#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৯
দুই মাস হয়ে গেল আমরা এসেছি৷ একেবারে যেন তুলোর মতো উড়ে উড়ে সময়গুলো চলে গেলো! আমার কাছে এই নতুন অচেনা জায়গায় নিজের মতো করে সংসার করার অনুভূতিটা প্রতি মুহূর্তে আনন্দ দেয়। একটা মেয়ের এমন স্বপ্নই তো থাকে! এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে কল্পনার মতো চমৎকার একটা মানুষের সাথে জীবন কাটানোর। না আছে কোনো লোকের কথা, না আছে সমাজের ভয়, আত্মীয়স্বজনের ভিড়ভাট্টা…কিচ্ছু না।
সে সকালে উঠে খেয়ে অফিসে চলে যায়, ফেরে সন্ধ্যায়। আমার দিন কাটে ঘরের কাজ করে, রান্না করে, বই পড়ে আর টিভি দেখে। মায়ের সাথে, আপার সাথে, ঝিনুর সাথে ফোনে কথা হয়। কখনো বা বিকেলে সে আগে আগে ফিরে আমাকে নিয়ে সে হাঁটতে বের হয়। চা বাগান দেখাতে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর চা খেতে খেতে সারাদিনের গল্প বলে, ক্লান্ত থাকলে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। আমি অপলক তার অপূর্ব মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি অনেক…অনেকক্ষণ…এইতো..আর কী চাই জীবনে?
তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেও সে জবাব দেয় না। এড়িয়ে যায় সযত্নে। আমিও তাই আগ্রহ দেখাই না। তারটা সে বুঝুক। আরেকটা আশ্চর্যের বিষয় হলো সে আমাকে পড়াশুনার কথা বলে না। এ পর্যন্ত একটিবারও বলেনি। আমি অবশ্য বেঁচে গেছি পড়া থেকে মুক্তি পেয়ে৷ তবে অবাকও হয়েছি।
এদিকটায় প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। কাছেপিঠে বাড়িঘর না থাকায় রাতের বেলা পুরো বাড়ি গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়। এক রাতে এই আঁধারের মাঝে সে আমাকে ছাদে নিয়ে গেল। আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠেছে। চারপাশ ভিজে যাচ্ছে রূপালী আলোয়। দূরের নদীর পানি চিকচিক করছে। আর খোলা জায়গায় ঝাঁকড়া গাছের বিশালাকার ছায়া ভুতুড়ে এক আবহ সৃষ্টি করেছে। তবে সে হাত ধরে থাকায় ভয় হচ্ছে না একটুও।
সে আমাকে ছাদের কোণায় নিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো প্রশান্তিগুলো হৃদয় ভেদ করে গেল, অনুভব করলাম তার শরীরের উষ্ণতা। অনেক সময় পার হলো। সে হঠাৎ বলল, “মনে করো আমি অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেলাম, কাজকর্ম করতে পারি না, ঠিকভাবে চলাফেরাও করতে পারি না। তোমার ওপর ভরসা করে চলতে হয়। তখন তুমি আমাকে এখনকার মতো করে ভালোবাসবে?”
আমি হেসে ফেলে বললাম, “সময় বলে দেবে। তাছাড়া উল্টোটাও তো হবে। তখন?”
“উমম…সেটাও নাহয় সময় বলে দেবে। আচ্ছা, তুমি আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না তো?”
“তোমায় কেন ভুল বুঝব?”
“বলো না তুমি! যদি পরিস্থিতি তেমন হয়, ভুল বুঝবে না তো?”
“নাহ।”
“কক্ষনো না?”
“কক্ষনো না!”
“তোমার শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে দেখা করতে, তাদের সাথে থাকতে ইচ্ছে করে?”
আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি বলতে ইচ্ছে করে না। শ্বাশুড়ি মায়ের কথাগুলো কানে বাজে। “তুমি কারো সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না!”
আমার নিরবতার সে কী মানে বের করল জানি না। সেও চুপ হয়ে গেল। আকাশ থেকে হঠাৎ তারা খসে পড়লো। সে আরেকটু শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “তারা খসার সময় কিছু চাইলে নাকি পূরণ হয়?”
