল সিদ্রার সারা শরীর। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল ও। লোকটা এবার হাতটা শক্ত করে ধরল আর হাঁটার জন্য টানল ওকে। কিন্তু সিদ্রার যেন ওখানে শিকড় গজিয়ে গেছে, এক চুলও নড়লনা ও। এতক্ষণ ও একা একা ভয়ে মরছিল, কিন্তু এখন এই জঘন্য লোকটার ওপর এত ঘৃণা হচ্ছে যে, তার সাথে আর যেতে ইচ্ছে করছেনা ওর। মনে হচ্ছে, এখানে গাছের ডাল মাথায় পড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অসুখ করে মরে যাওয়াও ভাল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনর্গল। বৃষ্টির ফোটার সাথে চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ও এগোচ্ছেনা দেখে লোকটা আবার টর্চের আলো ফেলল ওর মুখে। এবার বুঝতে পারল যে কাঁদছে ও। ও কিছুতেই এগুচ্ছেনা দেখে লোকটা ওকে ধরে বস্তার মত কাঁধে তুলে ফেলল। সাথে সাথে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল সিদ্রা। হাতপা ছুড়তে লাগল সমানে, “ছাড়েন আমাকে…….ছাড়েন বলছি………নামান আমাকে…….হাঁটছি আমি……..নামান বলছি……. ছাড়েন প্লি……জ………..”।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here