সিঁদুর শুদ্ধি নাফিসা মুনতাহা পরী পর্বঃ ৪৭

0
820

#সিঁদুর শুদ্ধি
নাফিসা মুনতাহা পরী
পর্বঃ ৪৭
.

বিদ্যার পেটের ভিতর সব কিছু স্বচ্ছ কাঁচের মত দেখা গেল। এত এত মায়া জল পেয়ে এক বিন্দু রশ্মি যেন ছোটাছুটি করতে লাগলো। মায়া পানির স্পর্শে বিদ্যার ব্যাথা আরও তিনগুন বেড়ে গেল। বিদ্যার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। মা বলে একটা চিৎকার দিয়েই অভির শার্ট খামচে ধরলো আর সেন্সলেস হয়ে গেল।
বিদ্যার এমন করুন চিৎকারে অভির ভিতরের অস্থিরতা বেড়ে গেল। এমন অবস্থায় ওর কাজ ও ঠিকমত করতে পারলোনা। মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। অভির চোখের সামনে সেই আলোক বিন্দুটা ছটপটাতে লাগলো। অভি বার বার ফোকাস করতে লাগলো ওর কাজে। কিন্তু আর সম্ভব হলোনা। অভি আবার মায়া প্রয়োগ করার আগেই আস্তে আস্তে আলোক বিন্দুটা নিস্তেজ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে তা নিভে যেতে লাগলো। বিদ্যার আসে-পাশের বরফ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। অভির কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। সব শেষ হয়ে গেছে। তারা তাদের প্রথম সন্তান হারিয়ে ফেলল। অভি অপরাধীর মত মাথা নিচু করতেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল পরে গেল শুভ্র তুষারের উপর। সাথে সাথে বরফগুলো গলে বাষ্প হয়ে উড়ে গেল।

জুলিয়া ধীরে ধীরে বরফ থেকে উঠে হাতের ইশারা করতেই বরফের দেয়াল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সে নিজেও বুঝতে পেরেছে তার দ্বারা কত বড় একটা ভুল কাজ হয়ে গেছে। সে দ্রুত অভির কাছে আসতেই অচেতন বিদ্যার শরীর থেকে ওর ২য় সত্ত্বা নিমিষেই বের হয়ে এসে জুলিয়ার শরীর থেকে ওর সমস্ত শক্তি শুষে নিতে লাগলো। জুলিয়ার মুখ থেকে শুধু অভি কথাটিই বের হল। আর কিছু বলতে পারলোনা জুলিয়া।

অভি ওর মায়ের কথা শুনেই পিছন ফিরে দেখলো, ওর মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। মম বলেই অভি বিদ্যার ২য় সত্ত্বা থেকে ওর মমকে ছিনিয়ে নিল। ২য় সত্ত্বাটি প্রচন্ড রেগে গিয়ে অগ্রসর হতেই সামনে অভিকে দেখে থেমে গেল। শেষে নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পেরে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বরফের উপর ওর শক্তি প্রয়োগ করলো। জুলিয়াকে মারতে না পেরে সমস্ত রাগ বরফের উপর ঝাড়লো। আসে-পাশের ১কিলোমিটার বরফ সাথে সাথে গায়েব হয়ে গেল। সে দ্রুত বিদ্যার শরীরের ভিতর ঢুকে গেল।

অভি চোখ বন্ধ করে কাউকে ডাকতেই দু’টা মানুষ এসে হাজির হল। ওর মাকে তাদের হাতে তুলে দিয়ে বিদ্যাকে নিয়ে আবার টুইংকেলের বাসায় নিয়ে এল। বিদ্যার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। অভিকে এই অবস্থায় দেখে ইনা অবাক হয়ে বলল,

—” ওকে তুই কই পাইলি?”

পরে কথা হবে। প্লিজ আন্টিকে ডাক বলেই বিদ্যাকে নিয়ে রুমের ভিতর গেল অভি। দ্রুত বিদ্যার পোষাক চেঞ্জ করে দিয়ে ওর শরীরের ব্লাড মুছে দিল। তারপর চিৎকার দিয়ে বলল,

—” ইনা, আমি কি বললাম! আন্টি কই?”

