কনফিউশন পর্ব ১৪

0
366

কনফিউশন পর্ব ১৪
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম

তিরা বেলা করে ঘুমুচ্ছিলো। ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। বিরক্ত মুখে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো তিরা কারণ যাদিদ ফোন করেছে! গলা খাকারি দিয়ে, পানি খেয়ে ঘুম দূর করার চেষ্টা করলো। এরপর ফোন ধরলো,
“হ্যালো।”
যাদিদ বিস্ময়ের সাথে বললো,
“এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছো তুমি আমার বৌ হবে কীভাবে?”
“না না ঘুমাচ্ছি না আমি।”
“তোমার ভয়েস শুনে কানাও বলে দিতে পারবে তুমি ঘুমাচ্ছিলে।”
“না কিছুক্ষণ আগে উঠেছি। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের সাথে কাজ করেছি তো তাই নাহলে এমনিতে আমি সকালেই উঠি বিশ্বাস করো।”
“কী কাজ করছিলে?”
“বিয়ে বাড়িতে কত কাজ থাকে!”
তিরা মনে মনে বললো,
“আমি যে শাড়ি ট্রায়াল দিতে দিতে অর্ধেক রাত পার করেছি তা তোমাকে কী করে বলি যাদিদ?”
যাদিদ বললো,
“আচ্ছা শোনো বিয়ের শপিং এ বেরিয়েছি। মা আর আপুকে বলছিলাম তোমাকে সাথে নিতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। হবু বৌকে সাথে নিয়ে শপিং করার ট্রেন্ড নাকি আমাদের বংশে নেই। যাই হোক, আমাকেই বলে দাও বিয়েতে শাড়ি পরতে চাও নাকি লেহেঙ্গা? আর কী রঙ? আমি সেভাবে পছন্দ করে নেব।”
তিরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। ছেলেটাকে যতটা রসকষহীন মনে করেছিলো ততটা সে না। বললো,
“শাড়ি পরবো, বেনারসি। রঙ টা তুমি পছন্দ করে দিও।”
“আচ্ছা।”
“আর কসমেটিকসের ক্ষেত্রে কি ব্র‍্যান্ড পছন্দ?”
তিরা গড়গড় করে বলে দিলো কোন জিনিস কী ব্র‍্যান্ড ব্যবহার করে। যাদিদ বললো,
“থামো থামো এসব জিনিসের নাম বাপের বয়সে শুনিনি। এতো মনে রাখতে পারবো না। সব লিখে মেসেজ করো।”

আরশি বাগানে গাছে পানি দিচ্ছিলো। কাব্য তাকে পছন্দ করে জানার পর থেকে বুয়াকে দিয়ে বাগানের গাছে পানি দেয়াতো। এখন থেকে আবার নিজেই দেবে ঠিক করেছে। এই সুযোগে যদি কাব্যর সাথে প্রতিদিন একবার দেখা হয় ক্ষতি কী? যদিও আরশি জানেনা কাব্য কোন দিন কখন বাসায় থাকে। কাল যখন পানি দিতে এসেছিলো কাব্য বাসায় ছিলো না। আজ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। জানালা যখন খোলা থাকতেও পারে।

নিজের কার্যকলাপে নিজেই অবাক হচ্ছে আরশি৷ কাব্যর সামনে যাতে পড়তে না হয় তাই সে নিজেকে একপ্রকার গৃহবন্দী করে রেখেছিলো। একমাস পর দেখা হতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। এখন সে নিজেই চায় বারবার কাব্যর সাথে দেখা হোক। তাহলে কি সে ভালোবেসে ফেলেছে কাব্যকে? এতো তাড়াতাড়ি কাউকে ভালোবাসা যায় তাও অপছন্দের কাউকে? তিরা যখন এসব জানতে পারবে তখন কি কষ্ট পাবে? কষ্ট পাওয়ার কথা না কারণ তিরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তারই পছন্দের কারো সাথে। কিন্তু কাব্য তাকে রেখে আরশিকে পছন্দ করলো এটা ভেবে কষ্ট পাবে না তো? ঠিক তখনই কাব্য জানালা দিয়ে ডাকলো,
“এইযে ডাক্তার আপা..”
আরশির হাসি পেলো৷ হাসি আটকে সে পিছনে ফিরলো। স্বাভাবিকভাবে বললো,
“এখনো ভর্তিও হইনি।”
“তাতে কি চান্স তো পেয়েছো। অফিসে যখন শুনলাম গতকাল মেডিকেলের রেজাল্ট দিয়েছে তখনই মনে হচ্ছিলো বাসায় এসে মিষ্টি খাব। কিন্তু এক্সপেক্ট করেছিলাম মিষ্টিটা তুমি নিয়ে আসবে।”
“সারাদিন আমি বাসায় একা ছিলাম। রাতে সাহিল ভাইয়া ফেরার সময় মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো। কেউ তার বোনকে রাত ১০ টার সময় একটা ছেলের বাসায় মিষ্টি নিয়ে পাঠাবেনা নিশ্চয়ই?”
কাব্য হাসলো৷ আরশি আবার গাছে পানি দিতে লাগলো। কাব্য বললো,
“আমি বাগানে এলে মাইন্ড করবে?”
আরশি না তাকিয়েই বললো,
“আসুন বেঁধে রেখেছে কে?”

