#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ১৩)
সায়লা সুলতানা লাকী
লাবন্যের ঘুম ভাঙল ওর আব্বুর চিৎকার চেচামেচি শুনে। কার সাথে যেন মোবাইল কলে কথা বলছিলেন তিনি। লাবন্য কানটা খাড়া করল বিষয়টা বোঝার জন্য। বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখল তখনও অন্ধকার বাহিরে।সম্ভবত ফযরের নামাজের জন্য উঠেছে তাই ভাবলো প্রথম। স্পষ্ট শোনতে পেল কোন এক এম্বুলেন্সের ড্রাইভারের সাথে কথা বলছেন, তাকে বাসার ঠিকানাটা বোঝাচ্ছেন বারবার, অগি দ্রুত আসার তাগিদ দিচ্ছেন । সাথে সাথে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল বিছানায় লাবন্য । “এই সময়ে এম্বুলেন্স কেন? কার কি হল?” চিন্তা করতে আর বসতে পারল না। দৌড়ে রুম থেকে বের হল। সামনেই লিখনের চিন্তিত চেহারা দেখে থমকে গেল। রেশমাকে আশেপাশে না দেখে দৌড়ে রেশমার রুমে ঢুকল। আর তখনই রৌশনের কাঁদার শব্দ কানে এল।
“আম্মু ও আম্মু তুমি উঠছো না কেন? কথা বলছো না কেন? আম্মু প্লিজ তুমি উঠো, আম্মু, ও আম্মু। ”
“আহ রুশ এমন করে নাতোকিভাবে বাবা, দেখছোতো তোমার আম্মু সেন্সলেস হয়ে আছে , হাসপাতালে নিয়ে যাই দেখবা ঠিক হয়ে যাবে।” চিৎকার করে কথাটা বলল ড্রয়িং রুম থেকে লিখন।
লাবন্য ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না। মায়ের অচেতন শিওরের পাশে চুপ করে বসে আছেন দাদি। যেনো তার কোন বিকার নাই । লাবন্য দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসতেই লিখন ডেকে উঠল
“এই লাবু তুই এখন ওদিকে যাস না। মা’রে তুই বাসায় রুশকে নিয়ে থাক। আমি রেশমাকে নিয়ে যাচ্ছি। নিচে এম্বুলেন্স চলে আসছে।” বলেই রুমে ঢুকল লিখন। লাবন্য ওর মায়ের হাতটা ধরতেই দেখল হাতটা বরফ শীতল হয়ে আছে। অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। মায়ের মুখটা আজ বড় ক্লান্ত বলে মনে হল। সব কিছু কেমন জানি মেসি মেসি লাগতে লাগল ঠিক কি করবে, কি বলবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মা’য়ের হঠাৎ কি হল গতরাতে কি আনন্দ করতে দেখল হুমা আপুর সাথে কথা বলার সময়, রাতে শারীরিকভাবে কি এমন অসুস্থ হল যে এখন এমন সেন্সহীন অবস্থায় পড়ে আছে? ভাবতে ভাবতেই দুইজন লোক রুমে ঢুকে ওর মাকে স্ট্রেচারে উঠিয়ে নিয়ে গেল। তখনই রুশ চিৎকার দিয়ে উঠল
“আম্মুকে কেন নিয়ে যাচ্ছো কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমি যাব।”
“না না তোমার যাওয়া দরকার নাই। তুমি লাবুর সাথে বাসায় থাক।”
হঠাৎ করেই লাবন্য বলে উঠল
“আমি যাব।”
লিখন তখন আর কোন কথা বলল না। ছেলেমেয়ে নিয়ে বের হয়ে গেল।
এম্বুলেন্সে বসেই লাবন্য হিমেলকে জানাল যে ওর মা’কে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে। আর বিশেষ কিছু বলতে পারল না। মায়ের মাথার কাছে বসে আলতো করে মায়ের মুখটাতে হাত বুলিয়ে দিল। শীতল হয়ে ঘুমিয়ে আছে বলে মনে হল লাবন্যের। মুখটা মায়ের কানের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে ডাকল “আম্মু, আম্মু, আম্মু তুমিকি আমাকে শুনতে পাচ্ছো? উঠ, না হলে কিন্তু রেশমা বলে ডাকবো বারবার।”
“আহ লাবু এমন করে না। বসে দোয়াদরুদ পড়। আল্লাহ রহমানুর রাহিম। রহম তিনিই করবেন। মনে মনে দোয়াদরুদ পড়। ” লিখন বেশ শক্ত করেই বলল।
লাবন্যের মুখ দিয়ে কোন দোয়া দরুদ আসতেছিলো না তখন। গলা মনে হচ্ছিল কেউ চেপে ধরে রেখেছে ভিতর থেকে । খুব কষ্টে কলেমা তাইয়েবা পড়তে শুরু করল।
রেশমার দেহটা নিয়ে ভিতরে চলে গেল সবাই। একটু পড়েই ডাক্তার ঢুকলেন দুই তিনজন। এর মধ্যেই হিমেল এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে। চোখেমুখে উদ্বিগ্নের ছাপ ফুটে আছে। লিখনকে দেখেই জিজ্ঞেস করল
“খালুজি কি হয়েছে খালামনির?”