টুইংকেল দ্রুত রুমে এসে দেখলো, বিদ্যার অবস্থা অত্যান্ত খারাপ। দ্রুত উনি ওনার মত করে চিকিৎসা শুরু করলেন। প্রায় দেড় ঘন্টা চেষ্টা করে বিদ্যার ভিতর থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম করলেন। জ্ঞান ফিরতে একটু দেরি হবে।
এবার টুইংকেল অভির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন। ওকে এভাবে কে আঘাত করলো! ওতো একটু হলেই মারা যেত। ওকে কোথায় পেয়েছ?

—“আন্টি থাকনা সেসব কথা! ও কি সুস্থ আছে?”

অভির এমন কথায় টুইংকেল খুঁশি হলোনা। কারন তার নিজেরও দু’টি মেয়ে আছে। সন্তান হারানো একটা মায়ের জন্য কতটা কষ্টকর সেটা শুধু সেই মা জানে। বিদ্যার সন্তান আর নেই। মেয়েটা নিঃশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে। সব বিপদ সন্তানের উপর দিয়েই চলে গেছে। টুইংকেল আর কোন কথা না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

আন্টি চলে যেতেই অভি এসে বিদ্যার শিয়রে বসলো। ওকে ছোয়ার মত মুখ নেই অভির। তবুও বিদ্যার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছে। একটুপর বিদ্যা চোখ খুলল। অভিকে পাশে দেখেই বিদ্যা অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করলো।

হেই ওয়েট বলে অভি বিদ্যাকে সাহার্য্য করলো। বিদ্যা আর দেরি না করে অভির একদম বুকের মধ্য জায়গা করেই ছোট ছোট শব্দে বলে উঠলো,

—” আমাদের বেবিটা আর নেই, তাইনা অভি?”

অভির ভিতরের কষ্টগুলো না পারছে প্রকাশ করতে আর না পারছে তা হজম করতে। ও শুধু বিদ্যাকে একটা আলতো কিস করে হুম বলল।

অভির হুম শব্দের ওজন অনেক। এই ওজন সহ্য করার ক্ষমতা বিদ্যার যে নেই। বিদ্যা আর চোখের জল আটকে রাখতে পারলোনা। স্বশব্দে আশেপাশের পরিবেশ ভারী করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। সমস্যা গুলো আরো জটিল হয়ে উঠছে। অভি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই ও বিদ্যাকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লো। বিদ্যার সামনে হাত জোড় করে বলে উঠলো,

—” প্লিজ, চলে যাও এখান থেকে। তাছাড়া সমস্যা আরো জটিল হবে। সব কিছু সমাধান হয়ে গেলে আমি নিজে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আর এখন যদি এমন পাগলামো করো তাহলে আমরা কেউ কাউকে কোনদিনও পাবোনা। বরং মাঝখান থেকে বহু প্রান শেষ হয়ে যাবে।”

এবার বিদ্যা উচ্চঃস্বরে কেঁদে উঠে বলল,

—” পারছিনা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে। আমার কষ্ট হয়। আমি কি করবো! আমার মনের অবস্থা একবার বোঝার চেষ্টা করো। আমারতো আর কেউই থাকলোনা। তোমার সব কিছু আছে কিন্তু আমার! আমারতো থেকেও সব কিছু হারা আমি। আজ নিজের সন্তানটাকেও হারালাম।”

অভি দ্রুত এসে বিদ্যাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

—” আজ আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি। কাল আমাকে তোমায় হারাতে হবে। আমি পারবোনা আর সহ্য করতে। আগে আমার মমকে নিয়ে সমস্যা ছিল কিন্তু তোমার কথা শুধু আমার পরিবারের মধ্য সীমাবদ্ধ নেই। সেটা আশে-পাশে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমি একজন, চারজন, দশজন, নাহয় ২৫ জনকে একসাথে কন্টোল করতে পারবো কিন্তু সবার হাত থেকে তোমাকে কি করে রক্ষা করতে পারবো? আর তাছাড়া তুমি নিজেও জানোনা তোমার মায়ের জন্মস্থান বা তার আপনজন কোথায় থাকে। তারা যদি জানত তোমার পরিচয় তাহলে আমার কোন চিন্তা ছিলোনা। কারন নিজের বংশের সদস্যদের তারা যেকোন পরিস্থিতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বোপ্রকার চেষ্টা করবে। তাই তুমি বোঝার চেষ্টা করো। সময় আমাদের হাতে আর নেই।”

