#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব ২
#লিখা_তানজিলা
চোখ থেকে চশমাটা খুলে শার্টের পকেটে ঝুলিয়ে রাখলো সীমান্ত। আইজা টিফিন বক্স থেকে একে একে খাবারগুলো বের করে টেবিলে সাজিয়ে যাচ্ছে। পুরোটা সময়ই সীমান্তর দৃষ্টি আইজার ওপর অটল।
-“আপনার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো? কী চান আপনি?”
ভণিতা না করে সরাসরি মূল বিষয়ে কথা বলার সীমান্তর এই অভ্যােসটা বেশ ভালো লাগতো আইজার। তবে সেটা বিয়ের আগে। এইমুহুর্তে বেশ অপমানিতবোধ হচ্ছে। শেষের প্রশ্নে সীমান্তর গলার ভাজে লেগে ছিলো রুক্ষতার আভাস। তারপরও আইজা ঠোঁটে মিষ্টি এক হাসি ঝুলিয়ে কিঞ্চিত মজার ছলে বলে উঠলো,
-“আপনার প্রেয়সী হতে চাই।”
আইজার উত্তর শুনতেই সশব্দে হেসে উঠলো সীমান্ত।
-“আমাকে নিজের প্রেমিক ভাবতে পারবেন তো? আমি আবার আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না।”
তীর্যককন্ঠে বললো সীমান্ত। কিছুক্ষনের জন্য ওদের মধ্যে একপ্রকার নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেলো। সত্যি বলতে সীমান্তর প্রশ্নের জবাব জানা নেই আইজার। তবুও শক্ত গলায় বলে উঠলো,
-“সেটা আপনার বিয়ের আগে ভেবে নেয়া উচিত ছিলো। এখন থেকে আপনার সময়জুড়ে একটা ভাগ আমার পাওনা। আপনি আমাকে ভালোবাসেন আর না বাসেন সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিন্তু অধিকার হিসেবে আপনার সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার আমি ঠিক করে নেবো!”
কথাটা বলেই উঠে এলো আইজা। সীমান্তর সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বললে হয়তো নিজেকে সামাল দিতে পারবে না। এমনিও আজ সীমান্তকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে চিন্তাও করেনি ও। সীমান্ত ওর প্রতি যেমনই হোক মানুষ হিসেবে খারাপ না। তার বাবা কোম্পানির সিইও হওয়া সত্বেও এমপ্লয়ি হিসেবে কোন বাড়তি সুবিধা নেয়ার অভ্যেস নেই।
বলতে গেলে আইজার সম্পূর্ণ বিপরীত!
***
ড্রইংরুমে বসে বেশ মনোযোগ সহকারে চারপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে আইজা। পাখি আর রাজিয়া কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে আইজার দিকে তাকিয়ে আছে। আঁড়চোখে তাদের মুখভঙ্গি দেখতেই বক্র হাসি ফুটে উঠলো মুখে। এই চার মাসে ওরা আইজার ব্যপারে এতটুকু তো বুঝেই নিয়েছে। ঘরের আসবাবপত্র এদিক থেকে ওদিকে টানাহেঁচড়া করার আগে এভাবেই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ও। আর তাতে রাজিয়া আর পাখিকেও ফাঁসতে হয়। গতকাল রাতেও রান্নাঘর নিয়ে কম কষ্ট হয়নি ওদের!
রাজিয়া আর পাখি এ বাড়িতে কাজ করছে প্রায় তিন বছর। আইজার শ্বশুর, সীমান্ত আর ওর ছোট ভাই রায়হান কেউই বাড়ির দিকে তেমন লক্ষ্য রাখে না। এখন আইজাকেই পুরো বাড়িটা দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়েছে ওর শ্বশুর।
-“এই টিভিটা সরাতে হবে। সোফা থেকে এতো ওপরে এটাচ করা যে চোখ আর ঘাড় দুটোই ব্যথা হয়ে যায়!আর এতো বড় কার্ডবোর্ড এখানে পড়ে আছে কেন?”
ভ্রু কুঁচকে নিজের ঘাড় ম্যাসেজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো আইজা। সীমান্তর জন্য এই বয়সেই প্রেশারটা বেড়ে চলেছে।
-“সীমান্ত ভাই রাখছে এখানে।”
ফরফর করে বলে উঠলো রাজিয়া যেন এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে!
-“এই কার্ডবোর্ডের এখানে কী কাজ! শুধু শুধু জানালা ব্লক করে রেখেছে!এটা সীমান্তর স্টাডি রুমে থাকবে।”
দৃঢ়ভাবে বলে উঠলো আইজা।কার্ডবোর্ডটা বেশ বড় হলেও তেমন ভারী না। খুব সহজেই উঠিয়ে নিতে পারবে আইজা। রাজিয়া আর পাখি কাউকেই ও নিজের ঘরে আসার অনুমতি দেয় না। সীমান্তর স্টাডি রুমের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
-“কিন্তু ভাবী, আপনি তো যাইতে পারবেন না। সীমান্ত ভাই ঐখানে কাউরে যাইতে মানা করছে!”
