মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ৪২,৪৩

0
366

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ,পর্ব ৪২,৪৩
সায়লা সুলতানা লাকী
৪২

“ইন্না-লিল্লাহ, লাবু তুই এইটা কি করলি? রুশ নানুভাই আমার, ব্যথা পাইছো তুমি?” লাবন্যের নানি চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আর তখনই মনে হল লাবন্যের হুশ হল ও এই মাত্র কি কাজটা করেছে তার। ওর ভেতরে জমিয়ে রাখা ভয় যে ওকে এতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা ও বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ করেই অপরাধ বোধ উদয় হল ভেতরে। রুশের দিকে তাকাতেই ওর অসহায় চোখগুলো মনের মধ্যে হাতুড়ি পেটানো শুরু করল। আচমকা রুশের হাতটা ধরে টেনে নিজের রুমে ছুটে গেল। ভেতরে ঢুকে দরজাটা আটকিয়ে দিয়ে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল। রুশ পুরোপুরি কলের পুতুল হয়ে গেল। লাবন্য যেভাবে টানছে সেভাবেই দুলছে। নিজে অনেকটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। কোনো রকম রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে বলে মনে হল। চড়টা খেয়েও কাঁদছে না শুধু অবাক চোখে বোনের অস্থিরতা দেখছে।

রুশকে নিয়ে রুমে যেতেই লিখন ভয় পেয়ে গেল। কি করে আবার রুশের সাথে? এমন চিন্তায় নিয়ে বসে থাকতে পারল না উঠে দরজায় নক করতে লাগলো “লাবু, লাবু মা আমার দরজাটা খোল। আমার কথা শোন। পুরো কথাটাতো একবার শুনবিতো! পুরোটা শোনা উচিৎ তোর, তাই না? মা লাবু দরজাটা খোল। মারে মাথাটা একটু ঠান্ডা কর। আমি তোদের বাবা বেঁচে আছি এখনও, তোরা এতিম না। মা শোন দরজাটা খোল।”

লাবন্য তখনও রুশকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। লিখনের কোনো কথাই ওর কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। আস্তে করে রুশ বোনের বুক থেকে মাথাটা উঠিয়ে বলল
“আপু, আব্বুু দরজাটা খুলতে বলছে, আমি খুলে দেই?”
“রুশ ভাইরে , তুইতো আব্বুর ভাগ কাউকে দিতে চাইতি না। এখন দেখ আব্বুই তোর আব্বুর ভাগ অন্যকে দিয়ে দিচ্ছে। আমাদের আব্বু আর শুধু আমাদের রইল না।”

“লাবু মা আমার কথাটা শোন, একটু দরজাটা খোল।”
এবার রুশ লাবন্যের বাহুবন্ধনী খুলে বের হয়ে দরজাটা আস্তে করে খুলে দিল।
লিখন এগিয়ে এসে লাবন্যকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো কিন্তু ও ওর আব্বুর হাতটা সরিয়ে দিল ধাক্কা দিয়ে। তারপরও লিখন জোর করে মেয়ের হাত ধরে পাশে নিয়ে বসালো

“লাবু, মাই লাভ। আগে আমার কথাটা শোন তারপর কষ্ট নিস। কথা না শুনেই শুধু শুধু কেন কষ্ট পাচ্ছিস বোকা মেয়ে। আমি লিখন তোর আব্বু এখনও বেঁচে আছি। তারপরও কেন নিজেকে এতিম ভাবছিস? মানলাম আমি নির্বোধের মতো একটা ভুল করে ফেলছি। তাই বলে কি আমি বারবার ভুল করব? তুই আর রুশই যে আমার জীবনের সব। তোরা ছাড়া যে আমি একেবারে শূন্য। তোরা আমার সন্তান, তোদের প্রতি আমার যেমন দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনি আমার মা আমার গর্ভধারিনীর প্রতিও দায়িত্ব আছে। মা শুধু আমার একা না অন্যদের ও। তাই বলে অন্য কেউ দেখছে না এই ভেবেতো আমি আমার দায়িত্ব ভুলতে পারি না। বরং তখন আরও বেশি দায়িত্ব বেড়ে যায় যখন দেখি আমি ছাড়া আর কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না । আমি বিয়েটা করেছিলাম সংসারটাকে আবার আগের মতো সচল করতে। সবাই মিলে চাপ দিলো বলল তোরাও একসময় মেনে নিবি। আম্মার কষ্টটাই তখন খুব বেশি ভোগাচ্ছিল মনে। নিজের পেটের সন্তানদের আচরন তার মায়ের প্রতি এতটা যে খারাপ হতে পারে তা সামনে থেকে না দেখলে বোঝা যায় না। আমি বিয়েটাতো করলাম কিন্তু তার আগে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছিলাম মেয়ে পক্ষকে। ওরা সব শর্ত মেনে নিল। তাদেরও কোন উপায় ছিলো না। যাকে বিয়ে করলাম তার বয়স চল্লিশ। তার বিবরন আর তোকে না’ই দেই। বিয়ের পর আমার জীবনটা যে এমন হয়ে যাবে তা বুঝতে পারিনি। তোদের প্রতিই যখন আমার পুরো ধ্যান তখন ওই দিকটায় আবার সেই পুরোনো ধাঁচে চলতে শুরু করে দিল সেদিকটায় আর তাকাইনি ফিরে । সবাইতো আর রেশমা হয় না যে মুখ বুঝে সহ্য করবে। সমস্যা একটু একটু করে বড় হতে শুরু করল। আমি রেশমার প্রতি সত্যি সত্যিই বড় অবিচার করেছি। এই পাপ আমাকে দুনিয়া আর আখেরাতে ভোগাবে তা নিশ্চিত। তাই নতুন করে আর পাপ করতে চাইলাম না। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সরিয়ে দিলাম দুই গ্রুপকে দুইদিকে।
এতদিন আমি এখানে থেকে দুজনকেই এভয়ড করেছি সমানতালে। তাদেরকে তাদের প্রয়োজন আর অবস্থান ঠিক করতে সময় দিয়েছি। এসব কথা কেন তোকে বলছি হয়ত তোর ভেতরে এমনই প্রশ্ন উঠছে তুই খুব বিরক্ত হচ্ছিস, হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি হলেও তাই হতাম। কিন্তু মা তোর বাবা একটা ভুল করছে সত্য এখন সেই ভুলটাকেতো আর অস্বীকার করা যাবে না। এগুলোর মধ্যেই চলতে হবে।”