কথাগুলো বলে অভি বিদ্যাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতেই বিদ্যা ওকে পিছন থেকে ডেকেই বলে উঠলো,

—” অভি, আমি তোমাদের মা-ছেলেকে দেখে নিব? যেটার জন্য ভয় করছো তোমরা! সেই কাজই আমি বৃন্দা কন্যা বিদ্যা করে দেখাবো।”

অভির ধৈর্য্যর বাঁধ এবার ভেঙ্গে গেল। বিদ্যুৎ গতিতে এসে বিদ্যার গালে কষে একটা ঠাস্ করে চড় বসিয়ে দিয়ে ওর গলা ধরে চিৎকার করে বলল,

—” নিজের শক্তির খুব অহংকার তোমার তাইনা? এত কিছু হয়ে যাচ্ছে তবুও তুমি নিজের জেদ নিয়ে পড়ে থাকবে?
তোমার এই অহংকারই আজ চুরমার করে দিব। এত জেদ তোমার কোথায় থেকে আসে আজ আমি সেটাই দেখে ছাড়বো।”

বিদ্যা অভির থাপ্পড় খেয়ে নিজের রাগটা আর দমন করতে পারলোনা। সাথে সাথে নিজের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। ওর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। নিজের সন্তান হারানোর কষ্ট আজ সবাইকে দিতে চায়। সেটা অভি হলেও মন্দ হবেনা।

বিদ্যার এমন হিংস্র চেহারা দেখে অভি এবার বিদ্যার ডান হাতটা মুচরিয়ে ধরে বলল,

—“আমার গায়ে তুমি হাত তুলবে! দেখি তুমি আজ কি করতে পারো! আর কত…..?”

অভির কথা শুনে বিদ্যার ভিতরের মানব সত্তা বিদ্যাকে বার বার কঠোর ভাবে ধিক্কার আর হুশিয়ার করে দিল। বিদ্যা যা করতে চাচ্ছে তা অন্যায় ছাড়া কিছু নয়। তার নিজের বাবা ওর মায়ের সাথে আরও জঘন্যতম ব্যবহার করেছে। তবুও ওর মা প্রতিবাদ করেনি। তাহলে সে তার মায়ের কাছ থেকে কি শিক্ষা লাভ করলো। বিদ্যা আস্তে আস্তে শান্ত হতে লাগলো। কিন্তু অভি আর শান্ত হলোনা। কারন একে এভাবে ছেড়ে দিলে ওর মাথা গরম হতে বেশিক্ষণ লাগবেনা। তখন সব শেষ করে দিবে।
বিদ্যা,, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তাই স্যরি বিদ্যা বলেই অভি বিদ্যার উপর মায়া প্রয়োগ করলো। বিদ্যা কিছু বুঝে ফেলার আগেই ও ধীরে ধীরে ছোট হতে লাগলো। তারপর একটা বোতলের মধ্য অচেতন অবস্থায় পড়ে রইলো। অভি বোতলটা নিয়ে বোতলের গায়ে কিস করে বলল,

—” তোমাকে বাঁচতে হবে আমার জন্য। এটা করা ছাড়া আমার হাতে কোন উপায় ছিলোনা। আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

অভি টুইংকেলের হাতে বিদ্যাকে দিয়ে বলল,

—” আন্টি, ওকে সব থেকে আপনার সুরক্ষিত জায়গায় রাখবেন। ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একটা নিদিষ্ট সময় পরে আমার জিবন আমাকে ফেরত দিয়েন। ততদিন পর্যন্ত ওকে হেফাযতে রাখবেন। ইনা, এ্যালি বা আপনি আর কখনো ভুলেও আমার সাথে যোগাযোগ করবেননা। আপনারা এখান থেকে চলে যান অন্য জায়গায়। যাতে আমিও যেন আপনাকে খুঁজে না পাই। এটাই বিদ্যার জন্য একমাত্র সুরক্ষার পথ। আমি এখন চলে যাচ্ছি।”

