#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩৩

0
318

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩৩
লেখিকা-#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________________
‘ লাগেজ প্যাক করো। আমরা প্যারিস যাচ্ছি। ‘
ভোরের আলো ফুটতে এখনও বেশ দেরি। সারারাত কেঁদে মাত্রই ঘুমিয়েছে আয়েশী। আয়েশীর চোখে এখন প্রচুর ঘুম লেগে আছে। আয়েশী চোখ পিটপিট করে চাইল। ধ্রুব আয়েশীর দিকে ঝুঁকে। মুখ ভয়ংকর গম্ভীর! আয়েশীকে জেগে উঠতে দেখে ধ্রুব সরে গেল। আয়েশী কিছুক্ষণ থেমে বলল,
‘ এখন যাব, এত সকালে? ‘
‘ হ্যাঁ।’
ধ্রুব হেঁটে আলমারি থেকে জরুরি নথিপত্র বের করছে। আয়েশী ধ্রুবকে লক্ষ্য করল। সম্পূর্ণ তৈরি ধ্রুব। এবারেও ধ্রুব সাদা রঙের টিশার্ট পড়েছে। ধ্রুবর কি সাদা রঙ খুব পছন্দ? আয়েশী যখন দেখে ধ্রুব আপাদমস্তক সাদায় আচ্ছাদিত! সাদা রং ধ্রুবর উজ্জ্বল চেহারায় ফুটে উঠে বেশ! সাদা পরিহিত অবস্থায় ভীষন সুন্দর দেখায় ধ্রুবকে। আয়েশী যদি মৃদুলকে ভালো না বাসতো তবে ধ্রুবর এই সুন্দর চেহারা দেখে ঘৃনা করতে পারত না।
ধ্রুব একটি বিশাল আকারের নথি হাতে নিয়ে বিছানায় বসল। ভ্রু কুঁচকে নথির পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখছে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটের এক অংশ কামড়ে ধরে কিছু চিন্তা করছে।
আয়েশী হামি দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। এলোমেলো চুল হাতখোঁপা করে কাঁটা দিয়ে আটকে বিছানা ছেড়ে নামল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে লাগেজ গোছাতে শুরু করল। মন খারাপ করছে আয়েশীর। মৃদুলের স্মৃতি থেকে পালাতে শহর ছাড়ছে। তবে পারবে কি মৃদুলের স্মৃতি মন থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে। কিংবা মৃদুলের প্রতি ঘৃণার অনুভব থেকে মুক্ত হতে? পারবে কি? আয়েশী জানে না। তবুও আশা করছে। মানুষ আশার উপর বাঁচে, আশা আছে বলেই মানুষ জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করে।
আয়েশী আলমারি থেকে কাপড় বের করছে। হঠাৎ চোখ পড়ল আলমারির ড্রয়ারে রাখা মৃদুল এবং আয়েশীর একটি সুন্দর ফটোফ্রেমের দিকে। আয়েশী কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইল ফটোটির পানে। আয়েশীর চোখ ভরে আসছে। আবার মন খারাপ করছে। আয়েশী হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল ছবিটিকে। অতঃপর কিছু একটা মনে পড়ায় ফটোটি নিয়ে লাগেজে পুড়ে নিল। ধ্রুব দেখল। তবে কিছু বলল না। নথিপত্র দেখতে মন দিয়ে বলল,
‘ শীতের কাপড় নিও। ‘
আয়েশী মন ভার করে বাকি কাপড় ব্যাগে পুড়ল।
ধ্রুবর কাজ শেষ হলে সে প্রয়োজনীয় নথিপত্র ব্যাগে পুড়ে আয়েশীর কাছে এল। আয়েশী কাপড় ভাঁজ করছে। ধ্রুব লাগেজের সামনে থেকে আয়েশীকে সরিয়ে লাগেজ খুঁজে মৃদুলের ছবির ফ্রেমটি বের করে মাটিতে শক্ত করে ছুঁড়ে ফেলল। কাঁচের ফ্রেমটি মাটিতে পড়ে কয়েক টুকরোয় বিভাজিত হল। সুন্দর ছবিটি সম্পূর্ণ নষ্ট হল। মৃদুলের মুখশ্রী ভাঙা কাঁচের আড়ালে ঢাকা পড়ল। আয়েশী হতভম্ব হল। মুখে হাত চেপে ফ্যালফ্যাল চোখে চাইল ভাঙা ছবির দিকে। চোখে জল এসে গেল তার। প্রিয় মানুষের স্মৃতি নিজের সামনে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে রাগে মাথার নিউরন কেঁপে উঠল। আয়েশী ধ্রুবর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
‘ এটা কি করলেন আপনি? আমাদের ছবি ভেঙে ফেললেন কোন সাহসে? ‘
ধ্রুব নির্বিকার। মৃদু রেগে আয়েশী কোমড় চেপে নিজের দিকে টেনে নিল। আয়েশী রাগে তখন কাঁপছে। ভুলে গেছে মৃদুলের দেওয়া শত আঘাতের স্মৃতি। শুধু মনে রয়ে গেছে মৃদুলের দেওয়া প্রণয়ের সুন্দর মুহূর্তসমূহ। আয়েশী ধ্রুবর বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিল ছাড়া পাওয়ার জন্য। পারল না। ধ্রুব আয়েশীর কপালের চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
‘ আজ থেকে মৃদুল কে তা ভুলে যাও। আজ থেকে আমাদের অর্থ শুধু আমি-তুমি! ঘৃণার শহর থেকে পালাতে চাইছ, অথচ ঘৃণার স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাচ্ছ দূর দেশে। এমন করলে হবে? মৃদুলকে ভুলতে চাইলে তার সকল স্মৃতিকে এভাবেই ভেঙে টুকরো টুকরো করতে হবে। বুঝেছ? ‘

