#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ১২)
সায়লা সুলতানা লাকী
ঢাকায় ফিরে লাবন্য যেনো এক অচেনা রেশমাকে দেখতে পেলো। আগের প্রান চঞ্চল হাসিখুশী রেশমাকে মনে হল ওদের গ্রামের বাড়িতেই রেখে আসল। ওর এমন পরিবর্তন যে শুধু লাবন্য খেয়াল করছে তা নয়। এই পরিবর্তন লিখনকে অনেকটা অস্থির করে তুলল। সরাসরি রেশমার সাথেও এবিষয়ে কথা বলতে চাইলো কিন্তু ও তেমন সাড়া দিলো না। এক পর্যায়ে লাবন্যকেও জিজ্ঞেস করল ওর মায়ের মুড হুট করেই এমন অফ হল কেন? ওখানে কি কিছু ঘটেছে কি না ? যদিও এর আগে আর কোন বারই লিখন এসব বিষয় জানতে চায়নি ওর নানাবাড়ীতে কখন কি কি হয়? লাবন্য ওর জানামতে সবই ওর আব্বুর সাথে শেয়ার করলো কিন্তু তাতেও কোন ক্লু খুঁজে পেলো না মন খারাপের।
এদিকে হিমেল মহা খুশি। এবার নানা বাড়িতে যাওয়া আর ফিরে আসার পর ওর নিজের বাসার আবহাওয়ায় আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে লাগল। ওর আব্বু প্রতিবেলা খাওয়ার সময় ওর মা’কে সাথে নিয়ে খেতে বসছে। পারলে খাবারের টুকটাক প্রশংসা করছে আর নয়তো চুপচাপ খেয়ে উঠে যাচ্ছে । অযথা ধমকা ধমকিটা বাসায় এখন নাই বললেই চলে। স্বামীর এমন আচরনে রেহেনা বেগমও খুব খুশি। মায়ের সুখী সুখী মুখটা হিমেলের মনে অনেক আনন্দ দিতে থাকল। প্রতিদিনই এই আনন্দ লাবন্যের সাথে শেয়ার করতে ভুলে না ফোনকলে। এদিকে লাবন্য ওর মায়ের কথা আর ওকে বলে না। কারন হিমেলের আনন্দে ভাটার টান আনতে চায় না। মায়ের এমন নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া নিয়ে নিজেই একদিন মায়ের সাথে সরাসরি কথা বলে
“আম্মু তুমি কি জানো, আমরা আমাদের হাস্যময়ী রেশমাকে কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলেছি। কি সাংঘাতিক বিষয়, তাই না? তুমি কি একটু কাইন্ডলি তাকে খুঁজে দিতে পারবে? তাকে ছাড়া জীবন বড় পানসে পানসে লাগছে। ”
” লাভ, তুইতো জীবনকে খুব সহজভাবে দেখতে পছন্দ করিস? বলতো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা কোথায় ছিল?”
“ভুলের কথা আসছে কেন? ভালোবাসা কোন ভুল না। আর যদি তা মানো তবে তুমি কোন ভুল করোনি, তোমার জীবনে কোন ভুল নাই। রিল্যাক্স আম্মু, আমার এত পারফেক্ট মমের হবে ভুল? কাভি নেহি।”
“মায়ের ভুলটা বলতে চাচ্ছিস না? কেন চেপে যাচ্ছিস? চারপাশে সবাই আমার ভুল ধরিয়ে দিতে দিতে এখন এই বিষয়ে আর কেন কষ্ট বা যন্ত্রণা ফিল করি না। তুই বলতে পারিস। আমি কষ্ট পাব না। তবে তোর মূল্যবোধটা জানতে পারলে ভালো লাগবে।”
“এভরিথিং ইজ ফেয়ার, লাভ এন্ড ওয়ার” মাই ডিয়ার ডার্লিং, তুমি “লাভ” এ ডুবেছিলা তাই তখন তুমি জিতে যাওয়ার জন্য যা করেছো তাই ঠিক। এখানে কোন ভুল খুঁজো না। সব জায়গায় ভুল খুঁজতে হয় না।”
“তোর যুক্তি মানতে পারলাম না। ভালোবাসার নানা শাখাপ্রশাখা আছে। আমি শুধু একটা শাখার ভালোবাসা পেতে গিয়ে ভালোবাসার অন্য শাখা প্রশাখাসহ গাছটাকেই উপড়ে ফেলেছি। এটা সবচেয়ে বড় অন্যায় ছিল আমার। আমি শুধু আমার রাইট টাই বিবেচনা করেছি। আমার উপর আর অন্যসবার রাইটটাকেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আমার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি৷ আমাকে নিয়ে দেখা অন্যসবার স্বপ্নের কথা কখনও পেছন ফিরেও দেখিনি। আমি চরম আকারের এক স্বার্থপর সন্তান।যে স্বন্তান তার বাবা মায়ের জন্য অনেক বড় অভিশাপ ।” বলেই রেশমা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
“এসব কি বলছো? তুমি নিজেকে কেন অভিশাপ ভাবছে? এসব ভেবে ভেবে এখন আমাদের রেশমাকে লুকিয়ে ফেলছো? এটা কিন্তু অন্যায়। আমরা আমাদের আগের আম্মু চাই। আজ কতবার তোমাকে রেশমা বললাম একবারও কান মলোনি। এসব কি আম্মু? প্লিজ আবোলতাবোল চিন্তাগুলো ড্রেনে ফেলে দাও। বাদ দাও এসব কথা এমন হবে জানলে নানাবাড়ীতে যেতেই চাইতাম না। প্লিজ আম্মু তুমি…….”
