মেঘে _ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৪৯ শেষ)

0
502

#মেঘে _ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৪৯ শেষ)
সায়লা সুলতানা লাকী

হিমেলের দেওয়া শাড়িটা পরে লাবন্য আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ওর নানি এসে ঢুকল রুমে।

“কিরে এত দেরি করছিস কেন? আজ মাত্র কথা বলবে, বিয়েতো আর আজই হবে না! এত সাজের কি আছে? কে দেখবে তোর সাজ?”
“কি আশ্চর্য আমি আবার সাজলাম কোথায়? শুধু মাত্র শাড়িটাইতো পরলাম।”
” এতক্ষণে শুধু শাড়িই পরলি? ইন্না লিল্লাহ! এত সময় যদি শাড়ি পরতেই যায় তবে সংসার করবি কীভাবে?”
“উফফ, তুমি শুধু শুধু পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চাচ্ছো কেন নানি, তোমার সমস্যা কী?”
“তোর সাথে ঝগড়া করতে যাবো অমন পাগল আমি না। ”
“তাহলে এমন করছো কেন আমার সাথে? রেডি হচ্ছি দেখছো না?”
“সবাই অপেক্ষা করছে সেই কখন থেকে…”
“উফফ কথা না বলে মালাগুলো খোঁপায় পরিয়ে দাওতো।”
“উঁহু, এগুলো আমি পারি না। যে পারে তারে পাঠিয়ে দেই,কি বলিস?”
“মানে? ও এখানে আসলো কখন?”

“এই মাত্রই, এসেই তোকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। চার চারবার আমাকে খোঁচা দিল তোকে জলদি নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন ওকেই পাঠাই….”
“ভুলেও এ কাজ করতে যেও না। তাহলে আর আমার ওখানে যাওয়া হবে না। সে বড় অবাধ্য প্রেমিক আমার, মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতেই থাকবে।”
“নাউজুবিল্লাহ, কী বলিস এগুলো? তোরতো মুখের কোনো লাগাম নাই।”
“আমার? হিহিহি, আর তোমার হি…মুরতো…..”
“চুপ ফাজিল, হইছে আর কিছু লাগাতে হবে না। চেনা বামনের আর পৈতা লাগাতে হয় না। যথেষ্ট হয়েছে, এতটুকুতেই চলবে, সুন্দর লাগছে খুব । চল।”

“তুমি কি আমার রুপের প্রশংসা করলে? করতে পারো, আমি কিছু মনে করিনি, শেষ পর্যন্ত স্বীকারতো করলে তাতেই খুশি আমি। ”

“মানে? তুই কি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর? মোটেও না! ভাব নিস কার সাথে।” কথাটা বলেই নানি একটু চোখ নাচিয়ে হাসি দিয়ে লাবন্যের হাত ধরে টেনে বের হয়ে এল রুম থেকে।

চারপাশে পরিচিত মুখ সবগুলো, অথচ আজ সবাইকে বড় অপরিচিত বলে মনে হল লাবন্যের। কারউ সামনেই মাথা উঁচু করে বসতে পারছে না।কোত্থেকে এত লজ্জা এসে ভর করল ওর চোখে তা ও নিজেও বুঝতে পারল না। হঠাৎ করেই কানে এলো কেউ বলছে

“ওরে এ আমাদের সেই লাবন্য নাকি? একেতো একেবারেই চিনতে পারছি না। একেবারে লাজুকলতা হয়ে আছে।”
” কি করে চিনবেন? ও যে এখন আমার ঘরের বৌ হয়ে আসছে অল্প কিছুদিনের মধ্যে । আজ একেবারে আমার বৌমা সেজে এসেছে আমার সামনে। বুঝছো রেহেনা এই হল আসল নারী চরিত্র। যখন যে পাত্রে রাখবা তখন সে পাত্রের রুপ ধারন করে ওরা। তাইতো ওরা যেখানেই যায় সেখানটাকেই নিজের করে নিতে পারে। প্রতিটা সংসার গড়ে উঠেতো এইসব নারীচরিত্রকে ঘিরেই। তোমরা শুধু শুধু ভয় পাও এদের নিয়ে, এমন হবে নাতো অমন হবে, মিলবে নাকি না অন্য কিছু, আগরুম-বাগরুম । আমি জানিতো আমার বৌমা হয়ে ও যেদিন আমার বাসায় আসবে সেদিন ও নিজের করে নিবে আমাদেরকে।” নাজমুল সাহেব বেশ আবেগি আবেশেই কথাগুলো বলে থামলেন।

