কনফিউশন পর্ব ৪৮ (শেষপর্ব)
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
আরশিকে লাল বেনারসি শাড়ি পরানো হয়েছে। পার্লার থেকে লোক এনে সাজানো হয়েছে। আরশি আজ কিছুতেই নিষেধ করেনি। খুব কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন নিয়ে আকদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজিন ও বাচ্চাকাচ্চারা আরশিকে ঘিরে রেখেছে। তিরা হা করে চেয়ে থেকে একসময় বলল,
“আরু তোকে আজকে যা সুন্দর লাগছে! উফফফ আমারই মনে হচ্ছে টুক করে গিলে খেয়ে ফেলি। হা হা হা।”
কাজিনরা সবাই তিরার কথায় হাসল কিন্তু আরশি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইলো। রশ্নি ঘরে ঢুকে বলল,
“সবাই একটু ঘরটা খালি করো। আরশিকে সাজানোর জন্য এই ঘরটাই সবচেয়ে এলোমেলো হয়ে আছে, গোছাতে হবে। সময় নেই একদম।”
সবাই বেরিয়ে গেল। কিন্তু আমরিন আর তিরার মেয়ে যোহা এখনো বসে আছে। দুজন আরশির দুইপাশে। রশ্নি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা তোমরাও এসো। আমার ঘরে গিয়ে খেলো।”
আমরিন বলল,
“আমি ফুপ্পির কাছে থাকতে চাই।”
যোহাও আমরিনের দেখাদেখি বলল,
“আমি খালামনির কাছে থাকতে চাই।”
“ঘরটা গোছানো হলে আবার এসো। এখন যাও প্লিজ।”
আমরিন ও যোহা বের হয়ে যেতেই রশ্নি বলল,
“তিরা তোকে কি আলাদা করে বলতে হবে?”
তিরা রশ্নির কাছে গিয়ে বলল,
“ভাবি, ও ভাবি আরুর কাছে আরেকটু থাকতে দাওনা। আমি এই ঘর একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে দেব।”
রশ্নি হেসে বলল,
“তুই গোছাবি ঘর?”
“এহ পাত্তা দিচ্ছ না যে? আমি এখন সব কাজ সুন্দর করে করতে পারি।”
“ঠিকাছে দেখি কেমন পারিস। আধা ঘন্টা সময় দিলাম। ছেলেপক্ষ কিন্তু আধা ঘন্টার মধ্যে এসে পড়বে।”
“আরে বাবা আধা ঘন্টা লাগবেও না।”
রশ্নি তিরাকে ঘর গোছানোর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল। তিরা সব গোছাতে গোছাতেই হাজার রকমের কথা বলে যাচ্ছে। কোনোটাই আরশির কর্ণপাত হচ্ছে না। সব গোছানো শেষ করতে না করতেই ছেলেপক্ষ চলে এলো। তিরা দৌড়ে গেল বর দেখার জন্য। বর দেখে এসে আরশিকে বলল,
“আরু তোর বরকে দেখে আমার মাথা ঘুরে গেছে। যদি আমি আগের তিরা হতাম ঠিক ক্রাশ খেয়ে ফেলতাম। এত্ত হ্যান্ডসাম। গায়ের রঙ একটু শ্যামলা কিন্তু হার্টবিট থেমে যাওয়ার মত জোশ দেখতে।”
আরশি হঠাৎ করেই বলল,
“তিরা আমি কাব্যকে ভালোবাসি।”
তিরা এ কথা শুনে এত অবাক হলো যে ওর চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। তারপর বিস্ময় কেটে গেলে হেসে বলল,
“সত্যি? তাহলে এই বিয়ে করছিস কেন? কাব্য আরো বেশি জোশ। কালো হইছে তো কী হইছে?”
“কারণ কাব্য আমাকে ভালোবাসেনা।”
“তুই বলেছিলি কাব্যকে?”
