একটি রূপকথার গল্প’ পর্ব-১৩

0
325

#একটি_রূপকথার_গল্প’১৩’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আরমান আসবে শুনে আশরাফ হোসেন আজ আর স্কুলে গেলেন না। অথৈ নিজে রান্নাবান্না না পারলেও বুয়াকে বলে দিয়েছে কী কী রাঁধতে হবে। প্রিয় মানুষটাকে সামনে বসিয়ে খাওয়ানোর মাঝে যে কতটা সুখ লুকিয়ে আছে তা সে কাল রাতে জেনেছে। বাবাকে আবার ঘরে ফিরে যেতে দেখে অথৈ জিজ্ঞেস করল,

~ আজ স্কুলে যাবে না বাবা?’

~ না। আরমান নাকি আসবে।’

আরমানের নাম শুনেই অথৈর মুখটা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। লাজুক ভাবে হাসল সে। বাবা কি জানে রাতে যে আরমান এসেছিল! বাবার সাথে যেহেতু দেখা করে যায়নি তার মানে তার সাথেই দেখা করে গেছে। বাবার চোখে তাকাতে পাচ্ছে না অথৈ। আরমানকে বাবাই পছন্দ করেছিল। তখন সে কি আপত্তিই না করেছিল! বাবা, ফুপির সাথে রীতিমতো যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর এখন সে-ই মানুষটার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। মানুষটাকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠে। আজকাল তো তার মানুষটাকে নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে। সুখ সুখ অনুভূতি হয়। বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অথৈ গলায় তেজ এনে বলল,

~ তোমার ছাত্র এমন কেন বাবা? এটা কি তার শ্বশুরবাড়ি! রাতদুপুরে এসে হাজির। কাল রাতেও এসেছিল। তুমি ঘুমিয়েছিলে তাই ডাকি নি। তুমি তো জানোই কাল সন্ধ্যা থেকে আমার মাথা ব্যথা ছিল। তার উপর তোমার ছাত্র এসে উপস্থিত। আমার এত রাগ লেগেছিল! আজকে এলে বলে দেব এত ঘনঘন যেন আমাদের বাড়িতে না আসে।’

আশরাফ হোসেন মেয়েকে লক্ষ করে দেখলেন। মেয়েটার মুখটা অবিকল তার মায়ের মতো হয়েছে। মায়ের মতোই গোলগাল চেহারা। নাকটা চাপা না আবার এত খাড়াও না। থুতনির মধ্যেখানে একটু ডেবে আছে। অথৈর চোখ দু’টো হয়েছে বুবুর মতন। ফুপুর এই একটা জিনিসই পেয়েছে। অথৈ যখন ছোট ছিল তখন আশরাফ হোসেন ওকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে স্ত্রীর সামনে মিছেমিছি অভিমান করে বলতেন,

~ তোমার মেয়ে আমার কিছুই পায়নি। মানুষ তো ওকে তোমার মেয়ে বলবে। আমার মেয়েটা কেন আমার কিছু পেল না! হ্যাঁ গো আম্মাজান, আপনি কেন আমার মতো হলেন না। আপনার চোখের দিকে তাকালেই তো ভয় পাই আমি। মনে হয় বুবু বুঝি রাগী চোখে আমাকে দেখছে। আপনার ফুপুর মত রাগী হবেন আপনি, হ্যাঁ!”

দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল, না? এক মাসের মাথায় অথৈর মা চলে গেল। প্রথম দিকে মা হারা মেয়েকে সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। বুবু না থাকলে তার কী হতো? বিশেষ করে অথৈর। নিজের বাড়ি থেকে এসে এসে অথৈকে কতটা আর সময় দিতে পারেন! এই ভেবে বুবু ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে এলো। বুবুর পেছন পেছন দুলাভাইও এসে হাজির। বুবু, দুলাভাই চলে এলে অথৈর সব দায়িত্ব তার কাঁধ থেকে নেমে গেল। মেয়েকে সারাদিনে একটু কোলে নেওয়ার সুযোগও পায়নি তিনি। অথৈর খিদে পেলে বুবু খাওয়াতো। কান্না করলে দুলাভাই কী সুন্দর কোলে নিয়ে ঘরজুড়ে হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে কিছু বলতো। সাথে সাথে অথৈ ঘুমিয়ে যেত। ঘুমন্ত মেয়েকে চুমু দিতে গেলে বুবু তার উপর রেগে যেত।
দেখতে দেখতে কেমন অথৈটা বড় হয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা মেয়েটার জ্ঞান দিয়েছেন। অথৈ বড় হয়ে তার মা’র ভূমিকা পালন করতে লাগল। বাবার সব বিষয়ে পরিপূর্ণ খেয়াল আছে তার। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে সত্যিই একা হয়ে পড়বেন তিনি। বাবা ওর দিকে এরকমভাবে তাকিয়ে আছে দেখে অথৈ লজ্জা পেল।