“কি বলতে চাও তুমি? তোমার ভুল নিয়ে তুমি থাকো। এসব নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নাই। আমরা কেন এগুলোকে সাথে নিয়ে চলবো?”

“তোদের মাথা ব্যথা হোক তা’ও আমি চাই না। তোরা ভালো থাক সেটাই আমার কাম্য। তোদের মাঝে যাতে আমার ভুল কখনও না আসে সেই ব্যবস্থা করতেই গিয়েছিলাম। আমি সেই সুখবরটাই দিতে এসেছিলাম। মা তার বৌয়ের সাথে মিলেমিশে থাকতে সম্মতি দিয়েছেন, দুজনই দুজনের সাথে মিলেমিশে থাকতে চাচ্ছেন এটা আমার জন্য একটা সুখের খবর। আমাকে আর মা বা সংসার নিয়ে চিন্তা করতে হব না। আমি আমার সন্তানদের সময় দিতে পারব নিশ্চিন্তে। আমি তাই বলতে চাচ্চ্ছিলাম। কিন্তু তুই কি বুঝতে কি বুঝলি…..”

“এসব কথা আমাকে শোনানোর কোনো প্রয়োজন নাই। কে কোথায় থাকবে তা দিয়ে আমি কি করব? আমরা আমাদের অধিকারে কারো হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারব না, পারি না। ”

“না তুই কিছুই করবি না। তবে…..”

“লিখন তুমি তোমার রুমে যাও আমি লাবুর পাশে আছি। তুমি যাও রুশকে নিয়ে যাও।” লিখনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন লাবন্যের নানি।

“জি আম্মা।” বলে লিখন রুশকে জড়িয়ে ধরে চলে গেল নিজের রুমে।

“লাবু এইটা তুই কি করলি? পুরো ঘটনাটাতো একবার জানার দরকার ছিলো। ছিলো না?
হুট করেই মাথাটা এমন গরম হয়ে উঠলো কেন তোর? কোনো কিছুই কি ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে পারিস না?”

“নানি আব্বু যেদিনই বিয়েটা করেছে সেদিন থেকেই আমি ভয়ে আছি, কবে আব্বু তার সুখবর শোনায়। তার নতুন কোনো বেবি আসবে পৃথিবীতে তার প্রতিনিধিত্ব করতে। আমরা তখন তার জীবন থেকে আউট হয়ে যাবো আস্তে আস্তে । আমাকে নিয়েতো ভাবি না, তবে এমন হলে রুশ অনেক কষ্ট পাবে। এমন কষ্ট কি ও সহ্য করতে পারবে? ওযে ছোট থেকেই আব্বুর নেওটা। আব্বু হলে ওর আর কিছু লাগে না। একবার ভাবোতো আব্বুর যদি এখন একটা ছেলে হয় তখন আব্বু কি আর রুশকে এইভাবে সময় দিবে?”

