#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ১
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিমা
নিজের রুমে বসে অফিসের জরুরী কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন শায়লা বানু। এমন সময় জরি বুয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল,
— সব্বনাশ হইয়া গেছে আম্মা। এক্কেরে সব্বনাশের মাথায় বারি না মুগুর পইরা গেছে। আম্মাগো আমার ডর লাগতাছে। আইজকা ছুড আফায় আইসা কি ঘটাইব কেডায় জানে। আগেই কইছিলাম পোলারে এত ছাড় দিয়েন না। আমার কতা তো হুনেননা। গরিবের কতা বাসি হইলেও ফলে।
— কি আবোল তাবোল বলছিস জরি। তোকে না কতবার বলছি যা বলার সরাসরি বলবি এত ভনিতা আমার পছন্দ না। এমনিতেই অফিসের একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত আর তুই আমাকে বিরক্ত করছিস। কিছু বলার থাকলে বল নইলে বিদায় হ।
— রাহেন আপনের জরুরী কাম। যা ঘটছে হের থেইক্কা জরুরী কিছু আছে নাকি। সব্বনাশ………
— জরি এবার কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আবারও ভনিতা শুরু করে দিলি। কিছু বলার থাকলে জলদি বল না।
— কিছু কইতাম না দেহাইতাম। জলদি আসেন।
বলেই আর একমুহূর্ত সময় না দিয়ে শায়লার হাত ধরে দ্রুত পাশের রুমে নিয়ে গেল জরি বুয়া। ছোট মেয়ে তিন্নির রুমে এসে চোখ কপালে উঠে গেল শায়লার। মেয়ের সমস্ত জামাকাপড় মেঝেতে ছড়িয়ে তার মাঝে একহাতে তুলি অন্য হাতে রংয়ের প্লেট নিয়ে মহাশান্তিতে জামার উপর রং করছে তার ছেলে সানভি। তিনি দ্রুত সানভিকে টেনে উঠালেন। হুট করে কাজের মাঝে এমন বাঁধা পেয়ে বিরক্তির সুরে সানভি বলল,
— উফ আম্মু দেখছোনা ছোট আপুর বোরিং ড্রেস গুলোকে রং করে সুন্দর বানাচ্ছি। এখন বিরক্ত করোনা।
বলেই আবারও বসতে যাচ্ছিলো সানভি। শায়লা বাঁধা দিয়ে বললেন,
— এসব কি করছিস তিন্নির আসার সময় হয়ে গেছে প্রায়। তোকে কিন্তু খুব বকবে ও।
— বকতে দাও। আমার ভালো লাগে না ছোট আপু কেন এরকম সাদা কালো ড্রেস পরে। বড় আপুর মতো সুন্দর জামা কেন পরে না। আমার বন্ধুরা বলে ছোট আপুকে বুড়িদের মতো লাগে। অথচ আপু কত সুন্দর। আপু কেন এরকম থাকে?
— এসব তোমার বুঝতে হবে না বাবা। এখন তুমি নিজের রুমে গিয়ে গোসল করে নাও। সারা গায়ে রং লেগেছে।
—কিন্তু এখনো…….…
—কোনো কিন্তু না যাও এখুনি।
সানভি বেরিয়ে যাবার পর জরির দিকে তাকিয়ে শায়লা বললেন,
—জরি তিন্নির আসার আগে সব ঠিক করতে হবে তুই………..
কথা শেষ করার আগেই মেইন ডোর খোলার শব্দ পেলেন শায়লা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিন্নি এসে তার সামনে দাঁড়ালো। তিন্নিকে দেখে জরি বুয়া আতংকে মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করল। মাকে আর জরি বুয়া কে নিজের রুমের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো তিন্নি। এর মানে জানেন শায়লা। মেয়ে বিরক্ত হচ্ছে। আর এটা রেগে যাওয়ার আগের লক্ষন। এই মুহূর্তে ওকে রাগানো যাবে না। কিন্তু রুমে ঢুকলে তো এমনিতেই রেগে যাবে। কি করবেন এখন তিনি? মেয়ের মুড ও তো বোঝার উপায় নেই। পাশে জরি বুয়া দোয়া পড়তে পড়তে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শায়লা এখনো পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবেন সেটাই ভাবছেন। তাকে সরতে না দেখে তিন্নি এবার বেশ ধমকের সুরে বলল,
–উফ আম্মা সরোতো। গোসল করে আমাকে আবার বেরুতে হবে।
ধমকে কাজ হলো। শায়লা সরে গিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিন্নি নিজের রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর শায়লার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ ঠান্ডা গলায় বলল,
— সানভি কোথায় আম্মা?
