#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ১০

0
301

#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ১০
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিম
সময় এবং কাজ কারো জন্য থেমে থাকেনা। দেখতে দেখতে ইফতেখারের মৃত্যুর সাতদিন পার হয়ে গেছে। রেডিও গুনগুনের আগের শো গুলো চালু করা হয়েছে। তবে তিন্নি আর ইফতেখারের শো গুলো বাদ দিয়ে। তিন্নি এখন তিথির বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। সেদিন ইফতেখারের মা তিন্নি কে না বোঝালে ও আগের সাহস টা এত তাড়াতাড়ি হয়তো ফিরে পেত না। ইফতেখারের মিলাদের দিন ইফতেখারের মা তিন্নিকে আলাদা করে ডেকে নিজের রুমে নিয়ে যান। তারপর আলমারি থেকে কয়েকটা প্যাকেট বের করে তিন্নির সামনে রেখে বলেন,
— আমার ছেলেটা তোকে বড্ড ভালোবাসতো। মাঝে মাঝেই তোর জন্য এটা ওটা কিনে নিয়ে আসতো। ওর রুম গোছাতে গিয়ে আমি সেগুলো পেয়ে যেতাম। একদিন জানতে চাইলে অনেক জোরাজুরির পর তোর কথা বলল। মনে মনে ছেলের বউ হিসেবে তোকেই দেখে এসেছি। কিন্তু সেটা আর সত্য করার কোনো সুযোগ রইলো না।
এটুকু বলে সামনে থাকা একটা প্যাকেট থেকে কয়েকটা বাক্স বের করলেন তিনি। তারপর সেগুলো খুলে বললেন,
— এই গহনা গুলো আমার শাশুড়ি মায়ের। দুই ছেলের বউদের জন্য রেখে গেছেন তিনি। এগুলো ইফতির বউয়ের জন্য। আমি তোকেই সবসময় ওর বউ হিসেবে দেখেছি। সে ও সেটাই চাইতো। এগুলো সব তোকে নিতে হবে। এর বোঝা বইবার ক্ষমতা আমার নেই।
— আমার কি আছে আন্টি?
— আছে। তুই সব পারিস। তোর মতো সহ্য ক্ষমতা আর মনের জোর আর কারো নেই।
— ইফতি ভাই কে কোনোদিন ঐ ভাবে ভাবিনি সত্যি কিন্তু সে আমার কাছে কি ছিল তা আমি জানি। আব্বার মৃত্যুর পর যেখানে সবার থেকে নিজের আসল সত্তা আড়াল করে রেখেছি সেখানে একমাত্র ইফতি ভাইয়ের কাছে কোনো আড়াল ছিলনা। আমার রাগ, আমার কষ্ট, আমার কান্না নির্দ্বিধায় তার সাথে শেয়ার করেছি আমি। বিশ্বাস করো তার জীবনের বিনিময়ে আল্লাহ যদি আমার জীবন চাইতো আমি তাই দিতাম।
— তোর ওপর অনেক দায়িত্ব মা। ইফতির স্বপ্ন ও তোর ভরসায় রেখে গেছে। সামনে তিথির বিয়ে। এখনই ভেঙে পড়িস না। ভেঙে পড়ার সময় আমাদের। তোরা তো আমাদের সামলাবি। কাল ওর রুম গোছাতে গিয়ে জিনিস গুলো পেলাম। মনে হলো এগুলো যার জন্য তাকে দিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এতে ছেলেটাও শান্তি পাবে। আর তাছাড়া এগুলো চোখের সামনে পড়লে আমার কষ্ট বাড়বে। তুই নিয়ে যা এগুলো। আর কোনদিন যদি তোর সমস্ত দায়িত্ব শেষ হয়। মনে হয় না এবার আমার বিশ্রামের পালা। তখন এই মা কে ভুলে যাস না। তোর জন্য এবাড়ির দরজা সবসময় খোলা। মনে রাখিস আমি তোকে আমার ইফতির বউ হিসেবে সারাজীবন মানবো। আর শোক করবার বয়স তো আমাদের তোদের তো শোক কাটিয়ে উঠার বয়স। রেডিও গুনগুনের এখন তোকে খুব প্রয়োজন। কত মানুষ অপেক্ষা করে আছে তোর কন্ঠ শোনার জন্য।
— আমি আর ঐ চেয়ারে বসতে পারবো কিনা জানিনা। ইফতি ভাইকে ছাড়া….