“না দিবে না, দিতে চাইলেও পারবে না। এটাই স্বাভাবিক, এটাই জীবন। এগুলোকে যত সহজে মেনে নিতে পারবি ততটাই ভালো থাকবি। রুশের জন্য তুই আছিস, আমি আছি, হিমেল আছে। সবাই মিলে চেষ্টা করব ওর অপূর্ণতাকে আদর ভালেবাসা দিয়ে ভরে দিতে। জীবন থেমে থাকে না। এই যে রেশমা চলে গেছে তাতে কি কারো জীবন থেমে আছে? সাময়িক কিছু অসুবিধা শুধু সৃষ্টি হয়েছে, এইটুকুই। এটাই জীবন এটাই বাস্তবতা। লিখনের বৌ মরেছে ও বিয়ে করে বৌ নিয়ে পূর্ণ করেছে ওর জীবন। তোর দাদিও সেইম। তোদের মা নেই তাই হয়ত সে জায়গারায় নানিকে এনে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কিছুতো থামিয়ে রাখেননি আল্লাহ । রেখেছেন কি?”

“আমরা আমার আব্বুর পাশে আমার মা ছাড়া আর কাউকে চিন্তা করতে পারি না। আমাদের আব্বুকে আমরা ছাড়া আর কেউ আব্বু ডাকবে তা ভাবতে পারি না। এরজন্য যদি কেউ আমাকে স্বার্থপর বলে বলুক। আমি এতটা উদার না। আমি আমার জিনিস শুধু আমারই হবে তাই চাই।”

“এই ঝামেলা হওয়ার পর লিখন চেয়েছিলো ডিভোর্স দিবে। আমি মানা করেছি। আমার মেয়েটার সাথে অন্যায় হয়েছে, অন্য কোন মেয়ের সাথেও হোক তা আমি চাই না। যে মেয়েটার সাথে লিখনের বিয়ে হয়েছে সে এখন লিখনের স্ত্রী। তার পূর্ণ হক আছে লিখনের সাথে সুখে থাকার। তার হককে নষ্ট করার অধিকার কারো নাই। তোরও নাই। একটা সময় তুই বিয়ে করবি, রুশ নিজের জগতে ব্যস্ত হবে তখন লিখন একা হয়ে পড়বে। সেই সময়টাতে ওর সঙ্গী দরকার হবে। তখন যদি ওর সঙ্গীর কথা ভাবি তবে এখন কেনো নয়। এখন হওয়ায় ও ওর মা’কে নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকছে এটাতো সত্য। তবে কেন আমরা বাঁধা দিব?
লিখন থাক ওর জীবন নিয়ে হাসিখুশি। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আমরা যা হারিয়েছি তা হারিয়েছিই। তা আর ফিরে পাবো না। এখন যা আছে তার মধ্যেই নিজেদেরকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। ভালো রাখার মালিক আল্লাহ। নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম প্রতিদান কারি। পরের মেয়ের সুখ নষ্ট হোক, হক নষ্ট হোক তা যখন চাইলাম না তখন নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার মেয়ের সুখ, হকও ঠিক রাখবেন। সেই বিশ্বাস আমার আছে। সব কিছু ভালো ভালো চিন্তা কর। শুধু নাই নাই ভাবিস না। কি আছে তা খুঁজে দেখ। যা আছে তার যত্ন কর।”

“আব্বু মরে গেলে কি আমাদের জীবন এমন হতো?”

“মায়েরা হচ্ছে ঘরের স্তম্ভ। বাবারা ছাঁদ। ছাঁদ সরে গেলে স্তম্ভ তার উপরেই ঘরটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। ঘরটা উড়ে যায় না। কিন্তু স্তম্ভ ভেঙে গেলে ছাদ আর কোনো কাজেই লাগে নারে লাবু।”

“নানি রুশকে যে আজ আমি মারলাম…..”