“বুঝতেছি না, ঘুম ভাঙতেই দেখি সেন্সলেস অবস্থায় পড়ে আছে। ঠিক কতক্ষণ এই অবস্থায় আছে তা বলতে পারছি না।”
লাবন্য ওর আব্বুর কথায় মনে হল এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল। “কি বলে এসব? এটা কি করে সম্ভব হয়? পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুজন ভালোবাসার মানুষ, যেখানে আম্মু বলতো আব্বুর প্রতি হৃৎস্পন্দন টের পেত সে পাশে শুয়ে, সেখানে কি আব্বু টের পেতো না আম্মুর হৃৎস্পন্দন ? দুই ডাক্তার বের হতেই ওর আব্বু আর হিমেল দৌড়ে তাদের সামনে গেল। ডাক্তার কি বলছে তা যেন ও শুনতে পারছে না। নিজের ঘোরটাই কাটছে না ঠিক মতো। সবকিছু কেমন ওলোট পালোট লাগছে। হঠাৎ মনে হল বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটা কথার ধ্বাক্কা লাগল কর্নগহ্বরে। “পেশেন্টতো আরও তিন চার ঘন্টা আগেই মারা গেছেন। ডেডবডি নিয়ে আসছেন, আমরা আর কি করতে পারি বলেন?”
সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল। ওর আম্মুকে ডেডবডি বলছে ডাক্তাররা, রেশমাকে ডেডবডি বলছে তারা।কি আশ্চর্য এটা কেমন কথা? একটা মানুষ ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে আর ডাক্তার তাকে ডেডবডি বলছে এটা কোন যুক্তির কথা হল? মনের মধ্যে ঝড় চলছে নিজের সাথে। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে উঠে ডাক্তারের সাথে তর্ক করার শক্তিটুকু ও পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বোবাভুতে ধরছে ওকে। পাশেই রুশ চিৎকার করে কাঁদছে। “আম্মু তুমি উঠো, আম্মু তুমি কথা বল! আম্মু আমি তোমাকে একটুও বিরক্ত করবো না। প্রমিজ, একেবারে পাক্কা প্রমিজ। ”
লাবন্য একবার ওর হাতটা বাড়িয়ে রুশের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
“রেশমা বলে ডাক তবে রেগে উঠে আসবে। তোকে মারতে চাইলে বলিস আমি বুদ্ধি দিছি তাহলে আর তোকে কিছু বলবে না। আমার উপর তেড়ে আসবে। চল দুজনই একসাথে জোরে চিৎকার করে ডাকি “রেশমা”।
লাবন্যের কথাগুলো কেউ শুনলো না। কি যে হল সব ঝড় ওর মনের মধ্যে চলছে কোন কথা ঠোঁট পর্যন্ত আসছে না। নিজের শরীরও নড়ছে না। শুধু চোখ জোড়া নড়ে নড়ে আশেপাশের সব মানুষের পারফর্ম দেখছে। ডেডবডিকে নিয়ে আবার এম্বুলেন্সে তোলা হল। সবাইকে খুব তৎপর দেখাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করল হুমা আপু লাবন্যকে জড়িয়ে ধরে টেনে তুলে কোথায় যেনো নিয়ে যাচ্ছে। ও আর ভাবতে পারছে না। এত ঝড় মোকাবেলা করতে করতে ক্লান্ত হয়েগেছে তাই কখন যে চোখ বুজল তা টের পেলো না।