রাজিয়ার কথা শুনে ওর দিকে আঁড়চোখে তাকালো আইজা। মেজাজ গরম হলেও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বললো,
-“আমার কাজে নাক গলিয়ে আর মাথায় এতো লোড নিতে হবে না তোমার। টেবিলে দ্রুত খাবার রাখো গিয়ে। বাবা আর রায়হান একটু পরই চলে আসবে! আমিও একটু বাইরে যাবো আজ।”
ঠান্ডা গলায় কথাটা বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালো আইজা। খাবার টেবিলের পাশেই ছোট্ট একটা রুমের দরজায় সীমান্ত স্টাডি রুম লিখে রেখেছে। যদিও অফিসের বেশির ভাগ কাজ সে ঘরে বসেই করে থাকে। খামাখা এই স্টাডি রুমের কি দরকার বোধগম্য হচ্ছে না আইজার। দরজায় কাছে যেতেই এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। ধুর! চাবিটা তো নিয়ে আসা হয়নি! কার্ডবোর্ডটা দেয়ালের সাথে চাপিয়ে রেখেই দ্রুত নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো আইজা।
-“কি দেমাগ দেখছস! সীমান্ত ভাই এতো ভালা মানুষ হইয়া এরে বিয়া করতে গেলো কেন বুঝি না! বাপে তো মাইনষের টাকা মাইরা গা ঢাকা দিছে! আর তার মাইয়ার ফুটানি এখনো কমে নাই! সহজ সরল মানুষটারে ফাঁসায় এখন আবার চোখ রাঙায়! কয়লা ধুইলে কি আর ময়লা যায়!”
অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে রাজিয়া। আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে কোন হেলদোল নেই ওর। আইজা মৃদু হেসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই লাফিয়ে উঠলো মেয়েটা। পাখি এক হাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে।
-“পাখি আমি কিছু কাজ দিয়েছিলাম তোমাকে।”
আইজার শান্ত কন্ঠ শুনে এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করলো না পাখি। এক দৌড়ে সে স্থান ত্যাগ করলো। মুহূর্তেই মধ্যেই আইজার ঠোঁটে লেগে থাকা মৃদু হাসি মিলিয়ে গেলো। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়ালো রাজিয়া। আমতাআমতা করে বলে উঠলো,
-“ভাবী আমার কাম আছে!”
-“এক মিনিট!”
আইজার গলায় কাঠিন্যের ছাপ। রাজিয়াকে থামিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল ও। আলমারির ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করে আবারও ড্রইংরুমের দিকে গেলো। রাজিয়া এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে। টাকাভর্তি খামটা রাজিয়ার হাতে ধরিয়ে দিলো আইজা।
-“এতোদিন যে আমার কথায় বাড়তি কাজ করেছো তার বোনাসও আছে এতে।”
ক্ষনিকের জন্য রাজিয়ার মুখে উৎফুল্লতার রেশ দেখা গেলেও আইজার পরবর্তী কথাগুলো শুনে সেই চাহনিতে সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে।
-“এটা তো সবে শুরু। যদি এভাবেই আমার কথামতো কাজ করো তাহলে পরবর্তীতে আরও অনেক সুবিধা পাবে।”
রাজিয়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলো। এই মুহুর্তে মেয়েটাকে চড় মারার অদম্য ইচ্ছেকে জোরপূর্বক দমিয়ে রাখলো আইজা। শুরু থেকেই এই মেয়ের চালচলন লক্ষ্য করে যাচ্ছে ও। রায়হানের সাথে গোপনে সম্পর্কে জড়িয়ে এতো সাহস বেড়েছে। সুযোগ পেলে ঠিকই শোধ নেবে একদিন আইজা। চাইলেই রাজিয়াকে বের করে দিতে পারতো ও। কিন্তু এতো সহজে ছাড় দেয়ার মতো মেয়ে তো আর আইজা না!
***
হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে নিজের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আইজা। মাকে প্রচন্ড বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। পড়নের শাড়িটাও জায়গায় জায়গায় কিছুটা ছিঁড়ে গেছে। ইদানিং নিজের খেয়াল রাখা হয়না দেখেই বুঝতে পারছে আইজা। এইতো এক বছর আগেও এসি রুম ছাড়া থাকতে হতো না ওর পারিবারকে। আর আজ!
হাতে থাকা শপিং ব্যাগগুলো বিছানার ওপর রাখলো আইজা। ওর মা সাথে সাথে ব্যাগ গুলো চেক করতে শুরু করলো। বাড়ির সকলের জন্যই নতুন জামাকাপর এনেছে ও। বিয়ের পর আসার তেমন সুযোগ পায়নি। সীমান্তর বাবা ওর ঘনঘন এখানে আসা পছন্দ করে না। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও শ্বশুরের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করছে আইজা। একে তো সীমান্ত ওকে কোন গুরুত্ব দেয় না। এখন যদি নিজের শ্বশুরের চোখে ভালো হতে পারে তবেই বাড়িতে গুরুত্ব থাকবে তার। নইলে রাজিয়ার মতো বাকিরাও সুযোগ পেয়ে যাবে!
