মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ৪৭,৪৮

0
298

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ৪৭,৪৮
সায়লা সুলতানা লাকী
৪৭

বৃহস্পতিবার রাতে লিখন বাসায় ফিরল দুই হাত ভরে বাজার নিয়ে। লাবন্যের নানিই ওকে আশ্বস্ত করেছেন যে নাজমুল সাহেব আসবেন বিয়ে বিষয়ক কথা বলতে। বিষয়টা জানার পর থেকে ওর মনের মধ্যে মিশ্র একটা প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। এমন দিনকে সামনে রেখে ওর আর রেশমার মধ্যে কত রকম স্বপ্ন পরিকল্পনা ছিল একটা সময় ।কত কত সময় ওরা পার করেছে একসাথে এই দিনগুলোর কথা ভেবে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে উত্তেজনাটা অবশ্য লিখনের চেয়ে রেশমারই বেশি ছিল। তাইতো হাতে টাকা জমলেই মেয়ের জন্য গহনা বানিয়ে রাখতো। ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে গহনায় মুড়িয়ে বৌ সাজাবে। নিজের ভাগ্যে বৌ সাজটা ছিলো না। কোনো রকমের একটা উড়না মাথায় দিয়ে কবুল বলে রেজিস্ট্রার খাতায় সাক্ষর দিয়েছিলো সেদিন। মেয়েকে বৌ বেশে দেখে নিজের মনের স্বাদ মেটানোর বড় ইচ্ছে ছিলো ওর। তখন অবশ্য লিখনও হাসতো আর বলতো মেয়ের পাশাপাশি তুমিও বৌ সেজে এসো, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব তোমাকে তখন। ওর কথা শোনার সাথে সাথেই রেশমা রেগে যেতো , বলতো “তোমার কি বিবেক বুদ্ধি সব নষ্ট হয়ে গেছে? মেয়ের বিয়ের দিন আমিও বৌ সাজবো? সেদিন আমার মনের অবস্থা কি হবে তা কি একবার ভেবে দেখেছো? একজন মায়ের জন্য দিনটা কতটা সুখের তা সবাই জানে কিন্তু কতটা প্যাথেটিক তা অনুমানও করতে পারে না কেউ । ” কথাটা শেষ করেই কেঁদে ফেলেতো ।

লিখনের আজ সেসব স্মৃতিগুলো ঘুরে ঘুরেই মনে পড়ছে। আর ওকে আরও বেশি ইমোশনাল করে তুলছে। আজ সারাদিন ও কাকে কাকে যে কল দিয়ে কথা বলেছে তা ও নিজেও মনে হয় না খেয়াল করেছে। মনে যা ভালো লেগেছে তাই কিনে এনেছে আগামীকালের জন্য। ভেতরের উত্তেজনাকে কোনোভাবেই সামাল দিতে পারছে না।

এদিকে লাবন্যের নানি সারাদিন লিখনের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসে আজ তাও আসে নাই তাতে তার চিন্তাটা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছিলো। মেহমানদারী নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা নাই, তার চিন্তা ছিলো এমন দিনে মেয়েটা ওর বাবাকে কাছে পাবেতো? মা নেই কিন্তু মাথার উপর বাবার ছায়াটাও যদি না থাকে তবে যে ওর মন আরও বেশি খারাপ হয়ে যাবে।এমনিতেই মেয়েটা বড় অভিমানী। রাতে যখন লিখনকে বাজার সমেত আসতে দেখলেন তখন ভেতর থেকে শান্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। মনকে স্থির করলেন যে, না লাবুর বাবার সব কিছু মনে আছে। রাতের খাবার ততক্ষণে তারা খেয়ে নিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখলেন তাসলিমা টেবিলে খাবার দিচ্ছে আবার। বিষয়টা জানতে সামনে আসতেই দেখলেন লিখন স্লিপিং ড্রেস পরে খেতে বসেছে। দেখেই বুঝলেন ও আর আজ কোথাও যাবে না, এই বাসাতেই থাকবে রাতে। মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। ডাইনিংএ তাকে দেখে লিখন বলে উঠল
“আম্মা এখনও জেগে আছেন? আমি ভেবেছি ঘুমিয়ে পড়েছেন তাই আর ডাকিনি। বাজার এনেছি একটু দেখে জানিয়েন কিছু বাকি রইল কি না?”
“বাজারের দরকার ছিলো না, তুমি থাকলেই হবে। বাচ্চাদের শুধু তাদের বাবার সঙ্গটা দরকার। আর কিছু না।”
“আম্মা আমি কোনো কমতি রাখতে চাই না….”
“এখন আর কোনো কমতি নাই।”
“ভুল বললেন আম্মা, রেশমার কমতি আমাদের জীবনে সবসময় থেকেই যাবে।”
“তুমিও ভুল বললে, তোমার জীবনে রেশমার জায়গাটা ভরাট হয়ে গেছে। তুমি কোনো কমতিতে নেই। বাদ দাও এসব কথা, খাও।” কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না, সোজা লাবন্যের রুমের দিকে চলে গেলেন। লিখন কোন উত্তর দিলো না, চুপচাপ বসে রইল টেবিলে।