“হুমম, তুই বড় বেশি ডিপ্রেশনে আছিস।হিমুকে বলব তোকে নিয়ে কোনো কাউন্সিলরের সাথে কথা বলার জন্য। ”
“মানে?”
“হুমম ওতো এমনই কিছু বলল।”
“কে তোমার হিমু? ও কি আমাকে অসুস্থ ভাবে?”
“উঁহু , ও না আমি। আমি তোর চোখেমুখে মাঝে মাঝে এতটা বিষাদ দেখি যে আমি ভয় পাই।”
“জানো নানি, আম্মু ছিলো আমার শক্তির আদার, আমার খুশির খনি, ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাসের স্তম্ভ। আম্মুর এমন করে চলে যাওয়াটা আমি মন থেকে মানতে পারি না। আমার শুধু মনে হয় আম্মু মরে নাই আম্মুকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে আম্মুর হাসিখুশি জীবনটাকে, তারপর বিশ্বাসকে, তারপর ভালোবাসাকে তারপর……”
“চুপ কর, আর বলিস না। এসব ভুলে যা। এসব বলে কি তুই আমাকেও খুনি বানাতে চাস? আমরা যে সবাই ওর আসামি ছিলাম। আয়নায় দাঁড়াতে পারি না। নিজের চেহারা নিজে চোখই যেনো আমার বড় শত্রু। তাই এখন চোখ বুজে মনকে বলি, রেশমা তুই তোর মা’কে ক্ষমা করে দিস। আমার আকাশে একদিন একটা চাঁদ হয়ে এসেছিল ও, যে কি না অসময়েই মেঘে ঢেকে গেছে। এই মেঘ ঘন কালো মেঘ। এই আকাশে বাতাস নেই তাই এই মেঘ স্থির, চারপাশ সব বরফ শীতল হয়ে আছে। তাইতো আমি তোদের মাঝে শুধু সূর্য খুঁজে ফিরি। যদি তোদের মাঝে একটু আলোর দেখা পাই, যদি একটু উত্তাপ পাই। হয়তো খুঁজতে খুঁজতে একদিন আমিও মেয়ের মতো বরফ শীতল হয়ে যাবো কোন মেঘের আড়ালে ডুবে। হয়তো তখন রেশমা আমাকে কাছে টেনে নিবে। আমাকে ক্ষমা করবে।”
“প্লিজ নানি এবার তুমি থামো। আর কিছু বলো না। আমি আর কখনওই এসব কথা বলবো না। তুমি অন্তত আমাদের পাশে থাকো। তুমি অন্তত চলে যাওয়ার কথা বলো না।”
“অন্তিম আলে যাওয়াটা কারউ হাতে নাইরে। ডাক আসলেই যেতে হবে। তাই চাই না আমাকে দিয়ে কোন খারাপ কাজ হোক। সব ডিসিশন আবেগ দিয়ে নিতে পারি না, বিবেক বাঁধা দেয়।”

“তুমি তাই করো যা তোমার বিবেক বলে। আমি আর কোনো কথা বলবো না। এখন থেকে তোমার সব কথা মেনে চলব। তুমি যা বলবে তাই মেনে নিব।”

“তবে এখন থেকে শুরু কর। পারবি? লিখনের সাথে স্বাভাবিক আচরন করতে পারবি? রুশকে সরি বলবি৷ লিখনকেও বলবি। হুট করেই মাথা গরম করবি না। যা তোর তার হেফাজত করবি কিন্তু অন্যের জিনিসে হাত দিবি না। ”

“না দিবো না।”
“কোনো একদিন যদি শুনিস লিখনের বাচ্চা হবে তখন কোনো সিনক্রিয়েট করবি না। ওটা ওর বৌয়ের অধিকার এটা মনে করে নিজে সংযত থাকবি।”
“হুমম থাকব। থাকতে হবে।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“ঠিকই বলেছো এসব ভেবে মনটাকে ভারি করাটা বোকামি। এখন মনটাকে অনেক হালকা লাগছে।”

“জীবন একটাই জীবনকে সহজ কর।”
“ও কে ডার্লিং লাইফটা ভেরি ইজি।” বলে হা হা হা করে হাসতে লাগল।

রাতে হিমেলের কল আসল লাবন্যের মোবাইলে। লাবন্য রিসিভ করে চিৎকার করে উঠল
“এই তুমি নানিকে কি বলছো? হ্যে আমাকে কোন কাউন্সিলের কাছে নিতে চাইছে?”
“হুমম নিতে চাইছি, যাতে যে কোনো বিষয়কে নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে পারোছ।”
“আমি ইতিবাচকই চিন্তা করি। তোমার মতো না।”
“হুমম, আমার মতো না। আমার মতো ঝামেলায় পড়ে দেখ তখন বুঝবি কেমন অবস্থায় আছি।”
“কেন আবার নতুন কি হল?”
“ছোট আপুর ফ্যামেলিতে খুব ঝামেলা হচ্ছে। যৌথ পরিবারের ঝামেলা লাগলে সব যৌথ ভাবেই লাগে। ছোট আপু মনে হয় খুব একটা ভালো নাই। আপুর ননাস ননদরা ওখানে যাওয়ার পর থেকেই নাকি ঝামেলা শুরু হইছে। আম্মুকে দেখলাম খুব কাঁদতেছে। বাসায় খুব থমথমে আবহাওয়া বিরাজ করছে।”
“ইন্না লিল্লাহি ! একি অশান্তি আবার শুরু হল ছোটাপুর সাথে, আল্লাহ রহম কর। তুমি এখন আমার সাথে কথা না বলে যাও খালামনিকে স্বান্তনা দাও। খালামনিকে কাঁদতে মানা কর।” কথাটা বলে কলটা কেটে দিল লাবন্য।

চলবে

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৪৩)
সায়লা সুলতানা লাকী

গভীর রাতে নানির ডাকে ঘুম ভাঙল লাবন্যের। হঠাৎ করেই এমন চিৎকার চেচামেচিতে লাবন্য একটু ভয় পেয়ে গেলো। রুম থেকে বের হতেই দেখল নানি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে জুতা পরছে। বারবার জুতা উলোট পালোট হচ্ছে তার। তাড়াহুড়োয় ঠিক মতো পা ঢুকাতে পারছে না যেনো।এমনটা কখন হয় তা লাবন্য বুঝতে পারে। ভয়টা আরও দ্বিগুন আকার ধারন করল তখন। এরই মধ্যে লিখন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বের হল ওর রুম থেকে। লাবন্য ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না ঘটনাটা আসলে কি হচ্ছে ?