“কার কাছে চাইবে?”
“জানি না।”
“আল্লাহর কাছে চাও, তিনি যেন আমাদের জীবনে এমন ধ্বস না আনেন।”
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “চাইলাম!”
.
পরদিন সকালে আমাদের জাফলং যাওয়ার কথা। খুব ভোরে উঠে দেখি সে পাশে নেই। পুরো বাড়ির কোথাও নেই। ফোনটা ফেলে গেছে। এত সকালে অফিসে যাওয়ার কথা না। অনেকটা সময় হয়ে গেল, তবুও সে এলো না। অফিসে ফোন করে দেখি সেখানেও নেই।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল, তার কোনো খবর নেই। এর মাঝে হুট করে আবির্ভাব হলেন তারানা জামান, আমার একমাত্র শ্বাশুড়ি।
আমি আমার ঘরে বসছিলাম। নিচে কথার শব্দ শুনে ভাবলাম সে এসেছে৷ ছুটে নিচে নেমে দেখি শ্বাশুড়ি মা। হঠাৎ অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। আমি মাথায় কাপড় দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “কেমন আছ মা?”
আমি থতমত ভাব কাটিয়ে বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনার শরীর কেমন?”
“এইতো আছি।” তারপর মা খালাদের মতো করে বললেন, “এতদিন হয়ে গেল, তুমি একটা ফোনও করলা না আমাকে, শরীরটা খারাপ খবরও নিলে না।”
আমি সত্যি লজ্জা পেলাম। খবর নেয়া উচিত ছিল। তার মধ্যে আবার এই অসুস্থ অবস্থায় তার ছেলেকে নিয়ে এখানে চলে আসাটাও আটকানো দরকার ছিল। শুনেছি সে নাকি ছেলের হাত ছাড়া খেতোই না! সব মিলিয়ে আমার ভারি অনুশোচনা হতে লাগলো। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি বললেন, “কেমন চলছে তোমার সংসার?”
“ভালো।”
“ঝগড়া টগড়া হয় নাকি?”
“না।”
“তবে তো ভালোই। সিলেট মিশন সফল হলো। ও তোমার সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে।”
সিলেট মিশন মাথায় ঢুকলো না। এদিকে জহিরুল এসে বলল, “ম্যাডাম আপনার ঘরের সব ঠিকঠাক করে দিছি।”
“কোন ঘর?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
জহিরুল বলল, “ম্যাডামের ঘর।”
সেই নিচতলার তালা মারা ঘরটা! মায়ের সাথে সে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই বিষ্ময়ে হা হয়ে রয়ে গেলাম। ঘরটা অন্যসব ঘরের চেয়ে আলাদা। প্রচুর আসবাপত্র। সবচেয়ে বড় কথা, ঘরের দেয়ালে বড় একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি টানানো। ছবিটা ওর সাথে ওর বাবা, মা, ভাই, বোন। কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে তোলা ছবি। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
আমাকে অবাক হতে দেখে মা বললেন, “এটা দু’বছর আগের তোলা। আমার ইচ্ছে ছিল বড় করে বাঁধিয়ে রাখবো ছবিটা। কিন্তু তোমার শ্বশুর আবার নামাজ পড়ে তো, তাই ওবাড়ির কোনো দেয়ালে ছবি টানাতে দেয় না। এখানে থাকা হয় না তেমন, তাই এখানে টানিয়ে রেখেছি।”
তার মানে কী? এই বাড়িটা ওদের? তবে যে বলেছিলো তানজিম ভাইয়ের?
মা সাথে ব্যাগ আনেননি। আলমারির চাবি দেখলাম তার কাছেই। পার্স থেকে চাবি বের করে আলমারি খুললেন। প্রচুর শাড়ি, কসমেটিকসে ভরা আলমারি। উনি বললেন, “আমার যেসব জিনিস না হলেই চলে না, সেসব এখানে সবসময় থাকে। যখন তখন চলে আসি তো, এ বাড়িটাতে শান্তি লাগে আমার। এই ঘরটাতেও। কেউ ঢুকে যাতে নোংরা না করতে পারে, তাই অন্য সময় তালা দেয়া থাকে। জহিরুল অবশ্য মাঝে মাঝে ঢুকে পরিষ্কার করে।”
আমার মাথা দপদপ করতে শুরু করলো। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ঘরে কী আছে। ও বলেছিল এখানে নাকি তানজিম ভাইয়ের জিনিসপত্র আছে। তাই তালা দেয়া। ও আমাকে এসব মিথ্যে কথা কেন বলল? এবাড়িটা তাদের সেটা বললে কি আমি থাকতাম না?