টুইংকেলের হাতে বিদ্যাকে সপে দিয়ে অভি চলে যায় সেদিন রাতে। এরপর টুইংকেলকে আর দেখা যায়না। অভি বাসায় এসে দেখে ওর মা কিছুটা সুস্থ। তাই অভি প্রথমে দেবকী দেবীর সাথে যোগাযোগ করে। অভি দেবকীকে অনুরোধ করে যেন বিদ্যাকে নিয়ে উনি বেশি বাড়াবাড়ি না করে। অভি তাকে মা ডেকে সবথেকে বড় শিকল বেঁধে দেয় দেবকীর পায়ে। দেবকী চাইলেও আর বিদ্যাকে কোনদিন সাহার্য্য করতে পারবেনা। কিন্তু দেবকী বিদ্যার মুক্তির ব্যবস্থা নিজে না করতে পারলে কিহবে! বিদ্যারতো সর্প সন্তান রয়েছে। এখন ওদেরও পরীক্ষা এসেছে। ওরা ওদের মাকে কিভাবে খুঁজে বের করে! খবর পাঠালো দেবকি তাদের কাছে।

প্রায় তিন মাস কেটে যায় এভাবে। অভি নিজেও জানেনা বিদ্যা কোথায় আছে। বিদ্যার মিসিং হওয়াতে সব যেন ঠান্ডা হয়ে যায়। না সেদিন অভির মা বিদ্যার ব্যাপারে কোন কথা বলল, না কোন অশরীগন বিদ্যার তল্লাশি চালাল। কারন বিদ্যাকে খোঁজার সমস্ত পথ অভি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে তারা বুঝে গেছে, হয় বিদ্যা মারা গেছে না হয় বিদ্যাকে চলে যেতে অভি বাধ্য করেছে। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এভাবে আরও দু’টি মাস কেটে যায়। অভির বাবা আশিষ ভৌমিক আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করে। শরীর নড়াচড়া করতে পারেনা কিন্তু অল্পস্বল্প কথা বলতে পারে। এটাই জুলিয়ার জন্য অনেক।

এখন প্রশ্ন হল, বিদ্যা আশিষ ভৌমিককে কি করেছিল?

যেদিন টুইংকেলের সংকেত জুলিয়ার কাছে আসে। সেদিনই জুলিয়া আশিষকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। আশিষকে একটা বিলাশবহুল হোটলে রেখে অভিকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিল জুলিয়া। আর এটারই সুযোগ নেয় শয়তার রুপী লালপ্রভা। সে চেয়েছিল, এমন কিছু করতে যাতে বিদ্যা সবার চোখে অপরাধী হয়। কিছু পিশাচ শক্তিকে এক করে বিদ্যার অবয়ব প্রতিরূপ তৈরি করে। প্রতিরূপ টি এমন ছিল যে, বিদ্যার ২য় শক্তির থেকে তাকে আলাদা ভাবে চেনা যেতনা। কিন্তু শক্তির দিক থেকে দুর্বল হলেও তাদের জন্য একটা সামান্য মানুষকে কাবু করতে কোন ব্যাপারই ছিলোনা।
তারা আশিষকে আঘাতের উপর আঘাত করে। ওকে মৃতপ্রায় করে ছাড়ে। তারপর সেই একত্র অশরীকে ওখান থেকে নিজেদের কাছে আনে লালপ্রভা।

অভিকে নিয়ে যখন জুলিয়া ফেরত আসে তখন আশিষের এমন অবস্থা দেখে জুলিয়া অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু অভি অনুভব করে এটা ঐ অশরীর কাজ। যেদিন ঋষি ওকে বন্দী করে। পরে অভি ওর মায়ের সাহার্য্য নিয়ে বিদ্যার অতীত সম্পর্কে সব কিছু জানতে পারে। জুলিয়া আর অভিকে ফিরতে দেয়নি। ওদের নিয়ে দেশে ফিরে আসে। আর অভির প্রতি কঠোর হয়ে যায়।