“ভুল করাতো হয়েছে অনেক আগেই এখন প্রস্তুতি নিচ্ছি প্রায়শ্চিত্ত করতে। কিন্তু ভয় সেই প্রায়শ্চিত্তের আগুনে না আবার আমার সন্তানও কষ্ট পায়! আচ্ছা লাভু যদি কখনও এমন হয় আমার পাপে তুইও জ্বলছিস তখন তুই ও কি আমাকে ঘৃণা করবি?”
“কি বলছো আম্মু! এমন কখনও হবে না৷ আর যদি কখনও হয় তবে আমি সেই শাস্তি পেতে প্রস্তুত। আমি কখনওই তোমাকে ঘৃণা করব না।”
“কি নির্মম শাস্তি আমার জন্য রেডি হয়েছে আল্লাহ ভালো জানেন। কিন্তু দেখ আমি স্বার্থপর সন্তান হয়েও নিজের সন্তানকে স্বার্থপর বানাইনি। আমার সন্তান আমার শাস্তি নিজের মাথায় তুলে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমি? আমি কি করেছি আমার বাবা মায়ের জন্য? আমার পরিবারের জন্য? আর বলতে পারল না। রেশমা মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে গেল। লাবন্য আর ওর মা’কে আটকালো না। যে কষ্টটা মায়ের বুকে বাসা বেঁধেছে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে বসল।
একরাতে লাবন্যের ঘুম ভাঙল রেশমার কাঁদার শব্দ পেয়ে। রেশমার গোঙানি শব্দে বাসার সবার ঘুম ভেঙে যায়। সবাই ছুটে যায় রেশমার রুমে। যেয়ে দেখে লিখন মুখ বুঝে রেশমার পাশে বসে আছে আর রেশমা অঝোরে কেঁদেই চলছে। ওর শাশুড়ি একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করল এত রাতে এমন করে কাঁদার কারন কি? জবাবে রেশমা শুধু বলল “আম্মা আপনিতো বলেছিলেন, সময় গেলে সবটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আবার আমি আমার পরিবার পাব। সবাই আমাকে আপন করে নিতে পারবে। কিন্তু কোথায় আমিতো কিছুই পেলাম না। আমার ভাগ্যেতো রইল শুধু শূণ্য আর শূন্য । কেন শুধু এগুলো আমার সাথেই হলো? ”
“ওরে আল্লাহ এতবছর পর আবার এই সব কথা উঠল কেন? শোনো রেশমা, এইবার তোমার বাবার বাড়ি থেকে ফিরার পর থেকে দেখছি তুমি উমা মুরগির মতো থুম ধরে বসে আছো। এমন এক দিন দুইদিন সহ্য হয়, লাগাতারতো কারউ ভালো লাগে না! এতরাতে তোমার কান্নার শব্দে ভয় পেয়ে উঠলাম। এগুলো কি এখনও সাঁজে? কত বছর পার হইছে তোমাদের বিয়ের? এখনও তোমাদের বাড়িতে এই ঢং চলে? তাইলে শোনো, তোমার ভাগ্যে সব শূন্য কারন তোমার পরিবারের ইগো বেশি, এরা একটু বেশিই — ” মাকে থামিয়ে লিখন বলে উঠল —
“আহ মা থামোতো! কি শুরু করলা? দেখছো না ওর অবস্থা? এমনিতেই মনের অবস্থা ভালো না। তার উপর কি বলছো?