— তিথির বিয়ে পর্যন্ত ও চেয়ার থেকে ছুটি তোর। ফিরে এসে নতুন উদ্যমে শুরু করবি সব। আমি জানি তুই পারবি। এখন তোর পরিবারের প্রতি যে দায়িত্ব বিশেষ করে তিথির প্রতি সেটা আগে পালন কর। মেয়েটা পাঁচ বছর ধরে অপেক্ষা করছে। ওর অপেক্ষা আর বাড়াস না। তারপর ইফতি যে দায়িত্ব দিয়েছে সেটা পালন করিস।
আর কোন কথা হয়নি সেদিন। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে অনেকক্ষণ। একজন ছেলে হারানোর শোকে অন্যজন একজন ভালো বন্ধু যে সবসময় বট গাছের মতো ছায়া দিতো, তাকে হারানোর শোকে।

দীর্ঘ সময় পর গ্রামের পথে ছুটছে তিন্নি। সেই চেনা পরিবেশ। যেখানে ওর শেকড়। এই ইট পাথরের নির্জীব শহরের থেকে হাজার গুন জীবন্ত ওর গ্রাম। জীবিকার তাগিদেই মূলত ওর শহরে থাকা, এমনিতে ওর মন পড়ে থাকে গ্রামে। তাইতো ওর এস এস সির পর ওর পুরো পরিবার যখন ঢাকা সেটেল্ড হলো ও গেলো না। দাদীর সাথে থেকে গেল। যদিও অন্য একটা কারণ ও ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ওকে সেই প্রিয় জায়গা ছেড়ে যেতেই হলো। বাস থেকে নেমে দাঁড়াতেই গ্রামের পরিচিত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো তিন্নি। তিন্নিকে দেখে পরিচিত এক ভ্যান চালক এগিয়ে এসে বলল,
— আরে তিন্নি আফা যে, ম্যালাদিন পর গ্রামে আইলা।
তিন্নি হেসে উত্তর দিলো,
— হ্যাঁ অনেক দিন পর। একটা কাজে এসেছি। তুমি ভালো তো বখতিয়ার ভাই? ভাবীর কি খবর?
— আল্লায় রাখছে আলহামদুলিল্লাহ। তোমার ভাবীর তো বাচ্চা হইবো। চার মাস চলতাছে।
— মাশাআল্লাহ। সময় থাকলে দেখা করে আসবো।
— অহন তো বাড়ি যাইবা। আও নামায় দেই। লগে ব্যাগ আছে নাকি?
— না। আর বাড়িতে না চেয়ারম্যান চাচার বাড়িতে চলো।
— আইচ্ছা উঠো।
গন্তব্যে পৌঁছে ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়ালো তিন্নি। পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে বখতিয়ারের সামনে ধরতেই সে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,
— ছি ছি আফা তোমার থেইকা ভাড়া নিমু? যহন কুনো কাম কাজ ছিল না তোমার আব্বায় আমারে প্রথম ভ্যান কিনা দিছিলো। আজ আল্লার রহমতে খাইয়া পইরা ভালো আছি। বড় ভালো মানুষ তোমরা তোমাগো থেইকা টাকা লইতে পারতাম না।
— বেশি কথা বলো না তো। তোমাকে ভাড়া কে দিচ্ছে। ভাবীর এখন স্পেশাল সময় চলছে। এখন ভালো মন্দ অনেক কিছুই খেতে ইচ্ছা করবে। ভাবীকে ফলমূল কিছু কিনে খাইয়ো।
— তুমি নিজে নিয়া যাইয়ো।
— আমার সময় হবেনা। আজ রাতেই বোধহয় ফিরতে হবে। তুমি রাখো তো। নাহলে আর তোমার ভ্যানে উঠবো না।
— আইচ্ছা দাও। তোমার লগে তর্কে জেতা অসম্ভব।
টাকা নিয়ে বখতিয়ার চলে যেতেই চেয়ারম্যানের বাড়ির ফটক দিয়ে ভেতরে গেলো তিন্নি। চেয়ারম্যান আর কাদের বসে কথা বলছে। তাদের দুজনের মুখেই হাসি। তিন্নি তাড়াতাড়ি ফোন বের করে ভিডিও রেকর্ডিং শুরু করলো। চেয়ারম্যান বলছে,
— শুনো কাদের জমিখানা তোমারে পাওয়ানোর ভালো একখানা পরিকল্পনা আমি করছি। কিন্তু আমার কথাটা ভুললে চলবেনা।
— না না চেয়ারম্যান সাব। জমি খানা পাইলে আপনার পাওনা ও আপনি পাইয়া যাইবেন। কিন্তু কিভাবে কি করবেন। ও জমি তো তৌহিদ আমার বাপের থেইকা কিনছিলো। কাগজ পাতি দেখাইলে?
