#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_____________________________________
বইছে ঝড়ো হাওয়া, গাছের পাতায় শীতলতার ঢেউ খেলছে, পিচঢালা রাস্তায় স্তরে স্তরে কাদা জমেছে। ঝুমঝুম বৃষ্টি নামছে। আকাশের বুকে বিশাল ফাঁটল পরিলক্ষিত হল। বিদ্যুতের ঝলকানির শব্দে রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ ঝাঁজরা হল। আয়েশী ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝুম বৃষ্টির ফোঁটা আয়েশীর মন-দেহ ছুঁয়ে। ওড়নার অগ্রভাগ ব্রিজের উপর গড়াচ্ছে। কাদা মেখে নোংরা! আয়েশী ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। মুখের হাত চেপে অবিরত কেঁদে মনের কষ্ট হালকা করার চেষ্টা করল। পারল কি? এখনও বুকের ভেতরটা জ্বলছে। কষ্টের তীব্রতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে কষ্টের পাহাড় তৈরি করছে। হয়তো একসময় এই পাহাড় ধ্বসে পড়বে, আয়েশী সেদিন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হবে। মূর্তির যেমন কষ্ট হয় না, অনুভূতি থাকে না! আয়েশীরও বুঝি থাকবে না?
আয়েশীর চোখের জল হার মানল। ফুরিয়ে এল একসময়। এখন যা আছে শুধুই ভেজা কিছু অনুভূতি! আয়েশী দুহাতে চোখ মুছল। অতঃপর শেষমুহর্তে আকাশের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলল, ‘ আমি তোকে ঘৃনা করি মৃদুল, এতটা ঘৃনা বোধহয় আমি আর কাউকে করতে পারবো না! ”
মেয়েলী কণ্ঠের তেজে রাতের আঁধার ভয় পেল। গুটিয়ে গেল। পালাতে চাইল! জড়োসড়ো হয়ে চেয়ে রইল জমিনের উপর বাস করা এক পরম দুঃখী নারীর দিকে!
____________
ধ্রুব পরপর আয়েশীর সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। পারছে না। আয়েশীর সেলফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। ধ্রুব রাগে তার সেলফোন বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলল। রাগে কাঁপছে সে। ভোর সকালে বেরিয়েছে, এখনো বাসায় আসার নাম নেই। বেশি ছাড় দিয়েছে বলেই সাহস বেড়ে গেছে। ডানা কাটার জন্যে তড়পাচ্ছে। ধ্রুব ওসমানকে ডাকল। ওসমান জড়োসড়ো হয়ে ধ্রুবর কাছে এল। ধ্রুব দ্রুত গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে বলল, ‘ গাড়ি বের করো। আমি বেরুবো। ‘
ঢাকা শহর হন্যে হয়ে খুঁজে গেল আয়েশীকে। পেল না। রাত-বিরাতে কোথায় গেল এই মেয়ে? ধ্রুবর রাগে মাথা ধপধপ করছে। মস্তিষ্কের রক্ত ফুটছে। আয়েশীকে ধ্রুব ইচ্ছে করে একটু স্বাধীনতা দিয়েছিল। ভেবেছিল স্বাধীনতা পেলে আয়েশীর মন খানিক নরম হবে। ভালোবাসবে ধ্রুবকে। অথচ ঘটেছে তার উল্টোটা। কি লাভ এত স্বাধীনতা দেওয়ার? যদি দিনশেষে পাখি পিঞ্জিরায় ফিরে না আসে!
ধ্রুব হার মেনে ঘরে ফিরে এল। ইতিমধ্যে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। ধ্রুব বাড়ি ফিরে নিজের কক্ষে এল। আয়েশীকে পাওয়া যাচ্ছে না, কতটা ভয়ঙ্কর সংবাদ। আশেপাশে ধ্রুবর শত্রুর অভাব নেই। কেউ যদি জেনে যায়, ধ্রুব ইউহান শেখের মত ক্ষমতাশীল ব্যক্তির স্ত্রী নিখোঁজ, শত্রুদের জিহ্বা দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়বে আয়েশীর ক্ষতি করার জন্য। আর ধ্রুব এই সুযোগটা তাদের দিতে চাচ্ছে না।
‘ আয়েশীর সকল বন্ধু বান্ধবের আজ রাতের মধ্যে লকাপে দেখতে চাই। থার্ড ডিগ্রি টর্চার পড়লে সব উগলে দিবে। এক ঘণ্টার মধ্যে আয়েশীকে আমার সামনে চাই। বুঝেছ? ‘
ধ্রুব সেলফোনে কানে কথা বলতে বলতে আয়েশীর কক্ষে এল। উদ্দেশ্য, আয়েশী সম্বন্ধে কোনো গোপন তত্ত্ব পাওয়া যায় কি-না! হয়তো এই তত্ত্ব এর পেছনে ছুটে ধ্রুব আয়েশীর কাছে পৌঁছে যেতে পারবে।
সেলফোনে কথা বলতে বলতে ধ্রুব আয়েশীর কক্ষে এল। কিন্তু হঠাৎ বারান্দা থেকে কান্নার শব্দ শুনে ধ্রুব থমকে যায়। আয়েশীর কণ্ঠ? আয়েশী কি বাড়িতেই?