“কিরে কি করিস? এই রাতে মেহেদী পরছিস হাতে? ঘুমাস নাই?” নানি একটু এগিয়ে এসে পাশে বসল লাবন্যের।

“জি না নানিজান, ঘুম আসে না তাই শখ করে মেহেদী পরছি হাতে। আগামীকাল আমার জীবনের জন্য একটা বিশেষ দিন কি না তাই একটু হাতটাকে সাজাচ্ছি। এক কথায় বলতে পারো… ”

“উফফ চুপ থাকতো! কত খুশি! একেবারে…

“একেবারে উছলায়ে পড়ছে, বুঝলা তুমি?” কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল লাবন্য।

“দুষ্টমি ছাড় এবার। একটু বোঝ জ্ঞান রেখে কথা বলতে শিখ।”

“উফফ তুমি যে কি না নানি একেবারে রস বিহীন মানুষ একজন। আগামীকাল আমাদের বাসায় আমার বিয়ে নিয়ে কথা হবে। জানো এই দিন নিয়ে আম্মু কত এক্সাইটেড ছিলো? আম্মুতো পুরাই বোকা ছিল, আমার কোনো একদিন বিয়ে হবে, আমি শ্বশুর বাড়ি চলে যাব তা ভেবেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করতো।আর তা নিয়ে দাদি রাগারাগি করত। দাদি বলতো “মাইয়্যা বিয়া দিও না, সারাজীবন আইবুড়ি কইরা কাঁধে ঝুলাইয়া রাখো। কোনদিন না কোনদিন বিয়া দিব আর এখন সেই দুঃখে কাঁদে, এমন পাগল দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আর একটাও নাই।”

“ওর মনটা অনেক নরম ছিলো। অল্পতেই গলে যেত। ”

“আমার কি মনে হয় জানো নানি! আম্মু এখন থাকবে না তাই হয়তো সেই সময়তেই কেঁদে নিয়েছিল আমার বিয়ে নিয়ে। আম্মু আগেই বুঝতে পেরেছিল এমন ইম্পর্ট্যান্ট সময়েই তিনি থাকবেন না আমার পাশে। তাইতো নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারতো না।”

“এসব কি কথা? মনগড়া কথা বলিস না। এখন এসব কথা থাক। ”

“কীভাবে রাখবো, আজ যে আরও বেশি আম্মুকে মনে পড়ছে। আজ আম্মু থাকলে কত খুশি হত। কত কি করতো আমার জন্য। ”

“কি করতো বল, আমি করি…”
“তুমিতো করছোই। আমাকে সঙ্গ দিচ্ছো।”

“রেশমার বিয়ে নিয়ে আমারও অনেক ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু তা পূরণ করতে পারি নাই।”

“ইন্না-লিল্লাহ, আমি আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভুলেও কোন স্বপ্ন দেখব না। ভালো করেছো তোমার কথা বলে। শিক্ষা নিলাম, ধন্যবাদ বস। নো স্বপ্ন টপ্ন।”
“এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব বদমাশ। এভাবে কেউ বলে? স্বপ্ন বলে কয়ে কেউ দেখে না এই স্বপ্ন এমনি এমনিই আসে। তুই….”

