কনফিউশন পর্ব ১৮

0
350

কনফিউশন পর্ব ১৮
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম

লাঞ্চ করার পর সিগারেটের জন্য অস্থির লাগছিলো কাব্যর। কেবিন থেকে বের হয়ে ট্রেনের ভেতর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আসলো। লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারলো পরবর্তী স্টেশন আসতে দেরি আছে। কাব্য চিন্তা করলো, ভালোই হলো আরশির সামনে আর সিগারেট খাওয়া লাগলো না। এসব ভেবে যখন কেবিনে ফিরছিলো ঠিক তখনই একটা হকার সামনে পড়লো। সে কাব্যকে জিজ্ঞেস করলো,
“মামা সিগারেট লাগবো?”
“না।”
হকার চলে যাচ্ছিলো। কাব্য তার দিকে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললো,
“দাঁড়ান মামা। একটা বেনসন দেন।”
হকার একটা সিগারেট দিতেই কাব্য বললো,
“না থাক বেনসন লাইট দেন।”
হকার আবার সিগারেট বদলে দিতেই কাব্য সেটাকে ধরিয়ে জানালার কাছে চলে গেলো। সিগারেটে একটা টান দিতেই কাব্যর প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। সাথে সাথেই তার মনে হলো, সে কেন সিগারেট খাচ্ছে? কেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারছে না? এটা মনে হতেই সিগারেট টা নিভিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো। এরপর একটা চকলেট খেয়ে আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে কেবিনে ফিরলো। আরশি একটা বই পড়ছিলো। কাব্যকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“চা খাবেন?”
“ফ্লাস্কে চা এতোক্ষণ গরম থাকে নাকি?”
“না। তবে আমি গরম করেই খাবো। আপনি খেলে বলুন।”
“অবশ্যই খাবো। চা সিগারেটে আমার কোনো মানা নেই। কিন্তু কীভাবে গরম করবে?”
“সে চিন্তা আপনার না করলেও হবে।”
আরশি তার চায়ের ফ্লাস্ক টি বের করলো। কাব্য আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলো। আরশি তার ব্যাগ থেকে একটি স্টিলের ছোটো মগ ও লাইটারও বের করলো। তারপর মগে চা ঢেলে লাইটার জ্বালিয়ে মগের নিচে ধরলো। কাব্য হেসে বললো,
“হোয়াট এন আইডিয়া!”
আরশি বললো,
“আমি ট্রেনে কোথাও গেলে এভাবেই চা গরম করি। এই মগ আর লাইটার টা শুধু এজন্যই।”
কাব্য মুগ্ধ চোখে দেখছিলো সবকিছু। চা গরম হতেই আরশি ফ্লাস্কের কাপে ঢেলে কাব্যকে দিলো। কাব্য চায়ে চুমুক দিয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই একটা জঙ্গল মতো জায়গা দেখতে পেলো যেখানে অনেক বড় বড় ঘাস জন্মে আছে। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“আরশি তোমার তো স্টিফেন কিং পছন্দ তাইনা?”
“আপনি কী করে জানলেন?”
“সেদিন তোমার অর্ডারকৃত বই দেখে বুঝেছিলাম যেদিন তুমি আমাকে আঙ্কেল ডেকেছিলে।”
আরশি হেসে ফেললো। ওই হাসিটার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“স্টিফেন কিং এর ‘ইন দ্যা টল গ্রাস’ পড়েছো?”
“না, এটা পড়া হয়নি। আরো কয়েকটাই বাকী। ধীরে ধীরে পড়বো।”
“অসাধারণ শ্বাসরুদ্ধকর একটা বই। বাইরে তাকাও দেখো কত বড় বড় ঘাস এই জায়গাটা দেখে বইটার কথা মনে পড়ে গেলো।”
“মিল আছে?”
“হুম। একটা প্রেগন্যান্ট মেয়ে তার ছোটো ভাইকে নিয়ে গাড়ি করে এক শহর থেকে অন্য একটা শহরে যাচ্ছিলো। রাস্তার পাশে এরকম বড় বড় ঘাস ছিলো। এর থেকেও বড় ঘাস অবশ্য, মানুষের উচ্চতার থেকেও বেশি। ৬/৭ ফুট হবে। তো তারা হঠাৎ ঘাসের ভেতর থেকে একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পায়। বাচ্চাটা ঘাসের ভেতরে হারিয়ে গেছে, বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিলো বাচ্চাটাকে বের করে আনবে। এরপর দুই ভাইবোন মিলে ঘাসের ভেতর ঢোকে। বাচ্চাটার কান্নার শব্দ পায় কিন্তু বাচ্চাটাকে খুঁজে পায় না। খুঁজতে খুঁজতে দুইজন দুই দিকে চলে যায়। বাচ্চাটাকে খুঁজে না পেয়ে যখন ওরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তখন ওরা এমন দূরত্বে ছিলো যে দুজন দুজনার কথা শুনছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না, মানে কাছেই। তো ওরা ঠিক করলো ওয়ান টু থ্রি বলে একসাথে লাফ দেবে। লাফ দিয়ে দেখলো ওরা একদম কাছেই। তো দুজন দুজনের দিকে হেঁটে গেলো। এরপরও দেখতে পাচ্ছে না বলে আবার লাফ দিলো। এরপর দেখে ওরা দুজন দুজনের থেকে অনেক অনেক দূরে।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“ওহ মাই গড!”
“ইন্টারেস্টিং না?”
“খুব। এরপর কী হলো?”
“পুরোটা আমি বলে দিলে আর মজা থাকলো কী? নিজে পড়ে নিও।”
“ধ্যাত তাহলে এইটুকু বললেন কেন?”
কাব্য হেসে বললো,
“ওইযে ঘাস দেখে মনে পড়লো।”

