#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ২

0
437

#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ২
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিম
বাসের অপেক্ষায় বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি। টিউশনির পাশাপাশি আরও একটা কাজ করে তিন্নি। রেডিও গুনগুন এর একজন জনপ্রিয় আর জে সে। মঙ্গলবার রেগুলার শো আর রোজ শুক্রবার তার স্পেশাল শো থাকে। আজ শুক্রবার, তাই টিউশন শেষে স্টুডিও তে যাচ্ছে ও। বাসের অপেক্ষা করতে করতে চশমা খুলে হাতে নিল তিন্নি। শাড়ির আঁচল দিয়ে চশমাটা মুছে আবার ও চোখে দিতে যাবে ঠিক তখনই কারো ধাক্কায় চশমাটা পরে ভেঙে গেল। তিন্নি ভাঙা চশমাটা উঠিয়ে দ্রুত ফিরে তাকালো। যে ধাক্কা দিয়েছে সে পেছন ফিরে তার বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। এটান্ত দেখে তিন্নির মাথা গরম হয়ে গেল। লোকটাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে কড়া ভাষায় বলল,
—বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন ভালো কথা। কিন্তু মাঝ রাস্তায় এরকম বান্দরের মতো লাফাচ্ছেন কেন। দিলেন তো আমার চশমাটা ভেঙে। ধুর!
লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টা তিন্নির দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। এতে তিন্নির মাথা আরো গরম হয়ে গেল। কড়া ভাষায় আরো কিছু কথা বলতে যাবে কিন্তু ততক্ষণে বাস চলে আসায় আর কথা বাড়ালো না তিন্নি। লোকটার প্রতিউত্তর না শুনে ই বাসে উঠে পড়লো। পিছন ফিরে আর তাকালো না। তাকালে দেখতে পেত যাকে কড়া ভাষায় কথা শোনালো সে কেমন চোখ বড় বড় করে ওর যাওয়ার পথেই তাকিয়ে আছে। এবং সে ততক্ষন পর্যন্ত তাকিয়ে রইল যতক্ষন না তার এক বন্ধু এসে তার পিঠে চড় মেরে তার ঘোর কাটালো। যে বন্ধুটি তাকে চড় মারলো সেই প্রথমে বলল,
— কিরে আবিদ বকা খেয়েই এই অবস্থা না জানি মিষ্টি করে কথা বললে কি করবি।
—দোস্ত এটা কি হলো?এটাই কি প্রথম দেখায় প্রেম?
— সেটা তো তুই বলবি। যে আবিদের পিছনে শতশত মেয়ে ফিদা, প্রথম দেখায় মেয়েরা বন্ধুত্ব করতে চায়, সেই আবিদকে সবার সামনে মেয়েটি বান্দর বলে চলে গেল আর আবিদ কিছু না বলে সেই মেয়েটির দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য!
—মেয়েটির ব্যাপারে কিছুই তো জানা হলো না।
চিন্তা করিস না। আমাদের জন্য তো ঢাকা শহর বেশি বড় জায়গা না খুজে ফেলবো।
— হুম।
আচ্ছা চল একটা লং ড্রাইভ দিয়ে আসি। বন্ধুরা মিলে অনেক দিন লং ড্রাইভে যাওয়া হয় না।
অতঃপর মেয়েটিকে মাথা থেকে সরিয়ে আপাতত বন্ধুদের সাথে লং ড্রাইভের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল আবিদ।

রাগে গজগজ করতে করতে স্টুডিও তে ঢুকলো তিন্নি। আজকে ও প্রচন্ড রেগে আছে। এবং রাগটা ঐ লোকের প্রতি যা ও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। ওর ব্যাগে সবসময় একটা এক্সট্রা চশমা থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত রাগে কাঁচ ভাঙা চশমাটাই সে চোখে দিয়ে রেখেছে। এসেই ওর শো অর্গানাইজারদের একজনকে ধমক দিয়ে ফেলেছে। স্টুডিওর সবাই তিন্নির রাগ কে খুব ভয় পায়। এইজন্য কেউ ওর ধারে কাছেও ঘেঁষছে না। কিন্তু শো শুরু হওয়ার মাত্র পনেরো মিনিট বাকি। এখন তিন্নিকে কিভাবে কি বলবে? এমন অবস্থায় একজন গিয়ে রেডিও গুনগুন এর পরিচালক ইফতেখার আহমেদ কে ডেকে নিয়ে এলেন। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র তিনিই তিন্নিকে সামলাতে পারেন। ইফতেখার এসে তিন্নি কে বলল,
— কিরে ভাঙ্গা চশমা পড়ে আছিস কেন?