“জামাই তোমার কথার একটু সংযোজন না করে পারছি না। তোমার কথাটা ঠিক তবে অসম্পূর্ণ। নারী চরিত্রটাকে যে পাত্রে রাখতে চাইবে সেই পাত্রের ধারন ক্ষমতা, ধরন, বৈশিষ্ট্যও ভালোমতো দেখে নিতে হয়। কারন মনমতো সব পেতে হলে ওটারও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। না হলে যে আশানুরূপ ফল লাভ করা যায় না। পাত্রের ধারন ক্ষমতা ভালো হলে নারীচরিত্রটা এটে যায় তাতে। বৈশিষ্ট্য ভালো হলে চরিত্রটাও ভালো হতে বাধ্য হয়।নারী চরিত্রটি সাবলীলভাবে নিজেকে মিলিয়ে নিতে ও বিলিয়ে দিতে পারে কিন্তু পাত্রটা যদি দূর্বল হয় তবে ওই পাত্রে যেতে না যেতেই তা ভেঙে যায়। আবার পাত্রের ধরন, গুন যদি খারাপ হয় তবে চরিত্রটিরও এডজাস্ট করতে সমস্যা হয়। সংসারে অশান্তি হয়। দোষ সবসময় নারী চরিত্রের হয় না, দোষ কিছু পাত্রেরও থাকে,তা মনে রাখতে হবে।” একদমে কথাগুলো বলে থামলেন নানি।

“আম্মা আপনি নিশ্চিত থাকেন আমার বাসায় লাবন্যের কোনরকম অসুবিধা হবে না। তার গ্যারান্টি আমি নিলাম। ও সঠিক পাত্রেই যাচ্ছে, এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না।”

“আম্মা আমি থাকতে আপনে এতটা ভয় পাইতাছেন কেন তা বুঝলাম না। আমার কাছে থাকা আর রেশমার কাছে থাকা ওর জন্য একই কথা। আপনি শুধু দেইখেন আমি ভুল বললাম কি না! ও আমারই মেয়ে এখন থেকে।” রেহেনা বেগম আগ বাড়িয়ে কথাটা বললেন।

“বড় আপা এগুলো বলা সহজ, তাই বিয়ের আগে সব শাশুড়িরাই বলে। কিন্তু বিয়ের পর শাশুড়িরা নিজের মেয়েকে নিজের মেয়েই ভাবে আর ছেলের বৌকে ছেলেরবৌই ভাবে। শুধু শুধু কেন যে এসব মিথ্যার আশ্রয় নেয় মানুষ তাই বুঝি না। আম্মাকে আমি এর জন্যই পছন্দ করি আম্মা এসব মিথ্যা আশ্বাস কোনোদিনই দেন নাই আমাদের ।” লাবন্যের ছোটমামি ঠোঁট বাঁকিয়ে কথা বলল।

“আহ! বাদ দাও এসব কথা এখন। তোমরা সুযোগ পেলেই খোঁচা খুঁচি শুরু কর। এই অভ্যাসটা আর ছাড়তে পারবা না জীবনে। একটা শুভ কাজে বসেছো শুভ শুভ কথা বলো। লাবন্যের ছোট মামা এবার একটু ধমকের স্বরেই কথাটা বলল তার ওয়াইফকে।

সবাই কিছুক্ষণের জন্য হঠাৎ চুপ হয়ে গেল।
লাবন্যের খুব অস্বস্তি লাগছে এভাবে বসতে কিন্তু কিছু যেনো করার নাই এভাবে বসে থাকা ছাড়া। ও বসে আছে ড্রয়িং রুমের ঠিক মাঝ সোফাটায়। ওর পাশে বসে আছে ওর নানি। ঠিক ওর সামনে বসে আছেন নাজমুল সাহেব আর লিখন। পাশের সোফায় ওর মামারা বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। রেহেনা বেগম নিস্তব্ধতা ভাঙলেন, হিমেলকে ইশারা করে বললেন
“বাবু নে, লাবুকে রিংটা পরিয়ে দে।”
“উঁহু, এভাবে কীভাবে রিং পরিয়ে দেয় হিমেল? ” বেশ জোরেই আপত্তি করে এগিয়ে আসলেন লাবন্যের বড় মামি।

মামা মামিদের দেখেই প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছে লাবন্য, তাই এখন আর তাদের তৎপরতা দেখে কোন রকম অবাক হচ্ছে না। তারপর ও মামির কথাটা শুনে মাথা তুলে তাকালো একবার। রিং পরাতে বাঁধা দিচ্ছেন কেন উনি? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে তখন।

“ভাগনা ভাগনি দুজনের দুই জায়গায় বিয়ে হলে দুইটা অনুষ্ঠান পেতাম।এখন দুইজনের সাথেই যখন বিয়েটা হচ্ছে তখন প্রতিটা পর্বে অনুষ্ঠান চাই। কোন ফাঁকি ঝুঁকি চলবে না। লিখন সাহেবের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আজকের আয়োজনে সামিল হয়েছি আর মনে মনে ঠিক করেছি এই দাবি তুলবো সবার সামনে। এখন বলেন আপনাদের কী মতামত।” বড় মামি বেশ জোর দিয়েই দাবি তুললেন।

“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি আপনারা আমার অনুরোধ রেখে আমাকে ধন্য করেছেন। আমি আপনাদের সব দাবি মানতে প্রস্তুত। আমার কোনো অসুবিধা নাই। আমি আয়োজন করব। আপনারা ডেট দেন। কবে কি আয়োজন করতে হবে তা জানান। আমি এরেন্জ করতে প্রস্তুত।”

“এনগেজমেন্টের সময় আবার রিং পরাবো বৌমাকে। অসুবিধা কী? কিন্তু আজ যে রিংটা এনেছি তা ফিরিয়ে নেবো কেন? দে হিমু বৌমার হাতে পরিয়ে দে।” বলে নাজমুল সাহেব হিমেলকে নির্দেশ দিলেন আবার।

হিমেল মনে হল এই নির্দেশেরই অপেক্ষায় ছিল। পাওয়ার সাথে সাথে লাবন্যের হাতটা টেনে নিয়ে রিংটা পরিয়ে দিল। রুম জুড়ে সবাই এক যোগে “আলহামদুলিল্লাহ ” বলে উঠলেন।
লাবন্যের মনটা হঠাৎ করেই কেমন জানি করে উঠল। কেমন এক অনুভূতি সমস্ত মনকে রাঙিয়ে দিল চোখের পলকে। রিংটা পরিয়ে হিমেল ওর হাতটা ধরেই আছে। সেদিকে ওর কোন খেয়াল নেই। অন্য সময় হলে হয়তো এমন আনন্দে ও একটা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠতো “ইইইইইয়েএএএএ” বলে। কিন্তু এখন তাও বলতে পারছে না। ভালো লাগার অনুভূতিগুলো দেহমন সব নাড়িয়ে দিতে লাগল।
হঠাৎ করেই রুশ এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
“আপু তুমি কি আজই চলে যাবে ভাইয়ার সাথে?”
সাথে সাথেই হিমেল রুশকে টেনে বুকে নিল।
“দূর বোকা, কাঁদিস কেন? বন্য কোথায় যাবে? তোর কাছেই থাকবে ও। সাথে আমিও থাকব।” শেষ কথটা কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল। আর তা শুনে রুশের মুখে হাসি ফুটল।লাবন্য কোনো কথা বলল না, ভাইয়ের হাসিটা দেখেই যেনো শান্তি পেলো কিছু ।

বড় মামি মিষ্টি এনে হিমেল আর লাবন্যকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিতেই পেছন থেকে ছোট মামিও উঠে আসল বলল
“ভাবি এখন আমরাও ওদেরকে মিষ্টিমুখ করাতে চাই।”
“অবশ্যই, করাবা তোমরা সবাই নিজেরাও মিষ্টিমুখ কর সাথে হিমেল আর লাবন্যকেও মিষ্টিমুখ করাও। সবাই ওদের জন্য বেশি বেশি দোয়া কর যেনো ওরা ওদের নতুন জীবনে সুখী হয়।” কথাটা বলতে গিয়ে নানির গলাটা ধরে এল আবেগে।

