#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৫

0
568

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ৩৫
-Farhina Jannat

৩৫.
বুবুর গল্পঃ
আমি তখন ইন্টার্নি করছি ডিএমসিতে। মাত্র আর এক মাস পরেই পরিপূর্ণ ডাক্তার হয়ে বের হব। মেডিকেলে পড়ার শুরুর দিক থেকেই একটা ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করত। যাওয়া আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রেম নিবেদন করা এসব যা করে আরকি বখাটে ছেলেরা। আমি কোনদিন পাত্তা দিইনি কিন্তু এ ছেলে হাল ছাড়েনি, এতদিন ধরে লেগেই ছিল। আমরা তখন পুরান ঢাকার এক ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। আমরা বলতে আমি, আব্বা-আম্মা আর ভাইয়া-ভাবী। আব্বা রিটায়ার্ড করেছে, ভাইয়ার টাকায় পুরো সংসার চলে। সবাই তাকিয়ে আছে আমি কবে ডাক্তার হয়ে ভাইয়ার বোঝা হালকা করব। কিন্তু আল্লাহ বোধহয় সেটা চাননি, তাঁর ইচ্ছে অন্যরকম ছিল।

এমনিতে তো বাসা কাছে হওয়ায় যাওয়া আসা করেই পড়াশোনা শেষ করেছি। কিন্তু গলিঘুপচির মধ্যে বাসা বলে ইন্টার্নি করার সময় বেশি রাত হয়ে গেলে কখনো ফিরতামনা আমি, হোস্টেলে থেকে যেতাম। কিন্তু সেদিন আম্মু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যায়, ভাইয়া আমাকে ফোন করে ওষুধ নিয়ে আসতে বলে আম্মুর জন্য। আমিও নিজের চিন্তা না করে রাত একটার সময় বের হয়ে যাই হাসপাতাল থেকে। রাস্তায় আমার পথ আটকায় ওই ছেলেটা, বরাবরের মত প্রেম নিবেদন করে, আমাকে নাকি বিয়ে করতে চায়।

এমনিতে আম্মুর জন্য টেনশনে মাথার ঠিক নেই, তার মধ্যে এই উটকো ঝামেলা, মাথা ঠিক রাখতে পারিনা আমি। ছেলেটাকে অনেক আজেবাজে কথা বলে অপমান করি। ছেলেটাও রেগে গিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যায় কোন এক গুদামঘরে। সেখানে তিন দিন আটকে রেখেছিল আমাকে। না না, তুই যেটা ভাবছিস তেমন কিছু না, ওর একটাই কথা ছিল, আমাকে বিয়ে করো। কিন্তু আমি ছিলাম প্রচণ্ড জেদি, একবার কোন কিছুতে না বললে কারও সাধ্য ছিলনা আমাকে হ্যাঁ বলাবে। জানিস, একটা কাজীকেও ধরে এনেছিল ও। কিন্তু আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েও আমার মুখ দিয়ে কবুল বলাতে পারেনি। আমার মাথায় ঘুরছিল শুধু, মরে যাবো কিন্তু ওকে বিয়ে করবোনা। কিন্তু আজ মনে হয় বিয়ে করলেই বেঁচে যেতাম! বুবুর চোখ দিয়ে টপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

শেষমেশ ও হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় আর আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসে। তারপর আমি ওকে আর কোনদিন ওই তল্লাটে দেখিনি।

আমাকে ফিরিয়ে তো দিয়ে গেল, কিন্তু জীবনটা আমার নরক হয়ে গেল। এক বখাটে ছেলে তুলে নিয়ে গিয়ে তিনদিন ধরে আমাকে আটকে রেখেছিল, ব্যবহার করে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, এমন কথা পাড়াময় চাউড় হয়ে গেল। পাড়ায় মুখ দেখানোর উপায় থাকলোনা আমার গোটা পরিবারের। বাড়িতে চরম অশান্তি শুরু হল। ভাইয়া তো মুখের ওপর বলে দিল, এমন অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভাল। হোস্টেলে চলে গেলাম বাধ্য হয়ে, কিন্তু সেখানেও স্বস্তি ছিলনা। আমাকে দেখলেই কানাঘুষা শুরু হয়ে যেতো, নিজের রুমমেট আর ক্লাসমেটেরা পর্যন্ত এমন ব্যবহার করতে লাগল যেন আমি অচ্ছুত হয়ে গেছি।

