গল্প – পিচ্চি বউ
পর্ব – ৫
গত দিনের ঘটনার পর, নিজের কাছে কিছুটা বিব্রত লাগছে, কখনও ভাবী নি ইহিতার সাথে আবার দেখা হতে পারে। রাতে ভালো ঘুম হয় নি, ঘুমোতে হবে। বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পরলাম, মিথু রেডি হয়ে কোথায় যেন বের হবে আয়োজন করছে, ভাবলাম কপাল হয়ত আজকেও পুড়েছে, ঠিকমত ঘুমোনোর সুযোগ পাচ্ছি না। চোখ লেগে আসতে শুরু করেছে, তখন মিথু ডাকল,
-অভ্র, ঘুমিয়েছিস?
-হু
-কি হু হু? শোন আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ঘন্টা খানের মধ্যে ফিরব। তুই ঘুমো!
-হু
-আর শোন, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে
ঘুমের মধ্যে আর কিছু বলেছিলাম কি না মনে পড়ছে না,
গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম…
.
আজকাল আমি দিবা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, দেখলাম আমি আর মিথু কোনো এক পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছে, হঠাৎ সে আমার হাত ফসকে এক খাঁদে পরে গেল। শুধু একবার তার চিৎকার শুনলাম, তারপর চারিদিক নিস্তদ্ধ হয়ে আসল, আমিও অতলে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। কে যেন আমার হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে, চেহারা ঝাপসা, ঠিকমত বুঝতে পারছি না। এইটুকু দেখার পর আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলাম না, লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, হার্টবির্ট অনেকটা বেড়ে গেছে। পাশে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। কত সময় ঘুমিয়েছি? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় দু’ঘন্টার অধিক হয়ে গেছে। মিথু বলে গেল কোথায় যেন যাবে। সে এখনো ফিরে আসে নি। চিন্তা লাগছে, ফোন দিলাম,
-হ্যালো মিথু! কোথায় তুই?
-এইত এসে পরেছি, রিসোর্টের পাশেই।
.
আর কিছু বললাম না, ফোন কেটে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম শাওয়ার নিতে । বেশ লম্বা সময় শাওয়ার নিয়ে বের হলাম সাথে সাথে কলিং বেলে চাপ পড়ল। ভাবলাম হয়ত মিথু চলে এসেছে। রুমের দরজা খুলে দিয়ে বললাম,
-কোথায় গিয়েছিলি হ্যাঁ? এত লেট হল কেন ফিরতে?
এবার উপরে তাকালাম, আমার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল, মিথু একা না, তার সাথে ইহিতাও দরজার সামনে দাঁড়ানো…
.
রিসোর্টের বারান্দায় বসে আছি, পিন পতন নিরবতা, কেউ কোনো কথা বলছে না, আমার আসলে রাগ করা উচিত কি না বুঝে উঠার চেষ্টা করছি, মিথিলা নিরবতা ভাঙ্গে,
-অভ্র, কফি খাবি? ইহিতা তুমি?
আমি এবার মিথুর দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকালাম। সে হুট করে কফি আনতে বেড়িয়ে গেল। রুমে আমি আর ইহিতা, আমি বুঝে উঠতে পারছি না, মিথিলা আমার বউ হয়ে ইহিতাকে কেন বাসায় নিয়ে আসল? আর এখন একা রেখে কেন বাইরে গেল? আসলে ও চাচ্ছে টা কি? ইহিতা এবার কথা বলতে শুরু করল,
-কেমন আছিস অভ্র?
-ভালো থাকার কথা ছিল…
-তোর পেঁচিয়ে কথা বলার অভ্যাস টা এখনো রয়ে গেল?
-অনেক অভ্যাস এখনো আগের মতই আছে। বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন হয় নি বা করার চেষ্টা করি নি!
-বিয়েটা কি ইচ্ছে করে করেছিস?
-তোর কি তাই মনে হয়?
-এখন আর আগের মত কিছু মনে করতে ইচ্ছে হয় না রে!
.
কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, তার আগেই মিথু কফি নিয়ে হাজির। কফি রেখে সে আবার কোথায় যেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে,
-কোথায় যাচ্ছিস তুই?