আয়েশী মাথা নিচু করে নিল। সত্যি তো! যাকে ঘৃনা করে নিজের দেশ থেকে পালাচ্ছে, তার স্মৃতি এখনও বইছে কেন সে? আয়েশী মৃদু স্বরে বলল, ‘ আমার ছাড়ুন। ‘
ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে ছেড়ে দিল। মূলত দেখতে চাইছে, ধ্রুবর দেওয়া টোপে কাজ করেছে কিনা। আয়েশী মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল। মৃদুলের ছবির উপর থেকে ওড়না দিয়ে কাঁচের টুকরো সরাল। অতঃপর মৃদুলের ছবি হাতে নিয়ে এক টানে ছবিটিকে ছিঁড়ে দু টুকরো করে ফেলল। অতঃপর তিন টুকরো, চার টুকরো, দশ টুকরো, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর।
আয়েশী ছবির টুকরো-গুলোকে বুকের সাথে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মৃদুলের স্মৃতি মুছে ফেলা আয়েশীর কাছে ততটা সহজ না। আয়েশী পারবে না। পারছে না! মৃদুল আয়েশীর শিরা-উপশিরার সাথে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে গেছে। আয়েশী চাইলেও সেই স্মৃতি মুছে ফেলতে পারছে না।
ধ্রুবর রাগ হচ্ছে ভীষন। তবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। আয়েশীর পাশে বসে আলতো করে আয়েশীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ শান্ত হও, আয়েশী। ‘
আয়েশী শুনল না। ঝাঁপিয়ে পড়ল ধ্রুবর বুকের উপর। আচমকা আক্রমণে ধ্রুব পেছনে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল। স্তব্ধ চোখে চোখ নিচু করে আয়েশীর দিকে চাইল। আয়েশী ধ্রুবর বুকের শার্ট দুই আঙ্গুল দিয়ে খামচে ধরে উন্মাদের মত কাঁদছে। বারবার বলছে,
‘ আমি পারবো না। যাকে এতটা বছর নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছি, তাকে ঘৃনা করতে পারবো না আমি। মরে যাব আমি। ম’রে যাব। ‘
আবার মৃদুল! আয়েশী তার’ই বুকের উপর পড়ে অন্য কাউকে ভালোবেসে চোখের জল ফেলছে, ভাবতেই ধ্রুবর র’ক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। ধ্রুব চোখ বুজে রাগকে সামলে নিয়ে আয়েশীর দুই গাল নিজের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে আয়েশীর মুখ নিজের দিকে উচুঁ করল। নরম কণ্ঠে বলল, ‘ এই আয়েশী, তাকাও আমার দিকে। ‘
আয়েশী কান্না থামিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুব বলল,
‘ যে তোমার ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে অন্য কাউকে ভালোবেসে সুখী ছিল, তার জন্যে তুমি তোমার চোখের জল ফেলতে চাও? এত সস্তা তোমার চোখের জল? সে তোমাকে কখনোই ভালোবাসেনি, তাই তাকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়া উচিৎ না। তার ভালোবাসাকে গলা টিপে মেরে ফেল। কবর দিয়ে দাও এই মৃত অনুভূতিগুলোকে। আমি জানি তুমি পারবে? কি, পারবে না? ‘

