#অন্তরিক্ষ_প্রণয় পর্ব-৬
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
সময় তো আর কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। সময় ঠিক চলে যায়। সময়ের সাথে সাথে প্রিয়তার মনে আকাশের জন্য দুর্বলতা বেড়েই চলেছে। দিন দিন সব ভুলে সে আকাশের ভাবনায় নিমগ্ন থাকে। রাতেও ঘুম হয়না বলে চোখের নিচে কালশিটে ভাব চলে আসছে। কেনো প্রিয়তা আকাশের ভাবনাতে মগ্ন থাকে তা প্রিয়তা কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তবে আকাশ তো তাকে এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি! আর আকাশকে প্রিয়তা সব সময় একা বসে থাকতে দেখে চুপচাপ। মাঝে মাঝে আকাশের বন্ধুদের দেখা যায় কিন্তু প্রায়ই একা থাকে। প্রিয়তা আকাশের সাথে গিয়ে বসে কথা বলতে চাইলে আকাশ সৌজন্যতা রক্ষার জন্য একটু টুকটাক উত্তর দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। প্রিয়তা বুঝে তাও বারবার আকাশের কাছে যায়।
এভাবেই কিছুদিন চলে যায়। আকাশ ওর চাচার মৃত্যুর চল্লিশ দিনের দিন আবারো চট্টগ্রাম যায়। প্রিয়তা তো সকাল থেকে ক্যাম্পাসে আকাশকে দেখতে না পেয়ে আকাশের বন্ধু হৃদয়কে জিজ্ঞাসা করে,
–আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
হৃদয় তার ফ্রেন্ডদের সাথে গল্প করছিল। প্রিয়তা সেখানে গিয়েই জিজ্ঞাসা করে। সালামের প্রতিউত্তরে হৃদয়ও সালামের জবাব দেয়।
–ওয়ালাইকুমুস সালাম।
প্রিয়তা খানিকটা ইতস্তত করে বলে,
–ইয়ে মানে ভাইয়া, আকাশ ভাইয়া কোথায়?
প্রিয়তা কথাটা বলার পর লক্ষ্য করে হৃদয় সহ হৃদয়ের সাথে থাকা রামিসা, ইফা ও সাগর কিভাবে যেনো দেখছে। প্রিয়তা ঘাবড়ে যায় তাই তাড়াহুড়ো করে বলে,
–না মানে, আমার তার থেকে মানব কঙ্কাল কেনার কথা ছিল। আমার জন্যই ওটা কিছুটা ভেঙে গেছিলো। আমি কিনতে চাই ওটা।
প্রিয়তার কথা শুনে ওরা এবার স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকায়। হৃদয় বলে,
–আকাশের চাচার আজকে মৃত্যুর চল্লিশদিন। এজন্য আকাশ চট্টগ্রাম গেছে। ওর চাচার রেখে যাওয়া বাড়িটা ভাড়া দিবে আর সেখানের কিছু এতিম বাচ্চাদের যাদের ওর চাচা মাঝে মাঝে খাওয়াতো তাদের খাওয়াবে।
প্রিয়তা শুনলো তারপর বললো,
–উনি অনেকটা ভেঙে পড়েছেন। চুপচাপ থাকে দেখি।
ইফা বলে,
–আকাশ এমনেও চুপচাপ। আমাদের ৫ জন ফ্রেন্ডের মধ্যে ওই এতো চুপচাপ। নাহলে মেহের ওকে যা জ্বালায়! আমারই তো রাগ উঠে। কিন্তু আকাশ শুধু বুঝায়।
রামিসা বলে,
–ওই ঢঙির কথা বলবি না ইফা। বুঝিনা আকাশটা যদি একটু স্ট্রিক্টলি বলে মেহেরকে তাহলেই তো মেহের চুপ হয়ে যায়। কিন্তু না! মেহের আকাশের গা ঘেষে আর আকাশ তাকে আস্তে আস্তে কথা বলে। আমি হলে, থাপ্পড় দিয়ে বিদায় করতাম। জুনিয়র মেয়ের কিনা সিনিয়রের সাথে এরকম করে এসে! দেখতেছে আকাশ ইন্টারেস্টেড না তাও মেয়ের লজ্জা হয়না।
হৃদয় বলে
–আকাশ এমনি। ওরে কিছু বললে ও কিছু বলে না।
