#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ৪
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিম
চার ঘণ্টা ধরে হসপিটাল করিডোরে বসে আছে তিন্নি। আবিদের বিশেষ কিছু হয়নি। কাটা জায়গায় তিনটা সেলাই লেগেছে শুধু। বেহুঁশ হয়ে গেছিল বলে ডাক্তার সিটি স্ক্যান করেছে কিন্তু তেমন কোনো সমস্যা পায় নি। তবে আবিদের মাথা ঘুরছিলো বলে ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এই মুহূর্তে তিন্নির নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না একটু আগে ও কেন কাঁদল। এর থেকেও কঠিন পরিস্থিতিতে শক্ত থেকেছে ও। তবে আজ কেন এমনটা হলো। এখন তো ওর মনে হচ্ছে ও ঐ পরিস্থিতির জন্য না বরং লোকটার জন্য কাঁদছিল। এও কি সম্ভব? না না লোকটার প্রতি কোনো রকম দুর্বলতা নিজের মনে আসতে দেওয়া যাবে না। এখন এখানে বসে না থেকে চলে যাওয়াই ভালো। কিন্তু তার আগে লোকটার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। মনে মনে এসবই ভাবছিল তিন্নি। আবিদের ওয়ালেট আর ফোন ওর কাছেই আছে। ইচ্ছা করলে এখন ই ওর ফ্যামিলিকে ইনফর্ম করা যায়। ওয়ালেটে আবিদের আইডি কার্ড, বিজনেস কার্ড দুটোই পেয়েছে ও। ফোনটা ও আবিদের ফিংগার প্রিন্টে আনলক করেছে ও। সেখানে ওর পরিবারের নাম্বার আছে। কিন্তু পুলিশের ঝামেলা হতে পারে ভেবে এতক্ষণ আর কাউকে জানানো হয় নি। তবে এভাবে বসেও থাকা যায় না। আবিদের কারণে এমনিতেই ওর আজকের টিউশনি গুলো মিস হয়ে গেছে। এখানে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকলে বাসায় ফিরতেও দেরি হয়ে যাবে ওর। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে একজন নার্স এসে বলল,
—আপনার পেসেন্টের ঘুম ভেঙ্গে গেছে এখন তাকে নিয়ে যেতে পারেন।
—এত জলদি ঘুম ভেঙ্গে গেল?
—খুব হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ ছিল। ডাক্তার সমস্ত চেক আপ করে ওনাকে এখনই ডিসচার্জ করে দিয়েছেন। রিসিপশনে গিয়ে বিল পে করে পেসেন্ট কে নিয়ে যান।
—আচ্ছা।
তিন্নি উঠে দাঁড়ালো। ওর মাথা ঝিমঝিম করছে। হুট করেই ওর মনে পড়লো ও হসপিটাল একদম সহ্য করতে পারে না। তাহলে এতক্ষণ ও এই হসপিটালে কেন ছিল? ওহো হো সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আজকেই শেষ। এরপর থেকে আবিদের সাথে ওর দেখা করা যাবেনা। কিছুতেই না। ও দ্রুত রিসিপশনে গিয়ে সমস্ত ফর্মালিটিজ শেষ করল। তারপর আবিদের এক বন্ধু কে ফোন দিয়ে আবিদের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে দিল। এবং সবশেষে একটা চিরকুট সহ নার্স কে দিয়ে আবিদের ওয়ালেট আর ফোন আবিদের কাছে পাঠিয়ে ও দ্রুত হসপিটাল ত্যাগ করল। নার্স গিয়ে আবিদের হাতে জিনিস গুলো দিল। আবিদ তিন্নির ব্যাপারে জানতে চাইলে নার্স বলল,
—উনি তো চলে গেছেন।
—কখন গেল?