“তোমরা কেথায় যাও?”
“হাসপাতালে। তুই রুশকে নিয়ে সবধানে থাকিস লাবু।”
“হাসপাতালে? কেন?”
“তোর খালামনি অসুস্থ। ”
লাবন্য খেয়াল করল ওর নানি কোনো কথা বলছেন না, শুধু ঠোঁট নড়ছে আর প্রচন্ড ঘামছেন তিনি । লক্ষ্মণটা ভালো ঠেকল না। হুট করেই দৌড়ে রুমে এসে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফিরে এসে বলল
“আমিও যাব চলো।”
“আহা! তোর যাওয়ার দরকার নাই তুই রুশকে নিয়ে থাক। ও আবার একা হয়ে যাবে বাসায়।”
“অসুবিধা নাই। বুয়াখালা আছে বাসায়। খালাই যথেষ্ট। এত ভাববার কিছু নাই। সমস্যা হলে আমাদের হাসপাতালে দিয়ে তুমি বাসায় চলে এসো।” বলতে বলতে ও ওর নানির হাতটা শক্ত করে ধরল। ও টের পেলো ওর নানি থরথর করে কাঁপছেন। লাবন্য এবার নানিকে শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল।

রেহেনা বেগমকে নিয়ে ডাক্তাররা ভেতরে আছেন। বাহিরে হিমেল ওর আব্বুর সাথে দাঁড়িয়ে ছিল নানুকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল বাচ্চাদের মতো।
“বোকা ছেলে একটা, মায়ের অসুস্থতায় এমন করে কেউ কাঁদে বুঝি? বেক্কল কোথাকার। এখন মনকে শক্ত রাখতে হবে আর বেশি বেশি আল্লাহকে ডাকতে হবে। তাও বুঝিস না? আল্লাহকে ডাক।আল্লাহকে ডাক। বলতে বলতে নিজে একটা চেয়ারে বসলেন। লাবন্য ওর নানিকে ছাড়ল না, পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। যতটা সাহস সে হিমেলকে দেখাচ্ছে আসলে তার ততটা সাহস নাই তা অন্তত লাবন্য বুঝতে পারছে।

লিখন চেষ্টা করল ডাক্তারদের সাথে কথা বলে পেশেন্টের বর্তমান অবস্থা জানার জন্য কিন্তু তেমন কোনো সুবিধা করতে পারল না। অপেক্ষা করা ছাড়া যেনো আর কোন কাজ রইল না তখন।

রাতটা কাটল এমন করেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবার কখনও বসে। সকালের দিকে ডাক্তারের সাথে কথা বলার সুযোগ হল। জানা গেলো রেহেনা বেগমের স্ট্রোকের কথা। প্রথম অবস্থায় শুনে ভয় পেয়ে গেল সবাই। তবে ডাক্তারের সব কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হল। অল্পতেই চিকিৎসা পাওয়ায় তেমন কোনো সমস্যা হয় নাই। বাম হাত আর পায়ের রেসপন্সটা এই মুহুর্তে কম পাচ্ছে তবে অল্প কিছু থেরাপি পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করলেন ডাক্তার । এছাড়া আরও কিছু টেস্ট করাতে হবে যা আজ করানো হবে অন্য কোন সমস্যা হয়েছে কি না তা জানার জন্য । এসব রিপোর্ট পেলে পরে সার্বিক অবস্থা জানা যাবে।