“প্লিজ নানি এবার আমি বলছি বাদ দাও এই টপিক। এখন মনটাকে রাঙাতে ইচ্ছে করছে, কষ্টের নীলে ঢাকতে চাই না। দেখো না মেহেদীর রঙে হাত রাঙাইতেছি।”

“দেখি কি দিলি?”
“দেখো, দোখো, তোমার হিমু দেখলেই ফিদা হয়ে যাবে।”
“হুমম সুন্দর। ”
“দাও তোমাকেও দিয়ে দিই।”
“আমার এত শখ নাই। ”
“আরে তুমি নানু শাশুড়ি হবে তোমার আবার শখ নাই মানে ….”
“থাম, আমি আরও দুজনের নানি শাশুড়ি হয়েছি অনেক আগেই ।”
“তাতে কি? ওই দুইজন তোমাকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু তোমার ছোট নাতনি জামাই দেখো তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচবে। কি আদর যত্ন করবে তা শুধু দেখো।”
“তাই নাকি? তেমনটা বলেছে নাকি সে?”
“বলবে কেন, আমি জানি না বুঝি? ওকে আমি ঠিক চিনি। ও আমার ভালোবাসার মানুষগুলোর যত্ন নিবে পুরোপুরি। একটুও অবহেলা করবে না।”

“এতটা বিশ্বাস? ”

“হুমম, যাকে মন প্রান দিয়ে ভালোবাসি তাকে বিশ্বাস করবো নাতো কাকে করবো? আম্মুর উপর একটা সময় খুব রাগ হতাম যখন ভাবতাম আম্মু একটা অজানা অচেনা ছেলেকে ভালোবেসে নিজের বাবা মা পরিবার ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। ওই ছেলে কি নিজের পরিবার আর বাবা মায়ের চেয়ে বেশি হয় গেলো? খুব রাগ করতাম আম্মুর সাথে প্রশ্ন করতাম কেন এমনটা করে ছিলো? আম্মু বলতো এর কোন উত্তর তার কাছে নাই। এখন নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেই। খালামনি তাদের বাসায় একদিন আমাকে অনেক অনেক বাজে কথা বলেছিলো আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। ভেবেছিলাম আর না, এই সম্পর্ককে আর টানবো না। এটাকে এখানেই ক্লোজ করবো। কিন্তু কেনোজানি তা করতে পারিনি। একটু একটু করে আরও জড়িয়ে পড়েছি।আবার যখন আব্বু বিয়ে করল তখন ভালোবাসার উপরই বিশ্বাস উঠে গেল। মনে হলো পুুরষদের ভালোবাসা বলে কিছু নেই যা আছে তা শুধু প্রয়োজন। যে তার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম তখন কেবল তারই আরাধনা করে পুরুষ । যখন মেটাতে পারে না তখন অন্যপাত্র খোঁজে প্রয়োজন মেটাতে। মনে হল হিমেলও ঠিক এমনটাই করবে আমার ভালোবাসার সাথে।মনকে শক্ত করতে চাইলাম, আর কাউকে ভালোবাসার নামে বিশ্বাস করব না। কিন্তু দেখো এবারও পারলাম না। হেরে গেলাম ভালোবাসার কাছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয় তাই সে এর বাহিরে আর কিছু ভাবতে পারে না। আম্মু বেঁচে থাকলে আম্মুকে বলতাম যে প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে ছিলো না, আমি সেই উত্তরটা খুঁজে পেয়েছি। আম্মু তার ভালোবাসাকে হারাতে চায়নি। আম্মু তখন অন্ধ ছিলো তাই তোমাদের বিষয়টা খেয়াল করতে পারেনি।”

“দোষ আমাদেরও ছিলো, আমরাও আমাদের সন্তানের মনকে বুঝিনি, ওর কাছে যেতে পারিনি। আমাদের সাথে ওর দূরত্বটাকে খেয়াল করিনি।”

“কি একটা অবস্থা তাই না? আমরা কোনো সমস্যা সময় মতো বুঝি না। যখন বুঝি তখন সব শেষ।”

