#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব৩
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিম
রাত সাড়ে বারোটা বাজে। অনেক মানুষ ঘুমিয়ে গেলে ও শহরটা ঠিকই জেগে আছে। একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল জরির। পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে সে ডায়নিং এ এলো। পানি খাওয়া শেষে নিজের রুমে যেতে গিয়ে দেখলো তিন্নির রুমের লাইট এখনো জ্বলছে। এটা নতুন দৃশ্য না। প্রায় দুই তিনটা অবধি তিন্নি জেগে থাকে। অনেক সময় সারা রাত ও কেটে যায়। জরি ভেবে পায় না রাত জেগে এত কাজ করার দরকার কি। আল্লাহ রাত দিয়েছেন ঘুমানোর জন্য। আর তিন্নি দিনে তো কাজ করেই রাতে একটু ঘুমালে কি হয়? জরি রান্না ঘরে গিয়ে ভালো করে কফি বানালো। এ বাড়িতে একমাত্র তিন্নির কোনো কাজ জরির করা লাগে না। তিন্নি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করে। তবে সুযোগ পেলেই জরি তিন্নির কাজ করে দেয়। এই যেমন এখন কফি বানালো। কফিটা নিয়ে তিন্নির টেবিলের উপর রাখতেই তিন্নি মুচকি হেসে বলল,
—থ্যাংক ইউ জরি বু এখন এক কাপ কফি খেতে খুব ইচ্ছা করছিল।
—ইচ্ছা হইলেই বা কি কহনো তো কইবাই না।
—না বলেই যদি পাওয়া যায় তাহলে তো ভালোই।
—তোমার জান নাই ছুড আফা। সারাডা দিন বাহিরে কাজ কাম করলা। বাসায় আইয়া আবার কত্তগুলান কাপুড় চুপুর ধুইলা। আমারেও ধুইতে দিলা না। ওহন আবার রাত জাইগা কি করো?
—এসাইনমেন্ট করছি জরি বু। সারাদিন তো কাজের মাঝে থাকি পড়াশোনা করার সময় পাইনা।
— এতু কাম কইরা লাভ কি? আম্মা তো কাম করেই। কিছুর তো অবাব নাই তুমাগো।
— শুধু মাত্র টাকা কামানো টাই কি সব?
— তা না তো কি?
—শোনো এটাকে বলে স্বনির্ভরতা। আমি আসলে কারো উপর নির্ভরশীল হতে চাই না। এই যে যখন তখন বেরিয়ে যাচ্ছি আমার কি কারো কাছে জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে। না কি হাত পেতে আম্মার থেকে টাকা নিতে হচ্ছে।
— মায়ের থেইকা টাকা লইতে দোষ কি?
— আচ্ছা তোমাকে একটু সহজ ভাবে বোঝাই। যেমন তোমার ব্যাপারটাই ধরো। যখন তুমি দুনিয়ায় এলে তোমার কাছে কিছুই ছিলনা। গায়ে পরার একটা সুতো পর্যন্ত না। এই অবস্থায় তুমি সর্বপ্রথম একটা সম্পর্ক পেলে। তোমার মা। তার প্রতি তুমি সবকিছুর জন্য নির্ভরশীল। তোমার মা অলরেডি তোমার বাবার ওপর নির্ভরশীল। কিছু বছর পর তোমার মা যখন মারা গেলেন তখন তোমার বাবা তার শূন্য স্থান পূরণ করতে আরেকটি বিয়ে করলেন। কারণ কিছু বিষয়ে তিনি তার স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু তোমার জন্য ব্যাপারটা হয়ে গেল ভয়াবহ। সৎমা তোমার মায়ের জায়গাটা তো নিলেনই না বরং তোমার বাবাও তোমার থেকে দুরে চলে গেল। আর বেঁচে থাকার জন্য তোমাকে ঐ জাহান্নামে পড়ে থাকতে হলো যতদিন না রফিক ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়ে হলো। বিয়ের পর তুমি রফিক ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলে। তারপর একদিন সে ও