“মিথ্যাতো কিছু বলিনাইরে লিখন? যে পরিবার মেয়ের ইচ্ছাকে মেনে নিতে পারে না। সে পরিবারের বাঁধন এত শিথিল হয় কীভাবে? তাদের মেয়ে নিজ ইচ্ছেতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসে কীভাবে? কই আমার মেয়েরাতো এমনটা করতে পারেনাই। আমার ছেলেও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেনাই। তুইতো আমার কাছেই ছিলি। বরং ও এক কাপড়ে চলে এসেছিল। আমি পরে তোদের বিয়ে দিয়েছে, ওকে মেনে নিয়েছি কারন ও আমার ছেলের পছন্দ। আর তাই কোনো প্রশ্নও করিনি।”
“মা প্লিজ তুমি একটু থামো। তুমি যাও এখন একটু ঘুমাও। এ বিষয়ে কোন কথা না বলো তাতেই ভালো।”
“লিখন তুমি আম্মার সাথে এমন করছো কেন? আম্মাতো সত্য কথাই বলেছেন। আমিই খারাপ ছিলাম। আমি পাগল হয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। তোমরা ঠাঁই না দিলে সারাজীবন ভাসতে থাকতাম, আম্মা মেনে না নিলে আমার কি হত? আমিই আমার আব্বা আম্মার মান, সম্মান ঢুবিয়েছি। আমিই তাদেরকে সমাজের কাছে —- “আর বিশেষ কিছু বলতে পারল না কেমন জানি নিস্তেজ হয়ে পড়ল ওর শরীরটা আর তখনই লিখন জড়িয়ে ধরল দ্রুত ।
লাবন্য কি বলবে তাই বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর আব্বুর কথায় পানি নিয়ে আসল দৌড়ে। লিখন পানি ছিটাতে লাগল রেশমার চোখেমুখে। আর লাবন্য সামনে থাকা নিউজপেপার তুলে মায়ের মাথায় বাতাস করতে শুরু করল।
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে রেশমার দিকে তাকিয়ে ওর শাশুড়ি আস্তে করে বলল
“রেশমা গতরাতে আমার কথায় মনে কষ্ট নিও না। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠায় মাথা ঠিক ছিলো না। একটু রেগে গিয়েছিলাম তাই আবোল তাবোল যা মুখে আসছে বলে ফেলেছি। ওগুলোকে মনে রেখো না।”
রেশমা বুঝে সবই। সকালে যখন ওর পাশে লিখনকে পায়নাই তখনই আন্দাজ করেছিল কিছু। লিখন চায় ওর মা আর ও মিলেমিশে থাক সবসময়। তাই বাড়তি আর কিছু না বলে সবসময়ের মতো রেশমাও মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল
“না আম্মা কি মনে রাখব! আপনি খারাপ কিছু বলেননিতো।”
যদিও এমন খোঁচা রেশমা গতরাতেই শুধু নয় মাঝে মধ্যেই খায় শশুরবাড়ির অন্য সদস্যদের কাছ থেকেও। ঘর ছাড়ার সাহস সবার থাকে না এই কথা শোনায়নাই এমন একজনও বাকি নাই পরিচিত মহলে।
সেদিনের পর নিজ থেকেই চেষ্টা করতে লাগল রেশমা মনের ভিতর চলতে থাকা যুদ্ধকে চেপে রেখে সবার সামনে স্বাভাবিক থাকতে। এভাবেই কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। এরই মধ্যে একদিন বাসায় হিমেল আসল। ওকে দেখে ঠিক আগের মতো করে খুশি হতে পারল না রেশমা বরং ওকে দেখেই মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রচন্ড রকমের এক ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইল। রেশমার চোখমুখ যে আগের মতো নেই তা হিমেলের চোখ এড়াতে পারল না। কোনরকম ভনিতা না করেই প্রশ্ন করল
“খালামনি তোমার কি হয়েছে? কি নিয়ে তুমি এত আপসেট।”
“কই কিছু হয়নিতো! আমার আবার কি হবে?” বলতে বলতে রেশমা নিজের রুমে চলে গেল। হিমেলকে আর কোন প্রশ্নই করতে সুযোগ দিলো না তাৎক্ষণিকভাবে।
“কিরে খালামনির এই অবস্থা কতদিন যাবৎ? তুইতো আমাকে এ বিষয়ে কিছুই জানাসনি? সমস্যা কি তোদের মা মেয়ের? কি লুকাচ্ছিস আমার কাছে?”