“তাতে কি? সব সমস্যাই কিছু না কিছু শিক্ষা রেখে যায়। যা থেকে সামনে যেনো একই ভুল আর দ্বিতীয়বার না হয় তার জন্য সতর্কতা বার্তা দিয়ে যায়। তাই বা কম কিসের? ”

“হুমম ঠিকই বলছো। আমি আমার মেয়েকে…”
“ইশশ,একটুতো শরম কর, বিয়ে না হতেই মেয়ে মেয়ে শুরু করেছিস। বিয়েটতো আগে হতে দে।”

“হায় আল্লাহ! এখন কি করলা নানি? আমার যে এখন শুধু লজ্জা লজ্জা লাগছে। ইশশ এত লজ্জা এখন কোথায় রাখি। প্লিজ নানি একটু উপকার কর একমুঠ লজ্জা একটু তোমার কাছে রাখো না!” কথাটা শেষ করেই খিলখিল করে হেসে উঠল লাবন্য ।

“ওরে নির্লজ্জ একটু আস্তে হাস, বাহিরে তোর বাপ খেতে বসেছে। শুনলে বলবে মেয়েটা বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে।”

“আব্বু এসেছে? আমি জানতাম আব্বু আসবে। এই টেবিলে বসে দুজন কত কি পরিকল্পনা করতো আমার বিয়ে নিয়ে। কি মিষ্টিসুরে গুটুর গুটর করতো দুজন! প্রায় সময় আমি আড়ি পাততাম তাদের প্রেমালাপ শুনতে।”
“কী?”
“হুমম, জানোইতো আমি নির্লজ্জ। শুনতাম আর একটু একটু করে ভালোবাসতে শিখতাম। আব্বু যখন বিয়ে করে আসল আমার মনে হল এই টেবিলে বসে আম্মুর জায়গায় অন্য কেউ…… ”
“চুপ,চুপ,চুপ একদম চুপ। অতিরিক্ত কথা বলিস তুই। এত কথা বলা বন্ধ কর। হাত ধুয়ে শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে। সকাল সকাল উঠতে হবে। কাল অনেক কাজ আছে। আমিও যাই ঘুমাই।” বলেই নানি উঠে রুম থেকে বের হয়ে এলেন।

চলবে

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৪৮)
সায়লা সুলতানা লাকী

সকাল থেকেই চলছে বাসার মধ্যে রান্নাবান্নার তোরজোর। লাবন্যের নানি বেশ ব্যস্ত তাসলিমার কাজের তদারকিতে। লিখন নিজেই আজ বাসাবাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা করছে । রুশকে সাথে নিয়ে ড্রয়িং রুমটার ডেকোরেশন চেঞ্জ করছে বারবার । লাবন্যের খুব বিরক্ত লাগছিলো প্রথম দিকে এগুলো দেখে। তাই নানিকে একবার বলেছিলো “আব্বু এসব কি শুরু করেছে?” জবাবে ওর নানি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন “আজ ওর একমাত্র মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসছে বাসায়, সেই খুশিতে ও যা খুশি তাই করতে পারে। কেউ ওকে বাঁধা দিতে পারবে না। ”
নানির কথায় যুক্তি আছে তাই আর কথা বাড়ায় নাই। নিজের রুমে ফিরে গেছে। হিমেল সকালে এসে শাড়ি আর বেলি ফুলের মালা দিয়ে গেছে। সকালে যখন ও কল দিয়েছিলো তখন লাবন্য ঘুমায়। রিংটোন শুনে ঘুম ভাঙে ওর। ওই অবস্থাতেই বাসার নিচে নামতে হয় হিমেলের জরুরি তলবে। ঘুম ঘুম ঢলোঢলো চোখে লাবন্যকে দেখতে বড় মায়াবী লাগে হিমেলের এ কথাটা ও বহুবার বলেছে। আজও একগাল হাসি দিয়ে বলেছিলো “উফফ বন্য তুই কবে আমার হবি? কবে আমি মুগ্ধ হয়ে তোর এই মায়াবী মুখটা দেখব। ইচ্ছে করছে এখনই জাপটে ধরে আদর করে দেই।”
এই কথা শোনার সাথে সাথে লাবন্যের চোখের ঘুম গায়েব হয়ে গিয়েছিল। চিৎকার দিয়ে বলে উঠেছিল “এই সাবধান, এটা বেডরুম না। ভুলেও এ কাজ করে বসো না। ”
ওর চিৎকারে গার্ড ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার ওদেরকে দেখছিলো। আর তাতে লাবন্যের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। মুখটা বাকিয়ে বলেছিলো “কি জন্য আসছো? ও শাড়ি দিতে? দাও, এরপর চলে যাও। এখানে দাঁড়িয়ে ড্রামা করতে হবে না। এখানে ড্রামা দেখার পাবলিকের অভাব নাই। ”
ওর কথা শুনে হিমেল হা হা হা করে হেসে উঠেছিল। শাড়ি আর মালা গুলো দিয়ে আর দাঁড়াতে পারে নাই। লাবন্য জোরকরে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
রোমান্টিক কোনো দৃশ্য দেখতে না পেরে মনে হল গার্ডের মনঃক্ষুণ্ন হল। ব্যাটার দিকে তাকিয়ে লাবন্য একটা হাসি দিয়ে উপরে চলে এসেছিল তখনই । এখন নিজের রুমে বসে সেই শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোট, জুয়েলারি মিলাতে ব্যস্ত হয়ে আছে। এক ফাঁকে বের হয়ে মায়ের রুমের দিকে গেল ম্যাচিং খুঁজতে । ওকে যেতে দেখেই হয়ত লিখনও ওর পেছন পেছন ওই রুমে ঢুকল।