তোমাকে ছেড়ে চলে গেল। আব্বা যদি তোমাকে আমাদের বাড়িতে না নিয়ে আসতো তাহলে তুমি কি নিজেকে সমাজ থেকে রক্ষা করতে পারতে? এর কারণ সবসময় তুমি বেঁচে থাকার জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আমি এমন হতে চাই না। নিজের যতটুকু যোগ্যতা আছে তা দিয়ে স্বনির্ভর হতে চাই বুঝলে। যাতে করে কেউ আমার জীবনে থাকুক বা না থাকুক আমার কোনো সমস্যা না হয়। আর স্বনির্ভর হওয়া মানেই স্বাধীনতা তুমি এমনিতেই পেয়ে গেলে।
—তুমার এই ভারী কতা আমার মাতায় ঢুকে না। যেরাম আছি ভালা আছি।
তিন্নি আর কিছু বলল না। মুচকি হেসে লেখায় মন দিল। জরি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ লেখার পরে তিন্নি বলল,
—তোমার কষ্ট করে জেগে থাকতে হবে না। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
— আফা আরেক খান কতা কই?
— বলো।
— তুমার চান্দের লাহান চেহারা মাশআল্লাহ। কিন্তু তুমি বড় আফার মতো টিপটপ হইয়া চলো না ক্যান? আমাগো তোমারে এমনে দেখতে ভালা লাগে না। এই জন্যই তো বাবু আইজকা কামডা করল।
— স্বাভাবিক মেয়েরা যেভাবে চলা ফেরা করে আমি সেভাবে চলতে পারিনা জরি বু। অনেক সময় সৌন্দর্য ও মেয়েদের জন্য অভিশাপ। আমার জন্য তো সৌন্দর্য আর বয়স দুটোই অভিশাপ।
— এ কেমুন কথা।
— আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আমি নিজের উপর অনেক দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি। এই দায়িত্ব গুলো আমার বয়সের মেয়েদের নেওয়ার কথা না। অনেক গুলো তো মেয়েদের ই নেওয়ার কথা না। তবুও এগুলো আমাকে নিতে হয়েছে। সেগুলো সঠিক ভাবে পালন করার জন্য আর নিজেকে সেফ রাখার জন্য আমাকে একটু পরিবর্তন হতে হয়েছে। বলতে পারো দায়িত্ব গুলো কে নিজের যোগ্য না বরং নিজেকে দায়িত্ব গুলোর যোগ্য করে তুলতে হয়েছে।
— তুমার কতার আগা মাতা কিছু বুঝিনা।
— আজ বুঝে কাজ নেই। পরে একসময় বুঝিয়ে দেব। তুমি এখন ঘুমাতে যাও। আমাকে লিখতে হবে।
জরি আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ তিন্নির রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ড্রয়িং রুমে বসে চা খেতে খেতে একটা ম্যাগাজিন পড়ছেন শিরিন রহমান। তাকে দেখে মনে হতে পারে তিনি ম্যাগাজিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু পড়ছেন। কিন্তু আসল ব্যাপার সেটা না। তিনি গভীর ভাবে কিছু একটা চিন্তা করছেন। তার চিন্তার কেন্দ্র বিন্দু তার দুই ছেলে। বড় ছেলে আফিফ রহমান। স্বভাবে শান্ত শিষ্ট। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সফল। তার হাতে বিজনেসের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে তিনি একপ্রকার নিশ্চিন্ত বলা যায়। কিন্তু তবুও একটা ব্যাপারে তার বড়ছেলে তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেটা হলো ছেলের বয়স ত্রিশ কিন্তু তিনি ছেলের বিয়ে দিতে পারছেন না। অনেক চাপাচাপির পর তিনি জানতে পেরেছেন যে তার শান্ত শিষ্ট বড়ছেলে প্রেম করছে। ছোট ছেলের ব্যাপারে এ তথ্য জানলে তিনি এতটা আহত হতেন না। তিনি বিশ্বাস ই করতে পারছেন না তার বড়ছেলে তাকে লুকিয়ে প্রেম করছে তাও পাঁচ বছর যাবত। যাই হোক সমস্যা সেটাও না। প্রেম করছে ভালো কথা এখন বিয়ে করতে তো আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু তাকে বিয়ের কথা বললেই সেটা সে এড়িয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির ব্যাপারেও কোনো তথ্য দিচ্ছে না। ব্যাপারটা রহস্য জনক। তিনি ভাবছেন তার ছেলে আদৌ প্রেম করে নাকি বিয়ে না করার বাহানা এটা। আর ছোট ছেলেকে নিয়ে তো তার চিন্তার শেষ নেই। বড়টার পুরোই উল্টো স্বভাবের। ছোট ছেলে আবিদ রহমান। বয়স ছাব্বিশ বছর। অনার্স শেষ করেছে একবছর হলো। কিন্তু কাজে কর্মে তার একটুও মন নেই। সারাদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে উশৃঙ্খল জীবন যাপন করছে। তিনি কতবার বলেছেন ভাইয়া কে বিজনেসে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু আবিদ তা কানেই তোলেনি। যদিও বড় ছেলের ব্যাপারটাই তাকে বেশি ভাবাচ্ছে। এমন সময় ছোট ছেলেকে সেজেগুজে বাইরে যেতে দেখে তিনি ডাক দিলেন। আপত্তি থাকা সত্বেও বিরক্তি নিয়ে আবিদ ওনার কাছে এসে বলল,
— কি বলবে জলদি বলো।
— এত তাড়াহুড়া করে কই যাচ্ছিস?
— এটা জানার জন্য ডাকলে?
— না। তুই কি জানিস তোর ভাইয়া প্রেম করছে?
কথাটা শুনে মোটেও বিচলিত হলোনা আবিদ। বরং বিরক্তি নিয়ে বলল,
— তুমি ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে একটু বেশিই টেনশনে আছি। তাই এরকম উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা তোমার মাথায় আসছে।
— তোর কি মনে হয় আমি হাওয়ায় কথা বলি। তোর ভাইয়া নিজের মুখে আমাকে বলেছে।
এবার আবিদ একটু অবাক হলো। মায়ের সামনের সোফায় বসতে বসতে বলল,
— ওহ মাই গড মা। তুমি কি ঠিক শুনেছ। ভাইয়া আর প্রেম এটা জাস্ট অসম্ভব।
মনে মনে একটু খুশি হলেন শিরিন। তিনি একাই এটাকে অসম্ভব মনে করেন না। কিছু একটা চিন্তা করে আবিদ বলল,
— ব্যাপারটা সত্যি হলে তো ভালোই মা। ভাইয়া যাকে পছন্দ করে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দাও। ভাইয়া ও খুশি, তুমিও খুশি।
কথাটা বলেই উঠে পরল আবিদ। মায়ের কোনো কথা না শুনেই বেরিয়ে গেল ও। আজ মঙ্গলবার। তিন্নির সাথে দেখা করার একটা সুযোগ এসেছে। সেটা কিছুতেই মিস করা যাবেনা।
বিকালের শো টা শেষ করে স্টুডিও থেকে বের হলো তিন্নি। দুটো টিউশনি আছে আজ। সেটা শেষ করে একবারে বাসায় যাবে ও। সেই উদ্দেশ্যে অফিস থেকে বের হলো তিন্নি। কিন্তু বের হওয়ার পর যে দৃশ্য দেখলো তাতে মাথা গরম হয়ে গেল ওর। ঠিক ওর অফিসের সামনে হাসিমুখে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবিদ। তিন্নি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আবিদ কে এড়িয়ে চলতে লাগল। আবিদ ও তিন্নির পিছু পিছু আসছে। আবিদ কে এড়ানোর জন্য তিন্নি দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। আবিদের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এল। তিন্নিকে