পাঁচ সর্প এতোদিন ধরে তারা নিজ দেশ হতে বিদ্যাকে পাগলের মত খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি। অন্যদেশে তারা তাদের তান্ডপ চালাতে পারবেনা। অচেনা জায়গা মানে অচেনা শত্রু। কিন্তু আজ তারা আশার আলো দেখেছে। তারা তাদের স্বজাতির সাহার্য্য নিয়ে বিদ্যার অবস্থান জানতে পেরেছে। তাদের ৫জনের মুখেই হাসি ফুটিয়ে উঠলো। ৫ভাই রওনা দিল তাদের অসহায় মায়ের কাছে। কনিষ্ঠ জনতো সবথেকে বেশি উত্তেজিত। কখন তাদের মায়ের সাথে দেখা করবে।
এক সূর্যাস্ত্রের সময় তারা উপস্থিত হলো এক জঙ্গলের কিনারায়। সড়সড় করে তারা জঙ্গলের ভিতর চলে গেল। পুরনো ভাঙ্গাচুরা একটা কাঠের দু’তলা বাসা। ভিতরে জরাজীর্ণ অবস্থা। মনে হয় হাত দিলেই সব ভেঙ্গে যাবে। তবুও খুব সাবধানে তারা সেখানে ঢুকে পড়ে। কিন্তু কি আশ্চার্য, ভিতরে খুব সুন্দর পরিবেশ। বাসার ভিতরে একটা বিশাল দিঘি। তার মধ্য পানির উপরে গালিচা পাতানো। সেখানে বিদ্যা অচেতন অবস্থায় সুয়ে আছে। আর চারদিকে শতশত রাজহংস দলবেঁধে তাকে পাহারা দিচ্ছে। এরা যে স্বাভাবিক কিছু নয় সেটা তারা ৫জনে ভালো করে বুঝতে পারলো। এত পাহাড়াদার দের কাছ থেকে কিভাবে মাকে নিয়ে পালাবে তারা! এদের মাঝখান থেকে একজন বেরিয়ে এসে প্রথমে সে দেবকীর সাথে যোগাযোগ করলো। দেবকী সব শুনে বলল,

—” আমি তোমাদের সাহার্য্য করতে পারবোনা। কিন্তু তোমরা তোমাদের মাথা খাটাও। তোমরা তোমাদের বংশের মধ্য সবথেকে শক্তিশালী সাপ। কিন্তু ওখানে তোমাদের শক্তি খাটবেনা। তোমাদের বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে।”

দেবকীর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে শো শো শব্দ করে কিছু একটা এদিকে এগিয়ে আসছে। সাপটি আড়ালে চলে গেল তার ভাইদের সর্তক করে দিয়ে। একটা মহিলা এসে উপস্থিত হল। এদিক ওদিক চেয়ে সেই দালানের ভিতর ঢুকলো। মহিলাটি এসে সব রাজহংসদের উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

—” অনেক কষ্ট করে এই পিশাচভক্ষন অশরীকে ধরেছি আমরা। কোন কিছুর বিনিময়ে তাকে হাতছাড়া করা যাবেনা। সে আমাদের রাজ্যতে থাকা মানে আমরা শক্তিশালী বংশ হিসাবে সবার কাছে পরিচিত হব। সে তার স্বামী দ্বারা ছলনায় বন্দী হয়েছে। তাকে আমরাও মুক্ত করতে পারবোনা। কিন্তু সে এমন একজন পিশাচ যে তার শক্তিকে, আগেও অনেকবার আলাদা করা হয়েছিল। তাই আমাদের সুবিধামত তার শক্তি ব্যবহার করতে পারবো। তাই সাবধান, তাকে আমাদের কাছে রাখতেই হবে। কোন প্রকার অসুবিধা যেন না হয়। অনেক বড়বড় শক্তিই তাকে আমাদের কাছ থেকে নিতে আসবে।”

কথাগুলো বলে সামনের দিকে তাকালো। সেখানে টুইংকেল আর ওর দুই মেয়ে বন্দী আছে। মহিলাটি টুইংকেলের কাছে এসে বলল,

—” সিস্টার, তোমার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি বাহিরে গিয়ে ভেজাল করবে। এই তোমরা কিন্তু অতিথীদের উত্তম আপ্যায়ন করবে।”

কথাগুলো বলে মহিলাটি চলে গেল। এই ৫ সর্পগন সব কথা শুনলো। দেবকী বলেছে বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে। যেখানে শক্তির কোন কাজ চলেনা সেখানে বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হয়। তাই তাদের সকাল হওয়া অবদি অপেক্ষা করতে হবে। কারন প্রকৃতি শক্তির কাছে সমস্ত জাদু শক্তি বিকল হয়ে পড়ে।