-এক মিনিট অপেক্ষা কর।
সে রুমে চলে গেল। নিজের ব্যাগ বের করে কি যেন খুজতে লাগল, আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, কি যেন একটা বের করে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসল।
-হ্যাঁ কি যেন বলছিলি অভ্র?
কিছু না বলে ওর হাতের দিকে লক্ষ্য করলাম। একি? আমার ডায়েরী ওর হাতে কেন? এই ডায়েরী তো গত ৬বছর আমি নিজেই খুলি নি।
-মিথু, এটা তোর কাছে কেন?
-কোনটা??
-ডায়েরীটা
-ও এইটা? তোর ওয়ারড্রপ থেকে জামাকাপড় সড়াতে গিয়ে পেয়ে ছিলাম।
-ধরেছিস কেন?
-কি বলিস? আমি না তোর স্ত্রী? এইটুকু অধিকার কি আমি সংরক্ষণ করি না?
.
কিছু বললাম না। চুপসে গেলাম। যেহেতু ডায়েরী মিথিলার হাতে সুতরাং ইহিতা সম্পর্কে কিছুই তার অজানা থাকার কথা না! এবার ইহিতা শুরু করল,
-আচ্ছা, তোমাদের সম্পর্ক এই রকম কেন?মনে হয় ইঁদুর বিড়ালের মত সারাদিন ঝগড়া কর।
আমি কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, তার আগেই মিথিলা জবাব দিল,
-আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না এই গবেট টাকে বিয়ে করার। কিন্তু ফ্যামিলি হুট করে বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের ৪ ঘন্টা আগে শুনলাম আজকে আমার বিয়ে। ব্যাপারটা অসাধারণ না?
.
ইহিতা একটু হাসল। এবার আমি শুরু করলাম,
-আমি কি তোকে বিয়ে করার জন্য বসে ছিলাম? তুই তো ৪ ঘন্টা সময় পেয়েছিস, আর আমি তো বিয়ের আসরে গিয়ে শুনেছি আমার বিয়ে।
ইহিতা এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। ওর হাসিটা আগের মতই আছে। মিথু আবার শুরু করল,
-আচ্ছা বাদ দে, ডায়েরীতে তুই ১১ পৃষ্ঠার পর আর কিছু লেখিস নি! কেন?
চুপ করে থাকলাম। আসলে আমি কখনো চাইনি এই ডায়েরী কারো হাতে পৌঁছুক, আর পড়া তো দূরে থাক। মিথুর কথার ভাবে যা বোঝা যাচ্ছে, সে শুধু ডায়েরী পড়ে নি, সকল কাহিনি আদি অন্ত বুঝে ফেলেছে। আর সেই সুবাদে আজকে ইহিতা আবার সামনে হাজির। কি দরকার ছিল সেদিন রেস্টুরেন্টে ডিনার করা, কি দরকার ছিল আবির ভাইয়ের সাথে পরের দিন দেখা হওয়া। দেখা হল ভালো, বাসার ঠিকানা কেন দিল? আর আমিই বা কেন সেটা মিথুর কাছে রেখে দিলাম? কথা গুলো মনে পরলে নিজের মাথা দেওয়ালের সাথে ঠুকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মিথুর কথায় আবার বাস্তবে ফিরে আসলাম,
-ইহিতা, ডায়েরীটা তুমি দিয়েছিলে এই বানরটাকে?
-হ্যাঁ
-কিন্তু দেখছ? গবেট টা শুধু মাত্র ১১ পৃষ্ঠা লিখে আর মনে হয় ছুঁয়েও দেখে নি।
.
ইহিতা এবার বলতে শুরু করে,
-জানো মিথিলা, অভ্র আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। অনেকটা সময় এক সাথে পার করেছি। হাইস্কুল, কলেজ ইভেন ভার্সিটিরও কিছুটা সময়। আমার থেকে ভালো মনে হয় পাগল টাকে কেউ চিনবে না। ওর পছন্দ, অপছন্দ, রাগ, অভিমান,প্রতিটি জিনিস খুব কাছ থেকে দেখেছি। জানি না সেই সময়ের মধ্যে অভ্র কখন এত কাছে চলে এসেছে। আমিও বুঝতে পারি নি, অনেক চমৎকার সময় একত্রে পার করেছি।
-জানি ইহিতা। তোমাদের গল্পটা চাইলে ভিন্ন রকম হতে পারত।
-আসলে ততটা সহজ ছিল, আমি আবিব কে দেওয়া কথা কোনো মতেই ফেলতে পারতাম না। আর অভ্রর আশে পাশে থাকলে কোন দিন আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তাই পালিয়ে এসেছি অনেক দূরে। জানি আমাকে অনেক খুঁজেছে সে। কষ্টও পেয়েছে নেহাৎ কম নয়। আমি নিরুপায় ছিলাম।
.