লাবন্য যখন চোখ মেলে তাকালো তখন ওদের বাসা ভরা আত্মীয় স্বজনে। এর মধ্যে ওর নানি আর বড় খালামনিকেও দেখতে পেল। নানি অঝোরে কাঁদছেন। খালামনিও কাঁদছেন। ফুপুরা চুপচাপ বসে আছেন কেউ কারউ সাথে কোন কথা বলছেন না। লাবন্য মাথা ঘুরিয়ে দেখল হুমাআপু রুশকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে। রুশ তখনও কাঁদছে। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল।ওর আম্মু কোথায়? আজ নানি বড়খালামনি সব এসেছে তার বাসায় আজ সে কোথায়? মনে হতেই উঠে বসল। আর সাথে সাথে খেয়াল করল ওর হাতে স্যালাইন লাগানো। ওর মাথাটা সোজা রেখে বসতে পারছে না, শুধু দুলছে সব আর শরীরটা কাঁপছে।
“লাবু আমার নানু, আমার নানুমনি তুমি এখন উঠো না। শুয়ে থাকো নানু” নানির কথায় লাবন্য কি উত্তর দিবে ভাবছে তখনই হিমেল ঢুকলো রুমে।
“বড়পু বন্য আর রুশকে নিয়ে একটু আসো। আর তোমরাও আসো। জানাজার জন্য নিয়ে যাব এরপর আর মুখটা দেখতে পাবে না।” হিমেলের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে লাবন্যের বড় ফুপু বলে উঠলেন
“লাশ কি এখনই নিয়া যাবা?”
লাশ কথাটা যেন বুকের মধ্যে বিঁধল। কি হল বুঝল না লাবন্য বাঘিনীর মতো ক্ষিপ্র হয়ে বলে উঠল
“লাশ কি হ্যা, লাশ কি? রেশমা বলতে পারো না? কেমন মানুষ তোমরা? মনুষ্যত্ব কোথায় রাখো শুনি?”
“আহা! বন্য এখন এত উত্তেজিত হওয়ার সময় না। তুই উঠ আমি স্যালাইন ধরছি। আয় খালামনিকে একটু দেখবি।” বলে হিমেল এগিয়ে আসতেই লাবন্য টান দিয়ে হাত থেকে স্যালাইনের সুঁই খুলে ফেলল
“এসব কি হ্যা, এসব কি লাগাইছো আমার হাতে সবাই মিলে? আশ্চর্য আম্মুকে কোথায় রাখছো? আম্মু কোথায়?” বলতে বলতে এক ঝাটকায় উঠে দাঁড়াল। চুল ভেঁজা। চুলের পানিতে পিঠ ভিজে যাচ্ছে। মাথাটাকে স্থির করার চেষ্টা করতে করতে হিমেল পেছন থেকে এসে ধরল চেপে। তারপর কোন কথা না বলে ওকে আস্তে আস্তে টেনে রুম থেকে বের করে আনল। ও বিরবির করছে, বাসার মধ্যে আম্মুর জায়গা হল না। আম্মুকে নিচে রাস্তায় রাখা হয়েছে কি নির্মম বাস্তবতা। লিফটে নামার সময় রুশকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে লাগল লাবন্য, শুধু শক্ত করে ভাইকে বুকে চেপে ধরে রাখল।
সাদা কাপড়ে পেঁচানো সাড়া শরীর শুধু মুখটুকু খোলা আর সেই মুখ শুধু খুব কাছের আপন মানুষগুলো এসে এসে দেখ যাচ্ছে।