“আব্বু তুমি?”
“হুমম, আমার লাভকে একটু সময়ের জন্য আমার কাছে বসিয়ে দেখার জন্য আসলাম। আমার পাশে একটু বসতো মা। ছোটবেলায় আমার গা ঘেষে বসতি। রুশ হওয়ার পর রেশমা তোকে কাছে রাখতে পারতো না। তুই তখন আমার কাছেই থাকতি বেশি সময়। আমরা দুজন সকালে হাটতে বের হতাম। পার্কের সামনে বসে মাঠা খেতাম। তুই সাদা গোফ বানাতি মাঠার ক্রিম দিয়ে। জিহ্বা উলটিয়ে চেটে খাওয়ার চেষ্টা করতি। একবার আমি রুমাল দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম বলে তোর সেকি কান্না। আমি সরি বলি তবুও তুই মানছিস না। শেষ পর্যন্ত পার্ক ভরা মানুষের সামনে দুই হাত দিয়ে কান ধরে দাঁড়ালাম ঠিক এমন করে (বলেই কান ধরে দাঁড়িয়ে গেলো লাবন্যের সামনে)। এরপর তোর কান্না থামল।
পার্কের লোকগুলো ঘুরেঘুরে আমাকে দেখছিলো আর হাসতেছিলো, সেদিন কিন্তু আমার একটুও লজ্জা লাগেনি কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে জানিস? বরং অনেক শান্তি লেগেছিলো কারন আমার মেয়েটা সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো যাও তোমাকে মাফ করে দিলাম। তোর কি সেই কথা মনে আছে? ”
লাবন্য মাথা নিচু করে বসে আছে। ওর চোখ ছলছল করছে ও ওর মাথাটা উঠাতে পারছে না। ওর মনে হল ওর মাথাটা উঠালেই ওর আব্বু ওর চোখের পানি দেখে ফেলবে। ওর ভেতর কাপিয়ে কান্না আসতে চাইছে কিন্তু ও চায় না ওর আব্বুর সামনে একটুও কাঁদতে।