“এত প্রশ্ন করছো কেন একসাথে? আর এ কি তোমার কথার শ্রী! এভাবে বলো না, শুনতে খারাপ লাগে। সব কথা কি তোমাকে বলতে পারি সবসময়?”
“আমি জানতাম পারিস, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে…. ”
“হুমম, এখন মনে হচ্ছেতো! তাতেই বাকিটা বুঝেনিও। এখন চুপ থাকো। এই প্রসঙ্গ এখন আর ভালো লাগে না।”
“কথা না বললে বুঝব কীভাবে? খালামনির হঠাৎ কি হল বলতো?”
“জানলেতো বলবে!”
“মানে?”
“নানাবাড়ি থেকে আসার পর থেকেই দেখছি। কিন্তু কিছুই শেয়ার করছে না।”
“চল” বলেই হিমেল লাবন্যের হাত ধরে টেনে রেশমার রুমে গিয়ে উঁকি দিল
“খালামনি আসব?”
“আয়।”
“একটা দারুন বিষয় তোমার সাথে শেয়ার করব বলে আসলাম।”
কি কথা বলবে তাই ভেবে রেশমা বুকটা চেপে রইল। হিমেল সেদিকে না তাকিয়েই বলতে শুরু করল ওর আম্মুর প্রতি আব্বুর পরিবর্তনগুলো। হিমেল এতটা আনন্দ নিয়ে বলছিলে যে লাবন্য খেয়াল করল বলার সময়, ওর চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিলো আনন্দে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই আনন্দে একটু একটু করে রেশমার চোখেমুখেও ছড়িয়ে পড়ছিলো।
আনন্দে গদগদ হয়ে বলতে লাগল রেশমা
“সত্যি বলছিস হিমু, আপা আবার আগের মতো দুলাভাইয়ের আদর ভালোবাসা পাচ্ছে। দুলাভাই আপার জন্য শাড়ি কিনে এনেছে? আপা নিশ্চয়ই অনেক খুশি হয়েছিলেন তখন? খুশিতে কাঁদেননিতো?”
“হুমম কেঁদেছে, আম্মুও এখন আর কথায় কথায় ক্যাটক্যাট করে না। কীভাবে যে তোমাকে বাসার আবহাওয়ার কথা বর্ননা করব তা বুঝতে পারছি না।”
“আমাকে বোঝাতে হবে না। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেলোরে হিমু। খুব শান্তি লাগছে মনে। অনেক কেঁদেছি আল্লাহর কাছে আল্লাহ শুনেছেন। মন থেকে একটা বোঝা নেমে গেল বলে মনে হচ্ছে।দাঁড়া তোকে মিষ্টিমুখ করাই। এত ভালো একটা নিউজযে দিলি।” বলে রেশমা রুম থেকে বের হয়ে গেল।
“তোমার ঘরে পূর্ণ শশী,
আমি ডুবা অমাবস্যায়।
আঁধার ঘেটে তুলবে টেনে
মানুষটা আজ আছে কোথায়?”
“এটা আবার কেমন কথা?”
“সত্য, কঠিন বাস্তবতা। তুমি যখন তোমাদের বাসার সুখের বারতা শুনাতা তখন আর ইচ্ছে হতো না আমাদের বাসার কথাগুলো তোমাকে বলে তোমার আনন্দকে ভাটায় ফেলতে।”
“বড় বেশি বুঝতে শিখেছিস –”
আর বলতে পারলো না কিছু, রেশমা মিষ্টি নিয়ে রুমে ফিরল।
“খালামনি আরেকটা সুখবর আছে। বড়পু আসবে সামনের মাসে। ছোটপুর কথা এখনও কনফার্ম হয়নি।”
“ওরে, এতো একটার পর আরেকটা দারুন খবর। এতদিনে বড় আপার ঘরে পরিপূর্ণ শান্তি আসল বলে মনে হলরে।”
“তুমিও আসো এই সুযোগে আমাদের বাসায় দেখবা আম্মু সব রাগ ভুলে যাবে তুমি আসলে।”
রেশমার আনন্দ মুহুর্তেই গায়েব হয়েগেল। অস্ফুটস্বরে বলল
“দেখি, আসব কি না পরে জানাবো।”
