#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ১৩

0
426

#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ১৩
#রোকসানা_রাহমান

” আমাকে দেখার জন্য কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই, রাগিসাহেবা। দূর থেকে অসুবিধা হলে কাছে এসে দেখতে পার। চোখে চোখ রেখে। হাত ছুঁয়ে, কাঁধে মাথা ফেলে। এত কষ্ট করে লুকিয়ে দেখতে হবে না। ”

অমিতের এমন কথায় আমি লজ্জা পেলাম। বারান্দার পাশের জানালার পর্দা ছেড়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে হাসলাম।

অমিতের পাঠানো লোকটি ঠিকঠাক কাজ করতে পেরেছে মনে হয়। সেজন্য অফিস যাচ্ছে না। ছুটি কাটাচ্ছে। সুযোগ পেলেই এটা-সেটা পরিষ্কার করছে। বিকেলে দেখলাম ছাদে পানি ঢেলে ঝাড়ু দিচ্ছে। আর এখন বারান্দার গ্রিল। সব কিছুতেই তার দাগমুক্ত হওয়া চাই!

নিজেকে ধাতস্থ করতে প্রায় মিনিট পেরুল। পিলপিল পায়ে বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
” কাঁধে মাথা ফেলেও দেখা যায়? ”

অমিত হাতের টুকরো কাপড়টা মগের পানিতে চুবালেন। মগটা গ্রিলের সাথে আটকে রেখে বললেন,
” অবশ্যই দেখা যায়। ”
” কিভাবে? ”
” এদিকে এসো দেখাচ্ছি। ”

তার ডাকে আমি এগিয়ে গেলাম। সামান্য দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালে তিনি বললেন,
” এত দূর থেকে কাঁধে মাথা রাখতে পারবে? ”
” কাঁধে মাথা রাখতে হবে? ”
” হ্যাঁ, নাহলে দেখাব কিভাবে? ”

আমি এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম,
” দেখানো লাগবে না। ”

অমিতও আর জোর করলেন না। নিজের কাজে মন দিলেন। আমি নীরব দাঁড়িয়ে থাকলাম তার পাশে। আড়চোখে তাকালাম সময়ে সময়ে। তার ব্যস্ত হাত দুখানা ভারি লোভণীয় ঠেকল। ছুঁয়ে দেওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা! স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে থাকায় কাঁধটা উন্মুক্ত হয়ে আছে। সন্ধ্যার ঈষৎ অন্ধকারেও কেমন মায়া। টানছে যেন খুব। মনে হচ্ছে মাথা ফেললেই সকল ক্লান্ত, অবসাদ, দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। মেলামেশা সহজ হয়ে যাবে নিমেষেই।

” তুমি কি আরও কিছুক্ষণ থাকবে? ”

অমিতের কণ্ঠস্বরে আমার ঘোর কাটল। কোনো রকম উত্তর না দিয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরলাম। তিনি পিছু ধরে বললেন,
” আমার কোনো তাড়া নেই। তুমি সময় নেও। ”

আমি থেমে গেলাম। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম। কোন ব্যাপারে কথাগুলো বলছেন বুঝার চেষ্টা করছিলাম। তখনই বললেন,
” মানিয়ে নিতে বলব না। শুধু বলব গুছিয়ে নেও। নিজের মতো চারপাশটা সাজিয়ে নেও। পরিস্থিতি হয়তো আমাদের কাছে আনবে। কিন্তু ভালোবাসা? সে তো আধ্যাত্মিক ব্যাপার। কখন, কেন, কিভাবে হয়ে যাবে বুঝতেই পারবে না। ”
অমিত আমাকে পাশ কাটিয়ে সামনে আসলেন। রুম থেকে বের হওয়ার আগে বললেন,
” এই যেমন আমি বুঝতে পারছি না! ছবিতে দেখে মনে হয়েছিল, তোমার মায়াভরা মুখটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সামনাসামনি দেখে মনে হলো তোমার পা’দুটোকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর এখন মনে হচ্ছে, তোমার দ্বিধাভরা মনটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ”