কাব্যর সাথে সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা সংক্ষেপে তিরাকে বলল আরশি। সব শুনে তিরা বলল,
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কাব্য এরকম।”
আরশি আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। রশ্নি ইভেন্টের লোকজনকে বাসর ঘর সাজানোর জন্য আরশির ঘরে নিয়ে এলো। আরশি ফুল এবং তাদেরকে দেখে শান্ত গলায় বলল,
“একটা ফুল যদি কেউ আমার ঘরে লাগায় তাহলে পুরো ঘর জ্বালিয়ে দেব।”
রশ্নি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে লোকজন নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এই ভয়াবহ রাতটা কাটতে চাচ্ছে না কাব্যর। যেখানে তার এমন সময় ঢাকায় থাকার কথা সেখানে সে এখনো বসে আছে কলম্বোতে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। ব্লাড প্রেশার বেড়ে ঘাড়ের রগ ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম।
আরশির বারান্দায় দুটো গদি বসানো নিচু চেয়ার পাতা আছে। সেখানে পাশাপাশি বসে আছে আনন্দ-আরশি। কিছুক্ষণ আগেই তাদের বিয়ে পড়ানো হয়েছে। আনন্দই প্রথমে কথা শুরু করল,
“তুমি বিয়ের আগে কথা বলতে চাচ্ছিলে না কেন?”
আরশি আনন্দের দিকে না তাকিয়ে যেভাবে বসে ছিল সেভাবে বসে থেকেই বলল,
“কথা বলে তারপর বিয়ে ভেঙে গেলে কথা বলাটাই বৃথা যেত৷ তারচেয়ে বিয়ের পরে কথা বলাই ভাল।”
এ কথায় আনন্দ হেসে ফেলল। বলল,
“এটা অবশ্য ঠিকই বলেছ। তবে আমি শুনেছি বিয়ের আগে তুমি আমার ছবিও দেখোনি। এমনটা তো আসলে এ যুগে হয়না তাইনা?”
আরশি এবার মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একবার ছবি দেখেই কি একটা মানুষকে বোঝা যায়? শুধু ছবি দেখার কথাই বা বলছি কেন? অনেক বছর একসাথে পথচলার পরেও মানুষকে বোঝা যায় না।”
“এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন দেখো। একবার তাকাও আমার দিকে। আমাকেও একটু দেখার সুযোগ দাও। তোমার ছবি দেখার পর থেকে অতৃপ্ত এই চোখ দুটো অপেক্ষা করছিল আজকের দিনটির জন্য।”
আরশি মাথা ঘুরিয়ে তাকালো আনন্দের দিকে। সরাসরি চোখের দিকে তাকালো। এবং অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করল কাব্যর চোখের দিকে তাকালে যে অস্থিরতা কাজ করতো, লজ্জা লাগতো, দম আটকে আসতো; সেসবের কিছুই হচ্ছেনা এখন। অথচ আনন্দও একটা পুরুষ এবং তার স্বামী। কেন একটা মিথ্যে মানুষের জন্য তার এত অনুভূতি হয়েছিল?
“পছন্দ হয়েছে?”
আরশির চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“কারো সাথে থাকার জন্য তার বাহ্যিক রূপটা জরুরি নয় আমার কাছে।”
“তাহলে কী জরুরি তোমার কাছে?”
আরশি আনন্দের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসা।”
আনন্দ মুচকি হেসে বলল,
“মাথায় রাখলাম।”
এরপর আনন্দ হাত ধরতে যেতেই আরশি হাতটা সরিয়ে নিল। আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে কিছুদিন সময় দিন প্লিজ? এভাবে হুট করেই বিয়ে হয়ে গেল! আমরা একেবারেই অপরিচিত। আমার সময় দরকার।”
আনন্দ হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে হাসিমুখে বলল,
“কোনো সমস্যা নেই। তোমার যত সময় দরকার তুমি নিতে পারো। আসলে আমি বিয়ের ব্যাপারে অতটা আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু সামনে আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে। বড়মা আবার আমাকে বিয়ে না দিয়ে ওকে দেবেনা। সেজন্য আমাদের একটু তাড়া ছিল৷ কিন্তু এত না। সাহিল ভাইয়া এখনই চাইল বিধায় এখনই বিয়ে করতে হলো। একটু চেনা জানার সময় পেলে আসলেই ভাল হতো।”
আরশি প্রসঙ্গ পালটালো,
“আপনি কোথায় থাকেন?”
“ব্যবসার জন্য যখন যেখানে প্রয়োজন। তুমি কি ঢাকায় থাকতে চাও?”
“আমি ইন্টার্নশিপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঢাকাতেই থাকতে চাই। এরপর আপনার ইচ্ছে।”
“ইন্টার্নশিপ পর্যন্ত তাহলে ঢাকায় একটা বাসা নিই। কিন্তু এরপর আমারা আমার ফ্যামিলির সাথেই থাকতে চাই। এটা অনুরোধ তোমার কাছে।”
“অনুরোধ করতে হবে না, আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে ঢাকায় বাসা নেয়ার দরকার নেই। ইন্টার্নশিপের একয়দিন আমি এখানেই থাকতে পারব।”
“কিন্তু এখানে আমি কী করে থাকব?”