ইহিতার গলা কেঁপে উঠছে কথা বলতে গিয়ে, তাই আর সামনে এগুতে চাইলাম না।
-আচ্ছা বাদ দে এইসব। তারপর ইহিতা, বিয়ে করলি কবে?
-এইত, ৬মাসের মত। দেশ থেকে আসার পর ইতালী ছিলাম মামার কাছে। অনেক দিন আবিরের সাথে যোগাযোগও করিনি। তারপর হঠাৎ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
-ভালো তো।
মিথু, আবার কোথায় যেন যেতে উঠে গেল, এবার সে একা নয়, ইহিতাও উঠল তার সাথে, আমি ভাবলাম হয়ত ইহিতা তাড়া আছে তাই ওর চলে যেতে হবে। কিন্তু মিথু কোথায় গেল? একা বসে থাকলাম বারান্দায়। একটু পরে দেখি দুজন আবার ফিরে এসেছে, উভয়ের মুখে বিজয়ীর হাসি। একটু সামনে এগিয়ে হামলে পড়ল আমার উপর। ইহিতার হাতে কেক, মিথু পার্টি স্পে দিয়ে আমাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম, আজকে আমার জন্মদিন! আসলে এই সব ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এইজন্য তাহলে মিথিলা বলেছিল আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে? আর ইহিতার সাথে আবার দেখা হওয়ার চাইতে বড় সাইপ্রাইজ আর কি ই বা হতে পারে? মিথু চিৎকার করে বলে উঠল,
-হ্যাপি বার্থডে অভ্র…
ইহিতাও সাথে যোগ দিল। ভালো লাগছে, মিথু এত খবর নিয়েছে তাহলে? পিচ্চি টা তাহলে আসলেই বড় হয়ে গেল?
কেক কাটার পর সবাই একত্রে লাঞ্চ করার জন্য বের হলাম। লাঞ্চ শেষ করে অনেকটা সময় বীচে ঘুরলাম। বিকেল গড়িয়ে গোধুলি হয়ে এসেছে, রিসোর্টে ফিরলামও এক সাথে। এবার ইহিতাকে যেতে হবে। অনেক কথা বলার ছিল তাকে, তব কেন জানি আর ইচ্ছে করল না। উঠে দাঁড়িয়েছে সে,
-অভ্র
-হু
-একটা কথা রাখবি?
-কি?
-ডায়েরী টা আমাকে দিবি?
মৃদু হাসলাম। যার জিনিস তার কাছে থাকা ভালো। মিথুর কাছ থেকে ডায়েরী নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিলাম। কেন যেন চোখটা ভিজে আসতে চাইছে বড্ড জোর করে। বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। আর কথা না বলে ইহিতা পা বাড়ল চলে যাবার জন্য, যাবার আগে মিথিলাকে শুধু একটা কথা বলে গিয়েছিল,
-পাগলটাকে আগলে রেখ…
.
বারান্দায় আমার গিয়ে দাড়ালাম। রিসোর্টের সামনের সরু রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে ইহিতা। বাতাসে তার চুল উড়ছে, হয়ত এই শেষ বার, আর কোনো দিন দেখা হবে না তার সাথে। সর্ব শেষ স্মৃতিটুকুও ফিরিয়ে দিলাম। মিথিলা খুব কাছে এসে দাঁড়াল। একটু হাসি দিয়ে বললাম,
-কিছু ভালোবাসার সমাপ্তি অপূর্ণ থেকে যায়, তাই না?
-হ্যাঁ, তবে সেটুকু পূর্ন করার জন্য আমি আছি…
চলবে…..
পর্ব – ০৬
https://www.facebook.com/934291790106385/posts/1296707407198153/?app=fbl