#মৃত_কাঠগোলাপ – ১২

0
610

#মৃত_কাঠগোলাপ – ১২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

খোলা জানলা টপকে এক মিষ্টি আলো ছুঁয়ে দিচ্ছে আয়েশীর ঘুমন্ত মুখশ্রী। এক ছটাক আলো আয়েশীর চোখের পাতা স্পর্শ করলে, আয়েশী চোখ খিঁচে নেয়। আলো থেকে রক্ষা পেতে ওপাশ ফিরে শোয়। সুন্দর একখানা স্বপ্ন দেখছে আয়েশী। আয়েশী মৃদুলের কাঁধে মাথা রেখে সমুদ্র দেখছে। সমুদ্রের পানির রং ফকফকা সাদা। পানিতে সে কি স্রোত! স্রোতের পানির ঝাপটা ছুঁইয়ে দিচ্ছে আয়েশী-মৃদুলের গা। আয়েশীর পরনে থাকা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। আয়েশীর শীতে চোখ বুজে আসে। মৃদুলের গায়ের সাথে মিশে উষ্ণতা নিতে চায়! মৃদুল আয়েশীর কানের কাছে মুখ এনে মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে সুধায়,
‘ সমুদ্রের জলে যেমন কলঙ্ক নেই, তেমনই আমার কাছে কলঙ্কবিহীন, রক্তজবা। আকাশে যেমন কোনো কালিমা নেই, তেমনই তোমার মনের মধ্যে এক রত্তিও কালো দাগ নেই। আকাশের নীলের ন্যায় বিশুদ্ধ তুমি! কিন্তু পৃথিবীর সকল পাপমুক্ত জিনিস কারো না কারো কুনজর পড়ে! তেমনি তোমার জীবনে আমি হলাম সেই একমাত্র কুনজর। যার কুনজর থেকে আজ অব্দি কেউ বাঁচতে পারেনি। সবাই ভুগেছে, ছটফট করেছে, মুক্তি চেয়েছে। কিন্তু আমি কাউকে মুক্তি দেয়নি। নিজের কাছে বন্দী করে রাখাই আমার ধর্ম! তাই তুমিও বন্দী হবে রক্তজবা। তবে আমার ভালোবাসা তোমার সকল অভিযোগকে সমূলে ধ্বংস করবে। ভালোবাসি, প্রাণের চেয়েও বেশি আমার রক্তজবা! ‘

‘রক্তজবা’ শব্দটা আয়েশী জীবনে প্রথম শুনল। ঘুমের মধ্যেই আয়েশীর ভ্রুরু কুঁচকে এল। চোখের সামনে মৃদুল সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে গেল। আয়েশী পাড়ে বসে আছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল কি?
স্বপ্নে হঠাৎ করে সমুদ্রের শান্ত জল, গর্জন করে উঠল। সমুদ্রের জল দৈত্যের ন্যায় আঁচড়ে পড়ল আয়েশীর গায়ের উপর। আয়েশী ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে যেতে আয়েশী দেখল,সমুদ্রের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক অতীব সুন্দর পুরুষকে! পুরুষটি আয়েশীর দিকে চেয়ে রহস্যময় হাসছে। তার গায়ের স্পর্শে সমুদ্রের জল শান্ত শিশুর ন্যায় হয়ে গেছে। সমুদ্রে যেন আলিঙ্গন করছে সে পুরুষটিকে! আয়েশী অবাক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পুরুষটির দিকে! কে এ পুরুষ? কে সে?

চুলে বলিষ্ট পুরুষালি হাতের স্পর্শে আয়েশীর ঘুম ভেঙে যায়। আয়েশী চোখ খুলে তাকায়। কেউ নেই পাশে। তাহলে কে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল? আয়েশী শোয়া থেকে উঠে বসল। গায়ে বিয়ের শাড়িটি আর নেই। বোধহয় মা পাল্টে দিয়েছেন। মস্তিষ্ক সজাগ হলে, আয়েশীর পুনরায় মনে পড়তে লাগল মৃদুলকে। আবার কান্না আসছে। আয়েশীর চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল
‘ কোথায় তুই মৃদুল? আমার খুব মনে পড়ছে তোকে। আয় না ফিরে। আমার কথা কি তোর একটুও মনে পড়ে না? এত পাষাণ কেন রে তুই? ‘

‘ আয়েশী, ঘুম থেকে উঠে গেছিস মা? ‘
মনোয়ারা চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন। আয়েশী চোখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে। আয়েশীর মা চায়ের ট্রে টি টেবিলের উপর রাখলেন। আয়েশীর দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ চা খা। শরীর ভালো লাগবে। ‘

আয়েশী চায়ের কাপ হাত দিয়ে ফিরিয়ে দিল। বলল,
‘ খাবো না। ভালো লাগছে না আমার। ‘
‘ আমি ভেবেছিলাম আজ মা-মেয়ে একসাথে চা খাবো। অথচ, তুই তো তোর কথা বলে দিলি। আমার কথা আর কে ভাববে? আমি কে তোর? ‘
মায়ের অভিমানী অভিযোগ শুনে অন্যসময় হলে আয়েশী হাসত। অথচ আর তার ঠোঁটকোলে বেদনার ছাপ। আয়েশী না চাইতেও চায়ের কাপ হাতে নিল। চায়ে চুমুক দিতেই গা-টা শিরশির করে উঠল। গরম মসলা চা খেয়ে গা বেশ চাঙ্গা লাগছে। শরীরের অবসন্ন ভাব নিমিষেই যেন নিঃশেষে হয়ে গেল। কেন সবসময় মা জেনে যায়, কখন আয়েশীর কি দরকার!
আয়েশীর মা, মেয়েকে এটা সেটা বলে ব্যস্ত রাখতে চাইছেন। ডাক্তার বলেছেন, আয়েশীকে যত ব্যস্ত রাখা যাবে, আয়েশী তত দ্রুত মানসিক অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারবে।