আরশি ও কাব্যকে নিতে তিরা এলো স্টেশনে। আরশি ট্রেন থেকে নামতেই তিরা দৌড়ে এসে আরশিকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর যখন কাব্য নামলো তিরা চেচিয়ে উঠলো,
“আব্বাজান কি অবস্থা? মেয়ের বিয়েতে আসলা অবশেষে।”
কাব্য হেসে বললো,
“বাবা ছাড়া মেয়ের বিয়ে হয় কখনো?”
“যাই হোক এসব ঢঙ আবার আমার ফ্যামিলির সামনে করো না। আমি বলেছি তুমি আমার বন্ধু। আর তুমি যে আরশির সাথে এসেছো এটাও বলা যাবে না।”
“না বললাম।”
“গুড বয়।”

রাতের ঘুমানোর সময় তিরা আরশিকে যাদিদ সম্পর্কে নানান রকম কথা বলছিলো কিন্তু কোনোটাই আরশির কর্ণপাত হচ্ছিলো না। সারাক্ষণ শুধু ওই একজনের চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করছে। মানুষটার হাসি, মানুষটার কথা বলা, মানুষটার হাঁটাচলা সবকিছু কেবলই চোখে ভাসছে। কীভাবে তার অমন দারুণ একটা ছবি তুলে ফেললো, কীভাবে সিগারেট ছাড়ার কারণে মাকে অজুহাত বানালো, কীভাবে গল্প বলছিলো সবকিছুই যেন এখনো ঘটছে৷ এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। আচ্ছা কাব্যরও কী এমন হচ্ছে? ইশ জানার যদি কোনো উপায় থাকতো!

অনেক রাতে ফোন আসতেই আরশির ঘুম ভেঙে গেলো। কাব্যর একটা ফোন বা মেসেজের জন্য অপেক্ষা করছিলো আরশি। কিন্তু আসেনি অথচ এতো রাতে ফোন করলো! তিরা ঘুমিয়ে পড়েছে তবুও আরশি বারান্দায় গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো,
“হ্যালো।”
“সরি ঘুম ভাঙালাম।”
“সমস্যা নেই, বলুন”
“আসলে ঘুম আসছে না।”
আরশির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো৷ সে হাসিটাকে লুকিয়ে বললো,
“কেন?”
“মেবি জায়গা বদলের জন্য।”
“আচ্ছা।”
“বাদ দাও এসব৷ এবাড়ির যে অবস্থা! এতো আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তোমার সাথে সামনাসামনি কথা বললে হয়তো তোমার জন্য সমস্যা হবে।”
“তা তো একটু হবেই।”
“এজন্যই ফোন দিলাম একটা দরকার ছিলো।”
“কী চা?”
কাব্য হেসে বললো,
“না সেতো আন্টি দিয়েছেনই।”
“তাহলে?”
“আমি তিরার জন্য গিফট কেনার সময় পাইনি। কালকে সন্ধ্যায় হলুদ, দিনটাতো আছে। ভাবছি কাল গিফট কিনবো।”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু কী কিনবো? আই হ্যাভ নো আইডিয়া। কী দিলে তিরা খুশি হবে?”
“শাড়ি গয়নার চেয়ে বেশি খুশি আর কিছু দিয়ে করতে পারবেন না।”
“তাহলে শাড়ি দেই?”
“দিন।”
“তোমার কি একটু সময় হবে আমার সাথে মার্কেটে যাওয়ার?”
“আমি!”
“হ্যাঁ। না মানে আমি তো খুলনায় এই প্রথম কিছুই চিনিনা আর তিরার কি ধরনের শাড়ি পছন্দ তাও জানিনা। তুমি একটু সাথে গেলে ভালো হতো।”
“আমি এক্ষুণি বলতে পারছি না। আমি তো একটু রিসার্ভড থাকি এজন্য ফুপী কিছুক্ষণ পরপরই আমার খোঁজ নেন। আমি ঠিক আছি কিনা, কিছু লাগবে কিনা। আর তিরাও আছে। আমি কী বলে বের হবো? আপনার সাথে যাচ্ছি এটা বলা যায় না কারণ আমি সাধারণত কারো সাথে কোথাও যাইনা।
“না পারলে জোরাজুরির কিছু নেই।”
“তবে সুযোগ হলে নিশ্চয়ই যাবো।”
“আচ্ছা।”