অমিত বেরিয়ে যেতেই আমার দ্বিধাভরা চোখদুটো বিস্ময়ে রূপ নিল। মনের সাথে মনের যুদ্ধ বাঁধল। এই যুদ্ধেই আমার মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটল। দ্বিধা কাটতে লাগল ক্ষণে ক্ষণে। চারপাশটা সাজিয়ে নিতে পারছিলাম নাকি জানি না। কিন্তু কোনো বাহানা ছাড়াই তার মুখোমুখি হয়ে শুতে পারলাম। ঘুম না আসলে বলতে পারলাম। গল্প করার ইচ্ছেপোষণ করতে পারলাম। আরও কয়েক রাত্রির চেষ্টায় কফি বানানো শিখলাম। দুপুরে কী রান্না হবে, রাতে কী রান্না হবে এ বিষয়ে শাশুড়ি মায়ের সাথে আলাপ করতে পারলাম। আপুর সাথে তার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কতগুলো বিকেল পার করলাম। অমিতের রুম গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত রাখলাম। বাইরে বেরুতে ইচ্ছে হলেই কল করে জানিয়ে দিলাম আজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে। রিকশায় করে গোধূলিতে মনোরঞ্জন করলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা ফেলাম। পার্কে বসে আইসক্রিম খেলাম। শপিংমল থেকে কেনাকাটা করলাম। পুরো পরিবার নিয়ে একবার বনভোজনও সেরে ফেললাম। এই গুছিয়ে নেওয়া, সাজিয়ে নেওয়ার মধ্যেই আমার মানিয়ে নেওয়াও হয়ে গেল। যা আমি টের পেলাম না। একদমই না। এবার আমি অপেক্ষা করছিলাম কাছে চলে আসার, ভালোবাসা হয়ে যাওয়ার। অপেক্ষারত এক বিকেলে আমি অমিতের ব্যবহৃত এটা-সেটা গুছাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি খাম পেলাম লাল রঙের। রঙটা চোখে লাগতেই আমার বুকটা ধক করে উঠল! মনে পড়ল প্রায় এক বছর আগের একটি দিনের কথা। সেদিন তিন্নি আমায় খুব বিরক্ত করেছিল। কোন এক ছেলের খুব প্রশংসা করতে করতে জানাল, তার প্রেমে পড়েছে। মনের কথা জানাতে না পেরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছে না। আর এই মনের কথা সরাসরিও জানানো যাবে না। কারণ, ছেলেটি তার পরিচিত। তাই চিঠি-পত্রের সাহায্য নিতে চাচ্ছে। আর এই চিঠি লেখায় আমাকে সহায়তা করতে হবে। নাহলে বাড়ি ফিরতে দিবে না। তার জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হয়ে সঙ্গ দিয়েছিলাম। প্রেমপত্র লেখায় কোনো সাহায্য না করে উল্টো বুঝাতে চাচ্ছিলাম ছেলেরা কতটা খারাপ। সে বিশ্বাস করল না। আমার পরামর্শ আমলে নিল না। লাল রঙের খামে নিজের প্রেমপত্র ঢুকিয়ে জানাল, এটা সে আজই দেবে। আর উত্তর নিয়ে তারপরেই ক্যাম্পাসে আসবে। তারপর দুইদিন ক্লাসে আসেনি তিন্নি। আমি ধরে নিয়েছিলাম ছেলেটি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু না। তিনদিনের দিন এসে জানাল, ছেলেটি নাকি আগে থেকেই তাকে পছন্দ করত। কিন্তু ভয়ে বলতে পারেনি। তিন্নির কাছ থেকে প্রেমপত্র পেয়েই দুজন আলাদাভাবে দেখা করেছে।

আমি অতীত থেকে বের হয়ে খামটি ভালো করে পরখ করলাম। তিন্নির প্রেমপত্র অমিতের কাছে এটা আমার বিশ্বাস হলো না। তাই খুলে দেখলাম। ভেতরে সেই পরিচিত লেখা দেখে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্য অমিতের পাশে তিন্নিকে কল্পনা করে বসলাম। উচ্চারণ করে ফেললাম, ‘ তিন্নি আর অমিত একে-অপরকে ভালোবাসে? ‘

আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। দুর্বল শরীরটাকে টেনে আনলাম বিছানায়। চাদর খামচে ধরে নিজেকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করছিলাম। তেমন অবস্থায় অমিতকে কল করে বললাম, তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে। জরুরি কথা আছে।

__________

আমার কল পেয়েও অমিত বাসায় ফিরল রাত করে। ফেরার পর একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করল না, আমার জরুরি কথার ব্যাপারে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তিনি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেকদিন পর আমার মন দ্বিধায় পড়ল। আসলেই কি অমিত আমাকে এড়িয়ে চলছে নাকি তিন্নির চিঠি পাওয়ার পর আমার মনের সন্দেহ থেকে এমন ভাবছি? এই দ্বিধাদ্বন্দ থেকে মুক্তি পেতে সরাসরি ডাকলাম,
” শুনছেন? ”

অমিত তখন রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় আধশোয়া হয়েছে। আমার ডাকে বন্ধ চোখ মেলে আবার বুজে নিলেন। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,
” আপনার সাথে কথা ছিল। ”

তিনি হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। আমি খামের প্রসঙ্গে কথা তুলব তখনই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বালিশ হাতে নিয়ে বললেন,
” আজ খুব গরম পড়েছে মনে হয়। আমি বারান্দায় শুব। তুমি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। ”