মনোয়ারা চলে গেলে, আয়েশী হাফ ছাড়ে। মায়ের চোখে নিজেকে ভালো দেখাতে গিয়ে, এতক্ষণ হাফিয়ে উঠছিল।
মা বলে গেছেন, বাবা খাবার টেবিলে যেতে বলেছেন। আয়েশী প্রথমে মানা করতে চাইলে, বাবার কথা ভেবে আর মানা করতে পারেনি। তাই অবিন্যস্ত চুল হাত দিয়ে খোঁপা করে বাথরুমের কাজ সেরে খাবার ঘরের দিকে যায়।

‘ বসো,মা। ‘
আয়েশীকে দেখতে পেয়ে কামরুল খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন। মেয়ে যে তার কথামত খেতে এসেছে সেই ত অনেক। আয়েশীকে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে চাইলে, সবার সঙ্গে মিশতে হবে। একা থাকা কখনোই যাবে না। বাবার কথায় আয়েশী চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ল।
খাবার খাওয়া শুরু করতে চাইলে, কামরুল বাঁধা দেন। বললেন
‘ আরো একজন আসবে। তার জন্যে অপেক্ষা করো। ‘

আয়েশী অবাক হলো। কে আসবে নাস্তার সময়? একটু পর কলিং বেল বাজল। কামরুল বলেন,
‘ আয়েশী, যাও দরজা খুলে আসো। ‘
আয়েশীর ভালো লাগলো না বাবার কথা। মন মেজাজ ঠিক নেই। হাঁটতে একটুও ভালো লাগছে না। শুধু গা কাপিয়ে কান্না আসছে। চিৎকার করে কান্না করতে পারলে মনটা হালকা হতে পারত। অথবা আত্মহত্যা করে ফেললে রক্ষা মিলে যেত এই মরণযন্ত্রণা থেকে! জীবিত থেকেও লাশ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে একবারে মরে যাওয়া ভীষন সুখের।

আয়েশী সদর দরজা খুলল। কিন্ত সে অবাক হলো ভীষন। ধ্রুব এখানে কি করছে? ধ্রুবর সাথে আয়েশীর মাত্র দুবার দেখা হয়েছে। তবে মৃদুলের মুখে বারবার ধ্রুবর কথা শুনেছে। মৃদুল বলেছে, ধ্রুবর মত ভালো আর শুদ্ধ মানুষ এই পৃথিবীতে নাকি দুটো হয়না!

‘ ভেতরে ঢুকতে দেবেন না? ‘
ধ্রুবর কথায় হুশ ফেরে আয়েশীর। লজ্জায় আলুথালু হয়ে যায়। দ্রুত দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলে,’আসুন।’

ধ্রুব ভেতরে প্রবেশ করে। ধ্রুব ঘরে ঢুকেই খাবার টেবিলে চেয়ার টেনে বসে যায়। আয়েশী ভীষন অবাক হয়। এখন কি ধ্রুব তাদের সাথে নাস্তা খাবে? বাবা কি তবে তার কথা-ই বলেছিলেন? আয়েশী চুপচাপ টেবিলে বসে। খাবার খেতে খেতে ধ্রুব ও কামরুল নানা রকম কথা বলেছেন। তাদের কথার শোরগোল আয়েশীর কান জ্বালা করে। ধ্রুবর এখানে আসা, মৃদুলকে হারানোর স্মৃতি আরো তাজা করে দিচ্ছে। আয়েশীর আবার কান্না পাছে। ইচ্ছে করছে মাথার চুল খামচে ছিঁড়ে ফেলতে। গায়ের জামাটাও টুকটুক করে কেটে ফেলতে। মৃদুল কেন তাকে ছেড়ে চলে গেল?

আয়েশী আর সহ্য করতে পারে না। অর্ধেক খাবার ছেড়ে উঠে যায়। কামরুল হাসান ধ্রুব থেকে চোখ সরিয়ে আয়েশীর দিকে তাকান।
‘ খাবার ছেড়ে উঠে গেলে যে? ‘

আয়েশী একপল ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব মাথা নিচু করে খাচ্ছে ও সুখী সুখী আওয়াজ তুলছে। আয়েশী বাবার দিকে চেয়ে বলে,
‘ আমার পেট ভরে গেছে। আমি রুমে যাচ্ছি। একটু একা থাকতে দাও আমাকে। প্লিজ! ‘

আয়েশী গটগট করে তার কক্ষে চলে যায়। ধ্রুব সেদিকে তাকায়। কামরুল হাসান গম্ভীর চোখে ধ্রুবর দিকে তাকান। বললেন,
‘ বিষয়টা মনে হয়না খুব সহজ হবে তোমার জন্যে, ধ্রুব। ‘

ধ্রুব হাসল। আজ পর্যন্ত তার কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব ঠেকে নি। সব কাজে সফল সে হয়েছে! সফল না হলে, কিভাবে সফলতা ছিনিয়ে আনা যায় সেটাও ধ্রুবর জানা। ধ্রুব কামরুল হাসানের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। বলল,
‘ আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো! সব সামলে নিব।’

#চলবে
গল্প পড়ে চুপচাপ চলে যাবেন না। একটা গল্প লেখার সময় লেখকের অনেক কষ্ট হয়। তাই পাঠকরা মন খুলে রিয়েক্ট ও বড়বড় কমেন্ট করার দ্বারা লেখকের কষ্টের মূল্য দিবেন এবং নিজেদের যোগ্য পাঠক বলে পরিচয় দিবেন। ভালোবাসা! ~~~~`(শব্দসংখ্যা- ১০০০+)

লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here