প্রিয়তার খারাপ লাগে। আকাশ কেনো ওই মেহের নামের মেয়েটাকে কিছু বলে না? তাহলে কি আকাশও মেহের মেয়েটাকে পছন্দ করে? প্রিয়তা চলে যায় সেখান থেকে। যাওয়ার আগে হৃদয়ের বলা কথাতেও ভাবাবেগ দেখায় না। প্রিয়তাকে চলে যেতে দেখে সাগর ডাক দিয়ে বলে,
–এইযে, তুমি কঙ্কাল নিলে আমাদের থেকে নিতে পারো। আকাশের সাথে আমি ও হৃদয় একসাথে কঙ্কালটা কিনেছিলাম।
প্রিয়তা তাতেও দাঁড়ায় না। চলে যায়। সেদিন রাতে প্রিয়তা সারারাত বিছানায় শুয়ে নিঃশব্দে কেঁদেছে। বেচারির কষ্ট হচ্ছে অনেক। কিন্তু বলতে পারছে না কাউকে।
পরেরদিন,,
আকাশ ক্যাম্পাসে এলো। কাল রাতের ট্রেনেই চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়েছে। এখন জার্নি করার কারনে শরীর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দূর থেকে প্রিয়তা সব খেয়াল করছে। প্রিয়তার চোখ মুখ ফুলে আছে। চোখ তো লাল হয়ে আছে। রুমমেটরা জিজ্ঞাসা করেছিল। তখন বলেছে, মাথা ব্যাথাতে ঘুমাতে পারেনি। হঠাৎ দেখলো একটা মেয়ে আকাশের হাত জড়িয়ে ধরলো। প্রিয়তা বুক ধুক করে উঠে। কিছুটা এগিয়ে যায়। তারপর পিলারের আড়ালে দাঁড়ায়। আকাশ তখন নোটিশ বোর্ডের কাছে কি যেনো দেখছে। হয়তো পরিক্ষার ডেট দেখছে। প্রিয়তা শুনতে পায় আকাশের হাত জড়িয়ে ধরা মেয়েটা বলছে,
–আই মিস ইউ সো মাচ বেবি! আমাকে বলে গেলে কি হতো? আমিও তোমার সাথে যেতাম। ইউ হার্ট মি।
প্রিয়তা নিজের এক হাত দিয়ে আরেক হাত খামচে ধরেছে। তখন আকাশ বলে,
–দেখো মেহের, আমার পিছু ছেড়ে দেও। তোমাকে কতোবার বলেছি বলতে পারো? আমি তোমার মতো না। আমার এসব ভালো লাগে না। আমাকে আমার মতো থাকতে দেও। তুমি তোমার স্ট্যান্ডার্ডের জীবন সঙ্গী পেয়ে যাবে।
মেহের তখন আকাশকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
–আমার তো তোমাকে পছন্দ। তোমার মতো ছেলে কই পাবো বলো? সব দিক দিয়ে পারফেক্ট তুমি। আই লাভ ইউ আকাশ। প্লিজ ডোন্ট রিফিউজ মি।
প্রিয়তার দিকে মেহেরের পিঠ ছিলো। প্রিয়তার আবারো কান্না পাচ্ছে। আকাশের মুখটা দেখে প্রিয়তা। তখনি চোখাচোখি হয় আকাশের সাথে প্রিয়তার। প্রিয়তা সেখান থেকে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে যায়। পেছোন ফিরে আর দেখে না। দেখলে হয়তো দেখতে পারতো যে আকাশ মেহের হাত কিছুটা রুডলি ছিটকে ছাড়িয়ে নেয়।
________প্রিয়তা কয়েকদিন ধরে আকাশকে এড়িয়ে চলে। মেহেরের সাথে দেখলে দূরে চলে যায়। আকাশ একদিন ডাক দিয়েছিল কিন্তু প্রিয়তা শুনেনি। এরই মধ্যে টার্ম পরিক্ষা চলছে। পরিক্ষার আজ শেষ দিন। পাঁচদিন বন্ধ পাবে। কয়েকজন বাদে সবাই নিজের বাড়িতে যায়। কয়েকজন যায় না কারন তাঁদের টিউশনি আছে। প্রিয়তা তো এমনেই বাড়ি পাগল তাই সে ব্যাগ প্যাক করবে হলে গিয়ে। পরিক্ষার পর বের হবার পর দেখে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর ইগনোর করে চলে যেতে ধরলে আকাশ ডাক দেয়,
–প্রিয়তা!
থমকালো প্রিয়তা। এই প্রথম তাকে আকাশ নাম ধরে ডাকলো। এর আগে ডাকলেও মিস! মিস! করে ডাকতো। প্রিয়তা থেমে যাওয়ায় আকাশ সামনে এসে বলে,
–তোমার সাথে একটু কথা আছে। যদি সময় হয় তো একটু ওদিকটায় আসবে?