রেহেনা বেগম এখন ঘুমাচ্ছেন তাই আর কেউ দেখা করতে পারল না। লিখন সবার জন্য সকালের নাস্তা অর্ডার করেছিল। এখন নানিকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল কেন্টিনে খাওয়ানোর জন্য। লাবন্য খাওয়ার পর নানিকে বাসায় চলে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগল তার ঔষধগুলো নিয়মিত করার জন্য। কিন্তু তিনি গেলেন না। পরবর্তীতে লিখনের সাথে হিমেলই বের হয়ে গেল নানির ঔষধ গুলো নিয়ে আসার জন্য। লিখন রুশকে স্কুলে দিয়ে অফিসে চলে গেল। হিমেল ঔষধ বক্স নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে এল।
সারাদিন এক প্রকার চাপা উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। ঘুম ভাঙার পর রেহেনা বেগম মা’কে পাশে পেয়ে যেন অনেক সাহস আর শক্তিও ফিরে পেলেন কিন্তু বাম হাতটা ঠিকমতো নাড়াতে পারছেন না বলে একটা সময় কেঁদেই ফেললেন। লাবন্যের নানি তখন অনেক কিছু বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বোঝতে শুরু করলেন বারবার বললেন “এই সময়টা আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষা নিচ্ছেন ইমানের, এখন ধৈর্য হারা হলে চলবে না। বেশি বেশি আল্লাহকে ডাকতে হবে। আল্লাহর সব ঠিক করে দিবেন মনের জোর ধরে রাখতে।”
লাবন্য চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে একটা অসুস্থ মেয়ের জন্য তার মায়ের পরম ভালোবাসা মাখা সাপোর্ট প্রত্যক্ষ করল । আর বারবার নিজের মায়ের মুখটা কল্পনা করল, যাকে সবসময় নিজের প্রয়োজনে কাছে পেত ঠিক এমনি করেই ।
নাজমুল সাহেব সকালে বসায় চলে গিয়েছিলেন রেহেনা বেগমের সাথে একবার দেখা করেই। হিমেলই পাঠিয়ে দিল কারন তার ঘুমের দরকার। রাতে ঘুমাতে পারেন নাই। এখন একটু রেস্টে না পেলে পরে তারও বিপি বেড়ে যাবে। তখন বিপদের উপর বিপদ হবে।

লাবন্যকে একা পেয়ে হিমেল কাছে এগিয়ে এসে বলতে শুরু করল
“ছোট আপু খুব ঝামেলায় আছে। ননদগুলো মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে তার শাশুড়ি আপাকে খুব আদর করত। নানান কাজে হেল্প করত। এখন সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। ননদরা জব করে তাদের সংসারও এখন আপুকেই দেখতে চাপ দিচ্ছে । এত প্রেসার আপু একা নিতে পারছে না। দুলাভাই এ ব্যাপারে ভালোমন্দ কিছুই বলছে না। আপা খুব কাঁদতেছে ওখানে বসে। গতরাতে নাকি আপুর শাশুড়ি বলেছেন “না পারলে দেশে চলে যাও।” এটা শোনার পর থেকেই আম্মুর শরীর একটু একটু খারাপ হতে শুরু করেছে কিন্তু আমাদের কাউকে কিছু বলে নাই। হঠাৎ করেই রাতে আব্বু ডেকে বলল এম্বুলেন্স ডাকতে। ভেবে দেখতো তখন আমার মনের অবস্থাটা কেমন ছিল ? এখনও মনে হচ্ছে সেই ভয়ানক ঘোরটা কাটে নাই। প্রচন্ড ভয় পেয়েছি আমি।”

“এরজন্যই বলি মা থাকতে মায়ের কদর করো। আর যদি কোনোদিন শুনি তুমি খালামনির সাথে কথা বন্ধ করেছো তবে দেখে নিও আমি কি করি! আমাকে মেনে নেয়া না নেয়া এটা তার ইচ্ছা তাই বলে তুমি কেন তাকে এমন মেন্টাল প্রেসার দিবা? এটাতো এক প্রকার টর্চার করা। এগুলা বন্ধ কর।”

“কি করব আমি তাতো আমি নিজেই যেনো বুঝতে পারছি না।”
“তোমাকে বোঝতে হবে না। যা হবে তা ভালোই হবে। এটা আমার কথা না নানির কথা। তুমি শুধু তোমার ডিউটি পালন করো। পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।”

আর কথা বাড়ালো না নানির ডাকে দুজনই কেবিনে ঢুকলো।

মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা বোনদের জানানোর পর থেকে বোনরা একটু পর পর হিমেলকে কল দিয়ে খবরাখবর নিতে লাগল। আর হিমেলও আপডেট দিয়ে যেতে লাগল।

ছোট মেয়েটা মায়ের অবস্থার কথা শুনে দেশে আসতে চেয়েছিল কিন্তু পারিবারিক ঝামেলার কারনে আর পারবে না তা জানিয়ে দিল। হোমায়রা প্রথম অবস্থাতেই নাজমুল সাহেবকে জানিয়ে দিল কিছুদিন আগেই এসে গিয়েছে তাই আর এখন আসতে পারবে না। আরও বলল একজন কেয়ারটেকার রেখে দিতে মায়ের দেখাশোনা করার জন্য। নাজমুল সাহেব হ্যা না কিছুই বললেন না মেয়েকে, তাদের দুজনের কথা শুনে চুপ হয়ে রইলেন।