-“এতো কিছু আনার কী দরকার ছিলো!
মায়ের কথা শুনে মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুলো না আইজার। এক দৃষ্টিতে নিজের মায়ের কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছে। ছোট বোনটাও অধীর আগ্রহে তার জন্য আনা ড্রেস গুলো নেড়েচেড়ে দেখছে। দুই রুমেই এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটার ভাড়া দিতেও হিমশিম খেতে হয় তাদের। অথচ একটা সময় এমন পরিস্থিতি কল্পনায়ও বিচরণ করতো না।
বেশ শব্দ করে দরজা আঁটকে শব্দে বুঝতে পারলো এটা নিশ্চয়ই আরফানের কাজ। ছেলেটা এতো বড় হলো তাও এই বদঅভ্যেস গেলো না। আইজাকে দেখেই হুট করে নিজের মুখ ঢেকে ফেললো ও। যদিও সফল হলো না। চোখের চারদিকে কালশিটে দাগ দেখে যা বুঝার বুঝে নিয়েছে আইজা।
-“আরফান তোকে কতবার বলবো নিজের রাগটা একটু কন্ট্রোল কর। এখন তো আর পাপা নেই যে তোকে প্রটেক্ট করবে! কলেজে কিছু হলেই মারপিট করতে হবে না-কি! কে মেরেছে এভাবে? তুই শুধু নামটা বল!”
আরফানের ক্ষুব্ধ দৃষ্টি উপেক্ষা করেই ওর হাতগুলো ধরে টেনে বিছানায় বসালো আইজা। তখনই হুট করে আরফানের গালে চড় বসিয়ে দিলো ওর মা। আইজার কান অব্দি তার মায়ের চিৎকার চেচামেচি প্রবেশ করছে না। সবসময় তো সেই একই কথা। ছেলেমেয়ের জন্য তার জীবনটা অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। হঠাৎ আরফান আইজার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বললো,
-“তোর কি ঐ সীমান্তকে বিয়ে করা খুব জরুরি ছিলো? জানিস, তোকে নিয়ে আমার ক্লাসমেটরা কত বাজে কথা বলে! আর এখন তো আমার বন্ধুরাও!”
ওদের মা ছেলের করা প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলো। ইশারায় আরফানকে কথা বন্ধ করতে বলেও লাভ হয়নি। সে দৃঢ়তার সাথে আইজার কাছ থেকে উত্তরের আশায় বসে আছে।
-“আরফান তোর খেয়াল রাখা উচিত তুই কাদের বন্ধু বলছিস! শুধু মুখে বন্ধু বললেই কেউ বন্ধু হয়ে যায় না।”
-“আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি। কেন করলি তুই এমন? তোর তো সাহিল ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। তাহলে মাঝপথেই সাহিল ভাইকে ছেড়ে ঐ সীমান্তকে কেন বিয়ে করলি? টাকার লোভে?”
আইজার হাতে থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা তৎক্ষনাৎ ফ্লোরে গিয়ে পড়লো। রক্তলাল চোখ নিয়ে আরফানের কথাগুলো শুনে গেলো ও। শেষ পর্যন্ত ওর ভাই ওকে সাহিলের জন্য কথা শোনাবে!
-“হ্যা! আমি টাকার লোভে সীমান্তকে বিয়ে করেছি! তো কী এমন হয়ে গেছে? কাউকে খুন করেছি আমি? না-কি কারও সম্পত্তি জোর করে নিজের নামে লিখে নিয়েছি? কি এমন করেছি যে সবাইকে শুধু আমার ওপরই আঙুল তুলতে হবে? ঐ সাহিল নিজের স্বার্থে শুধুমাত্র পাপার টাকা আর ক্ষমতার জন্য আমাকে ব্যবহার করেছে। দিনের পর দিন আমাকে বোকা বানিয়ে অন্য মেয়েদের সাথে সময় কাটিয়েছে! কেউ তো ওকে কিছু বললো না! যে যার মতো আসছে আর এক তরফাভাবে আমাকেই খারাপ বানিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদিকে সাহিল এতো সহজেই পার পেয়ে যাবে!”
নিজের ওপরই হাসি পাচ্ছে আইজার। যে কারণে সাহিলের জন্য মনে ঘৃণা জন্মেছে ঠিক একই কারণে নিজের স্বামীর কাছে ঘৃণার পাত্র সে! সাহিল ব্যবহার করেছে আইজাকে আর আইজা সীমান্তকে! তবে সীমান্তকে মিথ্যা বলেনি ও। আইজার ভালোবাসার কোন প্রয়োজন নেই। সীমান্তর সময়, মনোযোগ আর গুরুত্ব দেয়াটাই ওর জন্য যথেষ্ট।
চলবে…