ধ্রুব ধীর হাতে সেলফোন কান থেকে নামায়। সেলফোন পকেটে পুড়ে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে।
বারান্দার দরজা খুলে ধ্রুব হতভম্ব হয়ে যায়। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আয়েশী বারান্দার মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। মুখমন্ডল দু হাঁটুর মধ্যখানে লুকিয়ে রাখা। ফুপিয়ে কাদঁছে, যার ফলে শরীরে কম্পন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আয়েশীকে পেয়ে ধ্রুবর চোখে শান্তি নামে। মনের ঝড় নিমিষেই শান্ত হয়। অবশেষে আয়েশীকে খুঁজে পেয়েছে সে!
কিন্তু ধ্রুবর মাথায় আপাতত খুশির চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে। মন চাচ্ছে মেয়েটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। ধ্রুব নিজের রাগ দমন করতে পারল না। দ্রুত পায়ে আয়েশীর কাছে আসল। অতঃপর এক টানে আয়েশীকে সোজা করে দাঁড় করাল। আচমকা আক্রমন করায় আয়েশী ভয় পেয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল চোখে ধ্রুবর দিকে চাইল। ধ্রুব সে চাওনি লক্ষ্য না করে ধাম করে আয়েশীর ডান গালে সজোরে থা’প্পর বসাল। থা’প্পড়ের বিকট শব্দে চারপাশ ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠল। আয়েশীর কান ভনভন করতে লাগল। গালে বোধকরি কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার নরম তুলতুলে গাল। আয়েশী গালে হাত দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে চাইল। ধ্রুব এখনও রেগে আছে। রাগে তার পেটানো, বলিষ্ট দেহ কাঁপছে। ধ্রুব একটু সরে গেল। বাম হাত কোমড়ে রেখে, ডান হাতের আঙ্গুল কর্তৃক কপাল চুলকাল। আড়চোখে আয়েশীর দিকে একবার চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। আয়েশী গালের ব্যথায় কেঁদে উঠল। গাল আগুনের ন্যায় গরম হয়ে আছে। এত জোড়ে কেউ মারে? হাত নয় যেন দানব!
ধ্রুব আয়েশীর কান্নার শব্দে মহা বিরক্ত হলো। তর্জনী উচুঁ করে বলল, ‘ এই মেয়ে, কাদঁবে না। কাঁদবে না বলছি। কাঁদলে মে’রে ফেলব একদম। ‘
আয়েশী ভয় পেল। কান্না থামানোর চেষ্টা করল। ভয়ে কান্না থেমে গেছে, এখন ক্রমাগত হেঁচকি দিচ্ছে। ধ্রুব এবার একটু শান্ত হয়ে, ঢোক গিলে বলল,
‘ সকাল থেকে রাত অব্দি কোথায় ছিলে? হ্যাঁ? মানুষ মনে হয়না আমাকে? সম্পূর্ন ঢাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু না ম্যাডাম তো অদৃশ্য হয়ে আছেন। আর সেলফোন? সেলফোন আছে কিসের জন্যে? পূঁজো করার জন্যে? ফোন রিসিভ করে একবার বলা যাচ্ছিল না, আমি বাসায় আছি। চুপ করে থাকবে না, উত্তর দিবে। ‘
আয়েশী ভয়ে পেয়ে চোখ পিটপিট করল। গালে হাত রেখে বোকার মত বলল, ‘ সেলফোন ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। ‘
ধ্রুব অসহায় বোধ করল। চোখ উল্টে বিড়বিড় করল,’ওহ,ড্যাম। ‘
আয়েশীর কাদঁছে এখনো। তবে এ কান্নার শব্দ নেই, নীরবে শুধু চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে। প্রিয়তমার চোখের অশ্রু ধ্রুবর কাছে সহস্র তলোয়ারের আঘাতের সমান। প্রিয়তমা যখন কাঁদে ধ্রুবর ইচ্ছে হয়, সম্পূর্ণ দুনিয়াকে স্তব্ধ করে দিতে। প্রিয়তমাকে বুকের সাথে পিষে ফেলতে। তার চোখের জল নিজের জিহ্বা দ্বারা শুষে ফেলতে।
ধ্রুব তাই করল!