“লাবু, তোর আম্মু খুব ভয় পেতো তোকে নিয়ে। তুই কিছু নিয়ে বায়না করলেই ও রেগে যেতো। তোকে সেই জিনিসটা সাথে সাথে দিতে চাইতো না। আমি দিতে চাইলে বলতো “দিও না। মেয়েকে যা আছে তাতে মানিয়ে নিতে শিখতে দাও। ও মেয়ে ওকে সারাজীবন মেনে নিতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে।” জানিস, এই কথাটা শুনলেই আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে যেতো। ওর কথার প্রতিবাদ করতাম, বলতাম “আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ে কখনওই যা আছে তাতে মেনে নিবে না মানিয়ে নিবে না। ওর যা দরকার তা নিয়েই ও চলবে।” আমি তোকে মানুষও করেছি সেইভাবেই। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে চলার জন্য তুই না। তুই যা ডিজার্ভ করিস তা দিয়েই চলবি। আমি তোর আব্বু সবসময়ই তোর পাশে আছি। কখনও তুই নিজেকে একা ভাববি না। যেমনটা তুই ছোটবেলাও ভাবতি না। সবসময়ই তোর দলের লোক ভাবতি আমাকে। আচ্ছা বলতো মা আমি কি কখনও তোকে এই ব্যাপারে ডিজএপোয়েন্ট করেছি? কখনও এমন হয়েছে যে তোর দরকার ছিলো কিন্তু তুই আমাকে কাছে পাস নাই? যদি এমনটা হয় তবে কোনো দিনও আমি নিজেকে ক্ষমা করব না। কারন তাহলে আমি ব্যর্থ ।”

লাবন্য কিছু বলতে গিয়ে আবার থেমে গেল। বিয়ের আগে বা পরের কথা কি বলবেতা বুঝতে পারছিলো না। তখন আবার লিখনই শুরু করল

” তোর জন্মের পর রেশমা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তোর দাদি হঠাৎ করেই বলে বসল “মেয়ে হইছে তাতে এত খুশি হওয়ার কি আছে, খাইবো, ভোগ করবো এরপর সময়তো গাট্টি বোসকা বেঁধে শ্বশুর বাড়ি যাইব। তোমার থাকবি কি?”
সেই কথা শুনেই সেদিন তোর মা হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলল। তাই ভাবছি আজ রেশমা থাকলে না জানি কি করতো? বলতো আমার লাবু বড় হলো কেন?
আমারও এখন মনে হচ্ছে, আমার লাভ বড় হল কেন? ছোটই থাকতো! সারাদিন টুকটুক করে হাটতো এ ঘর থেকে ও ঘর। হাঁড়িপাতিলে রান্না করতো আর একটু পর পর চামচ মুখের সামনে ধরে বলতো দেখোতো লবন হয়েছে কি না? আর আমি মুখে নিয়ে চু চু করেই বলতাম, ইয়াম্মী অনেক মজাতো! আর তুই খিলখিল করে হেসে উঠবি। মারে কতোদিন তোর সেই হাসি দেখি না। আমার আবার তোর খেলার সাথি হওয়ার ইচ্ছে করে। আবার তোর সাথে সকাল বেলা পার্কে হাঁটতে যেতে ইচ্ছে করে। আবার একটা ভুল করে কানে ধরে দাঁড়িয়ে যাব ঠিক এমন করে দেখে নিস! ( কথাটা বলতেই কানে ধরে দাঁড়িয়ে গেল) একটুও লজ্জা পাবো না। কারন আমি যে অপরাধী। আমার সন্তানের কাছে অপরাধী, ওদের বিশ্বাস মতো স্থির থাকতে পারনি। কিন্তু বিশ্বাস কর একটা মুহুর্তের জন্যও তোদের ছেড়ে দেইনি আর দিবো না কোনোদিন । তোর এই ভুল করা আব্বুটাকে ছোটবেলার মতো এবারও মাফ করে দে না লাভ!আমার লাভ, আমার লাবু, আমার আদরসোনা শেষবারের মতো মাফ কর না আমাকে!”
এবার আর লাবন্য নিজেকে আড়াল করতে পারল না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওর আব্বুর বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল

“আব্বু আমাদের জীবনটা আগে কত সুন্দর ছিলো, তুমি আমি রুশ আম্মু কত সুখে শান্তিতে ছিলাম।আম্মু মারা যাওয়ার পর কেন এমন এলোমেলো হয়ে গেলো? তুমি কেন আমার থেকে দূরে সরে গেলে? কেন আমি তোমার আদর থেকে ছিটকে পড়লাম? এমনতো হওয়ার কথা ছিলো না।”