লাবন্য অপলক দৃষ্টিতে ওর আম্মুর ক্লান্ত মুখটার পানে চেয়ে রইল। যে মুখটা ব্যক্ত করছে অনেক না পাওয়ার কষ্ট, অনেক অপূর্ণ ইচ্ছার কথা, অনেক অবাস্তবায়িত স্বপ্নের কথা, অনেক অজানা নির্মম সত্য কথা। লাবন্যের কেন জানি কোন কান্না পাচ্ছে না আজ। কাঁদার একটু ইচ্ছেও করছে না। বরং চারপাশের মানুষগুলোর পারফর্ম দেখতে ভালো লাগছে। হঠাৎ চোখ পড়ল ওর আব্বুর দিকে। সে খুব ব্যস্ত অন্যদের সাথে আলাপচারিতায়। তার চোখে মুখে কেমন জানি একটা ভয়ের ছাপ লুকিয়ে আছে। কি সেই ভয় লাবণ্য তা বোঝার জন্য আরও ভালো করে ওর আব্বুর মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল।
চোখের সামনে দিয়ে রেশমাকে নিয়ে গেল সাদা কাপড়ে পেচিয়ে একটা খাটিয়াতে শুঁয়ায়ে। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে একদিন বাবার বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসেছিল। সেসব স্বপ্ন কি ওর পূর্ণ হয়েছিল? নাকি অপূর্ণ স্বপ্নগুলো বুকে চেপেই এবার এবাড়ি ছাড়ল? আজ কেন জানি লাবন্যের এই প্রশ্নের উত্তরটা বড় জানতে ইচ্ছে করছে। সবাই শুধু বলছে “লাবু তুই এমন বরফ হয়ে গেলি কেন? একটু কাদঁ তাহলে মনটা নরম হবে। এভাবে শোক মনের মধ্যে আটকে রাখলে কষ্ট বাড়বে বই কমবে না।”
কিন্তু ও কাউকে বলতে পারছে না যে ওর একটুও কান্না পাচ্ছে না। চোখে পানি নাই, ইচ্ছে করে কি কেউ কাঁদে নাকি? ভিতর থেকে আসতে হয়, মেকি কান্না কাঁদতে শিখেনি এখনও। বাসায় ফিরে সবাইকে দেখতে লাগল আর মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকে “এই যে সবাই এত গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কাঁদছে তা সবই কি অন্তর থেকে, নাকি সবটাই লোক দেখানো চেষ্টা মাত্র। হঠাৎ করেই ওর খালামনির হাতটা ধরে বলল
“আম্মুর উপর তোমার রাগ এখনও আছে? এখনও আম্মুকে ঘৃণা কর?”
রেহেনা কোন উত্তর দিতে পারল না। শুধু মুখ বুজে চোখের পানি ফেলতে লাগল। আজ ওর মুখের সব কথা কেউ কেড়ে নিয়েগেছে।
দাদির দিকে তাকিয়ে বলল “তোমার এখন কি হবে কালিয়া! কার কাঁধে বন্দুক রেখে ফোটাবে তা ঠিক করেছো কি? ”
“কি আবোল তাবোল বলছিস? তোর মাথা ঠিক আছেতো? মা মরতে না মরতেই কি পাগল হয়েগেলি?” দাদি একটু রুক্ষস্বরে উত্তর দিল।
“না দাদি এখনও পাগল হয়নি। তবে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান পেলাম তাই দেখছি”।
“নানুমনি তুমি রেশমার বড় সন্তান, তোমার অনেক দায়িত্ব। তুমি এমন ভেঙে পড়লে চলবে না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। রৌশনকে দেখে রাখতে হবে। তোমার আব্বুর খেয়াল রাখতে হবে। তুমি এমন অস্থির হলেতো বিপদ। স্থির কর মনকে। মায়ের জন্য দোয়া কর। যেনো আল্লাহ ওর সব হিসাব সহজ করে দেনসেখানে ।”
“তুমি কি আম্মুকে ক্ষমা করতে পেরেছো?”