— আর বলো না ইফতি ভাই। রাস্তায় এক বান্দর ধাক্কা মেরে চশমা ভেঙে দিছে। বাস চলে আসলো নইলে আজকে……….
— ও বাবা। তুই তো সত্যিই ক্ষেপে আছিস।
— তোমার কি মনে হয় নাটক করছি আমি?
— আরে না আমি তা বলেছি নাকি। আমি বলছি এত ক্ষেপার কি আছে। এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র।
— দুর্ঘটনা মানছি। সরি বলে দিলে হয়ে যায়। তা না করে ঐ ব্যাটা আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কত বড় সাহস। অপরাধ করে আবার চোখ তুলে তাকায়। ভাবতে পারো?
— ওরে বাবা। ব্যাটা নির্ঘাত তোর প্রেমে পড়েছে। আর তোর মতো বুড়ির প্রেমে যে পড়েছে সে নিশ্চিত কোনো এলিয়েন হবে।
ইফতেখারের বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললো তিন্নি। ইফতেখার এর সাথে কথা বলে রাগটা ও একটু কমেছে ওর। ওকে হাসতে দেখে ইফতেখার বলল,
— এখন যখন আপনার মুড একটু ভালো আমরা শো টা কি শুরু করতে পারি?
—ওহো। দেখেছো ঐ ব্যাটা বান্দরের জন্য আজ আমার শো টাই যেত।
—আচ্ছা আমি রেডি হতে বলি সবাই কে তুই ভেতরে যা।
ইফতেখার ঘড়ির দিকে তাকালো। বেশি দেরি হয়নি এখনও পাঁচ মিনিট আছে। সবাই কে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে বলল ইফতেখার। তিন্নির এই শো টার জন্য ই ওর রেডিও গুনগুন আজ ও চলছে। বরং তিন্নি ই তো এই রেডিও টা কে দাড় করিয়েছে। এইতো চার বছর আগের কথা। ওর রেডিওর রিচ তখন খুব কম। অন্যান্য রেডিও স্টেশন গুলো ওদের থেকে অনেক এগিয়ে। তিন্নি তখন সবে ওর রেডিও জয়েন করেছে। আঠারো বছরের ছোট মেয়ে। কিন্তু বুদ্ধিতে ওর থেকেও বড়। ইফতেখার যখন সিদ্ধান্ত নিলো রেডিও গুনগুন বন্ধ করে বাবার কথা মতো তার বিজনেসে ঢুকে যাবে তখন এই তিন্নিই তো ওকে ভরসা দিল। দুজনে মিলে দিন রাত পরিশ্রম করে রেডিও স্টেশন টি কে আজ টপ টেন রেডিও স্টেশন এর একটা করতে পেরেছে। ওর বিশ্বাস শিঘ্রই তা নাম্বার ওয়ান এ চলে আসবে। তিন্নি মেয়েটা সাধারণ থাকার চেষ্টা করে কিন্তু আসলে ও অসাধারণ। এই ছোট্ট বয়সে কত অসাধ্য সাধন করে বসে আছে। ইফতেখার শুধু ওকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে চায় না। লাইফ পার্টনার হিসেবে চায়। কিন্তু এই সামান্য কথাটা ও আজ পর্যন্ত তিন্নি কে বলতে পারেনি। ও সব কিছু তিন্নি কে বলতে পারে। প্রয়োজনে বকতে পারে, ওকে দিয়ে সবকিছু করাতে পারে, ওর একান্ত ব্যাক্তিগত গোপন তথ্য ও তিন্নির কাছে নির্দ্বিধায় ফাঁস করে দিতে পারে। শুধু একটা কথাই বলতে পারে না যে ও তিন্নি কে ভালোবাসে।