ড্রয়িংরুম জুড়ে হাসি আনন্দের এক মেলা বসল। লাবন্য তাকিয়ে তাকিয়ে আপনজনদের আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখছে যা তৈরি হয়েছে ওর নিজের বিয়েকে কেন্দ্র করে। মামিরা ওর পক্ষ নিয়ে কখনও খালামনি আর খালুজির উপর চড়াও হচ্ছে অনুষ্ঠান এমন হতে হবে অমন হলে চলবে না বলে আবার কখনও হিমেলের পক্ষ নিয়ে ওর আব্বুর উপর চেপে বসছে তাদের কি কি লাগবে তা নিয়ে। সবাই মিলে বেশ মজা পাচ্ছে এই কথপোকথনে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সবার একটিভিটি দেখে। লাবন্যের নিজেও খুব ভালো লাগছে এই আবহাওয়ায় বসতে এরই মধ্যে নানি বললেন
“লাবু তুই তোর রুমে যা। এখানে মুরুব্বিরা কথা বলুক তুই যা ভিতরে যা।”
নানির কথা শুনে লাবন্য উঠে দাঁড়াতেই ওর পেছনে পেছনে হিমেলও উঠে দাঁড়াল।
“নানুমনি আমিও যাই৷ এইসব কথা শুনে আমি কি করব।” কথাটা শেষ করেই লাবন্যের পেছনে সুরসুর করে ওর সাথে ওর রুমে এসে ঢুকল।

“এটা কী হল?”
“কী হলো? ”
“সবার সামনে থেকে তুমি এভাবে আমার পিছু পিছু চলে আসলে কেন?”
“সমস্যা কী? বাকি জীবনতো তোর পেছনেই ঘুরতে হবে। ”
“তুমি কি লজ্জার মাথা খেয়েছো? নানি এই কথাই বলবে দেখে নিও।”
“লজ্জার আবার মাথাও থাকে? আজব সব কথা বলিস। শোন তোকে বিয়ে করার জন্য আকাশ বাতাস সব এক করে ফেললাম ঝামেলা করে তখন লজ্জা লাগল না আর এখন তুই আমার হবু বৌ যার স্বীকৃতি দেওয়া হল এই সভায়, তখন তোর সাথে তোর রুমে আসতে লজ্জা পেতে বলছিস, বিষয়টা একটু সিনেমাটিক হয়ে গেলো না?”
“উফফ তোমার সাথে কথায় পারা কি সম্ভব?শুধু যুক্তি আর যুক্তি দেখারও। ”

“সম্ভব না মানে? অবশ্য ই সম্ভব, পৃথিবীতে এমন কোনো পুরুষ দেখছোস যে তার ওয়াইফের কাছে জিতেছে? সব পুরুষই তার ওয়াইফের কাছে পরাজিত আর তার ওয়াইফ হয় বিজয়ী। তুই কি তার বাহিরের নাকি? ”

“ভুল, আমার আম্মুইতো পরাজিত ছিল। মৃত্যুর পর আরও বেশি হেরে গেল, ভালোবাসার কাছে হারল,বিশ্বাসের কাছে হারল…..”

“উঁহু, ঠিক না। তুই নিজেই ভুল। তোর দৃষ্টিভঙ্গি ভুল পথে আছে।”
“মানে?”
“মানে খালামনি হারেনি, হেরেছেন খালুজি। খালুজি তার প্রয়োজনের কাছে হেরে গেছেন।”

“কি জানি? হয়তো তুমিই ঠিক, হয়তো না। অত কঠিন হিসাব আমি জানি না। আচ্ছা আমি মরে গেলেও কি তুমি তোমার প্রয়োজন দেখিয়ে আমার স্মৃতি মুছে অন্য কাউকে নিয়ে সংসার সাজাবে?”

“উফফ শুরুর আগেই শেষের বাঁশি বাজাচ্ছিস কেন?” কথাটা বলেই লাবন্যের হাতটা ধরে টেনে ওর পাশে বসাল।
“আরে কি করো তুমি?”
“আজ তোকে এত সুন্দর লাগছে যে আমি…. ”
“কাকে বেশি সুন্দর লাগছেরে হিমু?”
“ইন্না-লিল্লাহ, এই প্রশ্ন করতে তুমি আর সময় পাও নাই নানুমনি?”

“হুমম এতদিন আমাকে সুন্দর বলে বলে এখন শুনছি অন্য একজনকে বলছিস, তা আমি বুঝি জিজ্ঞেস করব না তোকে?”

“নো প্রবলেম, সব কিছু কনফার্ম হয়েগেছে এখন আর ভয় নাই, তুমি ভিলেন গিরি করলেও লাভ নাই। এই যে হাত ধরছি একদম সোজা গিয়ে কাজি অফিসে উঠবো। বন্য চেয়েছিলো পারিবারিক স্বীকৃতি। তা পেয়ে গেছে আজ, আর কোনো ভয় নাই। এখন আমি গলা ফাটিয়ে বলতে পারব আমার বন্য সবচেয়ে বেশি সুন্দর। ”

“ইন্না-লিল্লাহ কী করছো, আস্তে বলো। হাত ছাড়ো। এই লোকতো পুরাই পাগল হয়ে গেছে নানি? কি করবা একে নিয়ে?”

“হাত ধরা সহজ কিন্তু তা সারাজীবন বহন করা খুব কঠিনরে। হাত ধরার মতোই ছাড়াটাও কিন্তু খুব সহজ। ইচ্ছে হলো না, ভালো লাগলো না, একটা সময় পর মনে হলো খুব বিরক্তিকর এই হাত বহন করা, ব্যস ছেড়ে দিলাম। যেমনটা ইদানীংকার ছেলেমেয়েদের মাঝে খুব বেশি দেখা যায়। আমাদের সময় কিন্তু এমন ছিলো না। আমরা একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করতাম, জানতে চেষ্টা করতাম। পরস্পর পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতাম, সম্মান করতাম বলেই আমৃত্যু পর্যন্ত একজন আরেকজনের হাত ধরে রাখতে পারতাম। আমরা ভালোবাসা কি তা জানতাম না। কোনোদিন মুখেও আনিনি ভালোবাসার কথা। একজন আরেকজনকে ছেড়ে দূরে থাকতে কষ্ট হত। কিন্তু কি আশ্চর্য দুজনের কেউ কোনো দিন ভালোবাসি বলি নাই। এখন যখন পুরোনো কথাগুলো মনে হয় একদম তাজা লাগে। সেই অনুভুতি নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে একটুও কষ্ট হবে না। এখন কার মতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় লাভ ইউ বলার তাগিদ ছিলো না কিন্তু সময় মতো তার বাসায় ফেরার অপেক্ষা ছিল।”
“জানো নানি এই ব্যাটাও না কোনোদিন লাভ ইউ বলে নাই। একেবারে নানাজির মতো কঞ্জুস ও। ”
“তুই মনে হয় বলে ভাসিয়ে দিছিস দিল দরিয়া বেগম।”
“আমি বলবো কেন? হুমম আমি বলবো কেন? তুমি না আমাকে বারবার বলবা!”

“কি আশ্চর্য, কি শুরু করলি তোরা? কথায় কথায় ঝগড়া করিস। এগুলো কিন্তু ভালো না।”
“আমি করি না।”
“না তুই করিস না! একেবারে বন্য হয়ে বন্যের মতো ঝাপিয়ে পড়িস আমার উপর হুংকার দিয়ে। ”
“দেখছো নানি দেখছো?”
“হুমম দেখলাম, আমিতো আছিই দেখার জন্য। তোরা ঝগড়া ছাড়া থাকতে পারবি না। কর বেশি বেশি ঝগড়াই কর।”
“ইয়ে নানুমনি, মানে, বন্যকে বন্যরুপে দেখতেই বেশি ভালো লাগে। তাই একটু খোঁচা দেই। আর তাতেই….”
“একেকজনের কাছে সুখটা একেক রকম। দিনশেষে সুখে থাকতেই সবাই চায়। কেউ সুখের দেখা পায় আবার কারো কাছে তা মরীচিকা হয়েই থাকে। এক জীবনে যদি সুখী হতে চাস তবে একে অপরকে শ্রদ্ধা করিস সম্মান করিস আর বিশ্বাস করিস। এগুলো ছাড়া সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না।”
“নানি একটা জিনিস খেয়াল করেছো? আজ বহুদিন পর আমাদের বাসায় কেমন একটা সুখের বাতাস বইছে। ঠিক যেমনটা আম্মু থাকতে টের পেতাম । আব্বু কত খুশি আজকে। আমিতো অনেক অবাক হয়েছি আব্বু নিজে মামা মামিদের ইনভাইট করে আনিয়েছেন। আর তারাও এসেছেন আব্বুর কথায়, দিনটা সত্যি সত্যিই আম্মুর জন্য বড় স্পেশাল হতো যদি আজ আম্মু থাকতো। জানো, আমিতো ভেবে ছিলাম আম্মু বুঝি যাবার সময় সুখটাকেও সাথে করে নিয়ে গেছে? আজ আবার বাসায় এমন একটা পরিবেশ দেখে মনে হল, না সুখটাকে আম্মু নিয়ে যায়নি, আমরাই ওকে হারিয়ে ফেলেছিলাম কোথাও।যা আবার এসে ধরা দিল এই বাসায়, এই আমাদের জীবনে।”