আয়েশী মাথা নাড়ল। যার অর্থ পারবে সে।
ধ্রুব হাসল। তার বাঁকা হাসি আয়েশী দেখল না। দেখলে হয়তো বুঝতে পারত, ও হাসি হাসি নয়! বরং কাউকে পরাস্ত করে নোংরা বিজয়ের হাসি!
___________________________
আকাশের ভেসে বেড়াচ্ছে শুভ্র রঙের অজস্র মেঘেরা। প্লেন মেঘেদের বুক চিঁড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আয়েশী জানলার পাশে বসেছে। জানালার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আয়েশী। চারপাশে শুভ্র রং ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। চোখের মণি ঝাপসা হচ্ছে সাদার মায়ায়। আয়েশী জানালায় হাত রাখল। ধ্রুব বলেছে জানালা খোলা যাবে না। তাই সে জানালার কাঁচে হাত রেখে অদূরের মেঘ গুলো ছুঁতে চাইল। কাঁচও কি ঠান্ডা! মনে হচ্ছে আয়েশী সত্যি সত্যিই মেঘ ছুঁতে পেরেছে।
‘ কিছু খাবে? ‘
ধ্রুব পাশ থেকে প্রশ্ন করল। আয়েশী আনমনে বলে ফেলল,
‘ হ্যাঁ, মেঘ খাব!’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ মেঘ খাওয়া যায়? ‘
আয়েশীর মন খুব ভালো লাগছে। মেঘের সাদা যেন আয়েশীর ভেতরের সকল মন খারাপ রাক্ষসের ন্যায় শুষে নিয়েছে। আয়েশী উচ্ছ্বাসের সহিত বলল,
‘ মেঘ খেতে পারলে অনেক ভালো লাগত। মুখে দিলেই হাওয়াই মিঠাইর ন্যায় মিলিয়ে যেত। ইশ, মেঘ যদি খাওয়া যেত! ‘
ধ্রুব আয়েশীর কথা শুনে ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েটা বোধহয় জীবনের প্রথম প্লেনে উঠেছে। তাই যা দেখছে তাই সুন্দর লাগছে। এটাই স্বাভাবিক! আকাশ দেখতে সবার ভালো লাগে। আর যদি সে আকাশ অতি সামান্য দূর থেকে দেখা যায়, তবে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়, আমরা আকাশের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে বাচ্চা হয়ে যাই। আয়েশীও তেমন!
ধ্রুব এয়ারহোস্টেজকে দুটি স্যান্ডউইচ এবং দুটো ক্যান দিতে বলে আবার আয়েশীর দিকে চাইল। আয়েশী বাচ্চার ন্যায় আচরণ করছে। হাত বাড়িয়ে মেঘকে ছুঁতে চাইছে। পারছে না, তাই মন খারাপ করে মুখ ফুলাচ্ছে। আবার ছুঁতে চাইছে, আবার মন খারাপ করছে। ধ্রুবর আয়েশীর আচরণ দেখে হাসি পেল। মৃদু হেসে সে সেলফোন বের করে আয়েশীর সুখী মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করে নিল। ছবিটা সুন্দর এসেছে।
‘ স্যান্ডউইচ খাবে? ‘
আয়েশী তাকাল। স্যান্ডউইচ দেখে তার পেটের মধ্যে এতক্ষণ জমে থাকা ক্ষুধা যেন লাফিয়ে উঠল। আয়েশী ধ্রুবর থেকে স্যান্ডউইচ নিয়ে তাতে কামড় বসাল। ধ্রুব প্রশ্ন করল, ‘ ভালো লাগছে? ‘
আয়েশী মাথা নাড়ল। অর্থাৎ ভালো লাগছে তার। ধ্রুব স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ল। যাক, আয়েশীর মন ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। এটাই মুক্ষোম সুযোগ! এই সফরেই আয়েশীর মন থেকে মৃদুলের স্মৃতি আজীবনের জন্য মুছে ফেলবে ধ্রুব! ধ্রুব মৃদু হাসল। আয়েশী স্যান্ডউইচ খেতে খেতে জানালার দিকে চাইল। আকাশের মেঘ কেটে যাচ্ছে। আয়েশীদের প্লেন ধীরে ধীরে প্যারিসের ভূমিতে নামছে।

#চলবে ( শব্দসংখ্যা- ১১০০+ )
যারা গল্পটা পড়বেন কষ্ট করে রেসপন্স করবেন প্লিজ। আপনাদের ছোট্ট রিয়েক্ট, দু লাইনের কমেন্ট আমাকে গল্প লিখতে অনেক বেশি উৎসাহিত করে।
সেরা কমেন্টকারীদের নাম তাদের কমেন্টসহ লেখিকার গ্রুপে পোস্ট করা হবে।( গত দুই পর্বের কমেন্ট বিজয়ীর নাম আজ সন্ধ্যায় গ্রুপে পোস্ট করা হবে)

লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here