#অন্তরিক্ষ_প্রণয় পর্ব-৩
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
নিয়ন রাত্রির রক্তিম ফোলা আঁখিযুগল ও মুখ ফোলা দেখে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে যায়। দ্রুত পদে এগিয়ে এসে রাত্রির কপালে হাত রাখে তারপর বলে,
–সকালে তো ঠিক ছিলি। এখন তোর এলার্জি কিভাবে হলো? তুই কি চিংড়িমাছ জনিত কোনো খাবার খেয়েছিস?
রাত্রি নিয়নের এতো যত্ন দেখে চোখে হাসে। তারপর ঘার হেলিয়ে হ্যাঁ বলে। রাত্রিকে হ্যাঁ সূচক ঘার নাড়াতে দেখে নিয়ন চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
–তোর চিংড়িতে এলার্জি অনেক। তাও কেন এটা খাস! এখন তো তোর জ্বর আসছে। হোস্টেলে এখন তোর সেবা কে করবে? কি যে করিস তুই! মেডিসিন নিয়েছিস? তুই তো আবার নিজের ব্যাপারে একদম ভুলো মনা।
রাত্রি মুচকি হাসে। রাত্রিকে হাসতে দেখে নিয়ন ধমকে উঠে বলে,
–অসুখ বাধিয়ে সে এখন হাসছে! একটু নিজের যত্ন নিলে কি হয় তোর? এখনি রুমে গিয়ে খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে ঘুমাবি। আমি জানি তুই খাবারো খাসনি। রাত ৮টা বেজে গেছে কখন!
রাত্রি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিয়নের দিকে। নিয়ন রাত্রিকে রুমে যেতে বলে চলে যেতে নিলে রাত্রি ওকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–তুই কেনো এসেছিলি তা তো বললি না!
নিয়নের মনে পড়ে কথাটা। নিয়ন বলে,
–আজ প্রণয়ির টেস্ট করিয়েছি। রিপোর্ট ভালো এসেছে। ডাক্তার বলেছে ও রিকোভার করছে। শক দিতে হবে ওকে।
রাত্রি চিন্তিত সুরে বলে,
–প্রিয়তা শক দিতে চায়না। কান্না করে অনেক। মায়া লাগে দেখলে।
নিয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–মায়া তো আমারো কম লাগে না। কিন্তু ওকে সুস্থ হতে হবে। আমি যেকোনো মূল্যে ওকে সুস্থ করার চেষ্টা করবো। ও বাকি সবার মতো সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকবে।
নিয়ন কথা গুলো বলছিল আর চোখে যেনো আনন্দ চিকচিক করছিল। রাত্রি দেখে এটা। তারপর ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–ভালোবেসে ফেলেছিস প্রিয়তাকে তাই না!
চমকে তাকায় নিয়ন। রাত্রি তা দেখে মলিন হেসে বলে,
–তোর সামান্য ইঙ্গিত আমাকে তোর মন বলে দেয়। প্রিয়তাকে ভালোবাসিস ভালো কথা তবে ওর অতিত কি ওর পিছু ছাড়বে? অতিতে ওর সাথে কি হয়েছিল জানি না আমরা। ওর কিন্তু বেবি এবোর্ট হয়েছে। এখন ও বিবাহিত নাকি অবিবাহিত তা আমরা জানি না। তবে ওর কিছু কথাতে বুঝা যায়, ও কাউকে অনেকটা ভালোবাসে।
করুন হয় দৃষ্টিকোণ। চোখ মুখে অসহায়ত্ব নিয়নের। তা দেখে রাত্রি নিয়নকে কি স্বান্তনা দিবে! সে নিজেই তো এই প্রণয় রোগে আক্রান্ত। কি অদ্ভুত নিয়ম তাই না!
“আমি যাকে ভালোবাসি সে আমাকে ভালোবাসে না। আর সে যাকে ভালোবাসে বিপরীত পাশের মানুষটাও তাকে ভালোবাসে না।”
রাত্রি নিয়নের থেকে বিদায় নিয়ে হোস্টেলে চলে যায়। নিয়নও চলে যায়। নিয়নের ১০টা পর্যন্ত ডিউটি আছে। তারপর বয়েজ হোস্টেলে চলে যাবে।
_____________
–প্রণয়ি শোনো, আমাদের প্রথম মেয়ের নাম রাখবো ‘প্রহেলি’। এরপর আবার মেয়ে হলে ওর নাম রাখবো, ‘আহিতা’। সুন্দর না নাম গুলো?
