#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-১৬]
কর্মব্যস্ত দিনের শেষে অফিস ত্যাগ করার সময় লিখির মনটা প্রজাপতির মতো ফুরফুরে হয়ে আসে। এ যেন ছোটবেলায় স্কুল ছুটি হওয়ার মতো আনন্দ। যদিও সময়ের পরিপক্কতার আঁচ’ড়ে আনন্দের ধরন বদলেছে, বদলেছে প্রকাশের ভাষাও। লিখি খোলা চুল ওপরে তুলে একটা শক্ত ঝুটি করে নিলো। শ্বশুরবাড়ি থেকে অফিসটা খানিক কাছে হওয়ায় ছুটির পর হাতে একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। অফিস থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্য দাঁড়াতেই নবীন লিখির কাছে এল। লিখি খেয়াল করলো নবীনের চোখদুটি লাল হয়ে আছে। মুখে কেমন বিমর্ষতার ছাপ। তা দেখে বললো,
“আপনার কি শরীর খারাপ নবীন ভাই?”
“তেমন কিছু না। শরীর হালকা গরম, মাথা ভার লাগছে।”
“শরীর গরম! জ্বর এসেছে নিশ্চয়ই?”
“এসেছিলো রাতে। সকালে নেমেও গেছিলো। কিন্তু লাঞ্চ টাইমের পর মনে হচ্ছে আবার ফিরতি পথ ধরেছে।”
লিখি মৃদু কন্ঠে চুকচুক শব্দ তুলে আফসোস করে বললো,
“বাড়ির লোক জানে তো?”
লিখির কন্ঠে তিরস্কার ছিলো নাকি নিছক জানার আগ্রহ নবীন বুঝলো না। সে উদাস হলো খানিক। গতরাতে জ্বর বাড়লে একা বিছানায় কা’তরাতে কা’তরাতে নবীন একটা অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করেছে। ইদানীং নিজেকে কেমন নির্জীব, শূন্য লাগতো। এই শূন্যতার স্পষ্ট ব্যাখ্যাটি গতরাতেই সে আবিষ্কার করেছে। এর নাম নিঃসঙ্গতা। জীবনের তাগিদে ছুটতে গিয়ে, পরিবারের খেয়াল রাখতে গিয়ে, সবাইকে সঙ্গ দিতে গিয়ে সে যে কবেই মনের দিক থেকে নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে তা টেরই পায়নি। একটা আপন মানুষের বড্ড অভাব জেঁকে বসেছিলো হৃদয়ে। মনে হচ্ছিলো কেউ আসুক, পাশে বসে যত্ন নিক। ওর জন্য উতলা হোক, দুশ্চিন্তা করুক।
নবীন একবার ভেবেছিলো মাকে ডাকবে। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভাঙাতেও মায়া লাগছিলো তার। মানুষটা সারাদিন কম পরিশ্রম তো করে না। তাই প্যারাসিটামল খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। সকালে জ্বর সেড়ে যাওয়ায় মাকে আর কিছু বলেনি সে। তবুও যেন অবচেতন মন বারবার চাইছিলো মা একবার বুঝুক। মাথায় হাত দিয়ে পরখ করে বলুক,
“থাক, আজ আর অফিস গিয়ে কাজ নেই। একটা দিন বিশ্রাম নে।”
নবীন সত্যিই তাই করতো। সন্তানের খুটিনাটি বিষয় তো মায়েদের নখদর্পনে থাকে৷ সন্তানের অসুখের আঁ’চ মায়েদের গায়েও লাগে। মা কি তার জ্বরের উত্তাপ টের পাবে না? নবীনের মা আসলেই টের পায়নি। নবীনও তার জ্বরের ঘোর থেকে বের হয়ে আবেগকে জলে ফেলে অফিস চলে এসেছে। লিখি নবীনের উদাস মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“জ্বর-টর রাখুন আপাতত। মুনিয়া আপুর জন্য কিছু কেনাকা’টা করবো। আপনি কি সাথে আসবেন?”