“কেন আপনার বাসা যদি আমার বাসা হতে পারে। তাহলে আমার বাসা আপনার বাসা হতে পারবে না কেন?”
আনন্দ হেসে বলল,
“তবুও পুরুষ মানুষের পক্ষে এভাবে কন্টিনিউয়াসলি শ্বশুরবাড়িতে থাকা যায় না। মাঝেমাঝে আসতে পারি।”
“তাহলে এই কয় মাস এভাবেই ম্যানেজ করে নিন।”
“ঠিকাছে।”
“আমার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। অনুমতি দিলে আমি ঘুমুতে যেতে চাই।”
আনন্দ হাসিমুখে বলল,
“শিওর।”
আরশি চলে যাওয়ার পর আনন্দ একা একাই হাসলো। মুগ্ধ হয়ে ভাবতে লাগলো, মেয়েটি খুব অদ্ভুত, সব মেয়েদের থেকে আলাদা। প্রতিটি কথায় অন্যরকম একটা জোর, যুক্তি এবং আত্মবিশ্বাস। ছবি দেখে যেমন ভোলাভালা মনে হয়েছিল, একদম সেরকম না। বরং প্রচন্ড বুদ্ধিমতী। কি সুন্দর করে সে কি চায় প্রথমেই টেকনিক্যালি বুঝিয়ে দিল। শুধুমাত্র সাহিল ভাইয়ার বোন এবং যথেষ্ট সুন্দরী বলেই বিয়েতে রাজী হয়েছিল। এরকম কাউকে পেয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। এরকম কাউকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!
আরশি কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে যখন শুতে যাবে তখন সিগারেটের গন্ধ পেয়ে বারান্দায় তাকালো। জানালা দিয়ে দেখতে পেল আনন্দ সিগারেট খাচ্ছে। বলল,
“আপনি সিগারেট খান?”
আনন্দও মাথা ঘুরিয়ে বারান্দায় তাকালো। বলল,
“হ্যাঁ। কোনো সমস্যা?”
“গন্ধটা সহ্য হয়না।”
“সরি তোমার সামনে তাহলে আর খাবো না। এটা শেষ করি?”
“করুন। গুড নাইট।”
“গুড নাইট।”
সকালবেলা আরশি শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। একটা সালোয়ার কামিজ পরে তৈরি হতেই শাশুড়ি বলল,
“একি মা এভাবে যাবে?”
আরশি বলল,
“হ্যাঁ।”
“কষ্ট করে বিয়ের শাড়ি আর গয়নাগুলো পরো মা। সাথে হালকা সাজগোজ করো। আমাদের অনেক বড় ফ্যামিলি তো। ভাসুর, দেবর, ননদ একই বিল্ডিং এর বিভিন্ন ফ্লোরে সবাই থাকি। সবাই অপেক্ষা করছে তোমাকে দেখার জন্য। বোঝোই তো মফস্বলের মানুষজন একটু অন্যরকম হয়৷”
“কিন্তু শাড়ি পড়ে এতটা পথ জার্নি করব কীভাবে?”
“আমরা ফ্লাইটে যাচ্ছি। মাত্র এক ঘন্টার তো ব্যাপার। একটু কষ্ট করো মা।”
“ঠিকাছে।”
তিরা আরশিকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিল। আরশি পাথরের মত বসে রইলো। সাজগোজ শেষ হতেই শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
এয়ারপোর্ট থেকে কাব্য সোজা আরশিদের বাড়িতে এলো। মেইন গেট খোলাই ছিল যা কখনো খোলা থাকেনা। বাগানে অনেক লোকজন দেখা যাচ্ছে। ভেতরে ঢুকে সোজা দোতলায় চলে গেল সে। বেল বাজাতেই তিরা এসে দরজা খুললো। তিরা কাব্যকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কাব্য অস্থির গলায় বলল,
“তিরা আরশিকে একটু ডেকে দাওনা। বলো আমি এসেছি।”
আত্মীয়স্বজনে বাসা ভরে আছে। তাই তিরা কাব্যকে টেনে ছাদে নিয়ে গেল। তারপর বলল,
“কেন এসেছ? ৬ বছর অপেক্ষা করিয়ে বলেই তো দিয়েছ ভালোবাসোনা।”
“তুমি জানো সব?”