রাত পেরিয়ে যখন সকাল হল। সূর্য যখন উদয় হল তখন ৫ভাই তাদের তান্ডপ চালালো। ৫জন ৫দিকে গিয়ে ওদের ভারী ভারী লেজ দিয়ে সেই ভাঙ্গা বাসায় আঘাতের উপর আঘাত করলো। প্রচন্ড ধাক্কায় বাসার দেয়াল গুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সূর্যের রশ্মি এসে বাসার ভিতরে প্রবেশ করতেই সব মায়াজাল নষ্ট হয়ে গেল। কোথায় গেল পুকুর আর কোথায় গেল সেই রাজহংস। সব যেন চোখের সামনে ধুলিসাৎ হয়ে গেল। আর বিদ্যা বোতলে বন্দী হয়ে ভাঙ্গা কাঠের ফ্লোরে পড়ে রইল। তারা বিদ্যাকে নিয়ে চলে যেতেই একটা চিৎকার এল, আমাদের মুক্ত কর।

কিন্তু ৫ সাপ তাদের কথা শুনেও শুনলোনা। তারা বিদ্যাকে নিয়ে নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। টুইংকেল কান্না করতে করতে অভির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলো। এমনসময় ওদের শরীরে রোদের আলো ছুতেই ওদের বন্ধন কেটে গেল। ওরা বিদ্যার পিছে পিছে চলে গেল কিন্তু বিদ্যার আর দেখা পেলোনা। কোথায় গেল তারা। এখুনি অভিকে জানাতে হবে। না জানি অভি এতদিনে আমাদের উপর কতটা রেগে আছে।

৫সাপ বিদ্যার বোতল সামনে রেখে তার পাশে গোল হয়ে অবস্থান করছে। তারা বোতলে হাত দিতেই কোন এক শক্তি এসে ওদের আঘাত করে কাবু করে ফেলছে। আবারও বুদ্ধি খাটাতে হবে। কনিষ্ট সাপটা মা, মা বলে কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু বিদ্যার কোন রেসপন্স পেলোনা।
এভাবে হবেনা। অন্য কিছু ভাবতে হবে। কথাগুলো ভেবেই ১ম সাপ বলল,

—” আমাদের কোন মানুষের সাহার্য্য নিতে হবে। একদম সলেট মানুষ। কারন ওরা প্রাকৃতিক।”

১ম সাপটি তার মুখ হা করে বোতলের উপর আগুন নিক্ষেপ করলো। আর সেটা সোনার মত চকচক করতে লাগলো। দেখে যে কেউ বলবে, এটা স্বর্নের বোতল। তারা সবাই জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল। তারপর একটা লোকালয়ে গেল। রাস্তায় বোতলটি রেখে দুরে ঝোপের মধ্য লুকিয়ে পড়লো। কিছুক্ষন পর একটা ১০ বছরের ছেলে বোতলটা দেখে কাছে এল। তারপর সেটা রাস্তা থেকে তুলে পরীক্ষা করতেই দেখলো বোতলের ভিতর থেকে কিছু একটা চিক চিক করছে। সে গভীর আগ্রহ নিয়ে সেই বোতলের ছিপ খুলে ফেলল। অমনি ছিপ সহ বোতল উধাও হয়ে গেল।

সাপগুলো বিদ্যাকে নিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় চলে আসলো। কিন্তু বিদ্যার শরীর প্রচন্ড দুর্বল। সে চোখে ভালো করে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। সাপদ্বয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদের সমস্ত শক্তি বিদ্যার উপর প্রয়োগ করতেই বিদ্যা যেন গা ঝেড়ে উঠলো। অনেক্ষন ধরে বোঝার চেষ্টা করলো, সে কোথায় আছে? তারপর সাপদের দিকে চোখ পড়তেই ও বলল,

—” তোমরা?”

৫জনকে এবার কে দেখে! মা জেগে উঠেছে বলে উল্লাসে তারা বিদ্যার গায়ের সাথে পরম আদরে গা ছুয়ে দিল। আমার মা বলেই বিদ্যাকে লেজে পেঁচিয়ে ধরে উপরে তুলল কনিষ্ঠ সাপ। বিদ্যা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

—” আমাকে তোমরা কোথায় পেলে?”