হাসপাতালে থাকতে লাবন্যের নানির কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অসুস্থ মেয়েকে রেখে তিনি আর নড়লেন না। আর তাই লাবন্যও বাসায় গেলো না। দুদিন পর হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দিলো রেহেনা বেগমকে। বাসায় যখন নিয়ে যাওয়া হল তখন লাবন্যও সাথে গেলো। ভুলেই গেলো ওর খালামনি ওকে কি বলেছিলো এই বাসায় আসা নিয়ে। মনে হল ও সব কষ্ট ভুলে গেছে। খালামনিকে ধরে ধরে তার রুমে নিয়ে গেলো। হিমেল কোলে তুলে নিতে চেয়ে ছিলো। কিন্তু ডাক্তার বলে দিয়েছেন তাকে আস্তে আস্তে হাঁটাতে। কিছু থেরাপিও দিয়েছেন এগুলো প্রতিদিন বাসায় বসে করাতে হবে। একজন থেরাপিস্টও ঠিক করে দেওয়া হল যিনি বাসায় এসে একঘণ্টা থেরাপি দিয় যাবেন।
বড় মেয়ের বাসায় কখনও এসে থাকা হয়নি লাবন্যের নানির। তাই হয়ত খুব একটা সহজ হতে পারছিলেন না। ওদিকে রুশকে নিয়েও কিছুটা টেনশন হচ্ছিলো তাই তিনি লাবন্যদের বাসায় চলে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু লাবন্য মানা করল বলল
“নানি এখন খালামনির বেশি দরকার তোমাকে। তুমি খালামনির কাছেই থাকো কিছুদিন। রুশকে আব্বুর হেফাজতে ছেড়ে দাও, সেই দেখুক তার ছেলেকে। তুমি তোমার মেয়েকে দেখো। ”
যদিও লাবন্য বোঝে এই সময়তে এই দায়িত্ব লিখনের জন্য একটু সমস্যা হয়েই দাঁড়াবে, কিন্তু এছাড়াতো আর কোন পথ নেই, তাই জানিয়ে দিল ওর আব্বুকে ।

রাত জাগা হতে শুরু করে খালামনির খাবার, গোসল, কাপড়চোপড় পরাটাও লাবন্য নিজ হাতে করিয়ে দিতে লাগল। কেন জানি ওর নানি ইচ্ছে করেই এসব কাজে ইনভলভ হলেন না। দূর থেকে লাবুকে দেখেন তার মেয়ের সেবাযত্ন করতে। রেহেনা বেগম নিজেই এখন অনেকটা অশান্তিতে আছেন। মাঝে মধ্যেই ছোট মেয়ের সাথে টুকটাক কথা বলেন। হিমেল ওর ছোট বোনকে আগেই বলে দিয়েছে ওর কোন সমস্যার কথা যেনো মা’কে এই মুহুর্তে সরাসরি না বলে। তাই হয়ত বোনরা আর কোন সমস্যার কথা বলে না মা’কে । কিন্তু রেহেনা বেগম ইনিয়ে বিনিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করে “এখন অবস্থা কেমন? ” মায়ের প্রশ্ন শুনেই মেয়ে ঝটপট উত্তর দেয়, “এখন ভালো আর কোনো সমস্যা হয় নাই।”
মনে হয় এই উত্তরের অনেক শক্তি, যা রেহেনা বেগমকে নতুন করে প্রান শক্তি ঢেলে দেয় মনের মধ্যে ।

তখন দূর থেকে লাবন্য শুধু নিজের জন্য আক্ষেপই করে নিজের ভাগ্য নিয়ে। ওর জন্য এত ডিপলি ভাবার জন্য কেউ নেই পৃথিবীতে। আবার যখন নানিকে দেখে তখনই আক্ষেপ ভুলে মনে মনে শুকরিয়া জানায় আল্লাহর দরবারে।

লাবন্য বাসায় আসায় হিমেল মনে মনে অনেক খুশি হয়। ওর বিশ্বাসও ছিল এমনটাই করবে বন্য। খেতে বসে ইচ্ছে করেই প্লেটে খাবার তুলে নেয় না। একটা সময় দেখে ওর বন্যই ওর জন্য প্লেটে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে। তখন ওর মনের আনন্দ আর কেউ টের পায় না। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে হতে দেখে বন্য এক কাপ চা দিয়ে যাচ্ছে ওর রুমে। তখন ওর ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে খুব করে আদর দিতে। কিন্তু কখনোই পারে না। তবে রাতে বন্যের জন্য নিজে চা বানিয়ে দিয়ে আসে মায়ের রুমে। ওর মায়ের চোখে চোখ পড়লেই বলে উঠে “বন্য তুইতো রাত জাগিস তাই চা দিলাম এটা খেয়ে নে তাহলে তোর সুবধা হবে। ”

ওর মা তখন মিনমিন করে বলবে, “রাত জাগার কি দরকার? আমার দরকার হলেতো আমি ডাকতেই পারবো, তখন উঠলেই হয়। শুধু শুধু জেগে থাকার কি দরকার?”