মেয়ের এই গলাটাকেই ভয় পাচ্ছিলেন শায়লা। কোনোমতে ঢোক গিলে বললেন,
—গোসলে।
— গোসল শেষে ওকে আমার রুমে আসতে বলবে। আর জরি বু সানভির সমস্ত রং আমাকে এনে দাও। একটাও যদি থেকে যায় তাহলে….
— বুঝছি আফা কিছু কওন লাগতো না অহনি আনতাছি।
বলেই দৌড়ে বেড়িয়ে গেল জরি বুয়া। তিন্নি আবারো শায়লার দিকে তাকিয়ে বলল,
— আম্মা তোমার একটা শাড়ি এনে দাও। এখন যেগুলো পরো সেগুলো আনবে কিন্তু।
বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না তিন্নি। রুমে ঢুকে হাত ঘড়ি, চোখের চশমা আর কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাপড় তুলে নিল ও। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবগুলো কাপড় সাবান জলে ভিজিয়ে রেখে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো তিন্নি। শায়লা শাড়ি হাতে মেয়ের অপেক্ষায় ই ছিলেন। জরিনা বুয়া সানভির সমস্ত রং এনে রেখেছে। এখন মেঝেতে পড়ে থাকা রং পরিষ্কার করছে। শায়লার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে পরতে পরতে তিন্নি বলল,
— আম্মা যাও সানভি কে নিয়ে এসো।
মেয়ের গলার স্বরে ওর মুড বুঝতে ব্যর্থ হলেন শায়লা। মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন,
— ছাড় না মা রং গুলো তো নিয়েছিস। তাছাড়া ও তোকে ভালোবেসেই তো এসব করতে গিয়েছিল । আমাকে কি বলছিল……
— আম্মা প্লিজ আনতে বলেছি আনো। ভালো খারাপটা নাহয় আমি বুঝবো।
আর কথা বাড়ালেননা শায়লা। মেয়েকে এখন রাগানো যাবে না। কিছুক্ষণ পর সানভি কে নিয়ে তিনি মেয়ের রুমে এলেন। সানভি তার আঁচল শক্ত করে ধরে রেখেছে। তিন্নি আঁচলে সেফটিপিন লাগাতে লাগাতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বেশ শান্ত গলায় বলল,
— স্টাডি টেবিলের উপর থেকে ঐ চাবির গোছা টা আনো।
সানভি চুপচাপ সেটা নিয়ে এসে আবারো আগের জায়গায় দাঁড়ালো। এবার তিন্নি আবারো বলল,
— একেবারে মাঝখানে যে চাবিটা আছে সেটা দিয়ে আমার আলমারির ডানপাশের ড্রয়ারটা খোল। তারপর নিজের সমস্ত রং সেখানে রেখে দাও।
সানভি তিন্নির কথামতোই সব করতে লাগলো। শায়লা বলে দিয়েছে ছোট আপু যা বলবে চুপচাপ করবে। নাহলে শাস্তি বাড়িয়ে দেবে। শাড়িতে শেষ সেফটিপিন লাগিয়ে তিন্নি শায়লাকে বলল,
— সানভি কে যে অংক করতে দিয়েছি সেগুলো তিনবার করে করাবে। রাতে ফিরে আমি দেখবো।
— ঠিক আছে। তুই তো খেয়ে বেরোবি? আয় টেবিলে খাবার দিয়েছি।
— না আম্মা এখন সময় নেই এক ছাত্রী কে এক্সট্রা পড়ানো লাগছে। দেরি করা যাবে না।
— সকালে কি না কি খেয়ে বেরিয়েছিলি, এখন আবার না খেয়ে বেরোবি?
— সমস্যা নেই আমি বাইরে খেয়ে নেব।
আর কিছু বললেন না শায়লা। বলে লাভও নেই তিন্নি শুনবেনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়লা বললেন,
— টিউশনি গুলো বাদ দিলে হয় না? আমিতো ভালোই বেতন পাচ্ছি।
— নাহ হয় না। আপা কোথায়? তাকে দেখছি না।
— তিথি তো বেরিয়েছে একটু।
— এই ছুটির দিনে কোথায় গেল আবার?