ওরা দেবকীর কথা বলল। দেবকী মায়ের কথা শুনে বিদ্যা দ্রুত দেবকীর সাথে যোগাযোগ করলো। দেবকী সব শুনে বিদ্যাকে বলল,

—” যা হোক, ওরা তোমাকে ২য় বারের মত বাঁচিয়েই ফেলল। তোমাকে কিছু কথা বলি মা! অভি ধর্ম সংকট আর তোমাকে হারানোর ভয়ে এমন করেছে। আমি এতে ওর দোষ দেখছিনা। এখন তুমি বিপদকে আলিঙ্গন করে তাকে নিয়ে পথ চলছো। মনে রেখ, তুমি শুধু পিশাচ নও। তুমি একজন মানব সন্তানও বটে। তাই শক্তি আগে প্রয়োগ করবেনা। বুদ্ধি দিয়ে যদি সেটা সমাধান না হয় তবেই তুমি শক্তি প্রয়োগ করবে। আর তোমার সাপ বাচ্চাদের সামলে রাখবে। অভির ব্যাপারে সব বল তাদের। ওরা সাপ, তাই ওরা একটু বেশিই রাগী স্বভাবের হয়। তাই ওদের কন্ট্রোলে রাখবে। এবার তোমার কাজ হল অভির বাসায় ঢোকা। তাও ছদ্দবেশে।”

ওকে মা বলে বিদ্যা মন স্থির করলো। পরের টার্গেট অভির বাসা। বিদ্যা ওর দলবলকে নিয়ে তিনদিন অভির বাসার সামনে ওদের কড়া নজরে রাখলো। তারপর সে সুযোগ পেয়ে গেল, অভির দিদা আশীষকে দেখানোর জন্য এক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছে। এই সুযোগ, বিদ্যা তার লম্বা লম্বা চুলকে সোনালি চুলে পরিনিত করলো। তারপর চোখ নীলে পরিনিত করলো। একদম ব্রিটিশ মহিলা ডাক্তারের সাজ নিল। চোখে চশমা পড়লো। এবার অভিরই চেনা দায়।

সাপগুলো ওর সাথে যাওয়ার জন্য জেদ ধরলে বিদ্যা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

—” তোমাদের এখানেই থাকতে হবে। ঐ যে ব্যালকোনি দেখছো? ওখান থেকে তোমাদের সাথে যোগাযোগ করবো।”

বিদ্যা কথাগুলো বলে নিজেকে সম্পূর্ন মানব সত্তায় এনে বাসায় ঢুকলো। বিদ্যা এমন সময় বাসায় ঢুকলো
যখন অভি আর জুলিয়া দু’জনেই বাসায় ছিলোনা। বিদ্যা অভির দিদা কুন্তী দেবীর সাথে বেশ সময় নিয়ে আলোচনা করলো। কুন্তী দেবীর বিদ্যাকে খুব পছন্দ হয়েছে। কারন বিদ্যা বলেছে সে বাংলাদেশী বংশদূত। এটাই তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। সে নিজেই বিদ্যাকে আশিষের কাছে নিয়ে গেল।

আশিষ সুয়ে আছে। নিজের মায়ের সাথে একজন ডাক্তারকে দেখে হ্যালো বলল। বিদ্যাও তার কথার জবাব দিয়ে কুন্তী দেবীকে চলে যেতে বলল। কুন্তী দেবী চলে যেতেই বিদ্যা ওর আসল চেহারায় এসে বলল,

—” বাবা, আমায় চিনতে পেরেছেন? আমি বিদ্যা। ঐ যে ভিডিও কলে অভির সাথে কথা বলছিলেন? আমি অভিকে থাপ্পড় মেরেছিলাম? তারজন্য অভি আপনাকে অভিযোগ…….।”

কথাগুলো শেষ করতে পারেনা। তার আগেই পিছন থেকে অভি এসে বলল,

—” হেই, হু আর ইউ?”

অভির কন্ঠ শুনে বিদ্যা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। এই বুঝি সে ধরা পড়লো। ধরা পড়লে সব শেষ।

[ চলবে……]

বিদ্রঃ গল্প বড় করে লেখার জন্য শব্দের ব্যবহার একের অধিক বার বা বানান ভুল থাকতে পারে। আজও রিভিশন ঠিকমত দিতে পারলামনা। কারন অলরেডি সময় ওভার হয়ে গেছে।
আগামী পার্ট ১১ তারিখ রাত ১০টায় দেওয়া হবে।

ওয়েবসাইট থেকে পড়ুনঃ
https://nafisarkolom.com/2020/12/sidur-suddhi-47/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here