“হুমম, ধরেনে সুখটা একটা চাঁদ, যা এতদিন মেঘে ঢাকা পড়েছিল। আজ সেই মেঘ কেটে গেলো সবার মনের আকাশ থেকে। তাইতো এই সুখ নামক চাঁদটাক আবার দেখতে পাচ্ছিস। এখন এই সুখকে আর হারাতে দিস না। মনে কোনো মেঘ জমতে দিস না। যে মেঘ আবার সুখ নামক চাঁদটাকে ঢেকে দিতে পারে। মনকে রাখতে হবে মেঘ মুক্ত, স্বচ্ছ। তবেই সেখানে সুখ নামক চাঁদ জ্বলজ্বল করতে পারবে সবসময়।”

“নানুমনি তুমি যেনো কেমন করে এত কঠিন কঠিন কথা খুব সহজ করে বলো। তুমি পাশে আছো বলেই নির্ভয়ে আছি। মনে মেঘ জমতে দেখলেই তুমি ধরিয়ে দিও। আমরা সাথে সাথে তা উড়িয়ে দিব।”
“উঁহু, আমি না। আমার উপর নির্ভর করে লাভ নেই। আমি যেকোনো সময় মরে যাবো।চিরস্থায়ী আমরা কেউ না। নিজের মনের আকাশ নিজেকেই স্বচ্ছ রাখতে শিখতে হয়। অন্য কেউ তা করে দিতে পারে না। বরং অন্যরা মনের আকাশে মেঘ জমতে দেখলে তা আরও ঘনীভূত হতে সাহায্য করে। পৃথিবীতে এমন হাজারো সম্পর্ক ছিলো যা উদাহরণ হয়ে আছে শুধু মাত্র মনের জমে থাকা মেঘের ভারে নষ্ট হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে। তোদের জীবন মাত্র শুরু, তাই বলছি নিজেরাই নিজেদের সুখকে কীভাবে যত্নে রাখবি তা ঠিক করেনে। আমি যাই সবার খাবার দিতে বলি।” কথাটা শেষ করে লাবন্য আর হিমেলের কপালে দুটো চুমু খেয়ে চলে গেলেন তিনি ।

লাবন্য অপলক দৃষ্টিতে নানির চলে যাওয়ার পথে চেয়ে রইল।
“কি দেখিস? ”
“নানি না আসলে কী হত?”
“উফফ বন্য, এসব প্রশ্ন এখন আর না। আজ সব কিছু আনন্দের হবে। খালামনি কি বলতো মনে নাই তোর? ”
“হুমম, যেদিন তোদের দুজনের সম্পর্ককে সবাই মেনে নিবে সেদিন আকাশে বাতাস শুধু আনন্দ আর আনন্দ খেলা করবে। আমি সেদিন ছাঁদে গিয়ে ফানুস উড়াবো খুশিতে। সেদিনটা হবে আমার জন্য ঈদের দিন। ”
“চল গিয়ে ফানুস উড়াই, আমি ফানুস নিয়ে আসছি, নিচে গাড়িতেই আছে।”
“সত্যি সত্যিই নিয়ে আসছো?”
“হুমম।” বলে হিমেল লাবন্যকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেলো আর আস্তে করে বলল “ভুলি কীভাবে?”

লাবন্যদের বাড়ির ছাঁদে ওদের বাসার সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টি আকাশের দিকে। জ্বল জ্বল করে কতগুলো ফানুস উড়ে যাচ্ছে আকাশে। রুশ চিৎকার করে ওর আনন্দের প্রকাশ করছে। সবাই খুব খুশি কিন্তু লাবন্য এখন কেনো জানি খুব কাঁদছে। হিমেলের চোখও ভেঁজা। ওর নানি বারবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন কিন্তু লাভ হচ্ছে না। তারপরও ফানুসগুলোকে ঝাপসা চোখেই দেখছেন আগ্রহ নিয়ে। মনে আশা, আজ হয়তো তার মেয়েটা দূর আকাশে বসে এই আনন্দে সামিল হচ্ছে। ছাঁদের এককোনায় দাঁড়িয়ে লিখনও আজ নিরবে চোখের পানি ফেলছে আকাশের পানে চেয়ে। রেশমার এই ইচ্ছেটা যে ওরও জানা। ও নিজেও যে চেয়েছিলো রেশমার পাশে দাঁড়িয়ে একসাথে ফানুস উড়াবে আজ। কিছু কথা,কিছু জ্বলজ্বলে স্বপ্ন বুকেই চাপা থাকে আজাীবন কারো কারো, ঢেকে থাকে মেঘের আড়ালে চাঁদের মতো যা কেউ কোনো দিন জানতে পারে না।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here