গাড়ি ড্রাইভ করছে আবিদ। পাশের সিটে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড রিহান বসেছে। পিছনে বাকি তিন বন্ধু শোভন, ফাহিম আর রাফিন বসে আছে। শোভন ফোনে সময় দেখে রিহান কে রেডিও অন করতে বলল। ওর প্রিয় শো শুরু হবে এখন। রিহান রেডিও অন করতেই সেখান থেকে এক তরুণীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“আসসালামুয়ালাইকুম সবাই কে। আপনারা শুনছেন সময়ের অসময়ের সবসময়ের রেডিও গুনগুন। সাথে আছি আমি আর জে তিন্নি উইথ মাই ফ্রাই ডে স্পেশাল শো চিট চ্যাট উইথ তিন্নি। সবার আগে কিভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন সেটা জানাই……………………”
হুট করেই গাড়ি ব্রেক করলো আবিদ। জোরে চিৎকার করে বলল,
—এইতো পেয়ে গেছিইইইইই….
হঠাৎ আবিদের কাজে সবাই বিস্মিত। রিহান আবিদের পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলল,
— কি পেয়েছিস?
— এখনো বুঝিস নি?
— কি বুঝবো?
— রেডিওর কন্ঠটা তোর পরিচিত লাগলো না।
— হ্যা। এটা তো আর জে তিন্নির কন্ঠ। প্রায়ই তো শোনা হয়।
উত্তরে আবিদ কিছু বলল না। মুচকি হেসে গাড়ি ঘোরালো। সবাই বারবার জানতে চাইলো কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু আবিদ কিছুই বলল না। সরাসরি রেডিও গুনগুন এর অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামালো আবিদ। বন্ধুদের অপেক্ষা করতে বলে ও ভিতরে ঢুকলো। চারিদিকে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরও তিন্নিকে কোথাও দেখা গেল না। একটা মেয়ে নিজে থেকে এগিয়ে এসে বলল,
— আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
— হুম। আর জে তিন্নি কোথায়?
— তিন্নি আপু তো স্টুডিও তে। আপুর শো চলছে না।
— ও। কখন শেষ হবে?
— আরো এক ঘন্টা। তবে এখন একবার বের হবে বোধহয়। কিন্তু আপনি কে?
— আপনার আপু আমাকে চেনেন।
আপনি আপুর কে হন?
— বয়ফ্রেন্ড।
— কিহ! তিন্নি আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে?
— থাকতে পারেনা?
মেয়েটি উত্তর দিলো না। তাকে ভীষণ শকড্ দেখাচ্ছে। যেন তিন্নির বয়ফ্রেন্ড থাকা বিশ্বের অষ্টমাশ্চর্য। এমন সময় তিন্নি কে স্টুডিও থেকে বের হতে দেখে আবিদ সেদিকে এগিয়ে গেল। তিন্নি কিছু বোঝার আগেই ওর হাত টেনে ধরে করিডোরে নিয়ে এলো। আবিদ কে দেখে তিন্নি ভীষণ অবাক হলো। পরমূহুর্তে প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল,
— আপনি এখানে কি করেন?
— তুমি রাস্তায় আমাকে বাঁদর বলে চলে এলে আর আমি তার জবাব দিতে এখানে আসতে পারবো না।
— আপনি রাস্তায় বাঁদরামি করতে পারেন আর আমি বলতে পারবো না।
— অবশ্যই পারবে তবে একান্তে। সবার সামনে না।
— আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যান।
— বাড়াবাড়ি তো এবার হবে।
বলেই একটা ভয়ংকর কাজ করে বসল আবিদ। তিন্নির গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল ও। তিন্নি সেখানেই স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে কোনো প্রকার রিয়্যাকশান ওর মাঝে দেখা গেল না।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here