— শুনো মিয়া, গেরামে আইনের থেইকা আমার চলে বেশি। আর আমি জানি জমি কেনার সময় যে সাক্ষী ছিল তার একজন ও এইহানে উপস্থিত নাই। আর তোমার বাপ আর তৌহিদ কেউই জিন্দা নাই। জমির মাপ নিয়া গেরামের লোকজন রে যখন ভুল বোঝানো গেছে তখন জমি যে আদৌ বিক্রি হয় নাই এই কথা বোঝাতেও টাইম লাগবে না।
— যদি বাঁধা দেয়। তৌহিদের ছোট মাইয়া তো আবার সবকিছু একটু বেশি বুঝে।
— আরে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি আমার বুদ্ধি রে টক্কর দিবো। দেখতো পর পর দশ বছর ধইরা চেয়ারম্যান আছি কেউ নামাতে পারছে আমারে।
— কনফিডেন্স থাকা ভালো চাচা। ওভার কনফিডেন্স সবসময়ই মানুষ কে বিপদে ফেলেছে।
ওদের কথার মাঝখানেই তিন্নি কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এলো। তিন্নি কে দেখে দু’জনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। চেয়ারম্যান নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
— আরে তিন্নি যে। কখন আসলা। আসো বসো কতদিন পর দেখলাম তোমারে।
— বসাবসি পরে হবে। আগে কাজের কথা বলি।
— হ এর জন্যই তো অপেক্ষা করতেছি। আমিন আসলেই জমি মাপা শুরু করবো।
— জমির পরিমাপ তো ঠিকই ছিল চাচা। পুঁতে রাখা খুঁটি তুলে ফেলার বিচার করবেন না।
— জমি জমার বিষয়ে তোমার জ্ঞান খুবই সল্প। আমারে সব সামলাতে‌ দাও।
— যাতে আপনাদের প্লান সাকসেস হয়।
— প্লান কিসের প্রদান?
— এতক্ষণ ধরে আপনারা যে আলোচনা করছিলেন সেটা আমি আমার ফোনে রেকর্ড করে নিয়েছি। আজ জমি নিয়ে যদি বিন্দুমাত্র দুর্নীতি হয় তাহলে পুরো গ্রাম বাসি কে আমি রেকর্ডিং দেখাবো। মুজিবুর চাচা কয়েক বছর ধরে চেয়ারম্যান পদের জন্য লড়ছেন। সামনে বার বোধহয় ওনার স্বপ্ন টা পূরণ হবে।
— আমার ভুল হয়ে গেছে মা এমনটা করো না। তোমাদের জমি তোমাদেরই থাকবে। এই কাদের যত নষ্টের গোড়া আমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে ঝামেলায় ফেলতে চায়।
— সামনে তিথি আপার বিয়ে এই মুহূর্তে জমি জমার ঝামেলা বুঝতেই তো পারছেন আপার শ্বশুর বাড়ির লোকজন যদি জানে আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান দুর্নীতিবাজ। ব্যাপারটা কেমন দেখায় না।
— সেটাই তো। তুমি চিন্তা করো না। তোমাদের জমি তো সবই ঠিকঠাক কোনো ঝামেলা নাই।
— খেয়াল রাখবেন চাচা আমাকে এ ব্যাপারে যেন আবার গ্রামে ছুটে আসতে না হয়। বিয়ের এত ঝামেলা বুঝতেই তো পারছেন।
— হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। কোনো অসুবিধা হবে না।
— চলুন তাহলে। জমির ওখানে যাই। এবার আপনি নিজে জমিতে খুঁটি পুঁতবেন।