লাবন্য আর হিমেল কয়েকদিন বেশ শপিং করা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটালো। হিমেলের দুই বোন আসছে মানে অনেক বড় আয়োজন হবে বাসায়। হিমেলের আব্বু এই সময়তে দুইহাতে টাকা খরচ করেন। দুই মেয়ের শশুর বাড়ির সবার জন্য গিফট কিনেন। মেয়েদের প্রিয় সব জিনিস দিয়ে বাস ভর্তি করেন। আর এসবই হিমেল আর লাবন্য করল এবার। লাবন্য নিজেও খুব খুশি। কারন হিমেল বারবার ইঙ্গিত দিয়েছে এবার আপুরা আসলে দুজনের বিষয়টা সবার সামনে তুলবে। একটা ফাইনাল ডিসিশন হবে। হয়তো হিমেল আমেরিকা যাওয়ার আগে আকদও হয়ে যেতে পারে। নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে লাবন্য এই কয়দিন বেহুশ হয়ে থাকল।
হুমায়রা দেশে এসেই সাথে সাথে রেশমাকের কল দিল । লাবন্য ভাবল ওর আর হিমেলের বিষয়ে কথা বলবে তাই ও উঠে গেল মায়ের কাছ থেকে । এদিকে হুমা কল দিয়েই রেশমাকে বলল ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য। কথাটা শুনেই রেশমা আনন্দে এক চিৎকার দিয়ে উঠল “নিশ্চয়ই আসব” বলে। এমন একটা ডাকের আশায় ও আছে বহু বছর ধরে। ওর চিৎকার আড়িপেতে শুনে লাবন্যের আনন্দ আরও বেড়ে গেল। ও তাই আনন্দ ভাগ করতে হিমেলকে কল দিতে চলে গেল। আর তখনই হুমা জানালো হিমেলের সাথে ওর ছোট ননদের এনগেজমেন্টের প্রিপারেশনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ও নিজেই আসবে একদিন রেশমার বাসায়। কথাটা শুনেই রেশমা স্তব্ধ হয়ে গেল। আর কোন কথাই বলতে পারল না। শুধু হু হা করেই রেখে দিল।
রাতে ঘুমানোর জন্য শুয়ে থাকলো ঠিকই ঘুম আর চোখে নামলো না। মনের মধ্যে যে ভয়টা এতদিন ঘাপটি মেরে বসে ছিল তা যেনো আজ ঢাকঢোল পিটিয়ে সামনে এল। হিমেল আর লাবন্য দুজন যে দুজনকে পছন্দ করে তা নিশ্চয়ই বড় আপার অজানা না। তবে কেন আপা হিমেলের সাথে হুমার ননদের সাথে বিয়ের কথা বলছে? তবে কি আপা লাবন্যকে কোনদিনও মেনে নিবে না? রেশমার দোষে কি লাবন্য কোনদিনও ওর ভালোবাসার পূর্ণতা পাবে না? মায়ের কর্মফল কি মেয়ে ভোগ করবে? হিমেল কি লাবন্যকে ভুলে হুমার ননদকে বিয়ে করতে রাজি হবে? ছেলেটা বড় মা ভক্ত ছেলে, ও কি ওর মায়ের অমতে লাবন্যকে সঙ্গী করবে?
এমন হাজারো প্রশ্ন একের পর এক মনের মধ্যে উদয় হতে থাকল। হঠাৎ করেই বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হতে শুরু করল রেশমার। আর তার সাথেই বিন্দুবিন্দু ঘাম হতে লাগল। হাত বাড়িয়ে লিখনকে ডাকতে ইচ্ছে করল না।ও ঘুমাচ্ছে, ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে পেছনের কথা মনে পড়ল।রেশমার বান্ধবী একদিন প্রশ্ন করেছিল “আচ্ছা ভাইয়া, যদি এমন হত, আন্টি রেশমাকে মেনে নিল না, তবে আপনি কি করতেন? ভালোবাসাকে সাপোর্ট দিতেন নাকি মায়ের কথা শুনে রেশমাকে ত্যাগ করতেন?”
সেদিন লিখন কোন উত্তর দেয়নি। কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। পরে একদিন রেশমাই প্রশ্নটা করেছিল ওকে সেদিন উত্তরে বলেছিল “আম্মাতো মেনে নিয়েছে তবে আর এসব প্রশ্ন কেন তুলছো।”
তবুও মুখ ফুটে বলেনি একবারও “আমি ভালোবাসার সঙ্গী হতাম। যে মেয়েটা আমার ভালোবাসায় সব ছেড়ে চলে আসতে পারে তারে হারাই কীভাবে? আমিও যে ওকে খুব ভালোবাসি।”
রেশমা আর কিছু মনে করতে পারল না। সব কিছু কেমন জানি অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল চোখে। বুকের ব্যথাটা বাড়তেই থাকল ক্রমে ক্রমে, তা যেনো কমতে ভুলে গেল আজ।
চলবে