নবীন মাথা নেড়ে সায় দিলো। দুজনে মিলে শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে মুনিয়ার জন্য একটা ভালো শাড়ি কিনলো। লিখি ডিজাইন পছন্দ করলেও রঙটা নবীন পছন্দ করে দিলো। আরো কিছু কেনাকাটা করে যখন বের হলো নবীন জিজ্ঞেস করলো,
“হঠাৎ এত কেনাকাটা করলে যে? কোনো উৎসব আছে?”
লিখি মিষ্টি হেসে বললো,
“আপুকে সামনের শুক্রবার দেখতে আসবে। পছন্দ হলে কথা পাকাপাকি করে আংটিও পড়িয়ে যেতে পারে।”
নবীন চমকে তাকালো। জানতে চাইলো,
“পাত্র কে? কি করে?”
“পাত্র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। বড়লোকও বটে। শুধু একটাই সমস্যা।”
“কি সমস্যা?”
“লোকটা বিপত্নীক।”
“সেকি! জেনেশুনে বিবাহিত লোকের সাথে বিয়ে দেবে?”
“আপুর এত এত সম্বন্ধ ভেঙেছে, এত অপমান সয়েছে যে ফুপি এবার পঙ্গু কাউকে পেলেও বিয়ে দিয়ে দেবেন বলে জেদ ধরেছেন। সেখানে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পাত্র তো সোনায় সোহাগা। থাকুক না আগের বৈবাহিক সম্পর্ক। বউটা অবশ্য মা’রা গেছে।”
“এটা কিন্তু ঠিক না। মুনিয়া আরো বেটার ডিজার্ভ করে।”
লিখি হাসলো। বললো,
“এমন অনেক কিছুই আছে যা ঠিক নয় জেনেও আমরা মেনে নেই। মানতে হয়। আপনজনদের জন্য।আপনি মানেন না?”
পাল্টা প্রশ্নের মুখে নবীন চুপ করে গেলো। লিখি আবার বললো,
“নবীন ভাই, আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুবিধা-অসুবিধা আপনাকেই সবার সামনে মেলে ধরতে হবে। সবাই মন পড়তে পারে না। কেউ মনের ভেতর ঢুকে আপনার ইচ্ছেগুলো জেনে আসবে না আবার অনেকে জানতেই চাইবে না। তাই বলে যদি হাত গুটিয়ে থাকেন সারাজীবন নিজেই নিজেকে ঠকাবেন। আর দোষ দেবেন ভাগ্যকে।”
নবীন এবারও চুপ রইলো। লিখি নবীনের হাত থেকে শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে আবার বললো,
“আপনি আর মুনিয়া আপু অনেকটা একই রকম জানেন তো। কেউই নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না। নিজের ইচ্ছেকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে পারেন না। একজন সমাজের কাছে অসহায়, আরেকজন পরিবারের কাছে। পরিবার নিয়ে বললাম বলে রাগ করবেন না আবার। মুনিয়া আপুর বিয়ে ঠিক হলে দাওয়াত পাবেন অবশ্যই। আসছি।”
লিখি চলে যাওয়ার পর নবীনও বাড়ির পথে হাটা ধরলো। পথের মাঝে ভালো দেখে কিছু জামও কিনে নিলো নিধির জন্য। কিন্তু নবীনের মন ভালো হলো না। সারাক্ষণ মাথায় এলোমেলো ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। মনে মনে নিজেকে বলছিলো মুনিয়ার মতো এত ভালো একটা মেয়ে এমন কাউকে ডিজার্ভ করে না। বাড়িতে ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নবীন ফোনের ডায়াল লিস্ট ঘেটে লিখির সেভ করে দেওয়া নাম্বারটি বের করলো। এগারো ডিজিটের জ্বলজ্বল করা ফোন নাম্বারটি মুনিয়ার। সাহস নিয়ে মুনিয়ার নাম্বারে ডায়াল করে অপেক্ষা করলো। তিনবার বেজে যাওয়ার পর একটি নারী কন্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যালো?”