আর কথা বাড়ালো না চেয়ারম্যান। মনে মনে বললো, ” তৌহিদের ছোট মেয়ে শুধু বেশি বোঝে না অসময়ে অজায়গায় চলেও আসে।”

গ্রামে আরও একদিন থেকে আসতে হলো তিন্নি কে। শিরিন ফোন করে জানালেন গ্রামেই বিয়ের ব্যাবস্থা করতে পারে তিন্নিরা। তাই বর যাত্রীর থাকার জায়গা ঠিক করে আর কিছু এক্সট্রা কাজ করে তবেই ফিরেছে ও। তিন্নি দের গ্রামে প্রায়ই বিভিন্ন এনজিও থেকে লোকজন আসে। মাঝে মাঝে এসব এনজিওর সাথে জড়িত বাইরের দেশের লোকজন ও আসে। তাদের এখানে থাকতে অসুবিধা হয় বলে গ্রামে একটা সরাই খানার কাজ চলছে অনেক দিন থেকে। সেটা শেষ হয়েছে কিছুদিন। সেটার পুরোটাই বরযাত্রীর জন্য ঠিক করে এসেছে ও। এবং বাড়ি ঘর পরিষ্কার করতে গ্রামের কিছু লোক জন কে কাজে লাগিয়ে এসেছে ও। এখন বিয়ের বাকি আলোচনা করতে আফিফদের বাড়িতে এসেছে ও। শিরিন ড্রয়িংরুমে বসে কিছু একটা লেখালেখি করছিলেন। পাশে বসে তাকে সাহায্য করছে আফিফের ফুফা। বাকিদের কাউকেই দেখতে পেলনা তিন্নি। ও এগিয়ে এসে সালাম দিতেই শিরিন ওর দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
— তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। বসো।
তিন্নি বসতে বসতে বলল,
— কাউকে দেখছি না যে? বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি লাগছে না।
— সব বেরিয়েছে শপিং এ। আফিফের ফুফু, সমস্ত কাজিন দের নিয়ে ওরা শপিং এ বেরিয়েছে। আমাদের তো আয়োজন বলতে বৌভাত। সেটা বিশেষ সমস্যা না। হল বুক করলেই কাজ অর্ধেক শেষ। এখন বসে গেস্ট লিস্ট করছি। তোমার জন্য ও একটা লিস্ট করেছি।
— কিসের লিস্ট?
— বরে কারা কারা যাবে কবে কবে যাবে এই আরকি।
— তাহলে তো আমার খুব সুবিধা হবে।
— তোমরা কবে যাবে বলে ঠিক করেছো?
— ১৫ তারিখ।
— ও। লিস্টে লেখা আছে যদিও তবুও সংক্ষেপে তোমাকে আমি বলি আমাদের ইয়ং জেনারেশন মানে আফিফ আবিদের কাজিন বন্ধুরা আগে আগে পৌঁছে যাবে। আর হলুদের আগের দিন মুরুব্বি যারা আছে তারা। আফিফ কে ভেবেছিলাম মুরুব্বিদের সাথে পাঠাই। কিন্তু আমার ছেলেটা সেটা শুনলে তো। আমিও ভাবলাম পাঁচ বছরের প্রেম সংসারের মতোই হয়ে গেছে এখন আটকে লাভ কি। সবাই একটু আনন্দ করবে। তোমার দায়িত্ব কিন্তু বেড়ে গেল। একঝাঁক দড়ি ছাড়া ক্ষ্যাপা ষাঁড় পাঠাচ্ছি সামলে নিও।
— চিন্তা করবেন না আন্টি।
— চিন্তা করছি না তো। এটা তো ফরমালিটির জন্য বললাম। আমি জানি তুমি সামলে নিতে পারবে।
বিয়ের বাদবাকি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর বেরিয়ে এলো তিন্নি। এখনো বিয়ের একগাদা শপিং বাকি, গেস্ট লিস্ট করতে হবে। তবে তার আগে একবার ব্যাংকে যেতে হবে।

চলবে……..…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here