মেন্টাল প্রেসারে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, ফিরে এলাম বাসায়। তাতে বাসায় টেকা আরো দুঃসহ হয়ে উঠলো। ভাবী রাতদিন আমাকে আর আব্বা আম্মাকে কথা শোনাতে লাগল। মা আমার দিকে মাঝেমাঝে এমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকাত, মনে হত ধরণী, তুমি দ্বিধা হও। একদিন ভাইয়া ভাবি মিলে চরম সিনক্রিয়েট করল বাসায়। আমি ঠিক করলাম মরব, মরে গিয়ে সবাইকে শান্তি দিয়ে যাব। কিন্তু মরার আগে একটা ইচ্ছা পূরণ করার সাধ জাগল আমার। কলেজের স্টাডি ট্যুরে কক্সবাজার নিয়ে গেছিল আমাদের ক্লাসকে, চাঁদার টাকা যোগাড় হয়নি বলে আমি যেতে পারিনি। সেই থেকে মনে সমুদ্র দেখার সাধটা থেকে গেছিল। আমি আমার ইন্টার্নির স্যালারি তুললাম। তারপর এক কাপড়ে বাসে চড়ে রওনা দিলাম কক্সবাজার।

সারাদিন সমুদ সৈকতে কাটিয়ে বিকেলবেলা নেমে গেলাম পানিতে। উদ্দেশ্য, সাগরের বুকেই এ জীবন বিসর্জন দিব। কিন্তু আল্লাহ্‌ ফেরেশতারূপে পাঠালেন বাবাকে মানে ভাইটুর বাবাকে। আমি প্রায় হাবুডুবু খেতে শুরু করেছি এমন অবস্থায় উনি আমাকে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। বাবা ভেবেছিল আমি ডুবে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পরে যখন জানল যে আমি মরতে যাচ্ছিলাম, বাবা আর মা মিলে যা একটা বকা দিয়েছিলোনা, আমি আজও ভুলতে পারিনা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ, বাবা অন্যের মেয়েকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিল, অথচ আজ তাঁর নিজের ছোট ছেলেই সেই কাজ করেছে।

তারপর? জানতে চাইল সিদ্রা।

তারপর আর কি, বাবা মা আমাকে বুঝাল, তোমাকে আর ফিরতে হবেনা, আমাদের সাথে চলো, নতুন জীবন শুরু করবে। ওঁদের তো কোন মেয়ে ছিলনা, আমাকে মেয়ে করে নিল আর ওরা দুই ভাই তো এত বড় বুবু পেয়ে মহাখুশি। আমিও নরক থেকে বেরিয়ে এমন একটা বেহেস্তের মত জায়গায় আসতে পেরে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করলাম। আমি তো সাথে করে কিছু নিয়ে আসিনি, বাবা নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমার সমস্ত সার্টিফিকেট আর মার্কশিট তুলে আনার ব্যবস্থা করে। অনেক বলেছিল বিসিএস দিয়ে কোন একটা হাসপাতালে জয়েন করতে। কিন্তু যারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে, আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাইলাম। তাই তাদের এ প্রিয় মানুষগুলোর চিকিৎসা করার দায়িত্ব নিয়ে নিলাম সারাজীবনের জন্য। বিসিএস দিয়েছি, অন্যান্য ডাক্তারি ডিগ্রীও নিইয়েছে বাবা আমাকে দিয়ে, কিন্তু হাসপাতালে যোগদান করাতে পারেনি।
ওঁদের মৃত্যুর পরও সেই ঋণ শোধ করে যাচ্ছি, আল্লাহ চাহেতো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে যাবো। ব্যস, এই ছিল আমার গল্প।

***
সিদ্রা সেই কখন থেকে চোখের পানি ফেলছে, এবার বুবুকে জড়িয়ে ধরে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। বুবু তো অবাক, “আরে পাগলী কাঁদছিস কেন?”

বুবু তো আর জানেনা, সিদ্রা বুবুর সাথে সাথে নিজের কথা ভেবে কাঁদছে। বুবুর কাহিনী থেকে ও বুঝে গেছে, যদি, জাস্ট যদি কোনদিন ও মুক্তিও পায়, ওর জীবন কখনওই আর আগের মত হবেনা। বুবুর মতই ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করবে ওর জন্য।

বুবুর বাসা থেকে চলে আসার সময় আরেকটা কথা মনে হল সিদ্রার, “কিন্তু বুবু, তুমি কখনও বিয়ে করনি কেন?”

“বিশ্বাস কর বা না কর, যার জন্য আমার জীবনের এই দুর্গতি, তারই জন্য”

“কি? ওই বখাটে ছেলের জন্য? কি বলছ কি তুমি?”

“হুম, ওর চাওয়ার মধ্যে কোন লালসা ছিলনা রে, শুধুই ভালবাসা ছিল, শুধু ওর পন্থাটা ভুল ছিল। নাহলে ওই তিনটা দিন ও আমাকে বিয়ে করার জন্য জোর না করে নিজের লালসা ঠিকই মিটিয়ে নিতে পারতো, কি পারতো না বল?”