আয়েশীকে বাহু টেনে নিজের মধ্যে নিয়ে নিল। আয়েশীর নরম শরীরকে নিজের শক্ত দেহের মাঝে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি সুরে বলল, ‘ সরি বলবো না। কারণ ধ্রুব কাউকে কখনো সরি বলে না। দোষ করেছ, শাস্তি পেয়েছ। একই ভুল পুনরায় করবে না। ঠিক আছে? ‘
আয়েশী ধ্রুবর বুকের মধ্যে পড়ে আছে। ভীষন অস্থির লাগছে। ধ্রুবর বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল। পারল না। ধ্রুব বলল, ‘ শুধু-শুধু শক্তি অপচয় করছ। তুমি জানো, আমি যতক্ষণ না ছাড়বো, তুমি আমার থেকে ছূটতে পারবে না। ‘
আয়েশী রাগ হল, গুটিকয়েকবার চেষ্টা করল ছুটে পালানোর। পারলো না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে পড়ে রইল ধ্রুবর বৃত্ত-বুকের উপর। আয়েশীর ভেঙে যাওয়া মনে প্রশ্ন জাগল, ধ্রুব কি সত্যি আয়েশীকে ভালোবাসে? নাকি মৃদুলের মত সেও আয়েশীকে ধোঁকা দিবে? একবার ধোঁকা পেয়ে আয়েশী শেষ হয়ে গেছে, আরেকবার ধোঁকা খাওয়ার শক্তি তার মধ্যে নেই। মৃদুল আয়েশীর মন থেকে সমস্ত বিশ্বাস, আশ্বাস বন্য রা’ক্ষুসের ন্যায় শুষে নিয়েছে।
‘ আমি মৃদুল না। ‘ ধ্রুবর কথায় আয়েশী চমকে উঠে। ধ্রুব কি তবে সব শুনে নিয়েছে? কেমন করে? সে কি মন পড়ার মন্ত্র জানে? ধ্রুব মুচকি হেসে আয়েশীর চুলে ঠোঁট বুলালো। আয়েশী চোখ খিঁচে নেয়। অন্য পুরুষের স্পর্শ আয়েশীর কাছে বিষ সমতুল্য!
ধ্রুব আয়েশীকে নিজের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে। বলে,
‘ ফ্রেশ হও। ভিজে শরীরে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। ‘
আয়েশী কিছু বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল নিজ স্থানে। ধ্রুব চলে যেতে উদ্যত হয়। তবে আয়েশী পেছন থেকে ধ্রুবর হাত ধরে ফেলে। ধ্রুব চরম বিস্মিত হয়। ভ্রুরু কুঁচকে যায়। কপালের ভাজ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়। আয়েশী নিজ থেকে ধ্রুবকে স্পর্শ করেছে! বিশ্বাস হচ্ছে না ধ্রুবর। ধ্রুব পেছন ফেরে। তার অবাক চোখ আয়েশী পানে আটকে। আয়েশী ধ্রুবর হাত ধরে কাতর স্বরে অনুরোধ করে,
‘ আমায় এই শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে চলুন না। যে শহরে ঘৃনা থাকবে না, ধোঁকা থাকবে না, মন ভাঙার খবর থাকবে না। এ ঘৃণার শহরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ‘
ধ্রুব কিয়ৎক্ষণ আয়েশীর দিকে চেয়ে রয়। অতঃপর মৃদু হেসে বলে, ‘ নিয়ে যাবো, খুব শীগ্রই! ‘
আয়েশী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ধ্রুবর হাত ছেড়ে বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাড়ায়। ভালো লাগছে না কিছুই। অস্থির লাগছে ভীষন। কিছু কি খারাপ ঘটছে? জানে না।
ধ্রুব এখনও নিজের হাতের দিকে চেয়ে। আয়েশীর স্পর্শ এখনও ধ্রুব নিজের হাতের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারছে। আয়েশীর গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ এখনও ধ্রুব অনুভব করছে। ধ্রুবর বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। ধ্রুব হাত উঠিয়ে আয়েশীর স্পর্শ করা জায়গায় গভীর চুমু খেল। আবেগে চোখ বুজে এল তার। ধ্রুবর মনে হলো, সে স্বর্গে ভাসছে। নিজেকে মাতাল লাগছে ভীষন। ধ্রুব চোখ তুলে আয়েশীর দিকে চাইল। আয়েশী আকাশের দিকে চেয়ে। আর ধ্রুব তার একান্ত ব্যক্তিগত আকাশের পানে চেয়ে! আয়েশী, ধ্রুবর একান্ত ব্যক্তিগত আকাশের নাম! যার উপর ধ্রুব ব্যতীত আর কারো অধিকার নেই। থাকতে পারে না। আয়েশী শুধু ধ্রুবর, এই ধ্রুব ইউহান শেখের।
#চলবে ( শব্দসংখ্যা- ১২০০+)
প্রায় ১৪০০ মানুষ গল্প পড়েন, অথচ রিয়েক্ট করতে চান না। যারা গল্পটা পড়বেন কষ্ট করে রেসপন্স করবেন প্লিজ। পেইজের রিচ অনেক কমে গেছে। আপনাদের ছোট্ট রিয়েক্ট, দু লাইনের কমেন্ট আমাকে গল্প লিখতে অনেক বেশি উৎসাহিত করে।
সেরা কমেন্টকারীদের নাম তাদের কমেন্টসহ লেখিকার গ্রুপে পোস্ট করা হবে।
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri