মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ২৮,২৯

0
447

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ২৮,২৯
সায়লা সুলতানা লাকী
২৮

বেশ কয়েকদিন ধরেই লাবন্যের মনটা বেশ ভার ভার হয়ে আছে। সারাক্ষন কি যেনো ভাবে, কিন্তু নানিকে কিছুই বলে না। বিচক্ষন নানিও আগ বাড়িয়ে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেন না। ভিতরে ভিতরে হিমেলকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে নতুন সেমিস্টারে ফি জমা দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি তাই ভেবে নিলেন হয়ত এই বাড়তি টাকার জন্যই ও এতটা টেনসড হয়ে আছে। সেমিস্টারের ফি গুছানো হলে পরে তিনি ওকে ডেকে বলে দিলেন যে তিনি ওর আব্বুকে জানিয়ে দিয়েছেন বাড়তি টাকার কথাটা। লিখন টাইমলি তা পরিশোধও করে দিবে বলেছে।এসব নিয়ে যেনো লাবন্য কোন টেনশন না করে।
কিন্তু তারপরও ওর টেনশন যেনো কমল না। দিন যেতে যেতে যখন লাস্ট ডেট চলে এল তখন লাবন্য বেশ সাহস নিয়েই ওর নানির কাছে এসে বলল
“আচ্ছা নানি, এই সেমিস্টারে টাকাটা আব্বুকে বলো না আমার হাতে দিতে, আমিই জমা করে দিব।তাকে আর কষ্ট করতে হবে না তাহলে আমার জন্য ।”
লাবন্যের কথা শুনে নানি এবার বেশ চিন্তায় পড়লেন, মনে মনে বললেন” মেয়েটার আসলে সমস্যাটা কেথায়? সেমিস্টার ফি নিয়ে সমস্যা হলে এতদিনে সে জানতো যে তা দেওয়া হয়ে গেছে। মেয়ের সমস্যাতো অন্য জায়গায়। কিন্তু এখন বিষয়টা হল, জিজ্ঞেস করলে কি সত্যটা বলবে এই মেয়ে?”

নানি চুপ আছে দেখে লাবন্য আবারও বলল
“নানি শোনো ওনার এখন নতুন এক সংসার হয়েছে, শুধু শুধু কেন আমাদের জন্য সময় নষ্ট করবে, তার চেয়ে টাকাগুলো আমাদেরকে দিয়ে দিলেই হল, তার ঝামেলা শেষ। আমাদেরটা আমরাই সমাধান করতে পারবো।”
“টাকা দিয়ে আসলে কি করবি?”
“কি করব মানে? ফি জমা করে দিব!”
“উঁহু, তুইযে সত্য বলবি না তা আমি জানি।”
“আচ্ছা নানি তুমি যে রুশের স্কুলে যাও, তোমার সাথে ওই এডভোকেট আন্টির দেখা হয়েছে কখনও?”
“হুমম, এক দুই দিন দেখা হয়েছিলোতো।”
“কিছু বলেছে তোমাকে?”
“নাতো! কি বলবে? কি সম্পর্কে? ”
“টাকা নিয়ে, আমাকে খোঁজেনি? আমি তো এখন আর যাই না স্কুলে।”
“নাতো, টাকার কথাতো কখনও কিছু বলেনি। তবে হ্যা তোর খোঁজ খবর নিয়েছিলো।”
“জানতাম নিবে। টাকাটাইতো এখনও গোছাতে পারলাম না। কীভাবে যে দেখা করি তার সাথে?”
“কিসের টাকা? তার ফিসটা?”
“হুমম।”
“ওটাতো কবেই শোধ করে দিয়েছে লিখন। ওই টাকার চিন্তায় তুই এতটা কাতর হয়ে আছিস?”
“কি বলছো তুমি? ওই টাকা আব্বু দিয়ে দিয়েছে?”
“হুমম, অনেক আগেই দিয়েছে। সন্তানের করা ঋন, বাজিয়ে রাখবে না কি?”
“উফফ, জানটা বাঁচলো। কি যে একটা টেনশনে ডুবে ছিলাম তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।” কথাটা শেষ করেই লাবন্য আর দাঁড়ালো না নিজের রুমে চলে গেল।

ওর নানি চুপচাপ ওর আচরনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। উনি ভেবেছিলেন বাপ টাকাটা দিয়ে দিয়েছে শুনে বাপের উপর কিছুটা হলেও খুশি হবে। কিন্তু না ওর ভেতরে তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেলো না।

রাতে খাওয়ার সময় লাবন্য আবার একবার জিজ্ঞেস করল নানিকে, টাকাটা সত্যি সত্যিই দিয়েছেতো ওর আব্বু! আর নানি সে বিষয়ে পুরোপুরি কনফার্মতো!
এমন প্রশ্নে এবার তিনি একটু রেগে গেলেন। বেশ শক্ত গলাতেই বললেন
“এটা কেমন প্রশ্ন হল ? তোর আব্বুকে কি এতটুকুও বিশ্বাস করতে পারছিস না? সে বলছে দিয়েছে তারপরও তুই বলছিস কনফার্ম করতে? লিখন তোর দেওয়া কার্ড নিয়ে সেই এডভোকেটের সাথে দেখা করেছে, এই ফ্ল্যাট তোদের নামে রেজিষ্ট্রেশন করিয়েছে। তার ফিস দিয়েছে।আর তুই ওকে এতোটা অবিশ্বাস করছিস?”

“সত্য বলতে যতদিন শুধু সে আমার আব্বু ছিল ততদিন তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতাম।যখন থেকে সে আরেকজনের বর হয়েগেল তখন থেকে তার উপর থেকে ভরসা,বিশ্বাস সব হারিয়েছি।”

“এটা মোটেও ঠিক না। কখনও নিজের অধিকার রাগ করে ছাড়তে নেই। রাগ ভালো কিছু দেয় না জীবনে। ও তোদের আব্বু ছিল, আছে, থাকবে।তোরা অধিকার ছাড়লে তা অন্য কেউ দখল করবে। নিজের অধিকার নিজেকেই আগলে রাখতে হয়, যত্ন করতে হয়, প্রতিষ্ঠা করতে হয়।”

“মানে, তুমি কি বলতে চাচ্ছো? ”
“কিছুই না, নিজের বাপকে নিজের করে রাখতে বলছি, বাপের প্রতি নিজের অধিকার খাটাতে বলছি। যেমনটা আগে করতি।”

“তুমি সব জেনেও তাই বলছো? সে আমাদের কথা না ভেবে আরেকটা বিয়ে করে এসেছে, তাকে কি করে আবার আগের জায়গায় বসাই? এটা তোমার মতো মানুষ কেমন করে বলে তা বুঝতে পারছি না!”

“তোদের ধারনা কি ভুল শুধু ছোটোরা করে আর বড়রা সবসময় তা ক্ষমা করে দেয়? কখনও এমন কি হয় না যে বড়রা ভুল করে আর ছোটরা তা ক্ষমা করে দেয়?”

“ও মাই গড! আব্বুর এই ভুলতো কোনদিনও ক্ষমা করা সম্ভব হবে না। আমি কেন এটা কোন মেয়েই পারবে না।”

” হুমম, এই ক্ষমাটুকু আমরা করতে পারি না বলেই সারাজীবন শুধু কষ্ট, হাহাকার বহন করে বেড়াই।যদি তোর মা’কে ক্ষমা করতে পারতো তোর নানা, তবে আবার ও আমার বুকেই থাকতে পারতো। তাহলে আর ওর ভিতরটা এতটা দগ্ধ হতো না অনুশোচনায়। জীবনটা আমাদের বেশ আনন্দেই কাটতে পারতো।আমরা সবাই সবার জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু কষ্টের সাগরে ডুবে হাহাকার করতে করতে জীবনটাকে শেষ করতাম না। হায়রে ক্ষমা, হায়রে ক্ষমতা। কেন যে আল্লাহ সবার ভিতরে এই ক্ষমা করার ক্ষমতাটা দেয় না, তা আমি জানি না।” কথাটা শেষ করে একটা জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

“নানি আজ তোমার আসলে কি হয়েছে বলোতো! কিসব আবোল তাবোল বলছো। তাকে ক্ষমা করা মানে বোঝো? আমি আমার এই ছোট্ট মাথায় তা বুঝি আর তুমি এত জ্ঞানী হয়ে তুমি বোঝো না?”

“হুমম আসলেই বুঝি না। বাদ দে এসব কথা। আজ মনটা মনে হয় ভালো নাই। কোন কিছু ভালো লাগছে না। কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না। ”

“তোমার শরীর ভালোতো?”
“হুমম ভালো। তোরা খেয়েনে। আমি উঠি।” বলে নানি উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। লাবন্য বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে, আজ এই এক অন্য নানিকে যেনো দেখছে ও।

খালা বুয়া তরকারি নিতে এসে লাবণ্যকে বলল
“খালাম্মার মনডা আজকা বেশি খারাপ হইছে কারন আপনের মামারা যে কেউ খোঁজ নিতে আসে না সেই দুঃখে।”

লাবন্য প্লেটের খাবারগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে আপন মনেই বলল, পৃথিবীতে কেউ সুখী না।একেকজন একেক দুঃখে দুঃখী। সবারই নিজস্ব কিছু দুঃখ থাকে তা সে কাউকে শেয়ার করতে চায় না। মনের মধ্যেই চেপে রেখে শুধু কষ্ট পায়।

হোমায়রা চলে যাওয়ার পর রেহেনা বেগম একদিন কল দিয়ে তার মায়ের সাথে বেশ অনেকক্ষন কথা বললেন। লাবন্য টের পেলো যে বড় খালামনি কল দিয়েছেন তাই আর নানির সামনে গেলো না।বলুক কথা তারা নিরিবিলি। খালামনি কাঁদ ছিলো তা বোঝা যাচ্ছিলো নানির কথায়। দূর থেকে শুনে নিজেরই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সন্তান কষ্ট পেলে মায়ের কাছেই আশ্রয় চায়। সেটা যে বয়সেই হোক। সন্তান সন্তানই হয় আর মা মা’ই হয়। হয়তো মেয়ে চলে যাওয়ায় মনটা বেশি খারাপ খালামনির। হঠাৎ মনে হল খালামনি কতটা ভাগ্যবতী, এই বয়সেও তার মনের কষ্ট জমা রাখার ব্যাংক আছে অথচ এই ব্যাংকটা ওর আম্মুরও ছিলো না আর ওর এই বয়সেই তা নাই। হঠাৎ করেই বুকটা খা খা করে উঠল নিজের মায়ের জন্য। এখন হুটহাট খুব একটা মায়ের কথা মনে পড়ে না আজ এমনভাবে মনে পড়তেই চোখগুলো ভিজে উঠল। রুশকে আড়াল করে নিজের রুমে ঢুকে গেল। বুঝল আজ আর এই কান্না বাঁধ মানবে না।

এভাবে কাটতে লাগল দিনগুলো ওদের সবকিছু কেমন একটা নিয়মের মোড়কে আবদ্ধ হয়েগেল। বেশ কিছুদিন পর একদিন হিমেল আসল ওদের বাসায়।সেদিন হাতে ছিলো মতিচুর লাড্ডু আর রসগোল্লা। লাবন্য ওকে দেখেও না দেখার ভান করে নিজের রুমে গিয়ে বসে থাকল। রুশতো রসগোল্লা দেখেই খুশিতে লাফাতে লাগল। গোটা কয়েক এরই মধ্যে গপাগপ মুখে পুড়ে দিল। ওর অবস্থা দেখে হিমেল বেশ খুশি হয়ে গেল।

“শেষ পর্যন্ত চাকরিটাতেই জয়েন করে ফেললি?” নানি বেশ চিন্তিত মুডে প্রশ্নটা করলেন।

“হুমম, এছাড়া আর কি’ইবা করতে পারতাম? নিজের যোগ্যতা প্রমান করার আর কোন পথ খোলা ছিলো না সামনে।”
“উচ্চতর ডিগ্রি? ”
“ধরে নাও ওটা ভাগ্যে নাই।”
“পরে একটা সময় এটা নিয়ে আফসোস থাকবে মনে।”
“পরিপূর্ণ ভাবে কেউ সব পেয়েছে এমন মানুষ কয়জন পাবে? কিছু না কিছুতো ছাড় দিতেই হয়েছে জীবনকে গোছাতে গিয়ে৷ আমি না হয় ওটাই ছাড়লাম।”
“আফসোস জিনিসটা খুব খারাপ, খুব পোড়ায় কিন্তু। ”
“উফফ নানু, তুমি আগে ভাগেই এত ভয় দেখাচ্ছো কেন? আমার চাকরির মিষ্টি খাও। লাড্ডু খাও।”
“হুমম খাব, খাবো না কেন? তুই চাকরি পেয়েছিস তাতেতো অনেক খুশি হয়েছি। তুই কি ডিসিশন নিবি তা নিয়ে কয়দিন খুব টেনশনে ছিলাম।”

“কি মনে হয়? ডিসিশনটা ঠিক আছেতো? ”
“তা আমি জানি না। এটা সম্পূর্ণই তোর বিষয়। এই সম্পর্কে আমি কিছুই বলবো না কখনও। ”
“কিছু বলতে হবে না তুমি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করো।”
“তা সবসময়ই করি। তোরা সুখে থাকলে আমার চেয়ে আর কে বেশি খুশি হবে।”
“হুমম, যাই তাকেও একটু মিষ্টি খাওয়ায় আসি।” বলে হাসতে হাসতে মিষ্টি নিয়ে লাবন্যের রুমের দিকে গেল হিমেল।

“কিরে আমি আসলাম মিষ্টি নিয়ে সুখবর দিতে আর তুই মুখ ফুলিয়ে নিজের রুমে এসে ঘাপটি মারলি ঘটনা কি?এটা কেমন কথা হল বলতো ?
” এই কি? তুমি আমার রুমে আসছো কেন?”
“একশো বার আসবো। তোর সমস্যা কি? ”
“অনেক সমস্যা, সব তোমাকে বলতে হবে নাকি? তা আজ আসছো কেন? আজতো তোমার নানুমনি তোমাকে ডাকেনি? শুধু শুধু এ বাসায় আসছো কেন?”
“চাকরি পেয়েছি।” বলেই হিমেল একটা রাজ্য জয়ের অনুভূতির মতো একটা হাসি দিল।
“তো।”
“তো, মানে? এতো তো তো কোথায় শিখলি?” হিমেলের মেজাজটা একটু গরম হয়ে গেল ওর প্রশ্নে।
“আমার সাথে চিৎকার করবা না। তোমরা পুরুষরা এত সাহস পাও কোত্থেকে? যার তার সামনে দাঁড়িয়েই চিৎকার শুরু করো।সবকিছু কি তোমাদের নিজের সম্পদ মনে করো নাকি?” এবার লাবন্যও ক্ষেপে উঠল আরও বেগে।

“বন্য তোর হইছেটাকি বলতো? তুই সব কিছুতেই এমন রিয়েক্ট করিস কেন ইদানীং? ”

“আমার আবার কি হবে? আমি শুধু শুধু কেন তোমার সাথে রিয়েক্ট করবো? নিজেকে কি ভাবো তুমি?”

“চুপ একদম চুপ, বেশি ভাব ধরবি না? আসলাম তোকে খুশির খবরটা দিয়ে মিষ্টি মুখ করাতে আর তুই…..”

“মিষ্টিমুখ? এই মুখ বিষাদে ভরা, একেবারে তিতা হয়ে আছে। তোমার এসব মিষ্টিতে কখনওই মিষ্টিমুখ হবে না, বুঝলা?”

“তাহলে বল কি লাগবে তোর? তুই যা চাইবি আজ তাই দিয়ে তোকে মিষ্টিমুখ করাবো।” কথাটা বলে একটা দুষ্ট হাসি হাসলো হিমেল।
“এবার কিন্তু তুমি মাত্রা অতিরিক্ত করছো। তুমি এখনই এই রুম থেকে যাবে। এক্ষুনি যাবে। আমি মা হারা এক মেয়ে। আমার আব্বুর দুই বিয়ে। আমি জোর করে আব্বুর থেকে ফ্ল্যাট লিখিয়ে নিয়েছি। আমি অত সহজ মেয়ে না। এটা তুমি বুঝো না?

“এসবতো তুচ্ছ, এসব কোন ব্যাপার হল? তুই তার চেয়েও ডেঞ্জারাস। তুই বন্য। একেবারে খাঁটি বন্য। আমি তা জানি, এর বেশি আর কিছু জানাটা কি খুব জরুরি? ”
“এসব কথা আর কখনও আমার সামনে বলবা না। এসব এখন আর আমার শুনতে ভালো লাগে না। আমি রেশমা না, এমন সব কথায় মন গলে না। কেউ চাইলেই ধোঁকা দিতে পারবে না আমাকে। কোনো প্রতারকে ফাঁদে আমি পা দিবো না।”

“আমিও লিখন না। ধোঁকা দিতে শিখিনি। সব পুরুষকে এক পাল্লায় মাপিস না।”

“তাহলে তুমি কোন টাইপের পুরুষ? স্বার্থপর টাইপের কি? নাকি ফাঁকিবাজ টাইপের। সঙ্গীর বিপদে নিজে গুম হয়ে যাওয়া কেউ? যেখানে কি না সঙ্গী আশা করে থাকে তার পাশে এসে দাঁড়াবে কেউ। কিন্তু না উলটা ধমকা ধমকি করে দূরে সরে থাকা কেউ তুমি?”

“বাহ দারুন বলছিসতো! টাইপগুলোও ভালো মিলিয়েছিস। দারুন, দারুন। সবাই শুধু নিজেরটা দেখে, নিজের অবস্থান থেকে যা দেখা যায় তাই মনে গিট্টু বেঁধে রাখে। এটা এক প্রকারের অন্ধত্ব।”

“আমি অন্ধ? হুম আমি অন্ধ। হ্যা যাও আমি অন্ধ। আমার সামনে আর কখনও আসবা না। তুমি ভালো, তুমি ভালো নিয়ে থাকো। আমি এখন একা চলতে শিখেগেছি। আমার আর কাউকে লাগবে না। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না।দুনিয়ার সব পুরুষ খারাপ। চরিত্রহীন, স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক। এদের ছায়াও আমি আর মাড়াতে চাই না।” কথাগুলো এতটাই চিৎকার করে বলে উঠল যে ওদের নানু ছুটে আসল ওদের রুমে এসব শুনে ভয়ে।

“এই কি হল তোদের মাঝে? আস্তে আস্তে লাবু। এতটা রেগে গেলি কেন? শান্ত হয়ে কথা বলা যায় না?”
“সরি নানুমনি, তুমি আবার আসলে কেন? ভয় পেও না। ওতো আগে থেকেই পাগল এখন মনে হচ্ছে আরও বেশি পাগলামি বাড়ছে।”

“হ্যা আমি পাগল, তুমি যাও। ভালোদের কাছে যাও। সাবধান আর কখনও আমার সামনে আসবা না। আসলে কিন্তু ভালো হবে না। পাগলামি কাকে বলে তা দেখিয়ে দিব। আমি লাবন্য একটা শয়তান মেয়ে, বদমায়েশ একটা মেয়ে। আমি আমি হলাম পৃথিবির সবচেয়ে অযোগ্য একট মেয়ে। ” আর বলতে পারলো না হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

“উফ, ভয় পাইছি।উফফ ভয়রে….”
“আহ হিমু! এখন এসব দুষ্টুমির সময় না। ওকে এখন একটু একা থাকতে দে। এত রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। লাবু মাথা ঠান্ডা কর নানুমনি আমার।শান্ত হও। বসো সোনামনি, তুমি আমার কাছে বসো।আমার লক্ষী নানুমনি।” বলে লাবন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর ইশারায় বললেন হিমেলকে চলে যেতে।
নানুর ইশারায় ও আর দাঁড়ালো না। রুম থেকে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর দরজা আটকানোর শব্দ পাওয়া গেল।

চলবে

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ২৯)
সায়লা সুলতানা লাকী

ক্লাস শেষ হতেই এখন সরাসরি বাসায় চলে আসে লাবন্য। বন্ধুদের সাথে আড্ডাতে এখন আর আগের মতো মন বসে না। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে ডোরবেল বাজাতেই বুয়াখালা খুলে দিল। লাবন্য আর কোনদিকে না তাকিয়ে খাবার দিতে বলে সোজা নিজের রুমে ঢুকে গেল। পেছনে পেছনে তাসলিমাও ওর রুমে গেল। খাবার না বেড়ে ওর রুমে আসায় ও কিছুটা অবাক হয়ে গেল।
ব্যাগটা টেবিলে রেখে খালার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“খালা কিছু বলবা? নানি কি ঘুমায়?”
“না খালা, খালাম্মাতো রুশ বাবারে নিয়া হাসপাতালে গেছে। আপনে কিছু জানেন না?” তাসলিমার কথা শুনে ওর মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
“কি বলো খালা? কি হয়েছে রুশের? ও আল্লাহ, তুমি রহম কর। কোন হাসপাতালে আছে?” বলতে বলতে কন্ঠ ধরে এল ওর।
“আমিতো কিচ্ছু জানি না। ভাইয়ে ফুন দিছিলো খালাম্মারে, এরপর খালাম্মা দৌড়াইয়া বাইর হইছে। আমিতো আর কিচ্ছু জানি না।”
এতটুকু শুনেই লাবন্য হাইমাউ করে কেঁদে উঠল। কি করবে তা বুঝতে পারছিলো না। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে আছে। সাথে সাথে অন করল। বত্রিশটা মিসড কল হিমেলের। কোনো দিক পাশ না চিন্তা করে হিমেলকে আগে কল দিল-
“তুই কোথায়?”
“রুশ কোথায়?”
“রুশ এখন ভালো আছে, স্কুলে খেলতে খেলতে একটা এক্সিডেন্ট করেছিল। হাতে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। এখন তুই কাঁদবি না এভাবে। নিজেকে কন্ট্রোল কর। রুশের সামনে এভাবে কাঁদলে ও ভয় পাবে।”
“আমি রুশের কাছে যাব। ও কোথায়? আমার ভাই কোথায়?”
” আগে কান্না বন্ধ কর। তারপর বল তুই কোথায়?”
“বাসায়।”
“রেডি হ আমি আসছি।” বলে কলটা কেটে দিল হিমেল। লাবন্য কেনজানি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। কাঁদতেই লাগল অনবরত। মোবাইলটা কখন যে চাপে পড়ে বন্ধ হয়ে ছিল তা খেয়ালই করেনি। নিজের উপর এখন নিজেরই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।

এরই মধ্যে ল্যান্ডফোনে কল আসল, বুয়াখালা কলটা রিসিভ করতেই শুনল নানি কল দিছে। উনি কিছু জিনিস লাবন্যের সাথে দিয়ে দিতে বললেন। বুয়া সাথে সাথে তা প্যাক করে দিতে শুরু করল।

হিমেলের সাথে হাসপাতালে আসতেই ও দেখল রুশ ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে ঠিক যেমনটা ওর জ্বর আসলে ধরে রাখতো। ও সামনে গিয়ে রুশের পাশে দাঁড়ালো। ওর কপালে হাত দিতেই রুশ চোখ মেলে তাকালো
“আপু, আপু অনেক ব্যথা। আপু পায়ে অনেক ব্যথা।” বলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল রুশ।
“কাঁদে না ভাইটা আমার।আমার আদর সোনা ভাই। কাঁদে না। ভালো হয়ে যাবে। দেখো ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে।” লাবন্য কথাগুলো বলছিলো খুব সাহস দেখিয়ে ঠিকই কিন্তু ভেতর ভেতর নিজেও রুশের অবস্থা দেখে ভেঙে পড়ল।

রুশের ডান পা প্লাস্টার করা হয়েছে। ডান হাতটাও ফুলেছে তবে হাত ভাঙ্গেনি। পড়ার সময় হাতটা বেকায়দায় ছিল তাতেই মোচড় লেগেছে। লাল হয়ে আছে। নানি হিমেলকে দিয়ে বরফ আনিয়েছে তা দিয়েই এখন হাতে সেঁকতে লাগলেন। একটু ছোঁয়া দিলেই কুঁকড়ে উঠে ব্যথায়। ওর ব্যথাতে মনে হল লাবন্যও কষ্ট পাচ্ছে। এরই মধ্যে সিস্টার আসলেন ইনজেকশন দিতে। লিখন খুব যত্ন নিয়েই রুশকে মেনেজ করছে যাতে ইনজেকশন দেখে ভয় না পেয়ে যায়। একটু সময়ের জন্য লাবন্য ভুলে গেল ওর আব্বু যে আর ওদের সাথে নাই। রুশও সেই আগের মতোই ওর আব্বুকে জড়িয়েই আধশুয়া অবস্থায় বসে থাকল। কিছুক্ষণ পর রুশ ঘুমিয়ে গেল। লাবন্য তখনও কাঁদছে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে। ওর নানি আস্তে করে বললেন
“বোকার মতো কাঁদছিস কেন? আল্লাহর কাছে শুকোর গুজার কর যে বড় কোনো এক্সিডেন্ট হয় নাই। বিপদতো আরও বড় ধরনেরও হতে পারতো।”

“নানি আসলে কি হয়েছিলো স্কুলে? তুমি কিছু জানো? হঠাৎ কি হলো যে এমন এক্সিডেন্ট হল।”

“টিফিন পিরিয়ডে ওরা বন্ধুরা মিলে টিফিন করছিলো তখন পাশের সেকশনের এক ছেলে এসে ওকে বলেছে ও নাকি রুশের নতুন মা’কে দেখেছে ওর বাবার সাথে মার্কেটে। এই কথা শুনে রুশ একটু রেগে গিয়ে বলছে যে ওর কোন নতুন মা নাই। ওর একটাই মা যে কি না চলে গেছে আল্লাহর কাছে। তখন ওই ছেলে জিজ্ঞেস করেছিল যে রুশের আব্বু যাকে বিয়ে করছে তাকে তাহলে রুশ কি বলে ডাকে?
রুশ উত্তরে বলেছে ও তাকে কখনও দেখেনি, আর দেখতেও চায় না। কথাটা রুশ একটু চিৎকার করেই বলেছিলো। তখন পাশে থেকে অন্য এক ছেলে এগিয়ে এসে রুশকে ধাক্কা দিয়ে বলেছে (তোর আব্বু আবার বিয়ে করে তোদের ছেড়ে চলেগেছে, তুই আবার উঁচা গলায় কথা বলিস কোন সাহসেরে? তোর আব্বু আর তোদের সাথে নাই তাহলে এত সাহস কোথায় পাস?)
রুশ খুব কষ্ট পেয়ে যায় সেই কথায়। কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ করেই বলে উঠে ও টিচারকে কমপ্লেন করবে এসব কথার জন্য। আর তা নিয়েই হাতাহাতি শুরু হয়। রুশ একটা সময় সিড়ি থেকে পড়ে যায় নিচে। ” একদমে কথাগুলো বলে হিমেল থামলো।

পাশে থেকে লিখন ডুকরে কেঁদে উঠল। কোন কথা নাই ওর মুখে। ছেলের হাতটা নিজের হাতে চেঁপে ধরে শুধু কাঁদতে লাগল।

লাবন্য স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। একটু পর আস্তে আস্তে করে বলল “জীবনে আরও কত জানি নাজেহাল লিখা আছে কপালে আমাদের। যে যেভাবে পাড়ছে সে সেভাবেই খোঁচা দিচ্ছে মনের সাধ মিটিয়ে। ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোন পথ নাই দেখছি। ইচ্ছে করছে স্কুলে গিয়ে ছেলেগুলোর গালে জোরে একটা চড় মারতে। এতে যদি একটু মনের কষ্ট কমতো আমার।”

“আল্লাহ একেক সময় তার বান্দার পরীক্ষা নেন, যেমন এখন তোদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এতটা ধৈর্যহীন
হলে চলবে না লাবু। বাচ্চা ছেলেদেরকে চড় মেরে কী হবে? ওরা কি আর এসব বুঝে করেছে? ওরা না বুঝেই এসব বলেছে। ” নানি লাবন্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন।

“তুমি কিছু বলোনি স্কুলের টিচারদের? রুশকে যখন অন্য ছেলেরা মারল তখন তারা কি করছে বসে বসে দেখছে শুধু? ”

“আমিতো কিছুই জানি না। ক্লাস মিস তোর আব্বুকে কল দিয়েছিল। ও স্কুলে গিয়ে এই অবস্থা দেখে আর দেরি করেনি সাথে সাথে এখানে নিয়ে আসছে। পথে থাকতেই আমাকে কল দিয়ে জানিয়েছিল। পরে আমি হিমুকে জানালাম।ও ছাড়া আসব কীভাবে? আমিতো স্কুলেই যাইনি। গেলে বিষয়টা ভালোমতো জানতে পারতাম। হিমু যা বলল তা রুশ হিমুকে বলছে। এখন তা কতটুকু সত্য, কতটুকু মনগড়া তা বুঝব কীভাবে? ”

“কি বলছো তুমি? রুশ মনগড়া কথা বলবে কেন? তুমি ওকে বিশ্বাস করতে পারছো না কেন নানি?”

“কে কাকে বিশ্বাস করতে পারে বল? রুশতো ওর আব্বুকে বিশ্বাস করেছিলো, মনে করেছিলো কখনও দূরে যাবে না। কিন্তু সেই বিশ্বাসতো হারিয়েছে ও। তাই না?”

“আম্মা আমিই অপরাধী, আমার জন্যই আমার কলিজার টুকরার আজ এই অবস্থা। আমিই দায়ী। আমি চরম ভুল করে ফেলছি জীবনে।” কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল লিখন।

লাবন্যের কাছে ওর আব্বুর বলা কথাগুলো বিষের মতো লাগল। বিরক্ত হয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে এল। রাগে গা একেবারে গিজগিজ করছে যেন।তখনই পিছনে হিমেল এসে দাঁড়ালো

“কতবার কল দিয়েছি তা বলতে পারবি? নানুমনিকে নিয়ে হাসপাতালে আসার পর এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে, না পারছি তোর কি হল তা দেখতে যেতে না পারছি মাথা থেকে তোর চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে। এমনটা কেন করিস? ”

“মোবাইলটা চাপে পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে তোমার এত কল দেওয়ার কি দরকার ছিলো?”

“দরকারটা আমার ছিলো না, ছিলো রুশের। ও বারবার তোকে খুঁজছিলো। ব্যথায় বারবার কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। হাতটাও নাড়াতে পারছে না। আংকেল কোল থেকে একবার এই বেডে রাখে আবার ওই বেডে নেয়। এক্সরে করাতে যাও, আবার প্লাস্টারের জন্য যাও। এসবের ভয়ে ছেলেটা যে তার আপুকে খুব বেশি কাছে চাচ্ছিলো তাই কল দিয়েছিলাম।”

হিমেলের কথাটা শেষ হতেই লাবন্য হাউমাউ করে কেঁদে উঠল “সরি আম্মু, আমি রুশকে ভালোমতো দেখে রাখতে পারলাম না। আমি ব্যর্থ। তোমার দেওয়া দায়িত্ব আমি পালন করতে পারলাম না। আমি রুশের কষ্টের সময়টাতেও পাশে থাকতে পারলাম না।” কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো যখন বলছিলো তখন হিমেল এগিয়ে গিয়ে ওকে বুকে টেনে নিল। লাবন্য হিমেলের বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে লাগল অঝোরে।
“বোকার মতো কাঁদিস না, এখানে তোর কোনো দোষ নাই।সবই আমাদের ভাগ্য। ”

নানির ডাকে ওরা আবার কেবিনে ঢুকলো। নানি সবার জন্য খাবার বেড়েছে। প্লেট গুলো এগিয়ে দিয়ে জলদি করে খেয়ে নিতে। লিখন ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে বেশ শান্ত হয়েই এক পাশে বসল। হিমেল খাবারের প্লেটটা এগিয়ে দিল কোন কথা না বলেই। লিখনও চুপচাপ প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করল।

লাবন্যের ক্ষুধা লেগেছিলো তাই কোনদিক না তাকিয়ে চুপচাপ খেতে বসল। এখনকার কেন্টিনের খাবারই হাসপাতালের সবার খেতে হয়। বাহিরের খাবার ভেতরে আনা নিষেধ। খাবারের প্লেটটা হাতে নিতেই ওর চোখ ভিজে উঠল। খাবে কি, খাবার দেখেই ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে উপরে উঠতে লাগল। কয়েকবছর আগে দাদিকে নিয়ে এই হাসপাতালে ছিলো ওরা। প্রতিদিন এই সবজি, সালাদ আর ফ্রাই খেতে স্কুল থেকে বাসায় না গিয়ে ওর আব্বুর সাথে বায়না ধরে হাসপাতালে চলে আসতো। রেশমার অনেক বকা শুনতো তবুও আসত। লিখন তখনও সব কিছু উপেক্ষা করে মেয়ের জন্য এভাবেই প্যাকেট অর্ডার করতো। দাদিকে নিয়ে বাসায় ফিরার পর কয়েকদিন দাদিকে বলেছিলো “তুমি আবার অসুস্থ হও আমরা আবার তোমাকে ওখানে নিয়ে যাই। প্লিজ দাদি, প্লিজ। ওখানকার সবজি সালাদকে মিস করছি দাদি, তুমি কেন বোঝো না।”
ওর কথা শুনে ওর দাদি রেগে যেতেন। রেশমা কতদিন ওদের মতো করে বানিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে কিন্তু হুবুহু তেমনটা হয় না। দেখতে কেমন কাচা কাচা লাগে কিন্তু সেদ্ধটা হয় অসাধারন।রংগুলো থাকে অপরিবর্তিত। এমনটা বাসায় হয় না।
আজ হঠাৎ করেই সেই খাবারটা ওর সামনে। একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখল সবার জন্য কি খাবার। দেখল সবারটা নরমাল ভাত সবজি মুরগী। বুঝল ওর আব্বুই ওর জন্য আলাদা করে এই অর্ডার করেছে। কেন জানি আজ আর এই খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। প্লেটটা নামিয়ে রাখল। ওর চোখে পানি দেখে ওর নানি কিছু একটা আন্দাজ করলেন।আস্তে করে ইশারা করলেন খেয়ে নিতে। লাবন্য বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। ওর আব্বুর প্রতি রাগটা কোন ভাবেই কন্ট্রোল করতে পারে না। নানি দিনরাত এত কিছু বোঝান তবুও অবাধ্য মন মানতে চায় না। মনকে বলে “মেনে নে, খেয়ে নে। ”
মন উলটা উত্তর দেয় “মেয়ের প্রিয় খাবারটার কথা মনে আছে, কিন্তু মেয়ের নিরাপত্তার জন্য কি করা উচিৎ তা মনে থাকে না। যত্তসব ভন্ডামি।”
আবারও ওর নানির ধাক্কায় নড়ে উঠে লাবন্য। ইশারা পায় খাওয়ার জন্য। অবশেষে আস্তে আস্তে খাবার তুলে মুখে নেয়। দূরে বসে সবটাই খেয়াল করে লিখন। লাবন্য খাবার মুখে নিতেই ওর চোখজোড়া আবার ভিঁজে উঠে।

রাতে রুশের গায়ের টেম্পারেচার বেড়ে গেল। থার্মোমিটারে রিডিং দেখাচ্ছে ১০৩°F । কিন্তু ওর গায়ে হাত দিলে মনে হচ্ছে তারও বেশি। ওর জ্বর আসলে ও খুব বমি করে। ডাক্তার এসে দেখে গেলেন। সাপোজিটর দিতে বলে গেলেন। লাবন্য বারবার ভিজা রুমাল দিয়ে কপাল মুছিয়ে দিতে লাগল। লিখন বেড প্যানের মাধ্যমে ছেলেরে প্রসাব পায়খানা করালো একবার। ওর নানি মাথার পাশে বসে দোয়াদরুদ পড়ছেন আর বারবার ওর মাথায় ফু দিচ্ছেন। বিকেলে হিমেল বাসায় চলে গিয়েছিলো।

লাবন্য এতক্ষণ মনে মনে চেয়েছিলো ওর আব্বু চলে যাক, তাকে এখানে একদমই সহ্য হচ্ছিল না ওর। কিন্তু ওর নানি বারান্দায় নিয়ে বুঝিয়েছেন যে অসুস্থ ছেলের এটা হক ওর আব্বুর আদর ভালেবাসা পাওয়াটা। এটা থেকে লাবন্য চাইলেই রুশকে বঞ্চিত করতে পারে না। লাবন্য তাই আর কিছু বলে নাই ওর আব্বুর ব্যাপারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওর আব্বু ওদেরকে এভাবে একা রেখে যাতে না যায়। রুশের জ্বর আসলে ওর আম্মু দিনের বেলায় আর রাতে আব্বুই ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো। এখনও ও মনে মনে চায় ওর আব্বু রুশের পাশেই থাক। কারন লাবন্য রুশের পাশে থাকার পরও রুশ ওর আব্বুকেই শক্ত করে ধরে শুয়ে আছে। একটু সময়ের জন্যও ছাড়তে চাচ্ছে না। ঠিক আগের মতো করেই অধিকার খাটাচ্ছে ছেলেটা। যদিও মানুষটা আর আগের জায়গায় নাই বলেই লাবন্যের বিশ্বাস।

ওর আব্বু সাপোজিটার দিয়ে দেওয়ার এক ঘণ্টা পর জ্বরটা কিছু কমলো। কিন্তু গা তখনও কাঁপছিলো। ঠোঁটগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার। লাবন্য একটু পরপর গ্লুকোজ পানি চামচ দিয়ে তুলে ওর ঠোঁটদুটোকে ভিজিয়ে দিতে লাগল।

রাত দশটার দিকে আবার হিমেল আসল ওর নানুমনিকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাতে এখানে থাকার জন্য লাবন্যই থাকবে ওর আব্বুর সাথে। নানির শরীরের কথা চিন্তা করেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। নানি যাওয়ার আগে ওদেরকে খাওয়ায় দিয়ে গেলেন। রুশের জন্য স্যুপ রেখে গেলেন ফ্লাস্কের মধ্যে। লাবণ্য বলল রাতে ও আবার খাইয়ে দিবে। একবারে বেশি দেওয়া যাচ্ছে না। বমি বমি ফিলিং হচ্ছে কেবল ওর।

লাবন্য ওর আব্বুর সাথে কোন কথা বলছে না সেই প্রথম থেকেই। রুশের মাথা নেড়ে নেড়ে টুকটাক ওর সাথেই কথা বলতে লাগল। কিন্তু খেয়াল করল বারবার ওর আব্বুর মোবাইলে লাইট জ্বলে উঠছে। মোবাইলটা সাইলেন্টে আছে তাতেই রক্ষা। নইলে রিংটোনের শব্দে আর থাকতে হতো না এতক্ষণ ।

ওর আব্বু বারবার ইগনোর করছিলো কলগুলো। কিন্তু এবার কলটা রিসিভ করে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। লাবন্য এসব বিষয় এখন আর গায়ে মাখছে না। বলুক কথা যার সাথে খুশি তার সাথে। সে এখন আর ওদের নাই তা ও ঠিকই বুঝে নিয়েছে। মনকে বোঝাতে বোঝাতে দেখল রুশ ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজেও খুব ক্লান্ত ছিল বিধায় রুশের পাশেই মাথাটা হেলিয়ে শুয়ে পড়ল। একটা সময় ঘুমিয়েই গেল।

যখন ঘুম ভাঙল তখন রুশ খুব জোরে জোরে বমি করছে। ওর আব্বু ওয়াসরুম থেকে মগ ভরে পানি নিয়ে আসল রুশের সামনে। আর রুশ একাই বসে বসে বমি করছে সামনে রাখা বোলের মধ্যে। ধরিমরি করে উঠে ভাইকে ধরল লাবন্য । ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল বমি করতে। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। গায়ে আবারও তাপমাত্রা বাড়ছে। হঠাৎ কি হল লাবন্য কেমন রেগে উঠল

“তুমি ওকে একা রেখে ওয়াসরুমে গেছো কেন? ও যদি বমি করতে করতে বেড থেকে পড়ে যেতো?”

“ওর মুখে একটু পানি দিতে হবে তাই পানি আনতে গিয়েছিলাম। ”

“তাহলে আমাকে ডাকো নাই কেন? আমি আছি কি করতে? আমাকে দেখো নাই?”

“তুই অনেক ক্লান্ত ছিলি। ঘুমিয়েছিসও বেশি সময় হয় নাই, ভাবলাম তোর কষ্ট হবে তাই ডাকিনি।”

“তুমি শুধু ভাবতেই থাকো। নিজ মনমতো ভেবে ভেবে যা মনচায় তা করো। তোমারতো আর কোন ক্ষতি হয় না। যা হওয়ার হয়তো শুধু আমাদের। আমাদের নিয়ে ভবনাগুলো এবার বন্ধ কর।” ভালোমন্দ জ্ঞান হারিয়ে একদমে চিৎকার করে বলে উঠল লাবন্য।

“আপু প্লিজ, চুপ থাকো। আব্বুকে কিছু বলো না। তাহলে আব্বু আবার চলে যাবে আমাদেরকে ছেড়ে। প্লিজ আপু প্লিজ, তুমি থামো।” রুশ বেশ কাতর স্বরে বলে উঠল।

রুশের কথায় লাবন্য পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। নিজের রাগ, দুঃখ কষ্ট সবকিছু এক নিমিষেই মাটি হয়ে গেল অসুস্থ ভাইয়ের কথায়। ছোট্ট রুশ যে এখনও ওর আব্বুকে সেই আগেরমতো করেই কাছে চায় তা মুহুর্তেই উপলব্ধি করল লাবন্য।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here