সকালবেলা নাস্তা শেষ করে আরশি টেবিলেই বসে ছিলো। কারণ তিরা ও কাব্য তখনো নাস্তা করছিলো। মনজিলা বেগম ড্র‍য়িং রুমে হলুদের কাপড়চোপড় বিতরন করছিলেন। হঠাৎ আরশির কাছে এসে হলুদের শাড়ি গয়না দিয়ে বললেন,
“এইনে মা হলুদের শাড়ি গয়না।”
আরশি বললো,
“ফুপি আমি এসব পরতে পারবো না। আমি সালোয়ার কামিজ এনেছি। ওগুলোই পরবো।”
কাব্যর একটুর জন্য গলায় খাবার আটকালো না। একথা শুনে অবাক হলো যে আরশি বোনের হলুদে শাড়ি পড়বে না! মনজিলা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কী বলছিস তুই? সবাই একরকম কাপড় পরবে। আর তুই বুড়ী সেজে বসে থাকবি?”
“সরি ফুপি প্রথমত শাড়ি পরা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি পারিও না। কোনোদিন দেখেছো শাড়ি পড়তে? তার উপর বেগুনি রঙের! অসম্ভব!”
“তুই এমন আনসোস্যাল কেন বলতো? একটা বিয়ে বাড়িতে এসে এরকম সাদা সাদা জামা পরে ঘুরছিস! আবার অনুষ্ঠানেও যাবি এসব পরে? অথচ তোর বয়সী মেয়েরা দেখ কত সুন্দর কাপড়চোপড় পরে সেজেগুজে ঘুরছে। আর তুই সুতির একটা জামা পরে কাজের মেয়েদের মতো মাথার উপর একটা খোঁপা বেঁধে ঘুরছিস! একটু সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে শেখ মা।”
কাব্য এসব কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। এরকম পরিবারে এরকম কিছু সে আশা করেনি। একটা ইন্ট্রোভার্ট মেয়েকে আনসোস্যাল কেন বলে মানুষ? আর কে কীভাবে চলবে এটা তো একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিরা মাকে বললো,
“থাক না মা। ওর যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই থাকুক।”
“কেন? এক্সিডেন্ট কি মানুষের জীবনে হয় না?”
আরশি আর এক মূহুর্ত সেখানে থাকলো না। আস্তে করে উঠে ঘরে চলে গেলো। তিরা এবার রেগেমেগে বললো,
“মা কী দরকার তোমার ওকে এসব কথা বলার? তাও আবার সবার সামনে। তুমি এরকম করো বলেই ও আমাদের বাসায় আসতে চায় না। এবার আমার বিয়ে বলে না এসে পারেনি। এই দুটো দিন ওকে অশান্তি দিওনা প্লিজ। অনুষ্ঠানের এক কোণায় পরে থাকে ও। তবুও মানুষের সামনে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগলে বলে দিও ওকে তুমি চেনো না।”
“তোরা শুধুশুধু আমার উপর রেগে যাস। আমার ভাইয়ের মেয়ে, আমি তো ওর ভালোর জন্যই বলি নাকি?”
“এতো ভালো ভাবা লাগবে না তোমার।”
মনজিলা বেগম মন খারাপ করে চলে গেলো। সাথে সাথেই কাব্য তিরাকে বললো,
“এক্সিডেন্ট মানে? কী এক্সিডেন্ট হয়েছিল আরশির?”
তিরা আমতা আমতা করে বললো,
“ইয়ে মানে.. আমি..”
তিরার কিছু বলতে হলো না। তার আগেই তার চাচাতো বোন এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“কীরে এখনো গিলছিস? ওঠ তো কত কাজ বাকী একটু পরেই পার্লারে যেতে হবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here