~ তুমি এখানে সঙের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন বাবা! স্কুলে না গেলে ঘরে যাও। কাপড় খোলো। নাকি বাইরের কাপড় পরেই থাকবে। আজব!’
…..
অথৈদের বাড়িতে যাওয়ার আগে আরমান বুঝে উঠতে পারছিল না সে কি মিষ্টি নিয়ে যাবে? নাকি খালি হাতে যাবে। এতদিন স্যার ডাকলে সে তো খালি হাতেই ছুট দিত। আজকে মিষ্টি নিলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়! এটা তো এখনও তার শ্বশুরবাড়ি না যে জামাই মিষ্টি নিয়ে এসেছে এটা স্বাভাবিক ঘটনা হবে। তার উপর অথৈ যদি আবার রেগে যায়। ওই মেয়ের যা রাগ! দেখা যাবে স্যারের সামনেই এমন কিছু বলে উঠবে পরে তাকে না আবার লজ্জা পেতে হয়।
আকাশ পাতাল ভাবার পর আরমান কয়েক কেজি মিষ্টি কিনে নিল। কেনার পর ভাবল, অথৈর কী মিষ্টি পছন্দ তা তো সে জানে না। দেখা গেল সে যে মিষ্টি নিয়েছে তা অথৈরই পছন্দ না। এটা ভেবেই আরও কয়েক পদের মিষ্টি কেনা হয়ে গেল।

টিয়া এসে বিস্ময়ে ফেটে পড়ে বলল,

~ আপা ভাইজান কী কামডা করছে দেখছেন! আগে তো ভাবতাম ভাইজান অল্প পাগল। এখন দেখি মানুষটা পুরাই পাগল।’

টিয়ার এটা আরেকটা দোষ। দুনিয়ার সব কথা বলে ফেলবে। কিন্তু কোন বিষয়ে তার এত কথা সেটা বলবে না। অথৈ বিরক্ত হয়ে বলল,

~ কী হয়েছে তা তো বলবি। কী করেছে তোর ভাইজান?’

~ শুনলে আপনি রেগে যাবেন জানি। কিন্তু এইডা রাগের কথা না আপা। গর্বের কথা।’

~ এইবার কিন্তু তোর চাকরি…

~ কইতাছি আপা, ভাইজান এক গাট্টি মিষ্টি নিয়া হাজির। গাড়ি ভর্তি মিষ্টি। এত মিষ্টি তো ফ্রিজেও জায়গা নিব না। এত মিষ্টি কে খাবে আপা! আপনি নিজের চোখেই দেখেন গিয়া কী কাণ্ড ঘটছে।’

মানুষটা কি পাগল! অথৈর বিরক্তির সীমা রইল না। সকালে নাস্তার দাওয়াত দিয়েছে বলে মিষ্টি হাতে আসতে হবে? তাও অল্প হলেও কথা ছিল। গাড়ি ভর্তি মিষ্টি কে আনে? এই লোক এত অবুঝ কেন? বাবাকে কীভাবে মুখ দেখাবে সে! অথৈ নিচে যেতে যেতে মনে মনে ভেবে নিল, নিজের আনা সবগুলো মিষ্টি ওই লোকটাকেই খাওয়াবে। আজকে মিষ্টি ছাড়া কপালে অন্য কিছু জুটবে না। খা ব্যাটা খা। মন প্রাণ পেট ভরে মিষ্টি খা। এখনও না হওয়া শ্বশুরবাড়ির মানুষ গুলোকে রাক্ষস পেয়েছিস যে তুই মিষ্টির দোকান সাফ করে নিয়ে এসেছিস। এবার সারাদিন বসে এগুলোকে হালাল কর।
……
আরমান জবুথবু হয়ে আশরাফ হোসেনের সামনে বসে আছে। ভেতরে ভেতরে লজ্জা লাগছে তার। স্যার কিছু বলছে না কেন? সে নিজে কিছু বলবে? কিন্তু কী বলবে।

~ কবে ফিরেছ?’

~ গতকালই।’

~ ওহ। ওদিকে কেমন যাচ্ছে?’

~ ভালো।’ আরমানের কথার মাঝেই টিয়া এক প্লেট মিষ্টি নিয়ে এলো। মিষ্টির প্লেট টেবিলে রাখতে রাখতে আরমানকে দেখে বলল,

~ আপা বলছে সবগুলো শেষ করতে।’ মিটিমিটি হাসছে টিয়া। আরমান আড়চোখে স্যারকে দেখল। আশরাফ হোসেনের চেহারায় কোন ভাবান্তর নেই। কিন্তু আরমান বেচারা লজ্জায় সোফার ভেতর ঢুকে যেতে পারছে না। অথৈ তাকে এভাবে হেনস্তা করছে!