মা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসেছেন। শাড়ি পাল্টে একটা সুতির শাড়ি পরেছেন। এই বয়সেও উনার ফিগার সুন্দর। বয়স কম লাগে, যদিও বড় অসুখ থেকে উঠেছেন বলে চেহারায় একটা অসুখের ছাপ পড়ে গেছে। উনি বললেন, “এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন, বসো।”
আমি চাবি দেয়া পুতুলের মতো খাটে গিয়ে বসলাম৷ উনি বললেন, “আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমার ন্যাওটা। আমার পরামর্শ ছাড়া কিচ্ছু করতে পারে না। আমি তাকে যখন বললাম ডিভোর্স দিতে তোমাকে, তখন সে রাজি হলো না। উল্টে আমাকেই বলল কোনো উপায় বের করতে। সে তোমার সাথে থাকতে চায়। তাই আমি বললাম কিছুদিন দূরে গিয়ে থাকতে। যাতে তোমাদের মধ্যে বোঝাপড়া হতে পারে। যদি তোমরা মানিয়ে নিতে পারো, তো ভালো। নয়তো ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক। অবশ্য ছেলে বলল, তুমি নাকি খুব লক্ষী। মানিয়ে গেছ তার সাথে।”
ও আচ্ছা এই ছিল সিলেট মিশন! বাহ! আমি কিছুতেই বুঝলাম না এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? সব বলে দিলে কি আমি আসতাম না?
মা বলে চলেছেন, “ছেলে ছাড়া আমি কি আর থাকতে পারি? তাই চলে এলাম৷ কয়েকটা দিন এখানে থেকে তারপর তোমাদের নিয়ে একসাথে ফিরব ঢাকায়।”
এসময় বাইরে তার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। সে সোজা এঘরে এসে ঢুকলো। মা’কে দেখে প্রায় ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। অনেকটা সময় চলল তাদের মা ছেলের মিলন দৃশ্য। সে মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।”
মা তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “তুই যা করেছিস, ঠিক করেছিস।”
“আচ্ছা, তুমি কী করে এলে? আমি সেই ভোরবেলা থেকে এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে আছি। ফোনটা ভুলে নিয়ে যাইনি। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায় অবস্থা হয়েছিল।”
“প্লেনে আসতে ইচ্ছে করেনি। গাড়িতেই চলে এলাম। আর তোর মোবাইলে আমি টেক্সট করেছিলাম। দেখিসনি?”
“নাহ।”
“সমস্যা নাই। মায়ের জন্য একটু কষ্ট করেছ, এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।”
সে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে আমাকে বলল, “তুমি আজকে ইলিশ মাছ আর খাসির মাংস রান্না করবে। মায়ের পছন্দ এগুলো। আর হ্যাঁ, সাথে টমেটো ছাড়া সালাদ। একেবারে কুচি কুচি করে। ঠিক আছে?”
তারপর জহিরুলকে কিছু জিনিস আনতে বলে আবার মায়ের ঘরে ঢুকে গেল। আমি তখনো সেখানেই স্থির হয়ে আছি। সে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, “দাঁড়িয়ে থেকো না, হারি আপ! মা জার্নি করে এসেছেন।”
আমি তবুও দাঁড়িয়ে। সব হজম করতে পারছি না। জহিরুলের ডাকে সম্বিত ফিরল। “ভাবী, রান্না বসাইবেন না?”
আমার জীবনটার মতোই রৌদ্রজ্জ্বল দিনটা হঠাৎ আঁধার হয়ে এলো। মেঘ ডাকতে শুরু করলো ক্ষণে ক্ষণে আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।
(চলবে)