বাহুডোর আবদ্ধ প্রিয়তা মাথা ঘুরিয়ে তাকায় আকাশের দিকে। তারপর চোখ ছোট ছোট করে বলে,
–দুইটাই তো মেয়ের নাম ঠিক করলে। যদি ছেলে হয় তখন? ছেলের নামও ঠিক করো।
প্রিয়তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর নাকের সাথে নাক ঘষে আকাশ বলে,
–উহু। দেখো আমাদের মেয়ে হবে। একদম তোমার মতো দুষ্ট মিষ্টি হবে আমাদের মেয়ে। আমার মায়ের শূন্যতা পূরন করবে। আমি আমার মেয়েকে সব দিবো। ও যা চাইবে সব। মেয়ে আমার অভিযোগ করতে পারবে না ওর বাবার উপর।
অধরের আলতো স্পর্শ দেয় প্রিয়তা আকাশের অধরে। তারপর আকাশের বুকে নিজের মাথা রেখে বলে,
–সবে তো তোমার ঘরে বউ হয়ে এলাম। নিজের মাধুরী দিয়ে সাঁজাবো তোমার গৃহ। তারপর আল্লাহ চাইলে আমাদের ঘর আলোকিত করে আমাদের সন্তান আসবে। আমি তোমাকে পেয়ে শুকরিয়া আদায় করি মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে। আমার পৃথিবীতে এক গুচ্ছ সুখ এনে দিয়েছো তুমি। এই সুখ হারিয়ে ফেলার ভয়টা আমার প্রবল।
আকাশ তার প্রণয়িনীকে নিজের বুকে আরো জড়িয়ে নেয়। তার প্রণয়ির মনে আসা ভয়টাকে সে ঝেড়ে ফেলে দিতে চায়। তাই বলে,
–মুত্যুবিহীন তোমার থেকে আলাদা আমি হবো না।
_______মাথা চেপে ধরে হালকা চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে প্রিয়তা। প্রিয়তাকে নার্স মেডিসিন খাওয়ায় দিয়ে চলে গিয়েছিল। ঘুমিয়ে পরেছিল প্রিয়তা। কিছু পুরোনো স্মৃতি মস্তিষ্কে ধাক্কা দেওয়াতে ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির কাটায় গভীর রাত। কেও জেগে নেই এখানের। তাই প্রিয়তার চিৎকার কারো কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। প্রিয়তা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত বেড থেকে উঠে পরে। জানালার কাছে যায়। তারপর কৃষ্ণ অম্বরে এক ফালি চন্দ্রমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আউরায়,
–সে আমার! ও অন্যকারো না। আমার ও। শুধু আমার।
প্রিয়তা বিড়বিড় করে আউরাতে আউরাতে শ্রেয়া ঘোষালের একটা গানের প্রথম দুই লাইন মৃদু ছন্দে গায়,
“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে!”
ভোরের আলো ফোটে ধরণীর বুকে। স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত ভুবন। প্রিয়তা আর ঘুমায়নি। জানালের কাছে কিছুটা দূরে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে ছিল বাকিটা রাত। সকালে যখন নার্সরা খাবার ও মেডিসিন দিতে আসে তখন প্রিয়তাকে এভাবে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে ওকে ধরে উঠাতে যেয়ে দেখে গা গরম। বোধহয় জ্বর এসেছে। নার্স প্রিয়তাকে খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে চলে যায়। ঘুমে ঢোলে পরে প্রিয়তা।
________
–আমি দিবো না ওটা। ওটা দিলে মাথায় কেমন যেনো করে। দিবো না। ও রাত, শুনো না! দিবো না ওটা। মানা করো ওদের। কষ্ট হয় আমার।
প্রিয়তা রাত্রির হাত ধরে ইলিকট্রিক শক দিবে না বলে নিষেধ করছে। কিন্তু রাত্রিই বা কি করবে! রাত্রি চায় প্রিয়তার সব যেনো মনে পড়ে। মনের মাঝে ক্ষীন আশা আছে এখনো নিয়নের জন্য। সুস্থ হবার পর যদি প্রিয়তা নিজেই নিয়নকে মানা করে তাহলে তো সে তার এতো বছরের ভালোবাসাকে আপন করতে সুযোগ পাবে।
রাত্রির মনে ক্ষোভ হয়নি প্রিয়তার জন্য। প্রিয়তারই বা কি দোষ! প্রিয়তা এক মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী। ওর উপর ক্ষোভের কোনো মানে হয়না। আর রাত্রি জোর জবরদস্তি করে, ছিনিয়ে ভালোবাসাতে বিশ্বাসী না। রাত্রি এটাই মানে,
“যে তোমার ভাগ্যে আছে, সে শত-সহস্র দূরত্বে থাকলেও তোমার কাছে ঠিক আসবে। আসতে বাধ্য। নিয়তির খেলা কেইবা বুঝে!”
জোর করে প্রিয়তাকে ইলিকট্রিক শক দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ শক দেবার পর প্রিয়তা সেন্সলেস হয়ে যায়। নিয়ন প্রিয়তাকে কোলে তুলে নিয়ে যায় প্রিয়তার থাকার রুমে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাত্রি। আরেকটা মন খুব শিগ্রই ভাঙতে চলেছে তা রাত্রির বারবার মনে হচ্ছে। নিয়ন কিভাবে নিবে নিজের হৃদয় ভাঙার বেদনা! সেটাই রাত্রিকে ভাবাচ্ছে।
ভাবনা চিন্তাকে একপাশে রেখে নিয়নের পিছু পিছু যায় রাত্রি। প্রিয়তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে নিয়ন ও রাত্রি চলে যায়।
দুপুরের পর প্রিয়তা জাগ্রত হয়। তারপর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি করছে বারবার। হাতের কাছে যা পাচ্ছে ফেলে দিচ্ছে।
নিয়ন ও রাত্রি এগুলো জানতে পেরে ছুটে আসে হাতের কাজ ফেলে। প্রিয়তাকে নার্সরা ধরে রেখেছে। একটু আগেই তো ঘুম থেকে উঠলো। এখন কি আবার ঘুমের ইনজেকশন দিবে! তাহলে তো যখন ঘুম ভাঙবে তখনি এমন করবে। সবসময় কি ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে?
রাত্রিকে দেখে প্রিয়তা জোরে বলে,
–এই রাত! আমার আকাশকে এনে দাও। দাও না! আমার আকাশকে আমার কাছে এনে দাও।
রাত্রি প্রিয়তার কাছে যায়। তারপর ওকে থামানোর চেষ্টা করতে থাকে। আর এদিকে একজনের স্তব্ধ অবস্থা।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।