নবীনের বুক ধরাস করে ওঠে। কন্ঠে শব্দ জোগাড় করে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“আমি নবীন বলছিলাম…”
______________
নাহিদা বানুর বড় ছেলের বাসা থেকে এক ছড়া কলা এসেছে। সেখানে একটি জোড় কলাও আছে। নাহিদা বানু সেটা আলাদা করে রাখলেন। লিখি অফিস থেকে ফিরলে ওকে দেখিয়ে বললেন,
“জোড় ফল খাবে না কখনো। জোড় ফল খেলে জোড়া বাচ্চা হয়।”
পূর্ণিমা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলো। ওদের কথার মাঝে বাধ সেধে বললো,
“কি যে কন নানি, জোটওয়ালা ফল খাইলেই তো ভালা। বারবার নেওয়ার চেয়ে একদফায় কাম শেষ।”
“তুই চুপ কর। আমার চেয়ে বেশি বুঝিস। এটা আমি বা জাহানারা ছাড়া যেন কেউ না খায় বলে দিলাম।”
নাহিদা বানু ঘরে গেলে পূর্ণিমাও ঝাড়ু দেওয়া শুরু করলো। রাসিফ নিঃশব্দে লিখির পাশে এসে জোড় কলাটা হাতে নিলো। মিচকে হেসে লিখিকে চোখ টিপে ইশারা করলো সে খাবে কিনা। লিখি চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো। বললো,
“ইচ্ছে হলে খাবেন। এভাবে দেখার কি আছে?”
“সামলাতে পারবে তো?”
“কি?”
“জোড়া বাচ্চা।”
লিখির মুখ অপ্রতিভ হলো। সে কপাল কুচকে অন্যদিকে তাকালে রাসিফ বললো,
“মুখ ঘুরাচ্ছো কেনো? এদিকে তাকাও। আই ওয়ান্ট টু সি ইয়োর অভিব্যক্তি।”
“অভিব্যাক্তির ইংরেজি কী?”
“এক্সপ্রেশন।”
“তো পুরোটা ইংরেজিতে বা বাংলায় বলা যায় না?”
“না। তাহলে কথায় রস থাকে না।”
“অ্যাহ! আসছে রস বিশেষজ্ঞ। শুধু কথায় রস থাকলে হয় না। মনে এবং সাহসেও রস থাকা লাগে। নাহলে হাজার জোড় ফল খেলেও কাজ হবে না।”
রাসিফ বোকার মতো লিখির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা বোঝাতে কি চাইলো?
____________
বিয়ের দেড় মাসের মধ্যে রাসিফ-লিখির সম্পর্কেও কিছুটা বদল এসেছে। শুরুতে লিখি যেমন অপমান করার ছুতো খুঁজতো এখন সেটা একেবারে না হলেও কিছুটা কমেছে। রাসিফও সুযোগ পেলে ছাড় দেয় না। আবার কখনো স্বামী নামক এক অবাধ্য সত্ত্বার কবলে পড়ে বউয়ের সাথে ভাবও করতে চায়। পাত্তা না পেলে নিজেই নিজেকে শা’সায়। কিন্তু একে অপরকে দম্ভ দেখানোর স্বভাবটা এখনো বহাল তবিয়তে জিয়িয়ে রেখেছে। প্রায় প্রতিরাতেই দুজনের একবার করে ঝ’গড়া বেধে যায়। ঝ’গড়ার কারণ মশারি। দুজনের একজনও ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে চায় না। এর চেয়ে কষ্টের কাজ যেন আর হয় না। প্রথম প্রথম অবশ্য লিখির কথার ফাঁদে পড়ে রাসিফই কাজটা করতো। যখনই মশারী টানানোর সময় আসতো লিখি অলস ভঙ্গিতে হাই তুলে বলতো,
“আমি ঘুমালে আপনি টানাবেন, আপনি টানালে আমি ঘুমাবো।”
কথাটা এত দ্রুত এবং অস্পষ্ট করে বলতো যে রাসিফ প্রথম কয়েকদিন ঠিকমতো খেয়ালই করেনি। যখন প্রতিদিনই একই কান্ড ঘটছিলো রাসিফ নিজের বোকামি টের পেলো। এরপর থেকে ঝগড়া প্রতিদিনই চলছে। লিখি মশারি টানাতে বললেই রাসিফ বিদ্রোহ করে বলে,