“গতকাল সন্ধ্যায় আরশি সব বলেছে।”
“লিসেন আরশি জানে আমি ৪/৫ মাস পর আসব। কিন্তু আমার ফ্লাইট ছিল ১৫ দিন পরে। এসে ওকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। এতদিন ওকে ভালোবাসার কথা বলিনি কারণ সামনাসামনি বলতে চেয়েছিলাম। ও হঠাৎ বিয়ের কথা বলায় ঘাবড়ে গিয়ে ওসব বলেছি। ভেবেছিলাম পরদিনের কোনো ফ্লাইটে টিকিট ম্যানেজ করে চলে আসব। কিন্তু টিকিট না পাওয়ায় সাথে সাথেই ওকে কল করেছি সব বলে দেয়ার জন্য। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই ও ফোন টোন বন্ধ করে অস্থির করে ফেলেছে। যাই হোক, ওকে একটু ডেকে দাও প্লিজ।”
“অনেক বড় সর্বনাশ করে ফেলেছ কাব্য। গতকাল রাতে আরশির বিয়ে হয়ে গেছে। একটু আগে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে।”
কাব্য বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো তিরার দিকে। কাব্য বলল,
“তিনদিনের মধ্যে বিয়ে করে নিলো?”
“তুমি যা বলেছ তাতে এছাড়া আর কী করতো ও? অনেক বড় ভুল করে ফেলেছো কাব্য। সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমার বোনটাকে সারাজীবনের কান্না উপহার দিয়েছ তুমি।”
তিরা আরো অনেককিছুই বলছিল। কোনো কথাই কানে যাচ্ছিল না কাব্যর। আরশি এই সামান্য কারণে তিনদিনের মধ্যে বিয়ে করে ফেলবে এটা অসম্ভব। এটা কিছুতেই বিশ্বাস করেনা সে। বলল,
“সাহিল ভাইয়াকে ডেকে দাও।”
“সাহিল ভাইয়া আর রশ্নি ভাবি আরশিকে এয়ারপোর্টে দিতে গেছে।”
“সাহিল ভাইয়ার ফোন নাম্বার দাও তাহলে।”
“এখন আর ঝামেলা করোনা কাব্য। বিয়ে তো হয়েই গেছে।”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা নীচে চলে গেল। এরপর সামনের চায়ের দোকানে গেল। সে নিশ্চয়ই কিছু জানবে। দোকানদার কাব্যকে দেখেই বলল,
“আরে ভাই আপনে এতদিন পর কইত্থে আইলেন? বিদেশ না গেছিলেন?”
“চলে এসেছি।”
“ও আরশি আফার বিয়া খাইতে আইছিলেন?”
চমকে গেল কাব্য। তার মানে তিরা সত্যি কথাই বলেছে? বলল,
“আরশির সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি ঠিক জানো?”
“হ ভাই। কাইলকা রাইতে বিয়া হইল তো। ভাই চা দিমু?”
“না আরেকদিন।”
কাব্য ফুটপাত ধরে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছে, চোখে পানি। বুকের ভেতর সবটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আরশি বিয়ে করে ফেলেছে। মাত্র ৩ দিনের মধ্যে একটা মানুষের বিয়ে কী করে হয়? যে মেয়েটি অনেক বড় কিছু হয়ে গেলেও রাগ করেনা সেই মেয়েটি এইটুকু কথায় রাগ করলো! কথাটা কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করল না? এইটুকু বিশ্বাস আরশির নেই ওর উপর? এই চিনলো আরশি ওকে?
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কাব্যর সেই স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। লাল শাড়ি পরা আরশির হাত ধরে বনের মধ্যে হাঁটছিল। হঠাৎ সে গর্তে পড়ে গেল। এই তাহলে সেই গর্ত? মৃত্যুগর্ত! লাল শাড়ি পরে আরশি চলে গেল অন্যকারো জীবনে আর সে পড়ে রইল এই মৃত্যুগর্তে। কাব্য হাঁটছে তো হাঁটছেই৷ তার দুটিচোখ থেকে অঝর ধারায় অশ্রু বইছে। এই মেয়েটিকে ছাড়া সে বাঁঁচবে কীভাবে?
মাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কাব্য বাসায়ও জানায়নি যে দেশে আসছে। মা নিশ্চয়ই ফোন করেছিলেন। অনলাইনেও তো ঢোকেনি এতদিন। কোনো খবর না পেয়ে নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন। এবার কক্সবাজারের ফ্লাইট ধরলো কাব্য। ফ্লাইটে একটু পর পরই সে কাঁদছিল। কখনো আবার সিগারেটের প্যাকেট হাতে ধরে পাগলের মত একা একাই বিড়বিড় করছিল। একবার ফিসিফিস করে বলল,
“কীরে তুই তো খুব খুশি হয়েছিস তাইনা? শেষ মেশ তোর সতীন চলে গেল, তোরই জিত হলো। অথচ দেখ গত তিনটা বছর তোকে ছুঁইনি যাকে ছোঁব বলে সে জানতেও পারল না তোকে যে তার জন্য একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলাম! মা যে শাড়ি গয়নাগুলো কিনেছিল আমাদের বউয়ের জন্য সেগুলোর কী হবে বলতো? তুই তো আর সেগুলো পরতে পারবিনা।”
এ কথা বলে আবার কাব্য একা একাই হাসছিল।
কাব্য বাসার কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শাহনাজ বেগম পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। তিনিই এসে দরজা খুললেন। কাব্যকে দেখেই তিনি খুশিতে কাব্যর নাম ধরে চিৎকার করে কেঁদে ফেললেন। কাব্য মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা আমার লক্ষী মা। কেমন আছো?”
“তোর কোনো খবর না পেয়ে চিন্তায় আমি শেষ। ফ্লাইটে ছিলি তাইনা?”
“হ্যাঁ মা।”
মাকে এতক্ষণ জড়িয়ে ধরেই কথা বলছিল কাব্য। এবার ছাড়তেই আরশিকে ড্রয়িং রুমে বসা দেখতে পেল বউবেশে। এবার কাব্যর পুরো দুনিয়া ঘুরতে লাগলো। এবাড়িতে একমাত্র সে ছাড়া বিবাহযোগ্য আছে বড়ভাই। আরশির কি বাই এনি চান্স বড়ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে?
অন্যদিকে আরশিরও পা টলছে। মাথা ঘুরছে। আনন্দর বড়মাকে কাব্য মা বলছে শুনেই আরশি বুঝে গিয়েছে কাব্য আনন্দর চাচাতো ভাই। ছোটবেলায় আনন্দর মা মারা যায়। তারপর বাবাও। শাহনাজ বেগম নিজের ছেলের মত আগলে বড় করেছেন আনন্দকে। এই ফ্যামিলির সাথেই একসাথে থাকার কথা বলছিল আনন্দ। কাব্যর চোখের সামনে কী করে থাকবে সে? কাব্যর ফ্যামিলির অনন্তকে ছাড়া আর কাউকে চেনেনা আরশি। অথচ গতকাল অনন্তকে বিয়েতে দেখে আরশি ভেবেছে সাহিলের অন্য বন্ধুদের মত বন্ধু হিসেবে সে এসেছে। একবারো এটা মাথায় আসেনি অনন্তর ফ্যামিলির কারো সাথেও তার বিয়ে হতে পারে।
কাব্যকে দেখে এগিয়ে এলো আনন্দ। কাব্য বলল,
“আমাকে রেখেই বিয়ে করে ফেললি বড়ভাই?”
আনন্দ কাব্যকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার দোষ না ভাই। আমরা সবাই তোর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তোর ফোন আনরিচেবল ছিল। হোয়াটসঅ্যাপ করেছি, মেইল করেছি। এখন বুঝছি তুই হয়তো তখন ফ্লাইটে ছিলি। বড়চাচ্চু, বড়মা আর সাহিল ভাইয়ার গরজে এরকম হুট করেই বিয়ে হয়ে গেল। এমনকি গতকাল সকালেও শিওর ছিলাম না কালই বিয়ে হচ্ছে।”
কাব্যও জড়িয়ে ধরল। ছাড়তেই আনন্দ বলল,
“মন খারাপ করিস না। বিয়ে মিস করলেও রিসিপশন তো বাকী। আমার টেকনাফের রিসোর্টে গ্রান্ড রিসিপশন হবে। অনেক মজা করব আমরা।”
আনন্দ কাব্যকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে যেতে যেতে বলল, “চল ভাবির সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”
কাব্য হেসে বলল,
“আরশিকে আমি চিনি বড়ভাই। সাহিল ভাইয়ার বোন। পাঁচ বছর আগে ঢাকায় ওদের বাসাতেই এক বছর ছিলাম।”
আনন্দ বলল,
“তাই নাকি?”