—এইতো কিছুক্ষণ আগে।
—ওহ।
আর কথা বাড়ালো না আবিদ। চিরকুট টা খুলল ও। তিন্নি লিখেছে,
— ” আপনার হসপিটালের বিল পে করে দিয়েছি। আর আপনার একজন বন্ধু কেও ইনফর্ম করেছি। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। আপনার সাথে দেখা হওয়ার দিন এবং আজ যা যা ঘটেছে তাতে দোষ আমাদের দুজনেরই ছিল। আমার তরফ থেকে আমি ক্ষমা চাইছি এবং আপনাকেও ক্ষমা করে দিলাম। আশাকরি আমাদের আর দেখা হবে না।
তিন্নি ”
চিরকুট টা পড়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আবিদের। ও চিরকুট টা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলল। আর মনে মনে বলল, ” দেখা হবেনা বললেই হলো। ওয়েট এন্ড ওয়াচ মিস তিন্নি। আবিদ কে তোমায় ভালোবাসতেই হবে। ”
বাসায় পৌছে সোজা নিজের রুমে চলে গেল তিন্নি। ভাগ্যিস কেউ ওকে খেয়াল করেনি। ওর গলায় আবিদের রক্ত মাখা ওড়না জড়ানো। কেউ দেখলে এখন হাজার টা ব্যাখ্যা দিতে হতো। এই মুহূর্তে একদমই এসবের মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছে না ওর। সবার আগে গোসল করতে হবে ওকে। রক্ত আর হসপিটালের গন্ধ শরীরে মেখে আছে। ও ভাবতে পারছে না আজ কে ওর কি হলো। পরপর এতগুলো ভুল কেন করলো ও। যেখানে শত অসুস্থতায় ও একটা টিউশনি বাদ যায় না ওর সেখানে আজকেই দু দুটো টিউশনি বাদ গেল। বাবার মৃত্যুর পর গত চার বছরে একবারের জন্যও ও কাঁদেনি অথচ আজ প্রায় অপরিচিত একটা লোকের জন্য ও কাঁদল আর অপছন্দের হসপিটালে ও চারঘন্টা বিনা কোনো সাফোকেশন ছাড়াই কাটিয়ে দিল। তাহলে কি ইতিমধ্যেই ওর মনে অনুভুতির সৃষ্টি হয়ে গেছে। না না অসম্ভব এই অনুভূতি ও কিছু তেই এক্সেপ্ট করবে না। ভালোবাসা একটা মানুষের সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে। একটা মানুষের জীবনে ভালোবাসা আসলে মানুষটা নিজের সমস্ত নিয়ন্ত্রন হারায়। তখন সেই মানুষটিকে পুরো পুরি নিয়ন্ত্রণ করে ভালোবাসা। ওর কাঁধে তো শুধু নিজের জীবন না। আরো অনেক জীবন ও ওর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তিন্নি মনে মনে নিজেকে কঠোর ভাবে বোঝালো, ” তোমার জন্য বিয়ে, ভালোবাসা এই দুই হারাম তিন্নি। তুমি সবকিছুর দায়িত্ব নিতে পারো কিন্তু এই দুই সম্পর্কের দায়িত্ব কোনো ভাবেই পালন করতে পারবে না। এ তোমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এই দুটো জিনিস ই তোমার জীবনের জন্য নিষিদ্ধ।”
— তিন্নি টেবিলে খাবার দিয়েছি মা। জলদি আয়।
হঠাৎ শায়লার কন্ঠে চিন্তায় ভাটা পড়লো তিন্নির। দ্রুত গোসল সেরে রুম থেকে বেরিয়ে এল ও। সবাই খেতে বসে গিয়েছে। শায়লা এসে ছোট মেয়ের প্লেটে ভাত উঠিয়ে দিলে তিন্নি বলল,
— তুমি খেতে বসো আম্মা। আমি নিজে নিয়ে নিতে পারবো।
— সেটা আমিও জানি। আজ নাহয় আমি বেড়ে দিলাম।
তিন্নি আর কথা বাড়ালো না। এটা নিয়ে এখন তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। ও তিথিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— কিরে পরিক্ষার প্রস্তুতি কেমন?
— ভালোই।
— ভালোই বললে তো হবেনা। এটা ফাইনাল। এখন বাইরে কম গিয়ে পড়াশোনায় মন দে। আর মাত্র পনেরো দিন আছে পরিক্ষার। ভালোয় ভালোয় পরিক্ষাটা শেষ করে। তারপর ঘোরাঘুরির অনেক সময় পাবি। আর আম্মা আজ থেকে রোজ রাতে ওকে এক গ্লাস দুধ খেতে দেবে। শোন রাত জেগে কোনো পড়াশোনা না। দিনের মধ্যে সব শেষ করবি। কালকে ও দেখেছি রাত তিনটা পর্যন্ত তুই নেটে ছিলি। পরিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রাত এগারোটার সময় ফোনটা আমার কাছে দিয়ে যাবি।
— ঠিক আছে।
— আর কয়েকটা দিন এরপর আর তোর ওপর কোনো জোর জবরদস্তি করবো না।
— এমন কেন বললি? আমি কি কখনো অভিযোগ করেছি?