“র’ক্ত যখন দিয়েছি, র’ক্ত আরো দেবো, তবুও মশারি টানাবো না।”
“তাহলে বসে বসে র’ক্তদান কর্মসূচি পালন করুন।”
লিখি পা থেকে মাথা অবধি ঢেকে ঘুমায় বলে মশা নিয়ে তার খুব একটা সমস্যা হয় না, মশারিও টানায় না। রাসিফ আবার মাথা ও পা বের না করে ঘুমাতে পারে না। ফলে ঘুমের মাঝে ওকেই অতিষ্ট হয়ে মশারি টানানোর কাজটা সম্পাদন করে। আর জোরে জোরে লিখির কানের কাছে গিয়ে বলে,
“মেয়েগুলো একদম ভালো না। কেউ র’ক্ত খায়, আর কেউ শান্তি।”
রাতে মনে মনে এক দফা ঝ’গড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাসিফ যখন ঘুমাতে এলো দেখলো লিখি আগেই কাঁথায় নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে শুয়ে পড়েছে। তবে রাসিফের আগ্রহ সেটা নয়। ওর আগ্রহ নিজের বরাদ্দকৃত বালিসের ওপর রাখা একটি বাক্সের ওপর। বাক্সটা স্মার্টফোনের। রাসিফ ভ্রু কুচকে সেটা হাতে নিলো। লিখিকে ডেকে বললো,
“এই লিখি, এটা কার? এখানে কি করছে?”
লিখি বিরক্তিতে কপাল কুচকে একটুখানি মুখ বের করলো। বললো,
“আপনার বিছানায় উড়ে উড়ে তো আসবেনা তাইনা? কেউ দিয়েছে বলেই এসেছে। খুলে দেখুন ভেতরে কিছু আছে কিনা।”
লিখি আবার মুখ ঢাকলো। রাসিফ বাক্সটা খুলে একটা সুন্দর স্মার্টফোন পেলো। দাম কম হবে বলে মনে হয় না। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগে লিখি আবার বললো,
“ওটা আপনারই। পকেটমার ফোন নিয়ে যাওয়ায় ফোনের শোকে পাগল হয়ে তো মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি করেছিলেন।”
রাসিফ কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে ভেবে পেলো না। কিন্তু ফোনটা যে লিখি দিয়েছে সেটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে আপনমনে হেসে ফেললো। আজ ওর জন্মদিন। লিখি সেটা জেনেছে বলেই বোধহয় উপহারটি দিলো। বড় হওয়ার পর জন্মদিন নিয়ে রাসিফের কোনো আগ্রহ ছিলো না। জাহানারা বেগমও ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন পালন করেন না। কিন্তু রুনি এখনো জন্মদিনের একসপ্তাহ আগে থেকে ইনিয়েবিনিয়ে সবাইকে মনে করাতে থাকে নিজের জন্মদিনের কথা। রাসিফ কখনোই সেসব করেনি। আজ হঠাৎ শখের জিনিসটা উপহার পেয়ে মন্দ লাগলো না। বিয়ের খরচ সামলে উঠতে গিয়ে নিজের জন্য ভালো একটা ফোন আর কেনা হয়ে ওঠেনি। আবার সে বিয়ের পর লিখিকে কিছুই উপহার দেয়নি ভেবেও লজ্জা লাগলো। শুধু সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে বিয়ের কিছু গয়না গড়িয়ে দিয়েছিলো। সেটা তো আর উপহার হলো না। রাসিফ মনে মনে ঠিক করলো লিখির কোনো শখের জিনিস উপহার দেবে সে। মেয়েটাকে সে যতটা নিষ্ঠুর ভাবে ততটাও নয়। একটু পর লিখি সেই ভাবনাকে চু’রমা’র করে বললো,
“ইমোশনাল হওয়ার কিছু নেই। আগামী এক বছর মশারি টানানোর জন্য ঘু’ষ দিলাম। এবার জলদি মশারি টানান।”
চলবে…