____________
অমিতের এই এড়িয়ে যাওয়া দিনকে দিন বেড়েই চলল। দূরত্ব কমিয়ে আনা মানুষটা নিজেই কেমন দূরত্ব তৈরি করছিল। তার এমন ব্যবহার আমি নিতে পারছিলাম না। দুমড়ে-মুষড়ে যাচ্ছিলাম। ভেঙে পড়ছিলাম ধীরে ধীরে। আমার গোপনে মানিয়ে নেওয়া রূপটা সামনে প্রকাশ পাচ্ছিল আস্তে আস্তে। বদলে যাওয়া আমিটা আবারও ফিরে যাচ্ছিলাম আগের রূপে। এই ফিরে যাওয়ার পথেও বার বার অমিতকে আশা করছিলাম। কোথাও না কোথাও এ মানুষটাতেই নিজের শক্তপোক্ত মনোবল বিলিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। তেমনই একরাতে অমিতের ফোন বেজে উঠল। আমি তখনও জেগে। অমিত হয়তো বুঝতে পারেনি আমি তার কথা শুনছি। সে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিল। স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম না বলে আমি উঠে জানালার কাছে যেতে চাইলাম। তার আগেই অমিতের গলা থেমে গেল। হেঁটে এলেন রুমে। আমি সতর্কতায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তিনি ধৌতখানায় ঢুকলে আমি উঠে বসলাম। ছুটে গেলাম বারান্দায়। যা ভেবেছিলাম তাই। ফোনটা বালিশের কাছেই পড়ে আছে। ফোনটা হাতে নিতে একটা বার্তা এলো। বার্তাটি পাঠিয়েছে তিন্নি। তাতে একটি ঠিকানা দেওয়া। আমার সন্দেহমন ধরেই নিল এতক্ষণ তিন্নির সাথেই কথা বলছিল। আর এই ঠিকানায় অমিতকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমার অনুমান সঠিক নাকি ভুল তা জানার জন্য আমি নিজের বিছানায় ফিরে গেলাম। আগের ন্যায় চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। তারও ঠিক কয়েক মিনিট পর অমিত ধৌতখানা থেকে বের হলেন। বারান্দা থেকে মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। দরজাটা খুব সাবধানে ভিড়িয়ে দিতেই আমার চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল!

___________
অমিতের আসার অপেক্ষায় ছিলাম সারারাত। একফোঁটাও ঘুমাইনি। মনকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি সারাটি সময়। তিন্নি আর অমিত প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, ভাইবোনের মতো এ কথাটি আউড়েছি লক্ষবার। কাজ হয়নি। মন মানেনি। তার প্রমাণ দরকার। তাই ভোর হতে আমিও বেরিয়ে পড়ি। তিন্নির পাঠানো সেই ঠিকানায় গিয়ে হাজির হই। সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর জানতে পারি ওটা একটি আবাসিক হোটেলের ঠিকানা ছিল। ফ্লোর নাম্বার, রুম নাম্বার সবই এই হোটেলের, কোনো বাসার না। আমি ধুকপুক মনে সেই হোটেলে ঢুকি। রিসিপশন থেকে অনুমতি নিয়ে যখন রুমের সামনে হাজির হই তখনই তিন্নিকে দেখতে পাই। অমিতের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে অমিতের শার্ট। অমিত একহাতে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে দরজায় তালা মারছে। তালা মারা শেষে তিন্নিকেসহ পেছন ঘুরতে আমার চোখে চোখ পড়ল। সেই চোখে চোখ রাখা আমার সাধ্যি ছিল না। দূর থেকে আমি পালিয়ে আসছিলাম। ছুটতে ছুটতে পেছন থেকে শুনলাম অমিত আমাকে ডাকছে। তার কণ্ঠে আমার নামটি আর মাদকতা লাগল না। মায়া, দরদ সব বুঝি তার কণ্ঠ থেকে কেউ শুষে নিয়েছে। এক পলকেই বিষাক্ত ঠেকল সবকিছু। এক মুহূর্তেই চুরমার হয়ে গেল আমার গুছানো ও সাজানো চারপাশ। দেখিয়ে দিল কোনো পুরুষই আলাদা নয়। আরও একবার প্রমাণ করে দিল, সব পুরুষ এক।

চলবে

[] রমজান উপলক্ষে আমার লিখিত দ্বিতীয় বই ‘বউ সোহাগি’ পাওয়া যাবে মাত্র ২০০ টাকায় []

বিস্তারিত: https://www.facebook.com/102175672032505/posts/300117108905026/?app=fbl

বর্ণলিপিতে নক করলে ওনারা অর্ডার প্রসেস বলে দেবেন।

পেজ লিংক,

https://www.facebook.com/bornolipi.prokashoni/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here