— এমনিতেই বললাম। হবু ডাক্তার বলে কথা।
— ডাক্তার হই বা যাই হই তোর অবস্থান আমার কাছে কখনোই বদলাবে না। বুঝেছিস।
— হুম। হয়েছে এবার খেয়ে নে।
আর কোন কথা হলো না খাবার টেবিলে। খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেল। তিথি দ্রুত রুমে ঢুকে আফিফ কে ম্যাসেজ করলো, ” এক্সাম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার ফোন রাত এগারোটা থেকে তিন্নির কাছে থাকবে। রাতে কোনো রকম টেক্সট বা কল করো না।”
সঙ্গে সঙ্গে আফিফের ম্যাসেজ এলো, ” তোমার বোনকে না একদিন আমি দশতলা থেকে নিচে ফেলে দেব। বিয়েটা তো হতে দিচ্ছে না। এখন আবার প্রেমে বাঁধা। উফ্। ( সাথে একটা বিরক্তি ইমোজি)। ”
তিথি আর কথা বাড়ালো না। ম্যাসেন্জার থেকে লগ আউট করে। ফোন টা তিন্নির কাছে দিয়ে এলো। তিন্নি যদি ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে তাহলে আফিফের ব্যাপারে সহজেই জেনে যাবে। কিন্তু তিথি জানে ফোনটা যেভাবে দিয়েছে ঠিক তেমনিই ফেরত আসবে। এসব ঘাঁটাঘাঁটি করার স্বভাব তিন্নির না। পরিক্ষা শেষ হলেই ও তিন্নিকে আফিফের ব্যাপারে সব বলে দেবে।
বাসায় ফিরেই আবিদ নিজের ঘরে ঢুকে বসে আছে। শিরিন কতক্ষণ ডাকা ডাকি করলে আবিদ বলেছে সে এখন ঘুমাবে। তাকে যেন বিরক্ত না করা হয়। শিরিন বেশি বিরক্ত করলেন না। ছেলেটা অসুস্থ। এখন একটু বিশ্রাম নিক। ড্রয়িং রুমে আবিদের বন্ধু রিহান বসে আছে। ওকেই বরং জিজ্ঞেস করা যাক কিভাবে আবিদের মাথা ফাটলো। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ড্রয়িং রুমে গিয়ে রিহান কে জিজ্ঞেস করলেন,
— ওর মাথা ফাটলো কিভাবে?
— আমি জানিনা আন্টি।
— তুমি ওকে সাথে করে নিয়ে এলে। তুমি জানো না?
— আসলে আন্টি আমিতো ওর সাথে ছিলাম না। একটা মেয়ে হঠাৎ ফোন করে……
— মেয়ে মানে আজকাল ও মেয়েদের সাথে রাতে ঘোরাঘুরি করে নাকি?
— না না আন্টি। মেয়েটি ওকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে বলল, ” আপনার বন্ধুর মাথা ফেটে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। আপনি দয়া করে ওনাকে নিয়ে যান।”
— তুমি মেয়েটির পরিচয় জানতে চাও নি?
— চেয়েছিলাম। মেয়েটি বলল, ” আমার পরিচয় না জানলে ও চলবে। আমি একজন পথচারী মাত্র। আপনি ওনাকে নিয়ে যান আমি ঠিকানা পাঠাচ্ছি।”
— মেয়েটির নাম্বার আছে?
— না আন্টি।
— তুমি না বললে ফোন এসেছিল?
— মেয়েটি আবিদের ফোন দিয়ে কল দিয়েছিল।
— ও।
— আচ্ছা আন্টি। আমি আজ উঠি। জরুরী কাজ ফেলে এসেছি।
— আচ্ছা এসো।
রিহান চলে যাওয়ার পর ও সেখান থেকে উঠলেন না শিরিন। মেয়েটি কি সত্যিই পথচারী নাকি বড় ছেলের মত ছোট ছেলেও তাকে লুকিয়ে প্রেম করছে। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ছোট ছেলে যে নিজের পছন্দেই বিয়ে করবে এটা তো তিনি আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওরা ভুল কাউকে না ভালোবাসে। উনি কখনো চায় না ওনার এত সাধের সংসার কোনো ভুল মানুষের জন্য বরবাদ হয়ে যাক।
চলবে………