“হুম, সেটা ঠিকই বলেছো, কিন্তু তবুও”

“তবে সেটাই একমাত্র কারণ না, আমি আসলে এই বেহেস্তের মত জায়গা আর আমার ভাইদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি”

***
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে রাইয়্যান, ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল ও, আজ সোমবার। সবে জ্বর থেকে উঠেছে তবুও সিদ্রার রোজা রাখার ব্যত্যয় ঘটবেনা জানে ও। ফোন করে সেক্রেটারিকে বলল, “নেক্সট ফ্লাইটে ব্যাক করতে চাই আমি, ব্যবস্থা করো”

মাগরিবের আজানের মাত্র পনেরো মিনিট আগে বাসায় ঢুকল রাইয়্যান। সময় নেই দেখে বড় একটা ফাস্টফুড শপে ঢুকে যা চোখে পড়েছে তুলে নিয়ে চলে এসেছে। খালার হাতে খাবারের ব্যাগগুলো ধরিয়ে জলদি টেবিলে সাজিয়ে সিদ্রাকে ডাকতে বলল।

সিদ্রা ড্রয়িংরুমেই বসে ছিল, ওকে ডাকতে বলছে শুনে বেরিয়ে এল। খালা ওর সামনে দিয়ে মুখে একটা হাসি নিয়ে চলে গেল। সিদ্রা কনফিউজড হয়ে তাকাল রাইয়্যানের দিকে। রাইয়্যানের মুখটা সিদ্রাকে দেখে হাসিহাসি হয়ে গিয়েছিল, সিদ্রা তাকাতেই স্বাভাবিক করে ফেলল।

“ডাইনিং এ চল” গম্ভীর মুখে বলল রাইয়্যান।

কোন কথা না বলে হুকুম তামিল করল সিদ্রা। ডাইনিং এ ঢুকে টেবিলের দিকে তাকিয়ে ওর চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। অনেকগুলো বার্গার, স্যান্ডউইচ, বিশাল একটা পিজ্জা, কয়েক রকমের পেস্ট্রি কেক আর আরও কিছু নাম না জানা ফাস্টফুড আইটেম, পাশে একটা কোল্ড কফির প্লাস্টিক কাপও দেখা যাচ্ছে।

“এসব কি?” মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল সিদ্রার।

“তোর ইফতার আর আমাদের নাস্তা” হাসিমুখে বলল রাইয়্যান। এখন তুই বলতে অনেক খারাপ লাগছে ওর, কিন্তু হঠাৎ করে তুমি বললে সিদ্রা কি না কি মনে করবে তাই আর চেঞ্জ করলনা।

“আপনি কি কোন জিনিস কম কিনতে পারেননা? এতকিছু দিয়ে মানুষ ইফতার করে?”

“কেন? সারাদিন খাসনি, ক্ষুধা লেগেছে তো। আর একা কেন খাবি, আমরাও তো খাবো। শুনেছি, রোজাদারকে বসিয়ে ইফতার করালে অনেক নেকী হয়”

আরও কিছু বলতে মুখ হা করেছিল সিদ্রা কিন্তু আজান দিয়ে দিল। রাইয়্যান তখন ওর হা করা মুখে কি একটা ঢুকিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সিদ্রা নড়তেও ভুলে গেল। কি করছে লোকটা এসব? উনার মাথাটাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?

কোনমতে মুখটা বন্ধ করল সিদ্রা। চকলেট কেকের মত টেস্ট, কিন্তু ঠিক কেক না, তবে স্বাদটা ভালই।

“নে, এবার বসে ধীরেসুস্থে ইফতার কমপ্লিট কর” বলে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল রাইয়্যান।

“কিন্তু আমি তো রোজাই রাখিনি আজকে!” মুখেরটুকু গিলে উত্তর দিল সিদ্রা।

আয়েশ করে বার্গারে কামড় বসাতে যাচ্ছিল রাইয়্যান, হাতটা মাঝমথেই থেমে গেল। হায়রে, একদিনে আর কতগুলা টাশকি খেতে হবে আমাকে! জীবনে একদিন মেয়েটার জন্য ইফতারি নিয়ে আসলাম, আর ও রোজাই রাখেনি। একেই বলে কপাল! কোনমতে নিজেকে সামলে নিল ও।

“রোজা নাইবা রাখলি, নাস্তা করতে তো আর অসুবিধা নেই, বসে পড়”

বসল সিদ্রা, “আসলে আমি তো রোজা রাখতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু খালা কিছুতেই রাখতে দিলনা” মিনমিন করে বলল সিদ্রা। বুঝতে পারছে, লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে কামড় বসাল ও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here