“কাঁদিস না আমার ফেয়ারী কুইন, আমার লাভ। সব আবার আগের মতোই হয়ে যাবে। আমরা আবার সুখে শান্তিতেই থাকব। আমার আদর থেকে তুই কখনওই ছিটকে পড়িস নাই। সবসময়ই তুই আমার বুকেই আছিস। কে বলে তুই ছিটকে পড়েছিস? বোকা মেয়ে আমার। ” লিখন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলল এরপর ওর মাথায় একটা চুমু খেল।

“আব্বু তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। এডভোকেট আন্টিরসাথে কথা বলে……”
“দুর বোকা ওটা কোনো কথাই না। তোর জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। তুই যে তোর মাথা ঠান্ডা রেখে ওই পরিস্থিতিতে নিজের ছোটভাইকে সাথে নিয়ে সব গুছিয়ে থাকতে পেরেছিস তাতেইতো অনেক অনেক শুকরিয়া জানাই আল্লার দরবারে। ওসব কথা আর কখনও মুখেও আনিস না।তোদের জিনিস তোরাই নিয়েছিস, বুঝছিস?”

“কিন্তু আব্বু….”
“আর কোনো কিন্তু নাই। আজ একটা শুভ দিন।বড় আনন্দের দিন। আজ আমার সেই ছোট লাবুকে অন্য এক বাবা তার ঘরে নেওয়ার অনুমতি চাইতে আসবে এটা ভাবতেই ভেতরটা কেমন জানি লাগছে। সব কিছু শুভ শুভ ভাবে হয়ে যাক।এটাই এখন আল্লাহর কাছে চাওয়া। বড় আপাকে নিয়ে রেশমার অনেক টেনশন ছিলো, সে তোদেরকে কবে মেনে নিবে তা ভেবে নির্ঘুম কাটিয়েছে কতরাত ও। আজ সেই শুভদিনটা আসছে। আজ রেশমা থাকলে মনে হয় সবচেয়ে বেশি ওই খুশি হত। আমার বিশ্বাস ও উপর থেকে তোর জন্য দোয়া করছে। তাইতো সব কিছু এত সুন্দর মতো গুছিয়ে এসেছে। ”

আর বিশেষ কিছু কথা বলতে পারল না বাবা আর মেয়ে। রুশ এসে ঢুকল রুমে।
“আব্বু আসো না! এখনওতো কাজ বাকি! নানু এসে কিন্তু বকা দেওয়া শুরু করবে। জলদি আসো।”
“আসছি আব্বু, আসছি।” বলে মেয়ের মাথায় আরও একটা চুমু খেয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। লাবন্য স্থির হয়ে বসল, নিজের কাছে বড় হালকা বলে মনে হচ্ছে আজ। ফ্ল্যাটটা লিখিয়ে নেওয়ার পর থেকে ভেতরটা কেমন জানি ভার হয়ে ছিলো , আজ মনে হল সেই ভারটা নেমে গেলো মন থেকে। কেমন একটা আনন্দ ছেয়ে গেলো মনে বাবার আদর পেয়ে, সবচেয়ে বড় কথা ওর বাবা ওর উপর রাগ করে নেই তা জানতে পেরে বেশি ভালো লাগছে ।

দুপুরে সাধারণ খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ভাতঘুম দেয় কিন্তু আজ আর কেউ ঘুমাচ্ছে না। সবাই সবার রুমে ভালো কাপড়চোপড় পরে রেডি হচ্ছে। সবার ভেতর আনন্দ দেখে লাবন্যের আনন্দ আরও বেড়ে গেল।