কাব্য ঝটপট স্যান্ডেল পড়ে বাগানে এলো। আরশি হেঁটে হেঁটে সব গাছে পানি দিচ্ছিলো। কাব্য আরশির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“তিরার বিয়ে তো শুক্রবার। খুলনা যাচ্ছো না?”
আরশি তাকালো না, গাছে পানি দিতে দিতেই বললো,
“হ্যাঁ আমি তো কালই যাচ্ছি। সাহিল ভাইয়া বৃহস্পতিবার যাবে। আফসোস ভাবী যেতে পারছে না। বাবুর তো মাত্র এক সপ্তাহ হলো এখনই ওকে নিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না।”
“একা যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ।”
“আমাকে নেবে তোমার সাথে? মানে এতোটা পথ একা জার্নি করাটা কষ্টকর, তোমার জন্যও আমার জন্যও।”
আরশি জানেনা তার কী হলো! কাব্যর এই এতটুকু কথায় বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঝড় বইতে শুরু করলো। পা দুটো এমনভাবে কাঁপতে লাগলো যে দাঁড়িয়ে থাকা দায়! বললো,
“আপনি কি যাচ্ছেন নাকি তিরার বিয়েতে?”
“হ্যাঁ তিরা তো আমাক খুব রিকোয়েস্ট করেছে যাওয়ার জন্য। আমি যখন বললাম আমি তো চিনিনা তখন বললো তোমার সাথে যেতে। তোমাকে কিছু বলেনি?”
“না ও তো যাদিদ ভাইয়া আর বিয়ের শপিং নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত। কথা কম হয়েছে।”
“যাই হোক এখন বলো তো নেবে কিনা তোমার সাথে?”
“কিন্তু সাহিল ভাইয়া তো আমাকে ট্রেনে তুলে দেবে। একসাথে কী করে যাবো?”
“সমস্যা কী সেদিন তো সাহিল ভাইয়া তোমাকে হসপিটাল থেকে আমার সাথে বাসায় পাঠালো।”
“হসপিটাল থেকে বাসায় পাঠানো আর ঢাকা থেকে খুলনা পাঠানো এক না।”
“আচ্ছা তাহলে আলাদা আলাদা যাবো। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর একসাথে হবো। যদি শুধুমাত্র তোমার আপত্তি না থাকে। বাকীসব আমি ম্যানেজ করে নেবো।”
আরশির এতো জোরে হার্টবিট হচ্ছে যে মনে হচ্ছে কান ফেটে যাবে। কাব্য সব টের পেয়ে যাচ্ছে না তো? পালাতে হবে এক্ষুণি এখান থেকে পালাতে হবে। আরশি বললো,
“ঠিকাছে। টিকেট দেখে ট্রেনের ডিটেইলস আমি আপনাকে জানিয়ে দেবো।”
একথা বলে আরশি চলে যাচ্ছিলো। কাব্য থামালো,
“আরশি..”
আরশি দাঁড়ালো। কাব্য বললো,
“এক্ষুণি দিও। তোমার সাথে তো আর সিট পাব না আমি বরং ওই ট্রেনেই দুটো টিকেট কেটে ফেলি। এসি স্লিপার নিব?”
“আপনার টিকেট করতে হবে না। ভাইয়া পুরো একটা কেবিন নিয়েছে আমার জন্য। একা যেতে হবে যেহেতু অপরিচিত মানুষদের মধ্যে যাওয়া আমার কর্ম নয়।”
“একটা কেবিন মানে চারটা টিকেট করেছে ভাইয়া? এই টাকায় তুমি প্লেনে যেতে পারতে।”
“আমি ট্রেন জার্নিটা খুব উপভোগ করি তাই।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরশি চলে যাচ্ছিলো। পেছন পেছন কাব্য। সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই কাব্য আবার ডাকলো,
“আরশি..”
আরশি ঘুরে তাকালো৷ কাব্য বললো,
“চা খাবে? আমার বানানো?”