— ঐ তো কি একটা নোট নিতে গেল।
— ওহ। ওর ফাইনাল প্রফের তো বেশি দেরি নেই। ফিস টিসের ব্যাপারে তো কিছু বলল না।
— আমাকে বলছিলো। তুই রাতে ফিরে আয় তারপর এ ব্যাপারে কথা বলবো।
— আচ্ছা। তাহলে আমি বেরোই।
কথা শেষ করে সানভির কাছ থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে আলমারি লক করে বেরিয়ে গেল তিন্নি। মেয়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শায়লা। আজ তিন্নি না থাকলে যে কি হতো ভাবতেই আত্মা কেঁপে ওঠে তার। একেবারে বাবার যোগ্য মেয়ে তিন্নি। সবার খেয়াল রাখবে কিন্তু নিজের বেলায় সবসময় উদাসীন। তার স্বামী তৌহিদ সাহেব ও এমনই ছিলেন। বাড়ির ছোট ছেলে হয়েও তার শ্বশুরের মৃত্যুর পর একা হাতে বড় বোন গুলোর বিয়ে থেকে শুরু করে সংসারের সকল দায়িত্ব পালন তিনি করেছেন। তখনো তার বিয়ে হয়নি,এগুলো শাশুড়ির মুখে শোনা। তবে তার বিয়ের পর এগুলো যে একটাও বানিয়ে বলা নয় তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছেন। আর সন্তান দের জন্য তৌহিদ সাহেব প্রাণ দিতে পারেন এমন অবস্থা। তার প্রতিও কখনো অবহেলা করেননি। শায়লা বিয়ের আগে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। তৌহিদ সাহেবের উদ্যোগে সে উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বি.এ পরীক্ষা দিয়ে পাশ ও করেছে। তিন্নি যখন হলো তার শাশুড়ি তিন্নিকে কোলে নিয়ে বললেন, পুরো বাপের মতো চেহারা হয়েছে। তার বড় মেয়ে দেখতে তার মতোই। তবে তিন্নি হলো তৌহিদ সাহেবের মতো দেখতে। মেয়ের মুখ দেখে তৌহিদ সাহেব সে কি খুশি। মাথায় হাত রেখে বললেন, ” বুদ্ধি তে মনুষ্যত্বে সেরা হও।” নিঃসন্দেহে তিন্নি তা হয়েছে। তবে শায়লার মাঝে মাঝে মনে হয় এটা তিন্নির জন্য দোয়া না অভিশাপ। আর পাঁচটা মেয়ের মতো সাধারণ হতো সে। কেন এমন অসাধারণ হতে গেল?
— তুমি তোমার বোন কে এত ভয় পাও কেন বলোতো?
বেশ বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলল আফিফ। আফিফের কথায় ওর হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে বসল তিথি। তারপর বলল,
— ভয় পাবো কেন। এটা হচ্ছে রেসপেক্ট। ও আমাদের সবার অভিভাবক। আব্বার পর তার শূন্য জায়গাটা খুব ভালো ভাবে পূরণ করেছে ও। আমি যে ডাক্তারি পড়াটা চালিয়ে যেতে পারবো সেটাই……….
— এসব আমি জানি তিথি। কিন্তু একটা কথা বলো তোমার বাবা আজ বেঁচে থাকলে কি তোমার বিয়ে দিতেন না?
— ব্যাপারটা ওরকম না।
— তাহলে কি রকম? আমাকে একটু ক্লিয়ারলি বলো। মা আমাকে বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে ফেলেছে। বাধ্য হয়ে তোমার কথা বলে দিয়েছি। এখন তোমার পরিবারের সাথে দেখা করবে বলে জিদ ধরে বসে আছে। আর তুমি এখন পর্যন্ত তোমার বোনকে আমার কথা টা বলতে পারলে না।
— আম্মা তো জানে।
— আম্মা জেনে কি করতে পারলো?
— আম্মা সেদিন খাওয়ার টেবিলে আমার বিয়ের কথা তুলেছিল।
তিথির কথায় আগ্রহী হয়ে আফিফ বলল,
— সত্যি? তিন্নি কি বলল?
— কি আর বলবে। বলল, ” আম্মা তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সামনে আপার ফাইনাল প্রফ। এই মুহূর্তে ওর বিয়ের কথা তুমি কি ভাবে ভাবতে পারলে। তার উপর একটা বিয়েতে কত খরচ তুমি জানো? আর ওর বিয়েতে তো মিনিমাম দশ লক্ষ টাকা খরচ হবে। ওকে পড়াতে গিয়েই সমস্ত জমানো টাকা শেষ। এখন ওসব বিয়ের চিন্তা বাদ দাও। আগে ও ডাক্তার হোক। কিছু টাকা পয়সা কামাই করুক। তারপর ওর বিয়ে দিও।”
— কিহ! তোমার বোন এসব বলেছে।
— ও তো ঠিকই বলেছে। এত কষ্টে আমাকে পড়িয়েছে একটা ফিডব্যাক দিতে হবে না। মোটকথা ওর অনুমতি ছাড়া আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। তোমার অপেক্ষা করতে হয় করো নাহলে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলো।
এটুকু বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেল তিথি। আফিফ মুখ বাঁকিয়ে বসে আছে। বললেই হলো অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলো। বিয়ে তো ও তিথি কে ই করবে। তার জন্য যদি সারাজীবন অপেক্ষা করতে হয় তো তাই করবে।
চলবে……………