“সেতো আমি কত আগেই করেছি।”
“আম্মু মরলে তুমি এ বাসায় আসবে, খালামনির মন নরম হবে এমনটা জানলে আম্মু হয়তো আরও আগেই মরতে চাইতো। তোমাদের জন্য তার মনটা সবসময় ছটফট করতো।”
“পৃথিবীতে মানুষ যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তার হিসাব থাকে। তার প্রতি অন্যের রাগ থাকে মান অভিমান থাকে, চাওয়া পাওয়ার হিসাব থাকে। যখন তার মৃত্যু হয় তখন সব হবে সব বন্ধ হয়ে যায়। তখন আর কোন রাগ থাকে দুঃখ থাকে না কষ্ট থাকে না।থাকে না কোন লেনদেন।”
“এমন কেন নিয়ম? কেন মানুষটা জীবিত থাকতে তার দোষগুলোকে তার ভুল গুলোকে মেনে নেওয়া যায় না? কেন জীবিত মানুষটাকে একটু শান্তি একটু স্বস্তি দিতে তার চারপাশের মানুষগুলোর এত সমস্যা, বলোতো নানি? আজ তোমার আসছো, আম্মুর জন্য কাঁদছো কিন্তু আজতো আম্মু তা দেখছে না। আজতো আম্মু তার মনের অশান্তির বোঝা নামিয়ে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিয়ে যেতে পারল না। তবে আর এসবের কি দরকার বলোতো? এসব কি শুধু এক ধরনের দায়বদ্ধতা মাত্র! ”
“বড় কঠিন প্রশ্নরে লাবু, এর উত্তর আমার কাছে নাই। মেয়েটা আমার এমন করে চলে যাবে তা বুঝতে পারিনি। মেয়েটার সব কিছুতেই ছটফটানিটা বেশি ছিল। আমার নাড়ি ছেড়া ধন, আমার সবচেয়ে ছোট সন্তান আজ আমার সামনে লাশ হয়ে পড়েছিল, এ যে কি কষ্ট তা বোঝাতে পারবনারে। এই কষ্টও আল্লাহ আমার ভাগ্যে রেখেছিলেন তা বুঝিনি। দূরে ছিল কিন্তু বেঁচে ছিল, তাতেই শান্তি পেতাম। আজ সে শান্তিটুকুও শেষ। চিরতরে ওরে আজ বিদায় দিলাম”। বলে তিনি অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। তার কাঁদার সাথে সুর মেলালেন রেহেনা বেগম। লাবন্যর খুব কষ্ট হতে লাগল ওর মায়ের জন্য। হঠাৎ করেই ভিতরটা বড় শূন্য বলে মনে হল।নিজের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল।
লাশ দাফন হওয়ার কথা শুনে লাবন্যের নানি আর রেহেনা বেগম চলে গেলেন। যাওয়ার সময় লাবন্য আর রৌশনকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন কিন্তু লাবন্য যেতে রাজি হল না। তারা চলে যেতেই এতক্ষণ চুপ থাকা ওর দাদি সরব হয়ে উঠলেন
“এতদিন আসার নাম নাই আর আজ মেয়ে মরতেই আসছে ঢং দেখাতে।” আর যেন কি বলতে শুরু করেছিল সাথে সাথে ওর ফুপুরা থামিয়ে দিল।লাবন্য ইচ্ছে করেই শুনতে চাইল না। শুধু পাশের রুমে তাদের একান্ত ফিসফিসানিগুলো কানে আসতে লাগল। আজ এগুলো কোন কিছুই আর মানে রাখে না। আগে একটা সময় ছিল যখন ওর মা’কে নিয়ে কেউ কিছু বললে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ত। এখন আর তেমনটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনের মধ্যে কিসের যেন একটা “কিন্তু কিন্তু” থেকে যাচ্ছে যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না।
লিখন বাসায় ফিরে গোসল করে লাবন্যের পাশে এসে বসল
“খেয়েছিস কিছু?”
“ইচ্ছে নেই।”
“ইচ্ছে না হলেও খেতে হবে। আমাদের মাঝে রেশমা আর নেই, এটাই সত্য। তা মেনে নিতে হবে। নিজেদেরকেই নিজেদের দেখে রাখতে হবে। শক্ত হতে হবে। মনের মধ্যে কষ্টটা চেপে রাখিস না। মন খুলে কেঁদেনে, মনটা হালকা লাগবে। কাঁদলে…….”
“আচ্ছা আব্বু! আম্মুতো বলতো আম্মু তোমার পাশে শুয়ে তোমার হার্ট বিট গুনতে পারতো। তুমিও কি তা পারতে? তোমার হার্ট বিট না শুনলে আম্মুর ঘুম হতো না। তোমার কখনও এমনটা মনে হয়নি?”
লিখন কোন উত্তর না দিয়ে লাবন্যের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, এ যেনো এক অন্য লাবন্যকে দেখছে সামনে বসা।যার সাথে ওর কোনো জানা নেই চেনা নেই, এ এক ভিন্ন লাবন্য।
চলবে