আকাশ তাকে তুমি করে বললো! ভাবতেই প্রিয়তার লজ্জায় গাল ও নাক রক্তিম হয় যাচ্ছে। প্রিয়তা যায় আকাশের সাথে। আকাশ বলে,
–আমি জানি না তুমি আমাকে নিয়ে কি ভাবো। তুমি আমার সাথে মেহেরকে দেখলে কষ্ট পাও তা আমি লক্ষ্য করেছি। তুমি খুব ভালো মেয়ে। আমার জন্য নিজের জীবন নষ্ট করো না। আমার থেকে বেটার কাউকে পাবে। আমি এই একাকি জীবনে কাউকে এনে তাকে কষ্ট দিতে চাই না। তোমার…
আকাশকে থামিয়ে দিয়ে প্রিয়তা বলে,
–আপনি কি তাহলে চিরকাল এভাবে থাকবেন? কোনো সময় কি আপনি কাউকে জীবন সঙ্গিনী করবেন না? আপনার চাচা মারা গেছে বলে কি আপনি নিজেকে একা ভাবছেন? কিন্তু আপনার পাশে আপনান বন্ধুরা আছে। আপনি একসময় তো কাউকে না কাউকে জীবনে জায়গা দিবেনই।
আকাশ সুবিশাল অন্তরিক্ষের দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমার নামের মতো যদি আমার জীবনেও আপন মানুষদের লিস্ট বিশাল হতো! তাহলে কতো ভালো হতো। এক চাচা আমাকে রাস্তা থেকে এনে চিকিৎসা করেছে। সেও বিয়ে করেনি। তার বিয়ে না করার দুইটা কারন, যেদিন আমার এক্সিডেন্ট হয় সেদিনই তার ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে দেয়া হয় অন্যত্র জোর করে। চাচা আর তার ভালোবাসার মানুষটা ব্যাচমেট ছিল। দুজনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করতো নৃবিজ্ঞান নিয়ে। চাচা তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ার শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে ও সাথে জব খুঁজছে তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে নিতে। কিন্তু বিধাতার মর্জি তো অন্য ছিল। বেকার ছেলের কাছে ওই আন্টিকে তুলে দিবে না তার পরিবার। চাচার পারিবারিক অবস্থা তখন মধ্যবিত্ত। দাদি ও দাদা অসুস্থ। চাচার সব দিক সামলাতে হিমশিম খাওয়া অবস্থা। চার-পাঁচটা টিউশনি করিয়ে চলতো চাচা ও তার পরিবার। এক বোন ছিল চাচার তাকে বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক পুঁজি হারিয়েছে। চাচার বোনের শ্বশুর বাড়ি থেকে যৌতুক চায়নি কিন্তু চাচার বোন দেখতে একটু শ্যামলা ছিল বলে দাদা মেয়েকে আসবাবপত্র দিয়েছেন।
আকাশ থামলো। প্রিয়তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আকাশ তারপর বলে,
–চাচা আন্টির বাবার কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিল কিন্তু তাঁদের মন গলেনি। আন্টির বাবা আন্টিকে কসম দেওয়াতে আন্টি কান্না ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি। বিয়ে হয়ে যায় আন্টির এক সরকারি কর্মকর্তার সাথে। চাচা সেদিন ভগ্ন হৃদয় নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিল। তখন এক নিরিবিলি রাস্তায় গাছের সাথে ধাক্কা লেগে খাদে পরে যাওয়া গাড়ি নজরে আসে। সেখান থেকে এক বাচ্চার আবছা কান্নার শব্দ আসছে। চাচা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে, এক মহিলা তার ৬ বছরের শিশু সন্তানকে আগলে রেখেছে। মহিলাটার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু নিজের সন্তানের রক্তাক্ত অবস্থায় কান্নাতে হয়তো তখনো প্রান বায়ু তার দেহ ত্যাগ করেনি। চাচা গিয়ে কোনো মতে একপাশের দরজা খুলে বাচ্চাটাকে বের করে। মহিলাটা তখন চাচার হাত ধরে কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারেনা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আর মহিলাটির স্বামী তো আরো আগেই মারা গেছে।
প্রিয়তার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। আকাশ তা দেখে মলিন হেসে বলে,
–সেই বাচ্চাটি আমি। চাচা তখন সবার থেকে লুকিয়ে আমাকে নিয়ে যায় হসপিটালে। নিজের ভাতিজার পরিচয় দিয়ে আমার চিকিৎসা করায়। চাচা তখনো জানতো না আমার পরিচয় তবে তার বন্ধু এক ইন্টার্ন ডাক্তার ছিল, তাকে দিয়েই ম্যানেজ করে নেয়। এরপর আমি সুস্থ হই ধিরে ধিরে। নিজের নাম ও বাবা-মায়ের নাম বলতে পারলেও আমার বাকি পরিচয় জানা যায়নি। এরপর থেকে চাচা আমাকে নিজের কাছে এনে রাখে। দাদা-দাদি চাচাকে বিয়ে করাতে চেয়েছিল চাচার মাস্টার্স শেষ হবার পর কিন্তু চাচা রাজী হয়নি। তারপর আমার যখন ৯ বছর বয়স তখন দাদা-দাদিও মারা যায়। চাচার বোনও চাচাকে বিয়ে করাতে চেয়েছিল অনেক কিন্তু চাচা তার ভালোবাসার মানুষটাকে ভুলতে পারবে না আর আমার অবহেলা হবে ভেবে আর বিয়ে করলো না।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
কয়েকদিন ধরে রাইটিং ব্লকে আছি। লেখাতে মনোযোগ আনতে পারছি না।
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।