“কোনো দরকার নাই কিন্তু আমার মনে হয় আমি ঘুমিয়ে গেলে তুমি ডাকবে না। তুমি তখন কষ্ট করবে, আর নয়তো নানিকে ডাকবে। নানিতো আরও পারবে না পরে দুজনেই আরও সমস্যায় পরবে। তাই জাগি বুঝছো? দ্রুত সুস্থ হও তাহলেই আর রাত জাগবো না।”
রেহেনা বেগম আর কিছু বলেন না চুপ হয়ে যান। ইদানিং কি যেনো হয়েছে তার, প্রায় সময়ই চুপ থাকেন।

বিকেলে রেহেনা বেগমকে বসিয়ে লাবন্য চুলে চিরুনি করে দিচ্ছিল তখন তিনি আস্তে আস্তে বললেন
“আমার জন্য এত কিছু কেন করছিস?”
“তাহলে আর কে করবে?”
“আমার ছেলেকে বিয়ে করাবো, ওর বৌ এসে করে দিবে।”
“হাহাহা, সেটাতো খুবই ভালো কথা। কিন্তু সেতো করবে তার শাশুড়ির জন্য । আর আমিতো করছি আমার খালামনিরটা। দুটো কি এক হল? মায়ের বোন খালা, মায়ের চেয়ে ভালা। আমিতো সেই ভালা মানুষটার জন্য করছি। যার মধ্যে মায়ের মতো একটা ফিলিং আছে”
লাবন্যের কথা শেষ হতে না হতেই শুনতে পেলো রেহেনা বেগম হুহু করে কাঁদতে শুরু করেছেন। লাবন্য কথা থামিয়ে সামনে এসে দেখে নিল সত্যি সত্যিই কি খালামনি কাঁদছেন কি না!
“কি হলো খালামনি? এমন কি কঠিন কথা বললাম যে তুমি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করলা? যা সত্য তাইতো বললাম।”
“কি জন্য কাঁদছি তা তোকে বলতে হবে নাকি?”
“আহা রেগে যাচ্ছো কেন? কাঁদতে ইচ্ছে হলে কাঁদবে, তাতে কোনো সমস্যা নাই। কাঁদলে চোখ আর মন দুটোই পরিস্কার হয়..”
“থাম থাম থাম, এত বকবক করিস কেন? এখনই আম্মু রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন তোকে।” হিমেল হাসতে হাসতে মায়ের পাশে এসে বসল।
“উঁহু, হয় নাই। এই তোর ফাঁকিবাজ মা কি তোকে কিচ্ছু শিখায় নাই? নিজেতো ছিলো একটা অপদার্থ, মেয়েকে শিখাবে কি? মেয়ে যে……” লাবন্যকে থামিয়ে দিয়ে রেহেনা বেগম আস্তে আস্তে বললেন

“রেশমা যখন স্কুলে যেতো তখন প্রতি সকালে সাদা ফিতা আর চিরুনি নিয়ে আসত আমার কাছে। যতক্ষণ না দুই বেনী করে দিতাম ততক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করত। স্কুলের নিয়ম ছিল সাদা ফিতা দিয়ে চুল বেনী করে আসতে হবে। ও পারতো না, পুরোপুরিই আমার উপর নির্ভর ছিলো। আজ ওর মেয়ে আমার চুলে বেনী করে দিচ্ছে…. ”
“শোনো শোনো শোনো, আমি কিন্তু প্রতিদান দিচ্ছি না। এই ঘটনা আমি জানতাম না। তুমি বললা পরে জানলাম।”
“রেশমার জ্বর হলে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। আম্মা আব্বার জন্য ওকে কাছে নিয়ে রাখতে পারতো না। ঘুমের মধ্যে মাঝে মধ্যে আমাকে আম্মা মনে করে জড়িয়ে ধরতো। তখন আর আমি ওর হাত সরিয়ে দিতাম না। খুব মায়া লাগতো।
স্কুল থেকে ফেরার পথে পেয়ারা বরই তেঁতুল যাই কিনে আনত আমাকে রেখে কখনও খেতো না। ভাইরা ওর জন্য কিছু আনলেও আমাকে দিয়ে খেতো। আম্মা বলতো ওর মায়ার শরীর। অথচ ওর কপালটাই খারাপ, জীবনে নিজেই কারো মায়া পেলো না ঠিক মতো।” আর বলতে পারলেন না কাঁদতে লাগলেন তখন। লাবন্যের চোখও ছলছল করে উঠল। মায়ের জন্য খালামনির এই উপলব্ধিটা ওর চাওয়া ছিল অনেক পুরোনো। এমন একটা সময় উপলব্ধিটা আসল যখন ওর আম্মুই নাই দুনিয়ায়। আম্মুর জন্য বড় আফসোস হতে লাগল লাবন্যের মনে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here