আশরাফ হোসেন, আরমান ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেছে। অথৈও ওদের সাথে বসেছে। বিশাল আয়োজন দেখা যাচ্ছে। অথৈ ছুরির মাথায় জ্যাম নিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে ব্রেডে মাখাচ্ছে। আড়চোখে বারকয়েক আরমানকে দেখেছে সে। স্যারের সামনে বেচারা বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করতেও ভয় পাচ্ছে। অথৈর মনে পড়ছে না স্কুল জীবনে সে কোন স্যার ম্যামকে ভয় পেয়েছিল কিনা। আর এই লোক কিনা..! হাহ্। অথৈ মনে মনে বলল,

~ অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। না জানি আপনার ভেতর কোন চোর লুকিয়ে আছে।’

আরমান এর আগেও অথৈর ঘরে এসেছে। অথৈ যখন অসুস্থ ছিল আরমান সেই সময় ঘন্টার পর ঘন্টা অথৈর পাশে এ ঘরে বসে থেকেছে। কিন্তু আজকে অথৈর ঘরটা তার কাছে অন্যরকম লাগছে। জানালার পর্দার কালারটা কি আগে অন্যরকম ছিল? হুম, দরজা জানালার পর্দা চেঞ্জ হয়েছে।
অথৈর ঘরের দেয়ালেও ওর আঁকা বেশ কয়েকটি পেইন্টিং আছে। সবই ছোট বেলার আঁকা। দেখতে কেমন আদুরে লাগে। স্যার মেয়ের সবকিছুই যত্ন সহকারে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন।
আরমান দেয়ালে ঝুলানো ছবির দিকে চোখ রেখে বলল,

~ তোমার আঁকাআঁকির হাত কিন্তু অসাধারণ।’

অথৈ হাসল৷ কিছু বলল না। আরমান বলে যাচ্ছে,

~ তা এই অধমের কি ভাগ্য হবে একদিন এই গুণী শিল্পীর ছবির বিষয়বস্তু হওয়া!’

~ আঁকাআঁকির আমি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এখন যা আঁকি তা ড্রেসের ডিজাইন। তাও সাদা কাগজে পেন্সিলে।’

~ রংতুলির সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করার কারণ কী?’

~ আমার মা পছন্দ করতেন না।’

~ মেয়ের এমন একটা গুণে উনার খুশি হওয়া উচিত ছিল।’

~ আমার মা যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন। সে খুব ভালো আঁকত। আঁকাআকিটাকে শখ হিসেবে ফেলে না রেখে প্রফেশন হিসেবে নিলে নামডাক করতে পারতেন। কিন্তু তিনি শুধু মন ভালো থাকলে শখের বশে আঁকতেন। মায়ের এই গুণটা আমি ভালো করেই পেয়েছি। তিনি বেঁচে থাকলে এটা জানতে পেরে হয়তো খুশিই হতেন। কিন্তু আমার জন্মের এক মাস পরেই তিনি আল্লাহর প্রিয় হয়ে যান।’

আরমান ঠিক বুঝল না। অথৈর মা যদি ওর জন্মের এক মাস পর মারা যান তাহলে তাকে ছবি আঁকতে নিষেধ কীভাবে করেছে? এক মাসের নবজাতক শিশু নিশ্চয় রংতুলি নিয়ে আঁকতে বসতে পারেনি।
অথৈ আরমানের দিকে দেখে প্রশ্নটা হয়তো বুঝতে পারল।

~ আমার বাবা দুইটা বিয়ে করেছে এটা নিশ্চয় আপনি জানতেন না। অনেকেই জানে না। আমার তিন বছর পর্যন্ত ফুপিই আমাকে বড় করেছে। ফুপির ভালোবাসায় কোন কমতি ছিল না। একজন মা তার সন্তানকে যতটুকু ভালোবাসা দিতে পারত ফুপি আমাকে তার থেকে বেশি ভালোবাসা দিয়েছে। তবুও উনার মনে হলো আমার মা দরকার। বাবা কোনোভাবেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না। ফুপি এই কাজ কীভাবে করেছে তিনিই জানেন। বাবাকে বিয়েতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন। আমিই মনে হয় দুনিয়ায় এমন একজন মেয়ে যে চার বছর বয়সে সেজেগুজে খুশি মনে বাবার বিয়েতে গিয়েছে। তাও আবার বাবার কোলে বসে। বিয়ে কী তখন এটা না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম বাবা বিয়ে করলে আমি মা পাব। নতুন মা পাওয়ার খুশিতে আমি তখন আত্মহারা।’

এটুকু বলে থামল অথৈ। বাবার বিয়ে নিয়ে ছোট বেলা করা নিজের পাগলামির কথা মনে করে হাসছে সে।

চলবে_
আমার গ্রুপ লিংক
https://facebook.com/groups/928548141001685/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here