রাগানোর জন্য ও ও দ্রুত হাঁটতে লাগলো। তিন্নি এবার দৌড় শুরু করল। আবিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ও ভাবতে পারেনি যে তিন্নি দৌড় শুরু করবে। ও এক মুহুর্ত থমকে দাঁড়ালো। তারপর তিন্নিকে আটকাতে ওর পিছু পিছু ছুটল। কিছুক্ষণ দৌড়ে তিন্নির মাথায় এলো ও কেন দৌড়াচ্ছে? লোকটাকে ভয় পাবার তো কিছু নেই। ও সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। এতক্ষণ দৌড়াতে গিয়ে খেয়াল করেনি কোন দিকে যাচ্ছে। থেমে দেখল অফিস থেকে কিছুটা দূরে একটা নির্জন জায়গায় চলে এসেছে। ও ফিরে যাওয়ার জন্য পিছন ফিরতেই কেউ একজন ওর পেটে ছুরি ধরে বলল,
— যা আছে লক্ষি মাইয়ার মতো দিয়া দেন।
হঠাৎ আক্রমনে ঘাবড়ে গেল তিন্নি। কোন মতে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
— আপনি কে?
— অত কিছু জাইনা তো আপনের লাভ নাই। যা আছে দেন। জান নিয়ে বাইর হইয়া যান।
— দেখুন আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমি পুলিশ ডাকবো।
— কেমনে ডাকবা। একটু নরনচরন করছ কি ছুরি তোমার পেটের মধ্যে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আবিদ পিছন থেকে এসে লোকটাকে চেপে ধরলো। লোকটার হাতে ছুরি তখনও ধরা রয়েছে। সেটা দিয়ে আবিদের ওপর হামলার চেষ্টা করল লোকটা। তিন্নি ইতিমধ্যে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। আবিদ আর লোকটার মধ্যে তখন ও ধস্তাধস্তি চলছে। তার মাঝ থেকেই আবিদ বলল,
— চিৎকার না করে হেল্প করো আমাকে।
— কিভাবে?
— সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে? আসে পাশে দেখ কিছু পাও কিনা। সেটা দিয়ে লোকটাকে এ্যাটাক করো।
তিন্নি কিছুক্ষণ আসে পাশে খুঁজে একটা লাঠি জাতীয় কিছু নিয়ে এলো। সেটা দিয়ে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে সজোরে বারি মারতেই আবিদ চিৎকার দিয়ে উঠলো। ধস্তাধস্তির কারণে লোকটা আর আবিদের জায়গা বারবার পরিবর্তন হচ্ছিলো। তাই লোকটার বারি না লেগে বারিটা আবিদের মাথায় লাগল। লোকটা ছাড়া পেয়ে তিন্নির দিকে আসতে যাবে তখনই কিছু লোক জনের আওয়াজ শুনে সেখান থেকে দ্রুত সরে পরল। আবিদের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। তিন্নি দ্রুত সেখানে গিয়ে আবিদ কে ধরে বসল। আবিদের মাথায় আরো একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। তিন্নির ওপর ভর দিয়ে ও বেহুঁশ হওয়ার নাটক করল। তিন্নি ওকে সামলাতে না পেরে ওকে নিয়ে মাটিতে বসে পরলো। আবিদের কাটা জায়গায় নিজের সাদা ওড়না চেপে ধরতেই মুহূর্তেই সেটা লাল হয়ে গেল। আবিদ কে বেহুঁশ হতে দেখে আর এত রক্ত দেখে ঘাবড়ে গিয়ে হুট করে তিন্নি কাঁদতে শুরু করে দিল। এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিত সেটা ওর মাথায় আসছে না। লোকটার প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। চোখটাও খুলছে না। লোকটা মরে যাবেনা তো আবার!
চলবে…………..