দুই দুইবার ডোরবেলের শব্দ হলেও এখনও খালামনি খালুজি আসেন নাই তা লাবন্য ভেতরে বসে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কে আসছে তা জানতেও লাবন্য রুম থেকে বের হয়নি একবারও।
আসরের পর পরই আসলেন রেহেনা বেগম আর নাজমুল সাহেব। এবার লাবন্য ঠিকই টের পেলো, কারন হিমেল কল দিয়ে কনফার্ম করেছে। নিজে নিচে বসে জানিয়েছে “আব্বু আম্মু উপরে উঠল, আর আমি নিচে বসে আছি। যদি বলিস তবে চলে আসি।”
সাথে সাথে লাবন্য বলে উঠেছে ” না না, তোমার এখন আসার দরকার নাই। তুমি আশেপাশেই থাকো। প্রয়োজন হলে যেন সাথে সাথেই পাই। আমার কেন জানি খুব ভয় হচ্ছে ।”
হিমেল হা হা হা করে হেসে কলটা কেটে দিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষন পর রেহেনা বেগম এসে ঢুকল লাবন্যের রুমে। দরজায় নক করতেই লাবণ্য খুলে দিল। ভেতরে এসেই রেহেনা বেগম চমকে গেল ওকে দেখে।
“কিরে তোর কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন? এত কেঁদেছিস কেন? শাড়ি পছন্দ হয়নাই? গাধাটাকে বলেছিলাম তোকে সাথে নিয়ে কিনতে। ও শোনে আমার কোনো কথা? সারপ্রাইজ দিবে শাড়ি দিয়ে । এবার হলোতো! আমার হবু বৌমার শাড়িই পছন্দ হয় নাই। হিমু যে কবে বুঝবে এসব, সবসময় সারপ্রাইজ ভালো না। ধূরররর এখন কী হবে? চল যাই তুই আর আমি। কান্না বন্ধ কর। উঠ, চল।”

“কোথায়?”

“শপিংয়ে যাই, শাড়ি কিনে আনি। আমার বৌমা প্রথম শাড়ি পরে তার শ্বশুর শাশুড়ির সামনে যাবে তার পছন্দমতো শাড়িটা পরে। চল।”

“খালামনি আমারতো শাড়িটা পছন্দ হয়েছে।”

“তবে কি শাড়ি পরতে পারিস না? ঠিক আছে নে শাড়িটা নে, আমি পরিয়ে দেই।”

“খালামনি.. ”
“কি কিছু বলবি? বুঝেছি, আমিতো খারাপ,আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিস খুব , বিয়ের পর আমি তোকে আমার বাসায় নিয়ে অনেক জ্বালাবো কি না? এসব প্রশ্ন করবি?”

“খালামনি আমার খুব খারাপ লাগছে আম্মুর জন্য।”

“আমারও লাগছে, আমিও দুদিন ধরে শুধু ওর কথা ভেবে কেঁদেছি। কিন্তু আজ ঠিকই মন ভালো করতে সুরসুর করে চলে এসেছি ওর বাসায়। এই দেখ এখন আমার মনটা ভালো লাগছে। ওকেতো আর ফিরে পাবো না, তবে ও যা রেখে গেছে তার যত্ন করে যদি কিছুটা শান্তি পাওয়া যায় মনে। আসল কথা হচ্ছে মনে শান্তি পাওয়া। আমি এখন শান্তি পাচ্ছি যা এত বছর পাইনি। চোখের সামনে দেখেছি কিন্তু ছুঁতে পারিনি।”

“সবকিছু কেমন জানি স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে আজ।” আর বলতে পারল না ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো লাবন্য।

“জীবনতো এমনই। যে বাস্তবকে ঘিরে স্বপ্ন তৈরি হয় তা পূরণও হয়। স্বপ্ন যখন আকাশকুসুম হয় তখন তা পূরণ হওয়া হয় অবাস্তব ।এখন এই স্বপ্ন টপ্ন থাক। বাহিরে তোর হবু শ্বশুর অপেক্ষা করছে তার হবু বৌয়ের মুখ দেখে মিষ্টিমুখ করবে বলে। জলদি রেডি হয়েনে। আমি তাই ভেতরে চলে এলাম মেয়েকে নিতে কিন্তু এভাবেতো আমি আমার মেয়েকে কাউকে দেখাতে চাই না। আমার মেয়ে হতে পারে তার বরের কাছে বন্য কিন্তু সেতো আমার কাছে আমার মা, আমার লাভ আমার লাবু।মিষ্টি একটা ভালোবাসার খনি যার মনটা বড় খাঁটি। ”
শেষ কথাটা শুনে লাবন্য ওর খালামনিকে জড়িয়ে ধরে জোরে কাঁদতে শুরু করল। সাথে রেহেনা বেগমেরও চোখ ভিজে উঠল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here