শাহনাজ বললেন,
“হ্যাঁ তাইতো, আমি একদম ভুলেই গিয়েছিলাম।”
আরশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে শক্ত মুখে বলল,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
কাব্য হেসে বলল,
“আমাকে ভাইয়া বলতে হবেনা আরশি। আমি তোমার ভাসুর নই, দেবর। এনিওয়ে কংগ্রাচুলেশনস।”
“থ্যাংকস।”
শাহনাজ কাব্যকে বললেন,
“বাবা তোকে অনেক অসুস্থ দেখাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে কিছু মুখে দিয়ে একটা ঘুম দে।”
“হ্যাঁ মা যাচ্ছি।”
“ওহ আরেকটা কথা।”
“বলো মা।”
“তুই বিয়ের প্রস্তুতি নিতে বলায় তোর বউয়ের জন্য যেসব শাড়ি গয়না কিনেছিলাম তাড়াহুড়োয় বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে ওগুলোই আরশিকে দিয়ে দিয়েছি। কিছুদিনের মধ্যেই তোর জন্য আবার কিনে ফেলব।”
কাব্য হেসে বলল,
“খুব ভাল করেছ মা। জিনিসগুলো ভালো কাজে লেগেছে। ওসব আমার আর লাগবে না। ব্রেকাপ হয়ে গেছে।”
“মানে! এতদিন পর একি বলছিস তুই?”
অবাক হলেন শাহনাজ বেগম। আনন্দও অবাক হয়ে বলল,
“যে মেয়ের জন্য সুইডেন যাওয়ার আগের দিন মাঝরাতে দেয়াল টপকে যেতে পারিস তুই তার সাথে ব্রেকাপ হয় কী করে?”
কাব্য হেসে কপালে আঙুলের দাগ টেনে বলল,
“এখানে লেখা থাকলে সব হয়। বাদ দে এসব।”
কাব্য নিজের ঘরের দিকে যেতেই আরশি শাহনাজকে বলল,
“বড়মা আর কোনো আত্মীয় কি এখন আসবে? নাহলে আমি শাওয়ার নিতে যেতাম।”
“না মা তুমি যাও। সবাই তো দেখা করে গেছে। এখন আর কেউ আসলে যেমন থাকবে তেমনই দেখা করবে।”
আরশি ঘরে গিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
নিজের ঘরের সামনে গিয়ে কাব্যর অনন্তর সাথে দেখা হয়ে গেল। কাব্যকে দেখে জড়িয়ে ধরে অনন্ত বলল,
“আরে তুই! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! কেমন আছিস?”
“ভাল ভাইয়া। তুই কেমন আছিস?”
“ভাল। আচ্ছা সাহিলের নাম্বার পরশু রাতে মেসেজ করে দিয়েছিলাম, পেয়েছিস তো?”
“পরশু রাতে আমি ফ্লাইটে ছিলাম। তুই না বললি সাহিল ভাইয়ার নাম্বার তোর কাছে নেই?”
“আরে ও কিছুদিন আগে নাম্বার চেঞ্জ করেছিল, নতুন নাম্বারটা মেসেজে দিয়েছিল। সেভ করা হয়নি। ভুলে গিয়েছিলাম।”
“আমাকে জ্যান্তই কবর দিয়ে ফেলেছিস। কেয়ারলেস কোথাকার।”
কাব্যর কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না অনন্ত। কাব্য ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। দুহাত নিজের কোমরে রেখে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরশিকে লাল শাড়ি পরা দেখাতে খুব ইচ্ছে হতো কাব্যর। আরশি রঙ সহ্য করতে পারেনা বলে কখনো সেই ইচ্ছের কথা বলার সাহসও হয়নি। আজ লাল শাড়ি, লাল লিপস্টিকে একদম বউ সাজে দেখল। আল্লাহ কত সুন্দর করে তার ইচ্ছে পূরণ করল। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো কাব্য। চোখের জল কোনোভাবেই বাঁধ মানছে না।
মানুষের জীবন বড় অদ্ভুত গতিতে চলে। এর গতিপথ কখন কোনদিকে মোড় নেবে কেউ জানেনা। কারো ছোট একটি ভুল, কিছু মিথ্যে কিংবা কারো একটুখানি রাগ হতে পারে দুটি মানুষের হাজারও দীর্ঘশ্বাস ও চোখের জলের কারণ!
সমাপ্ত!