আরশি হুট করেই কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কাব্যরও তাড়া নেই, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে উত্তরের জন্য। আরশির খুব ইচ্ছে করছে কাব্যর হাতের চা খেতে, কাব্যর কোনো বই নিয়ে এসে তার বুকমার্কের লেখাগুলো শতশতবার পড়তে! আরো বেশি ইচ্ছে হয় কাব্যর সামনে অনন্তকাল থাকতে, ইচ্ছে হয়ে কাব্যর বাসায় যেতে, কাব্যর ব্যবহৃত সবকিছু ঘেঁটেঘুঁটে দেখতে। কেন এসব অসভ্য ইচ্ছেগুলো হয় আরশির? আরশি কিছু বললো না, চুপচাপ কাব্যর ফ্ল্যাটে ঢুকলো৷ কাব্য সদর দরজা খোলাই রাখলো। আরশির ব্যাপারটা ভালো লাগলো। কাব্য বললো,
“তুমি বসো। আমি চট করেই চা টা বানিয়ে আনি।”
কাব্য রান্নাঘরে চলে গেলো। আরশি আশেপাশে সবকিছু দেখতে দেখতেই হঠাৎ অ্যাস্ট্রেতে চোখ পড়লো। আরশি অবাক হয়ে দেখলো মাত্র একটা ফিল্টার! অথচ আগের যেদিন এসেছিলো এই সময়েই এসেছিলো এবং অ্যাস্ট্রেতে ভর্তি সিগারেটের ফিল্টার দেখেছিলো। হঠাৎ আরশি খেয়াল করলো আজ কাব্যর গা থেকে আগের মতো উৎকট সিগারেটের গন্ধ আসছে না। ঘরেও তেমন সিগারেটের গন্ধ নেই। সে কি তবে সিগারেট খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে? যে ছেলে ওই হারে সিগারেট খায় তার পক্ষে কি সিগারেট খাওয়া কমানো সম্ভব? সিগারেটের প্যাকেটটা সেন্টার টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে। আরশি প্যাকেট টা খুললো। প্যাকেট ভর্তি সিগারেট! ঠিক তখন শুনতে পেলো কাব্য বলছে,
“সিগারেট খাবে?”
কাব্য চা নিয়ে ঢুকছিলো। ঢুকেই আরশিকে সিগারেটের প্যাকেট খুলে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাব্য একথা জিজ্ঞেস করলো। আরশি লজ্জা পেয়ে হেসে বললো,
“না না।”
আরশি প্যাকেট টা আবার রেখে দিলো। কাব্য আরশির মুখোমুখি বসতে বসতে বললো,
“এইতো হাসলে সুন্দর লাগে। হাসোনা কেন তুমি?”
একথায় আবার আরশির মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর মুখ করে উঠে বুকশেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাব্য বুঝলো এসব প্রশ্ন এত দ্রুতই করা যাবে না। চায়ের কাপ নিয়ে আরশির কাছে গিয়ে বললো,
“চা নাও।”
আরশি চা নিতে নিতে কাব্য টপিক চেঞ্জ করার জন্য জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা তিরার রেজাল্টের খবর কী?”
“ও তো মেডিকেলে পরীক্ষা দেয়নি।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরশি চায়ে চুমুক দিয়েই বললো,
“আমার মতো করে বানিয়েছেন?”
“চেষ্টা করেছি, কতদূর হয়েছে বলতে পারছিনা।”
“অনেকটাই হয়েছে নাহলে তো একথা বলতে পারতাম না যে আমার মতো করে বানিয়েছেন।”
কাব্য হাসলো। আরশি চা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই দোতলার বেল বাজলো। দরজার সামনে গিয়ে দেখে গেটের বাইরে বুয়া দাঁড়িয়ে। আরশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজ আসি। এই বুয়া চাচ্চু ফুপি সবার বাসায় কাজ করে। আমাকে এখানে দেখলে গল্প বানিয়ে ফেলবে।”
কাব্য কিছু বলার আগেই আরশি দোতলায় চলে গেলো গেটের চাবি আনতে। কাব্য বিড়বিড় করে বললো,
“শালার বুয়া আসার আর সময় পেলো না!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here